লাহিড়ীমশাই: ছবি বিশ্বাস ও প্রমোদকুমার। ডানে তাঁরই আর একটি ছবি। ছবি সৌজন্য: পরমভট্টারক লাহিড়ী।
মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের মধ্যে থেকে বড়ে গোলাম আলির গলায় গান ভেসে আসছে, ‘কেয়া করুঁ সজনী আয়ে না বালম...’। কে গাইছেন বনের মধ্যে অমন গান? গাইছেন লাহিড়ীবাড়ির মেজছেলে প্রমোদকুমার লাহিড়ী। কখনও গান শেখেননি, কিন্তু অন্যের গলা নকল করতে পারতেন হুবহু। তাঁর বাবা বিভূতিভূষণ লাহিড়ী ছিলেন শান্তিপুরের ছেলে। তিনি এক রাতের মধ্যে বাবা-মাকে দু’জনকেই হারান। তার পর আত্মীয়স্বজনের সাহায্যে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। কয়লার খোঁজে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের (এখন ছত্তীসগঢ়) কোরিয়া জেলায়। সেখানকার রাজার আনুকূল্যে চিরিমিরি অঞ্চলের কয়লাখনিতে রেজিং কন্ট্রাক্টরের কাজ পেলেন বিভূতিভূষণ। জঙ্গল, পাহাড়, নদীঘেরা জায়গাটি তাঁর ভারী পছন্দ হল। ক্রমে নানা ব্যবসায় টাকা নিয়োগ করতে লাগলেন। গড়ে তুললেন চিরিমিরি শহর, প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল ও কলেজ। কোরিয়ার মহারাজার খুব আস্থা ছিল তাঁর উপর, তিনি বিভূতিভূষণকে ইংল্যান্ডে পাঠালেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। ক্রমে বিভূতিভূষণ লাহিড়ী পরিচিতি লাভ করলেন ‘বিবিএল’ নামে। বাঙালি সমাজ তত দিনে এক ডাকে চিরিমিরির লাহিড়ীদের চিনে ফেলেছে। বহু বাঙালির চাকরির ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন সেখানে। সেখানে বারেন্দ্রদের বিশেষ কদর ছিল। সেখানকার কলেজের সুনাম শুনে, সাহিত্যিক তারাপদ রায় সেখানে অধ্যাপনার জন্য দরখাস্ত করেন। দরখাস্তে নাকি উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনিও বারেন্দ্র! হঠাৎ সরকারি চাকরি পেয়ে যাওয়ায় তাঁর চিরিমিরি যাওয়া বাতিল হয়ে যায়।
বিভূতিভূষণের চার পুত্র, পাঁচ কন্যা। এক পুত্র অকাল প্রয়াত। বড় ছেলে প্রশান্তকুমারের হাতে ধীরে ধীরে ব্যবসার দায়িত্ব দিতে লাগলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু তার পরের ভাই প্রমোদকুমারকে কিছুতেই কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যাচ্ছিল না। তিনি তখন খেলাধুলো আ? ????? র শিকার নিয়ে ব্যস্ত। লাহিড়ীবাড়ির ছেলেরা সবাই বন্দুকচালনায় দক্ষ ছিলেন, নিয়মিত শিকার করতেন। প্রমোদকুমার এক বার আহত লেপার্ডের আক্রমণ থেকে বন্ধুকে বাঁচিয়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। মাথা ঠান্ডা রেখে গুলি না করলে দু’জনেই মারা পড়তেন। এ বার বিভূতিভূষণ চাইলেন মেজছেলেকে কাজের জগতে আটকে রাখতে। কোরিয়া জেলায় তাঁদের তিনটি সিনেমাহল ছিল। সেগুলোর দেখাশোনার ভার পড়ল প্রমোদকুমারের উপর। কাজের সূত্রে ছবি দেখতে লাগলেন তিনি। এ বার তাঁর ভাবনায় ঢুকে পড়ল চলচ্চিত্র। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি কয়েক বার পড়া ছিল। ভাবলেন, ছবি করলে ‘আরণ্যক’ নিয়ে করবেন। ‘আরণ্যক’-এর গল্প তাঁর খুব চেনা। চিরিমিরির পাহাড় জঙ্গল নদী আদিবাসী সবই যেন ‘আরণ্যক’-এর পাতা থেকে উঠে এসেছে। বাবা আপত্তি করবেন না, জানতেন। বিভূতিভূষণ লাহিড়ীর অভিনয় জগতের প্রতি অনুরাগ ছিল ছেলেবেলা থেকে। তাঁর দাদা ললিতমোহন লাহিড়ীর হৃদ্যতা ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে। এক সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ললিতমোহনের পছন্দ ছিল কালো পাড়ের ধুতি। শিশিরকুমার তাঁকে আদর করে ‘কালোপেড়ে দাদা’ বলে ডাকতেন।
ইংরেজ অভিনেতা জিওফ্রে কেন্ডাল তখন তাঁর ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’ দল নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিভূতিভূষণ যোগাযোগ করলেন তাঁদের সঙ্গে। সপরিবারে জিওফ্রে কেন্ডাল দু’বার দুর্গম চিরিমিরিতে এসেছেন দলবল নিয়ে। সঙ্গে জেনিফার আর শশী কপূর। লাহিড়ী স্কুলের অডিটোরিয়ামে তাঁদের দলের অভিনয় দেখে সেখানকার মানুষ তো মুগ্ধ। আরও পরে সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসার’ ছবির শুটিংয়ের জন্য চিরিমিরির লাহিড়ীদের বাড়িতে ইউনিটের লোকজন নিয়ে কয়েক দিন কাটিয়েছিলেন।
বিভূতিভূষণের আগ্রহে শান্তিনিকেতন থেকে প্রতি বছর শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসে ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান, অভিনয় শেখাতেন। রঙ্গমঞ্চের প্রতি বরাবর আকর্ষণ ছিল লাহিড়ীদের। এরই মধ্যে এক সিনেমা-অনুরাগীর দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে গেল তাঁদের। ঋত্বিককুমার ঘটকের মেজদি ও জামাইবাবু, ডলিদি ও রায়মশাই, ওই অঞ্চলে বসবাস শুরু করলেন কর্মসূত্রে। তাঁরা অচিরেই লাহিড়ীদের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। এক বার কলেজের ছুটিতে ঋত্বিক ওখানে বেড়াতে গেলেন, লাহিড়ীবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। প্রশান্তকুমার ও প্রমোদকুমারের স্ত্রীরা তাঁকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতেন। ভাইফোঁটা দিতেন। সিনেমার কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন প্রশান্তকুমার, প্রমোদকুমার এবং ঋত্বিক। এই সব আড্ডার ফসল হল ছবি তৈরির আইডিয়া। সংস্কৃতিমনস্ক বিভূতিভূষণ লাহিড়ী সায় দিলেন তাতে। বিভূতিভূষণ তাঁর তিন ছেলে, প্রশান্তকুমার, প্রমোদকুমার এ?? বং পরমসৌগত-র নামে ‘এল বি ফিল্মস ইন্টারন্যাশনাল’ নামে ফিল্ম কোম্পানি খুললেন। ‘এল বি’ মানে ‘লাহিড়ী ব্রাদার্স’। সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন প্রশান্তকুমার এবং প্রমোদকুমার। তত দিনে নাগপুরে গিয়ে সপরিবার থাকতে শুরু করেছেন প্রমোদকুমার। শহরে ব্যবসার কাজ দেখতেন আর ফাঁক পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেতেন বিদর্ভের চান্দার জঙ্গলে। আগ্রহীদের জন্য জঙ্গলে সাফারির ব্যবস্থা করে দিতেন।
