Street food

শূন্য স্বাদসরণি হারানো চেনামুখ

বেঁচে থাকাটাই কি ঘরবন্দি হয়ে গেল? অফিসপাড়া থেকে ডেকার্স লেন, চিৎপুর থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট ধু ধু। কোভিডকালে শহরের আর এক স্মৃতি-আলেখ্য।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২১ ১৫:৪৬
Share:

লাঞ্চ-টিফিনের অফুরন্ত বৈচিত্র ছিল অফিস-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বেঁচে থাকাটাই কি ঘরবন্দি হয়ে গেল? অফিসপাড়া থেকে ডেকার্স লেন, চিৎপুর থেকে জাকারিয়া স্ট্রিট ধু ধু। চন্দননগর-চুঁচড়ো থেকে মিষ্টি নিয়ে যাঁরা কলকাতায় আসতেন, তাঁদেরও দেখা নেই। অফিসবাবুদের বছরভর রকমারি খাবার সরবরাহ করা মানুষজন অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায়। কোভিডকালে শহরের আর এক স্মৃতি-আলেখ্য।

Advertisement

Advertisement

দাদা, দীনেশদাদার খবরটা কি সত্যি?” কোভিড-দিনে চাপা স্বরে থতমত ফোন এখন জীবনের অঙ্গ। তবু বেঙ্গালুরু থেকে প্রবাসী বোনের ভয়ার্ত স্বরটুকু ছিল ঘাবড়ানোর মতোই। দেশে কোভিড-হামলার সেটা প্রথম পর্ব। খোঁজখবর করতে গিয়ে মালুম হল, তত দিনে খবরটা ভালই চাউর গোটা পাড়ায়, যার কেন্দ্রে এ তল্লাটের অতি জনপ্রিয় ফুচকাওয়ালা দীনেশ সাউ।

বংশানুক্রমে এ পেশায় চৌকস, স্বর্গীয় জয়হিন্দ সাউ, ওরফে মাখনের ছেলে দীনেশ নিছক একটি নাম নয় উত্তর কলকাতার টালাপার্ক-পাইকপাড়ায়। তাঁর ফুচকার স্বাদ ছাপিয়ে সরস ব্যবহার, মজাদার বিপণন শৈলী, সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়ে লোক বুঝে স্বতন্ত্র ‘পার্সোনাল টাচ’-এর মহিমাই আলাদা। তাঁকে নিয়ে খবরে আলোড়ন হবেই।

দীনেশের অবশ্য আয়ু বেড়েছে এ যাত্রা। কোভিডের দিনকালে হঠাৎ বাজে ডায়রিয়ায় তাঁকে হাসপাতালবাসী হতে হয়েছিল গত বছর। একই দিনে কিশোরবয়সি পুত্র-সহ বেলেঘাটার আইডি-তে ভর্তি হন দীনেশ। খবর পল্লবিত হয়ে ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। জনপ্রিয় ফুচকা-শিল্পী ‘কোভিড-শহিদ’ ধরে নিয়ে শোকগাথা লেখা হতে থাকে।

বিভ্রান্তি দূর হতে সময় লাগলেও ৪২ বছরের দীনেশ চাঙ্গা হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। হাইকোর্টপাড়ার বিশিষ্ট চরিত্র কামতা সিংহ কিন্তু এই দুঃসময় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। ২০২০-র প্রথম লকডাউন আলগা হওয়ার পর ওই পাড়ায় গিয়েই টেম্পল চেম্বার্স-এর জনৈক প্রবীণ করণিক জানতে পারেন সেই অনিবার্য পরিণতি। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে হাইকোর্টের মুখোমুখি সাবেক বাড়িটার নীচের খোপকাটা রোয়াক শূন্য। কামতার চিহ্নটুকু নেই।