এরই মধ্যে সিনেমা তৈরির সুযোগ এসে গেল। ‘আরণ্যক’ নয়, অন্য ছবি। তখন সবেমাত্র ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির কাজ শেষ হয়েছে। দাদা প্রশান্তকুমার তপন সিংহের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন, আর কলকাতায় ডেকে পাঠালেন প্রমোদকুমারকে। ব্যবসার কাজ ছেড়ে এক নাগাড়ে বেশি দিন কলকাতায় থাকা সম্ভব ছিল না প্রশান্তকুমারের পক্ষে। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন প্রমোদকুমার। উঠলেন রাসবিহারী মোড়ে তাঁদের বসতবাড়িতে, নাম ‘সর্বতোভদ্র’। ফিল্ম তৈরির সমস্ত রকম কাজকর্ম সামলাতে লাগলেন। তাঁর একটি গুণ ছিল, সবার সঙ্গে চট করে মিশতে পারা। সবাইকে সহজেই আপন করে নিতেন। ১৯৫৭ সালে হইহই করে শুরু হল ‘লৌহকপাট’ ছবি তৈরির কাজ। লাহিড়ীদের ‘সর্বতোভদ্র’ ক্রমে হয়ে উঠল চারটি উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবির সূতিকাগৃহ। ‘লৌহকপাট’-এর কাজ চলছে, এমন সময় খবর পাওয়া গেল, ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কিছু দিনের জন্য বিদেশে চলে গেছেন, সত্যজিৎ রায় খুব সমস্যায় পড়েছেন। এই সুযোগ ছাড়লেন না প্রমোদকুমার। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করলেন এবং বললেন, তাঁর একটি ছবি তিনি প্রযোজনা করতে চান। সত্যজিৎ রায়ের ইউনিট তখন বসে আছে। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে খোলাখুলি বললেন, একটি নতুন ধরনের ছবি করতে চান। তবে সে ছবি দর্শক কতটা নেবে তা বলা মুশকিল। প্রমোদকুমার ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে বললেন, ভাল ছবি প্রযোজনা করবার স্বপ্ন তাঁর বহু দিনের। এর মধ্যে ঋত্বিক ঘটক প্রমোদবাবুকে বললেন তাঁর একটি ছবি প্রযোজনা করতে। তত দিনে সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে শুনে ঋত্বিক ঘটক পিছিয়ে এলেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না, সে কথা বলে তিনি নিজে অপেক্ষা করতে রাজি হলেন। তৈরি হল সেই ছবি, ‘পরশপাথর’।
পিঠোপিঠি ছবি ত ৈরি করা সহজ কাজ নয়। অর্থের টান পড়ল। ‘পরশপাথর’ শেষ হয়েছে, এ দিকে ঋত্বিক ঘটক অপেক্ষা করছেন কাজ করবেন বলে। দুটো প্রিন্টিং প্রেস ছিল লাহিড়ীদের— একটা মধ্যপ্রদেশে, আর একটা কলকাতায়। দুটোই বিক্রি করে দিলেন প্রশান্তকুমার। এ ভাবে টাকার ব্যবস্থা হল। ‘অযান্ত্রিক’-এর কাজ শুরু করলেন ঋত্বিক ঘটক। ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পেল যথাসময়ে। প্রমোদকুমার তখন তাঁদের তৈরি ছবি নিয়ে বিদেশের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে ঘুরছেন। ছবিগুলি কেমন প্রশংসিত হয়েছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি ফেরার আগে ভেনিসে গিয়ে সেখানকার চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অযান্ত্রিক’ দেখানোর ব্যবস্থা করে আসেন। ১৯৬০ সালে ওই একই চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। এ ছবির জন্য দু’বার স্ক্রিপ্ট লেখেন ঋত্বিক ঘটক। প্রথম বার লিখে মনে হল, বক্স অফিসের দাক্ষিণ্য পাওয়া যাবে না। লাহিড়ীদের আর্থিক অবস্থার কথা জানতেন তিনি। আবার লিখলেন স্ক্রিপ্ট। এ বার ছোট্ট নায়কের চোখে কলকাতা শহরকে ফুটিয়ে তুললেন। এ দিকে মনের মতো টুকটুকে চেহারার ছেলে পাওয়া যায় না। তেমন কাউকে চোখে ধরে না। হঠাৎ মনে হল, লাহিড়ীবাড়িতেই তো রয়েছে কাঞ্চন! প্রমোদকুমারের একমাত্র সন্তান পরমভট্টারক। আপত্তি উঠল পরমভট্টারকের মা দেবযানীর তরফে। ছেলেকে সিনেমায় নামতে দিতে নারাজ তিনি। এ দিকে ঋত্বিক নাছোড়বান্দা। কাঠখড় পুড়িয়ে অনুমতি মিলল। বাকিটা ইতিহাস।
বিদেশের ওপেন এয়ার থিয়েটার দেখে খুব ভাল লেগেছিল প্রমোদকুমারের। নিজেদের বসতবাড়ির পিছনের জমিতে শ’চারেক দর্শক ধরানোর মতো থিয়েটার তৈরি করলেন ১৯৬০ সালে বীরেশ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায়। নাম দেওয়া হল ‘মুক্ত-অঙ্গন’। এখানেই শেষ নয়। প্রমোদকুমার লাহিড়ীর উদ্যোগে ১৯৬১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা’। এই কাজে তিনি পাশে পেয়েছিলেন রাম হালদার এবং রতিলাল দাভেকে। বিদেশের ফিল্ম ক্লাবগুলি দেখে অনুপ্রাণিত প্রমোদকুমার ভেবেছিলেন, আমাদের দেশের দর্শকদের মনে ভাল ফিল্ম দেখার চাহিদা তৈরি করতে হবে। দরকার একটি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন আন্দোলনের। কলকাতার প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজক সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা। প্রমোদবাবু মনে করতেন, দর্শকদের মধ্যে দু’টি ভাগ আছে। এক দল চায় ভাল জগৎবিখ্যাত সিনেমা, অন্যরা আনসেন্সরড সিনেমার উত্তেজনা। আশা করতেন, ভাল ছবি দেখার ফলে ভবিষ্যতে ভাল পরিচালক তৈরি হবে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী লাহিড়ীদের কলকাতার বাড়ি। ওই বাড়ির তিন তলায় ভিন্ন সময়ে ভাড়া থেকেছেন সপরিবার ঋত্বিক ঘটক ও দীনেন গুপ্ত। সলিল চৌধুরী ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির জন্য গান লিখেছেন এখানেই। নিয়মিত আসতেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন। বিদেশি ফিল্মের প্রিভিউয়ের সময় ভিড় জমত লাহিড়ীদের ঘরে। বাড়ি থেকে পালিয়ে’ যখন তৈরি হচ্ছে, তখন আসতেন শিবরাম চক্রবর্তী। লাহিড়ীদের বাড়ি এ ভাবেই হয়ে উঠেছিল সিনেমা-সংস্কৃতির পীঠস্থান।
সুরসিক, সঙ্গীতানুরাগী প্রমোদকুমার ছিলেন বন্ধুবৎসল, ভালবাসতেন নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে। কাশ্মীরের বিখ্যাত রান্না গোস্তাভা খাইয়ে তৃপ্ত করেছেন অনেককেই। ১৯২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম, সম্প্রতি নিঃশব্দে পূর্ণ হল তাঁর জন্মশতবর্ষ। ১৯৯৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। ‘আরণ্যক’ নিয়ে কাজ করা হল না বলে আক্ষেপ ছিল আজীবন।
তথ্যঋণ: পরমভট্টারক লাহিড়ী, শম্পা মৈত্র, সুদেষ্ণা রায়