টেম্পল চেম্বার্স-এর নীচের সেই সাড়ে তিন হাত জমি থেকেই নাগাড়ে ছয় দশক কলকাতা শাসন করেছিলেন বিহারি কচৌরি-সামোসা-জলেবি বিক্রেতা। শাসন কথাটায় অত্যুক্তি নেই। বাস্তবিক সামোসা, খাস্তা কচুরি বা পকোড়িতে দইটই মেখে অতি সুস্বাদু চাট পরিবেশনের সময়ে কামতা আর যা মেশাতেন, সাদা বাংলায় সেটাকে অ্যাটিটিউড বলে। রাশভারী, নো-ননসেন্স ব্যক্তিত্ব। খেজুরে আলাপের ধারেকাছে নেই। খাবারের স্বাদটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে তাঁকে শুধু সসম্ভ্রমে দেখে যেতে হয়। বয়স তাঁর হয়েছিল ঠিকই! কিন্তু পাক-ধরা বার্ধক্যে ক্ষয়ের চিহ্ন ধরা পড়ত না। প্রথম লকডাউনের মতোই আচমকা তাঁর প্রস্থান জীবন রঙ্গমঞ্চ থেকে। ক’দিন আগেই শেষ বার বিহারের ঔরঙ্গাবাদে দেশে ঘুরে এসেছিলেন। এখানে লিলুয়ার ডেরায় এক সন্ধেয় ফিরে হঠাৎ সব শেষ। কামতার ছেলে ধর্মেন্দ্র পরে বলেছিলেন, “এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে। বাবা কাজ ছাড়া, মানুষ ছাড়া হাঁসফাঁস করতেন।” কোভিড-পর্বের ঠিক গোড়ায় বৃদ্ধের সহসা হৃদরোগ, জাবনের চাকা স্তব্ধ।

খদ্দেরের অভাবে উধাও রাস্তার রকমারি খাবারও।

স্বভাবে পাইকপাড়ার দীনেশের ঠিক উল্টো কামতা। দীনেশ অন্যমনস্ক খদ্দেরকেও জোর করে স্পেশ্যাল মশলা ছড়ানো ফাউ ধরিয়ে ফুট কাটেন, “এটায় কাঠগুঁড়ো মিশিয়েছি দিদি!” শালপাতায় ঝাঁঝালো টকজল ঢেলে বলেন, “কমপ্ল্যানটা ঠিক ছিল তো!” আর সব চেয়ে প্রকাণ্ড ফুচকার গায়ে আইসক্রিমের কোনে মেশিনজাত ফেনায়িত ক্রিমের মতো ঝালবিহীন আলুর পুর মাখিয়ে রাখেন। মায়ের সঙ্গে আসা শিশুটির হাতে মুফতে ‘আইসক্রিম ফুচকা’ তুলে দেন। যে যা খুশি ভাববেন, সেলসম্যানশিপ বা স্নেহের পরশ। কামতার সঙ্গে এ সব মেলানো যাবে না! ‘কামতা’ নামটাই জেনেছি ওঁর মৃত্যুর পরে। কখনও বাড়তি কথা বা অর্বাচীন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ফুরসত তাঁর হয়নি। কিন্তু তার সেই চাট-জিলিপির সমঝদার নামজাদা উকিল-জজসায়েবরাও। নিঃশব্দ গম্ভীর ব্যক্তিত্বেও এমন চরিত্র হয়ে উঠতে সবাই পারেন না। কামতার সঙ্গেই শেষ হাইকোর্ট পাড়ার একটা অধ্যায়।

অতিমারি-দিন মানে অলক্ষে এমন অনেক কিছু শেষ হওয়ার আতঙ্ক। অনেক দিন দেখা না-হওয়া মানুষগুলোও কি নেই হয়ে যাবেন? ক্লেদাক্ত প্রাত্যহিকতার একঘেয়ে রুটিন কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠত যাঁদের ছোঁয়ায়! মহানগরের নতুন, পুরনো অফিসপাড়া বা ব্যস্ত বাণিজ্যিক মহল্লা জুড়ে এমন রংবেরঙের চরিত্রের ছড়াছড়ি। ক্যালকাটা টেলিফোনস-এর অনতিদূরে বিনোদবিহারী নাগ গণেশচন্দ্র দত্তদের দোকান। ক্যাশে বসে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ ছবির দুর্দান্ত ভিলেন পাঞ্জা। কলাপাতায় লুচি, ডাল, ক্ষীরের শিঙাড়া খেতে খেতে তাঁকে দেখে হতভম্ব আপিসপাড়া। তিনি আসলে গণেশ দত্তের বড় ছেলে অসীম দত্ত। বইয়ে পার্ট করার সুযোগ খুঁজতে স্টুডিয়োপাড়ায় ঘুরঘুর করেন। ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’-র ভিলেনের ভূমিকায় অসীমকেই পছন্দ হয়েছিল তপন সিংহের।

পাঞ্জাকে দেখাতে বাড়ির ছোটদেরও আকছার বিনোদবিহারীতে নিয়ে আসতেন বড়রা। দেখেছ তো, কথা না-শুনলে কিন্তু এখনই ধরে নিয়ে যাবে! সহ-অভিনেতা শমিত ভঞ্জ, শম্ভু ভটচাজ, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়রাও এসেছেন কত বার। আরও খুচখাচ পার্ট করলেও অসীমবাবুর নামডাক পাঞ্জারই সৌজন্যে। খদ্দেরমহলে অসীম নামটাকেই ঢেকে দিয়েছে পাঞ্জা পরিচয়। সিনেমার চামড়ার জ্যাকেটধারী দাড়িওয়ালা ভিলেনের চেহারায় বদল কালের নিয়মেই হয়েছে। পাক ধরলেও রং করে পাঞ্জার ট্রেডমার্ক দাড়িটা তিনি বজায় রেখেছেন।

ফোনে বহু দিন পর সত্তরোর্ধ্ব অসীমবাবুর কথা শুনেও সেই বাজখাঁই গলার পাঞ্জাকেই চেনা যায়। মানিকতলায় সস্ত্রীক থাকেন। অসীমবাবু, তাঁর দুই ভাই আশিস ও দেবাশিস দত্তই দোকানে বসেন। মানে মাসকয়েক আগেও বসেছেন। মিষ্টির দোকান ছাড়, তবু খাঁ খাঁ অফিসপাড়ায় দোকান খুলে কী হবে ভেবে ঝাঁপ বন্ধই বিনোদবিহারীর। মন ভাল নেই পাঞ্জার! “ট্রেন চালু না হলে স্টাফদের আনা যাবে না!” বলে সব স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় প্রবীণ।

এ এক অদ্ভুত সময়ই বটে! যখন কারও সঙ্গে কথা হলেই, ‘ভ্যাকসিন পেলেন’ কিংবা ‘হয়ে গেছে’-ই আলাপচারিতা হয়ে ওঠে। ফুটোনো চা এক মগ থেকে আর এক মগে ঢালার দর্শনীয় কসরতে সিদ্ধহস্ত সুনীল সিংহের চোখেমুখে অচেনা ভয়ের জড়তা। ‘পতা নেহি, ক্যায়া অজীব বিমারি দাদা, অভি তক প্যায়ের ঠিক সে নেহি চল রহা!’ থিয়েটার রোডে এসি মার্কেটের উল্টোফুটে বহু দিনের চা-সামোসা কারবারি সুনীল। তাঁকে কোভিডে ধরেছিল মাসদুয়েক আগে। এখন সকালে ঘণ্টা তিনেক দোকান খুললেও আর টানা বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না।

কাট টু সেক্টর ফাইভ, নেটগুরু বিল্ডিং তল্লাট! চা-টিফিনের কারবারি দেবিরানি ঘোষ। উচ্চ রক্তচাপের জন্য বরকে আগলে রাখতে হত চিরকালই। ঘরের সব কাজ সামলে চা, টোস্ট, ইনস্ট্যান্ট নুডলস-এর দোকানটায় তাই দেবীকেই বসতে হয়েছে দিনভর। লকডাউনে রোজগারহীনতায় সেই সম্বলটুকুও কার্যত ছারখার। জমানো পুঁজি খতম হয়েছে গত বছরই। ফলে এক বৃদ্ধার বাড়িতে পরিচারিকার কাজও নিতে হয় দেবীকে। তিনি গত হতে ফের মরিয়া হয়ে দোকানে বসেই মাছি তাড়ানো।

দুপুর থেকে বিকেল, এক লিটার দুধের চা-ও বিকোয় না। সল্টলেকে সদ্য তরুণ পুত্রের ফলের দোকান পুরোপুরি বন্ধ। ঘাড়ে ফ্রিজ, টিভি কেনার অপরিশোধ্য ধারের কিস্তি। কোভিডাতঙ্ক, ভ্যাকসিন চিন্তা অন্নচিন্তার চাপে মাথায় উঠেছে। চল্লিশোর্ধ্ব দেবী জানেন না, লড়াইয়ের শেষ কোথায়।

সরকারি বুলডোজারে ইএম বাইপাসের ধারের অস্থায়ী বাজারে তাঁর ভাতের হোটেল এবং আমপানে পাটুলির ফ্লোটিং মার্কেট ধ্বস্ত হওয়ার পরে রেখা মারিকও সংসারটা টানতে স্থানীয় বাজারে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রির রাস্তা বেছেছেন। কোভিড শুরুর আগে ফ্লোটিং মার্কেটে রেখা মোমোর দোকান করেছিলেন। স্বামী পেশায় ড্রাইভার, কিন্তু আপাতত কাজ নেই। ছেলে ক্লাস টেন। বাজারের আনাজওয়ালা, মাছওয়ালাদের ভোর চারটে থেকে বেলা দশটা চা ফেরি করে ছিটেফোঁটা রোজগারটুকু আজ কুড়িয়ে নিচ্ছেন।

ডালহৌসি পাড়ায় এজি বেঙ্গলের সামনের ফুটে মিষ্টি-গাড়ির হকার চুঁচুড়ার প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও এই দুর্দিনে মনে পড়ছে, জীবন শুরুর সময়কার সংগ্রামের কথা। সে তিরিশ বছর আগের কথা! এক মন্ত্রীর দাক্ষিণ্যে পাড়ার অনেকেরই ঝটপট চাকরি হচ্ছিল। রাজনৈতিক কারণে কপালে শিকে ছেঁড়েনি প্রদীপের। কিন্তু কলকাতার ফুটপাত তাঁকে ফেরায়নি। এই তল্লাটে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ, বড় ক্লাবের খেলোয়াড়, আকাশবাণীর ঘোষক, বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। হাইকোর্টের জজসায়েব নিজে গাড়ি থেকে নেমে তাঁর মিষ্টি কিনেছেন, বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলেছেন। কিন্তু নোটবন্দির সময় থেকেই অবস্থা ক্রমশ খারাপতর। পাঁচ বছর আগে ডেলি ৮০০-৯০০ টাকা হাতে এলে এখন ৪০০ টাকাও হয় না। ৫৮ বছরের নাছোড় জেদ দাঁতে দাঁত চিপে তবু অপেক্ষা করে, দুই মেয়ের পড়াশোনা শেষ হওয়ার। বড় মেয়ে ইতিহাসে এমএ করছেন। আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে টিপেটুপে সংসার চালিয়ে মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করানো অবধি লড়াই জারি রাখাই প্রদীপের চ্যালেঞ্জ।

প্রদীপ তাও প্রথম বারের টিকা পেয়েছেন। সে সব এখনও জোটেনি চন্দননগরের বাসুদেব দাসের। ক্যালকাটা টেলিফোনস-এর তিন নম্বর গেটে ষাটোর্ধ্ব বাসুদাও মিষ্টি বেচেন। পান্তুয়া, দরবেশ, লর্ড চমচম থেকে বাটার রোল, শান্তিভোগ, ম্যাঙ্গো রোল— কম সে কম ২৭-২৮ রকমের আইটেম। চন্দননগর, চুঁচুড়ার ছানায় লোকে মজবেই। মৃত্যুঞ্জয়, পঞ্চানন, রাজরাজেশ্বর, সারেঙ্গি বা সুয্যি মোদক—এইসব দোকানের মিষ্টির পসরা বেঁধে কলকাতামুখো হন এমন ৪০-৫০ জন মিষ্টিওয়ালা। মিষ্টিপিছু কমিশনই বহু দশক ধরে কত সংসার সচল রেখেছে।

গেল বছর ট্রেন চালু হওয়ার আগে লঞ্চেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চন্দননগর থেকে বাবুঘাটে এসে নামতেন তাঁরা। এ বার নিরুপায়। বাসুর বৌয়ের সুগার, প্রেশার। ওষুধের দোকানে ধার। মেয়ে, নাতি, নাতনির দায়িত্ব। একদা হকার আন্দোলনের ডাকাবুকো মুখও এই দুর্বিপাকে অসহায়।

ফুটপাথে বাসুদার পড়শি জয়নগরের আলাউদ্দিন পৈলান মরসুমি মোয়া, কেক, মিষ্টি থেকে সুন্দরবনের জংলি মধু পর্যন্ত সরবরাহ করেন। বাবুদের ছাতাও সারিয়ে দেন। এ বর্ষায় বাড়িতে বসে তাঁর দুশ্চিন্তা এগারো ক্লাসের পড়ুয়া পুত্রের স্কুলের মাইনে নিয়ে। ডেকার্স লেনে রোল-চাউমিনের কারবারি মন্টু হালদার বাধ্য হয়ে শিয়ালদহের বাড়ি থেকে সেফ হোমে কোভিড রোগীদের পুষ্টিকর ঘরোয়া খাবার সরবরাহ করছেন। ডেকার্স লেনের প্রবাদপ্রতিম চিত্তদার ভাইপো সন্দীপ রায় হোটেল ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রিধারী। আপাতত তিনিও উবার-র‌্যাপিডোর ডেলিভারির কাজে বিকল্প খুঁজছেন।

হাইকোর্টপাড়ার সুইট হোম ও বিখ্যাত সম্রাট হোটেলের বাড়ির ছেলে প্রণব ঘোষ বলছিলেন, ‘অফিসপাড়ার ব্যবসায় দুঃসময় কিন্তু রাজ্য সরকার রাইটার্স বিল্ডিং ছেড়ে নবান্নে পাড়ি দেওয়া ইস্তকই শুরু হয়েছে। এক ধাক্কায় গাদাগাদা লোক কমে গেল।’ পর পর অফিস নিউটাউন, সেক্টর ফাইভগামী। এ ডালহৌসি সে ডালহৌসি নেই। ১৯৯০-৯২-এ যে আপিসে সাত-আটশো লোক গমগম করত, সেখানে এখন বড়জোর ২০-২২ জন।

শহরের ‘খাও গলি’ ডেকার্স লেন জুড়েও গুচ্ছের সাবেক দোকানের শব। গরগরে মেটে কষা রুটি-খ্যাত দাস কেবিনের চেয়ার, টেবিল উল্টোনো। উল্টো দিকেই বরিশাইল্যা প্রণববাবুর ভাতের হোটেল। শুধু চারাপোনা, কাতলা নয়, পার্শে, ট্যাংরা, পাবদা, চিতল, চিংড়ি, তোপসে সব ফ্যান্সি মাছ এখানে পাবেন, তারস্বরে ঘোষণা শোনা যেত রোজই। সেই গুমোর আপাতত শিকেয়। কোভিড ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে প্রণববাবুর শঙ্করপুরের হোটেলেরও ক্ষতি হয়েছে। দোকানের কর্মচারীরা হেঁড়িয়া, কাঁথিতে দেশে। মালিক ম্লান হাসেন, “ব্যবসা জমবে জানলে স্টাফগুলোকে নিজে গাড়ি করে এখনই নিয়ে আসতাম। ক’টা দিন কাটুক। অফিসপাড়ায় এই ক’টা লোক নিয়ে পড়তায় পোষাবে না।”

চিত্তদার দোকানের পাশে মথুরা পেঁড়াখ্যাত নামহীন রংচটা দোকানের দিকে চাইলেও বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। তবে দোকান বন্ধ রেখে পেঁড়া, কালাকাঁদ বিশারদ শ্যাম শর্মা ইউপিমুখো হননি। জিঞ্জিরাবাজারের বাড়িতেই রয়েছেন। শ্যামের বাবা বুধসেন শর্মা আগরার গ্রাম থেকে কলকাতায় আসেন ছোট্ট বয়সে। সে গাঁয়ে ঘরে ঘরে পেঁড়া, কালাকাঁদ, লস্যি, রাবড়ির কারবার। তবে বিধিনিষেধ জারির আগে ভৈঁসের দুধে রোজ ১০০ লিটারের কাজ হলে এখন খুব বেশি হলে ৪০ লিটারও হয় না।

আজন্ম ডেকার্স লেনের ভূমিপুত্র শ্যাম বা চিত্তদার ভাইপো সন্দীপরা দেখেছেন, কালে-কালে জমজমাট সাউথ ইন্ডিয়ান খানার দোকান বন্ধ করে দক্ষিণী মালিক কলকাতা ছাড়ছেন। সে জায়গায় পত্তন হচ্ছে রঙিন পানশালার। অতিমারির দিনে সেই পানশালাও মাছি তাড়াচ্ছে। শ্যামের ইচ্ছে, পুরনো কর্মচারী মেদিনীপুরের কার্তিক ও বিহারের রামজী ফিরতে পারলে ফের দোকান খোলার। তবে এ বার অনলাইন খাবার জোগানদার অ্যাপও রাখতে চান তিনি। চিত্তদার কর্তারা অবশ্য বিশ্বাস করেন, তাঁদের স্টু বা ফিশফ্রাই অ্যাপে চলবে না। পেটে খিদে নিয়ে আসা রানিং কাস্টমারদের জন্যই তা জুতসই।

ডেকার্স লেনের দুপুর এখন রীতিমতো সুররিয়াল মনে হতে পারে। ইমিউনিটি বাড়াতে ক’দিন আগেও রোজ রাতে হইহই করে মরিচ, তুলসীপাতা, মুলেটির টোটকা বা বিচিত্র কারাজল সেবন করতেন চিত্তদার কর্মচারীরা। দিনে রান্না খাবার ঘিরে হাঁকডাক। এখন সবই অবিশ্বাস্য মনে হয় জনশূন্য গলিতে।

কলকেতার জন্মের পরে চিৎপুরের এমন শুনশান চেহারাও কি দেখা গেছে কখনও! কলুটোলা, জাকারিয়া, ফিয়ার্স লেনের দ্বিপ্রাহরিক ক্ষুৎপিপাসা থমকে গেছে এই আজব সময়ে। আলাউদ্দিনের প্রভাতি জিলিপির সদ্গতি হয়নি খর দুপুরেও। আলুপুরি, হালুয়াখ্যাত লিয়াকতের দোকানের সামনেটা নিঝুম। তবে দোকান খুলেছে কয়েক দিন হল। ঝাড়খণ্ডের গিরিডি-ফেরত কর্মচারী সাবির আনসারি প্রত্যয়ী, “দেখবেন, আর ক’দিনেই সব কিছু মাশাল্লাহ হয়ে যাবে।” আদমের বিখ্যাত কাবাব সম্ভারও দরজা খুলছে বিকেলের পর। লাল মসজিদের পাশের বাদশা দিলশাদ কাবাবি ফোনে আশ্বাস দেন, মাসটা পার হতেই লখনউ থেকে ফের কলকাতামুখো হবেন তিনি।

খোঁজ নেই জাকারিয়ার দিকের খিরি, গুরদা কাবাবশিল্পী আব্দুল হামিদের নাতির। পাঁড় কংগ্রেস অনুগামী মহম্মদ শামিম। নেহরু-গাঁধী পরিবারের খাসতালুক অমেঠীতেই তাঁদের বংশেরও মুলুক। ২০২০-র লকডাউন থেকেই সেই দাদা-পরদাদার গ্রামেই পড়ে আছেন শামিম। বদলে তাঁর এক ভাইপো রিজওয়ান কলকাতায় ‘প্রক্সি’ দিচ্ছেন। ‘জলেবি স্পেশালিস্ট’ কামতা সিংহের মতোই কাবাব সেঁকায় দক্ষ হাত শামিম ভাইয়ের। কিছুতেই বাঁধা ধরা দু’-একটা আইটেমের বেশি হাত দেবেন না। যেন কোন পারফেকশনের সাধনায় অনন্তকাল মগ্ন। ভয় হয়, শহর তাঁর পুরনো চেহারা ফিরে এলেও সব কিছুই আগের মতো থাকবে তো! করোনাকাল ফের কোন বিচ্ছেদ ঘটাবে কে জানে!

সাম্প্রতিক বৃষ্টিভেজা বিকেলে ম্যাডান স্ট্রিটে আমতলা থেকে আসা থকথকে কমলারঙা ঘুগনি বিশারদ দু’ভাইয়ের হদিস মিলল না। দেখা নেই গণেশ অ্যাভিনিউয়ের নির্ভার কাঞ্জিবড়া বিশারদ মাড়োয়ারির। বড়বাজারে মশলাদার কাথিয়াওয়াড়ি রান্নার গুজরাতি বাসার কর্মচারীরাও উবে গিয়েছে। তবে এলআইসি বিল্ডিংয়ের কাছে জানবাজারের গৌতম সাউ একাই একশো ভঙ্গিতে অনিয়ান দোসা, দইবড়া, সম্বর বড়া নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। কোভিডের পরে সঙ্গীদের দেশ থেকে ফেরা অনিশ্চিত। জানবাজারের সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের আশ্রম-লক্ষ্মী মার্জারকুলও ঝাঁপ বন্ধ দেখে সম্ভবত অন্য কোথাও খিদে, তেষ্টার টানে পাড়ি দিয়েছে।

শরৎ বসু রোডের মুখে নানা কিসিমের নিরামিষ তরকারি, রুটি, পোলাও গরমাগরম সাজিয়ে দেওয়া পবন দাসও মরিয়া হয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক, হন্ডা শোরুম, কৃষ্ণা বিল্ডিং, কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের খদ্দেরকুল টিমটিম করে। অফিস আসতে বললেও খেতে বেরনো নিয়ে নিষেধ আছে কোথাও কোথাও। দোকানের ডালায় একমাত্র নেপালি কর্মচারীকে রেখে তবু কাজ চালিয়ে যান পবন। যা বাজার, টেনেটুনে বাজারের খরচ ওঠাই মুশকিল। মেয়ের অপটোমেট্রি শিক্ষার মতো ছোট, ছোট সাধ-আহ্লাদগুলোই তাঁর পিঠে চাবুকের মতো কশাঘাত করে এই আতঙ্ক, অনিশ্চয়তার দিনকালে।

আগের মতো নয়, তবু বিধিনিষেধেও কিছুটা অন্য ছবি বড়বাজারের ফুটপাতে। সত্যনারায়ণ পার্কে বলরাম পাণ্ডের ছেলেরা রাজস্থানি চিল্লার সঙ্গে তাওয়ায় সেঁকা মোটা পাঁউরুটির চিলি টমেটো পিৎজা করতে শিখে গেছেন। পাশেই শঙ্করের পাওভাজি বা শম্ভু সিংহের ফুচকারও জোর কদর। অফিসপাড়ার হাওয়া লাগলে, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের লিট্টি-চোখা থেকে বিরিয়ানি, চাউমিনের সুবাস অবচেতনে অন্তত ছুঁয়ে থাকেই। হঠাৎ আলাপ হয়, সেই সুরভি মেখে গন্তব্যহীন হাঁটছেন শরবতের দোকানের প্রৌঢ়, লকডাউনে কাজহারা মুরারি জয়সওয়াল।

শহরের পোড়খাওয়া হকারনেতা শক্তিমান ঘোষের ভাঁড়ারে মজুত কলকাতার হকারকুলের নানা কীর্তিকাহিনি। বরদান মার্কেটের এক জনের দইবড়া খেয়ে মুগ্ধ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দিল্লির বিমানে ওঠার আগে বিপুল পরিমাণে প্যাক করে নেন। আর এন মুখার্জি রোডের পঞ্জাবি বিক্রেতার হাতের পরিচ্ছন্ন নিরামিষ স্বাদের হয়ে তিনি নামী রেস্তরাঁর সঙ্গেও বাজি ধরতে রাজি। এর বাইরেও আছে অখ্যাতদের জীবনসংগ্রাম। কাকভোরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েও দিনের শেষে মরচে ধরে না উলুবেড়িয়ার মিন্টু সাহার প্রাণশক্তিতে।
শুনশান হাইকোর্ট পাড়ায় বিকেল শেষে নামমাত্র বিক্রি। মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ অ্যাডভোকেট দিদিকে দেখে তবু উজ্জ্বল তাঁর চোখমুখ। “এলেন কী করে?” প্রশ্ন শুনে রসিক উত্তর, “উড়ে আসি উলুবেড়িয়া থেকে!” উনুনে পরের দিনের ঘুগনির মশলা ভাজতে ভাজতেই সহাস্য জবাব, “দেখছেন না, বিকেলের মধ্যে পরোটা, ঘুগনি, আলুরদম সাবাড়! তবেই বুঝে নিন!”

বেসুর বেতাল দিনকালের কথকতায় পেটের মধ্যে বাড়তে থাকে খিদের আগুন, স্মৃতিময় ফোড়নের লোভনীয় সুঘ্রাণ। এক-একটি মানুষের আধার হয়ে তা এখনও নড়েচড়ে ভিড়হীন শহরে। জীবনের স্বাদ, গন্ধ, লড়াইয়ের স্মারক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement