ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
এই আখ্যান অশ্রুত না হলেও বিস্মৃত তো বটেই। কাহিনি পুনর্নির্মাণের আগে প্রণতি জানাই প্রয়াত এক কবিকে। তিনি, বিনয়বাবু, যে-ই খাতায় ‘বিড়াল দেবতা’ লিখলেন, অমনি সাত-আটটা বনবিড়াল কোথা থেকে তাঁর বাড়িতে ভাত খেতে হাজির হল। এক অস্থির কবির এ হেন ঘোরের ভিন্নতর দর্শন ভাবাচ্ছে না। বরং ভেবে দেখলাম, কেউ তো কখনও তাদের ভাল চোখে দেখেইনি!
এই বিড়াল জীবজগতের এমন এক প্রজাতির সদস্য, যাদের নিয়ে ভাল কথা লেখা হয়েছে কদাচিৎ। ভিনদেশি কবি সিলভিয়া প্লাথও হাসপাতালের শয্যায় সাতপাঁচ ভাবছিলেন সামনে রাখা টিউলিপের তোড়া নিয়ে। পাপড়ি মেলা এহেন সুন্দর ফুল দেখে তার কেন যেন মনে হল আফ্রিকার বনবিড়ালের কথা। এই বুঝি তারা দাঁত-নখ-থাবা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
যে দিকে তাকাই, ছত্রে ছত্রে তার হিংস্রতার ব্যাখ্যান। রেহাই দেয়নি প্রবাদমালাও। সেখানেও বিধান, ঘরের বিড়াল বড় আদুরে পোষ্য, কিন্তু সে যেন কখনও অরণ্যচারী না হয়। তা হলেই হয়ে যাবে বনবিড়াল। অবস্থান্তরে পাল্টে যাবে চরিত্র।
কম গেলেন কি রবিবাবুও? হচ্ছিল কালান্তর আর রায়তের কথা। হঠাৎ কি মনে হল, ফস করে লিখে দিলেন “আজ যারা কাড়তে চায় যদি তাদের চেষ্টা সফল হয় তবে কালই তারা বনবিড়াল হয়ে উঠবে।”
মোদ্দা কথা বিড়াল ভাল, বনবিড়াল ভারী পাজি। যাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বিভূতিভূষণ। সে ঝোপের তলা দিয়ে কালু মোড়লের ধানখেতের দিকে যাচ্ছে। ডোরাকাটা পুচ্ছ। থমকে দাঁড়ানো ‘পথের-কবি’ জানেন, নড়াচড়া করা যাবে না। সাড়া পেলেই লেজ তুলে হারিয়ে যাবে। মিনিট খানেকে হলও তাই। কী করে বুঝে ফেলেছে, কোনও মানুষ তাকে দু’চোখে গিলছে। বুঝতেই এক দৌড়ে কোথায় সত্যিই মিলিয়ে গিয়েছে।
মিলিয়ে সে সত্যিই গিয়েছে। খেতের ঘাসফড়িং কিংবা ইঁদুর চিবোতে সে আর আসে না। মুরগি আর পায়রার ঘাড় ধরে নিয়ে যেতে গেরস্থের ডেরায় হানা দেয় কি? দিব্যি তো বেড়ে উঠছে গাছের কোটরে পাখির ছানা। ডিমও ফুটছে দিব্যি। মাঝরাতে সে সব তুলে নিয়ে যাওয়ার ‘ছেলেধরা’ বনবিড়ালই যে নিরুদ্দেশ। কোনও ঝোপের গহ্বরে সারা দিন ঝিমোচ্ছেও না সাহেবি বিচারে ‘অদ্ভুত’ সেই নিশাচর।
গ্রামবাসীর পিটুনিতে আজও বনবিড়ালের দফারফার খবর শুনলে খানিক বিস্মিতই হই। ভাবি, আছে ওরা এখনও? কোন গ্রাম? কোন দেশ? কোন জেলা? থাকার তো কথা নয়! সে তো সেই কবে কোন কালে নবাব সৈয়দ মিরজাফর আলি খানের ভেট হয়ে পৌঁছে গিয়েছে শ্রপশায়ারের তোলাবাজের জিম্মায়। এমনকি জাহাজে চেপে পাড়ি দিয়েছে বিলেতেও!
সে জন্তু বিলেতে কিন্তু সত্যিই এখনও আছে। বিশ্বাস না হলে ‘লন্ডন’ ম্যাগাজ়িন খুঁজুন। ১৭৫৯ সালের কোনও এক সংখ্যায় সে সটান তাকিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাবার নীচে ধরা মৃত মুরগি-সহ। গলায় লৌহশৃঙ্খল। শৃঙ্খলের অন্য প্রান্ত ধরে গাছের নীচে উপবিষ্ট কোনও ‘নেটিভ’। যাকে নবাবের ভেট নিয়ে দেখভাল করতে জাহাজে উঠতে হয়েছে। পরনে তার দরবারি পরিচ্ছদ। মাথায় ইয়া বড় পাগড়ি। প্রেক্ষাপটে গাছপালা। সঙ্গে মেঘ আর পাহাড়ের আবছা আভাস। কয়েক বছর পরে ১৭৯৩ সালে জন্ম নেওয়া বিলিতি ‘ওয়ান্ডারফুল’ পত্রিকাও তাকে বিনোদন ডালির অতি উত্তম খোরাক ভেবে রিপ্রিন্ট করেছে। সঙ্গে বেশ রসিয়ে লেখা হচ্ছে, এনগ্রেভিংয়ে ‘নাবোব’ প্রেরিত ভারতীয় ‘সারভ্যান্ট’ দিব্যি দিশি ভাষায় জন্তুর সঙ্গে অনর্গল কথা বলত। জন্তুও কেনা গোলামের মতো তার প্রতিটি নির্দেশ পালন করত।
এ কথা জানলে বাঙালি মাত্রেরই বঙ্কিমকে মনে পড়বে। বঙ্কিম মানে কমলাকান্তের কথা। যিনি ‘হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছিলেন’। যাঁর মনে হচ্ছে, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তাঁর কাছে আফিম চেয়েছেন। কর্তার দুধ সাবাড় করেছে সে বিড়াল। কর্তা এ বার পুরুষত্ব প্রমাণ করবেন। তা-ই হাতে ‘ভগ্ন যষ্টী’ নিয়ে ‘মার্জারীর প্রতি ধাবমান হইলেন’। কিন্তু বিড়াল আদৌ ভয় না পেয়ে হাই তুলে বলছে ‘মেও’! প্রশ্ন রাখছে, “সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, মৎস্য, মাংস সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন?” বঙ্কিমের বিড়াল কমলাকান্তকে বোঝাতে চেয়েছে, পরোপকারই পরম ধর্ম, “আমি চুরিই করি, আর যাই করি, আমি তোমার ধর্মসঞ্চয়ের মূল কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া, আমার প্রশংসা কর।”
সন্দেহ নেই, বঙ্কিম তাঁর বিড়ালকে ‘ওয়ান্ডারফুল’ বানাতে প্রাণপাত করেছেন। এ হেন মার্জারী তুলেছেও অব্যর্থ প্রশ্ন। তাতে কেবলই মনে হচ্ছে, বনবিড়ালও দিব্যি তার মতোই বলতে পারত, “ঘাস ফড়িং আর ইঁদুর খাইয়া আমরা তো তোমাদের ফসলই রক্ষা করিতাম। মুরগি-কবুতর তোমরা একা কেন খাইবে, আমরা খাইলেই কেন ক্রোধানলে জ্বলিয়া হত্যা করিত উদ্যত হও?”
এ দিকে নবাবের বনবিড়ালকে ‘ওয়ান্ডারফুল’ করতে বঙ্কিমের মতোই সেই ব্রিটিশ পত্রিকা তার গায়ে খানিক রং চাপিয়েছে। প্রতীয়মান, জন্তুর একগুচ্ছ গোঁফ আর ধারালো দাঁত। সঙ্গে বনবিড়ালের ‘ট্রেডমার্ক’ কিঞ্চিৎ বাঁকানো লম্বা গগনমুখী কানজোড়া। ‘নাবোব’ প্রেরিত প্রতিপালক আঙুল তুলে তার দিকে নির্দেশ করে যেন বলছে, ‘দেখো দেখো, তোমরা সাহেবসুবোরা তো অদ্ভুত জানোয়ার দেখতে চাইছ, এই যে তেমনই এক প্রাণী নিয়ে হাজির হয়েছি তোমাদের ডেরায়।’
‘তোমাদের ডেরা’ মানে ‘টাওয়ার অব লন্ডন’। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বা কুখ্যাত সেই দুর্গ, যেখানে ছ’শোর বেশি বছর ধরে ছিল চিড়িয়াখানাও। এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা চষে ফেরা ইংরেজদের মুখে বাঘ-ভল্লুক-জ়েব্রাদের গল্প শুনে সাধ মিটবে কেন ছাপোষা মানুষজনের? ওদের ভাষায় ‘বহিরাগত’ কিংবা ‘অদ্ভুত’ প্রাণীদের জাহাজে চালান করা হত হামেশাই। চমকে যাই, সেই সব বহিরাগত অতিথিদের ভিড়ে টাওয়ারে সুরক্ষিত এক মেরুভল্লুকের গল্পে। তৃতীয় হেনরির জিম্মায় যাঁর আগমন নরওয়ের রাজার উপহার হয়ে। তিনি নাকি লাঞ্চ সারতে টেমস নদীতে মাছও ধরতেন। মোদ্দা ব্যাপার হল, যে রাজতন্ত্রে সূর্যাস্ত হয় না, তার বৈভবের দেখনদারি। তাই রাজার নিজস্ব চিড়িয়াঘর।
কে না জানে, সেই মধ্যযুগ থেকেই রাজা-মহারাজাদের হরেক উপহার বিনিময়ের অভ্যাসের কথা। এই হরেকের মধ্যে থাকত অসহায় অবোলা প্রাণিকুলও। শুধু সৌজন্য আর অভ্যাস তো নয়। কূটনীতিও। তৃতীয় হেনরি যেমন বিয়েতে রোম সম্রাটের কাছ থেকে পাওয়া তিনটি চিতাবাঘ (মতান্তরে, সিংহ) পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেছেন, তখনই রাজামশাইয়ের মাথায় খেলেছিল চিড়িয়াখানার ভাবনা। যদিও সে শখ তাঁর পিতৃদেব জন-এরও ছিল। বা ইংল্যান্ডে তাঁদের আগেকার অনেক রাজারও।
আগেই বললাম, এক দিন দেখতে দেখতে টাওয়ারে নরওয়ে থেকে এল মেরুভল্লুক। আফ্রিকার সিংহ। ফ্রান্সের রাজা পাঠালেন বিশাল এক হাতি। যাকে চাক্ষুষ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাজার-হাজার লন্ডনবাসী। ঐরাবতের জন্য একেবারে নতুন করে ৪০ বাই ২০ ফুটের ঘর বানানো হল। সে হাতি অবশ্য অচিরে দেহ রাখল। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে টাওয়ার অব লন্ডনে ডানা ঝাপটাল ইগলও। ইতিহাসে বার বার শুধু লেখা হয় রাজামশাই জেমসের পূর্ণাঙ্গ বাইবেল প্রকাশ কীর্তি। লেখা হয় না, একই সঙ্গে এই রাজা একেবারে কাছ থেকে লন্ডনবাসীর সিংহ দর্শনের বন্দোবস্তও করেছিলেন।
কিন্তু আমাদের গেঁয়ো বনবিড়াল? তাকে তো কেউ আগে দেখেনি! দেখেনি বলেই হইহই কাণ্ড। মিস্টার পিট, মানে ‘বড়’ উইলিয়াম পিট তখন ডাকসাইটে প্রধানমন্ত্রী। যাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিত ফরাসিদের বৈভব আর নিজের গেঁটে বাত। তিনি মোহিত হলেন লর্ড ক্লাইভের কীর্তিতে। হাউস অব কমন্স-এ দাঁড়িয়ে বলে দিলেন, সর্বঘটে ইংরেজদের মহিমা, সম্মান, মর্যাদা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অথচ ভারতবর্ষে একেবারে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনও সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটেছে!
গঙ্গাপারের দুর্গ বা দমদমার কান্ট্রি হাউসে বসে তো ক্লাইভের পক্ষে পিটের প্রশস্তি জানার কথা নয়! শুনেছিলেন অনেক পরে। পিটের মতো লোক ধন্য-ধন্য করেছেন জেনে স্বভাবতই হয়েছিলেন আহ্লাদে আটখানা। প্রতিদানে উপহার কিছু না দিলেই নয়! তখনই নিশ্চয় তাঁর মনে হয়েছে, মিরজাফরের দেওয়া সেই বনবিড়ালটাই পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? এমনিতে রাজরাজড়াদের মতোই হোমরাচোমরা আমলাদেরও অনেক সময় নিজস্ব পশুশালা থাকত। তাতে সমাজে তার ঠাটবাট বাড়ত বই কমত না। সঙ্গে সাহেবসুবোদের অদেখা জন্তু হলে তো কথাই নেই! আমাদের বনবিড়াল ভেট পাওয়া ইংরেজ সেনানায়ক লর্ড ক্লাইভের পোষ্যের ফিরিস্তি শুনলেও তো চোখ কপালেই ওঠে!
অবশ্য এ দেশেও নবাবি পশুশালা ঠাটবাটে কম যায়নি। মেটিয়াবুরুজে ওয়াজেদ আলির চিড়িয়াঘরের খবর কে না রাখত। তাঁর ৩৭৫ জন বেগম, কিন্তু চব্বিশ হাজার পায়রা। খাঁচায় ২৩টি বাঘ, চৌবাচ্চায় কিলবিল করে সাপ আর পুকুরধারে বাগানে হাওয়া খেয়ে বেড়ায় আফ্রিকার জিরাফ।
আমাদের আখ্যানে অবশ্য কোনও নবাব নন, লর্ড ক্লাইভেরই দাপাদাপি। যিনি বাংলার মসনদে বসা পুতুল রাজা মিরজাফরের ভেট ‘কিম্ভূত’ বনবিড়ালকে মহার্ঘ ভেবে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। নজরানাই বটে! সঙ্গে অপ্রত্যাশিত প্রশস্তির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লম্বা চিঠি। যাতে কিনা বিলেতের ইংরেজরা তাঁকে নিয়ে ‘নাবোব’ বলে ঠাট্টা বন্ধ করে মূর্তিটূর্তি বসানোর ব্যবস্থা নেয়!
ছেলেবেলাতেই গুন্ডামি করে নাম কুড়োনো সেনানায়কের চিঠি নিয়ে বিলেতের জাহাজে উঠে পড়লেন জন ওয়ালশ। যিনি শুধুই কোম্পানির বিশ্বস্ত কর্মচারী নন, সম্পর্কে ক্লাইভের স্ত্রীর তুতো ভাইও। দেখতে দেখতে চিঠির সঙ্গে পিটের উপহার ইংরেজি ‘ক্যারাক্যাল ক্যাট’ অজানা প্রতিপালক-সহ এক দিন পৌঁছে গেল লন্ডনে। অবশ্য কেউ লেখেনি বনবিড়াল ভেট পেয়ে উল্লসিত হচ্ছেন সাহেব। সমারসেট আর কেন্টে ছুটিছাটায় ‘বড়’ পিট বাগান করতেন জানা গিয়েছে। কিন্তু জীবজন্তুতে মতি ছিল বলে বিশেষ শোনা যায়নি। হয়তো সেই কারণেই সাত তাড়াতাড়ি পাল্টা উপহার হিসেবে তিনি রাজার কাছে জন্তুটিকে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা আর কী করবেন? বঙ্গবিজয়ের চিহ্ন মনে করেই হয়তো তাকে দুর্গে জায়গা দিলেন। মুর্শিদাবাদি ঝোপঝাড় থেকে উড়ে আসা কোনও বনবিড়াল জুড়ে বসল টাওয়ার অব লন্ডনে!
তখন লর্ড ক্লাইভ স্থায়ী ভাবে কলকাতাবাসী। নিবাস ফোর্ট উইলিয়াম। সপ্তাহান্তে ছুটি কাটান দমদমের বাগান বাড়িতে। তবে এই দু’জায়গার কোথাও তিনি বনবিড়াল দেখেছেন বলে কেউ কিচ্ছুটি লেখেনি। হয়তো প্রথম দেখে থাকবেন মুর্শিদকুলি, আলিবর্দির শহরে। এমনটা অনুমান করার কারণ, তাঁর এক বিশ্বস্ত সৈনিক জন করনেলি মুর্শিদাবাদেই দর্শন পেয়েছিলেন বিনয় মজুমদারের দেবতা, সিলভিয়া প্লাথের দস্যুর। করনেলি-ও মেজর জেনারেল। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি সুইৎজ়ারল্যান্ড। তাঁর বাবাও ইংরেজদের হয়ে যুদ্ধ করার চাকরি করেছেন।
এ হেন সুপুত্র পলাশির প্রান্তরে কামান দাগার পাশাপাশি লিখতেন ডায়েরি। ডায়েরিতে লেখা হচ্ছে, ক্লাইভের দলবলকে তুষ্ট রাখতে মিরজাফর নাটক পর্যন্ত দেখাচ্ছেন! প্রহসনও বলা যায়। ভাষার মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরেও বিষয়বস্তুর হালকা আভাস দিয়েছেন সাহেব। আন্দাজ করেছেন নাটকের রূঢ়তা। কে জানে কী ভাবে এ-ও বুঝেছেন, জীবনে ছিটেফোঁটা অর্জন না করতেই যারা উপর মহলের নকল করে, তাদেরই সেখানে কটাক্ষ করা হচ্ছে। ভাবুন, সেই নাটকে ভাঁড়ের ভাঁড়ামোর সম্ভাব্য দর্শক হয়তো স্বয়ং ‘ইংরাজ বীরবাহাদুর’ ক্লাইভও!
পালার বর্ণনা এ কাহিনির মোক্ষ নয়। বরং চোখ রাখা যাক ‘ইংরাজ’ বিনোদনের জন্য উপস্থাপিত অন্য এক বৃত্তান্তে। যেখানে সাহেবসুবোদের সামনে খোলা মাঠে নিয়ে আসা হচ্ছে চোখে কাপড় বাঁধা এক চিতাবাঘ। মাঠের অন্য মাথায় ছাড়া হচ্ছে কোনও হরিণ। রীতিমতো ‘শেখানো-পড়ানো’ চিতার চোখের কাপড় সরিয়ে দিতেই খেলা শুরু। সে পেটে ভর দিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। হরিণও বুঝছে, তার প্রাণসংশয়। পালাচ্ছে পড়িমড়ি করে।
করনেলি লিখছেন, গাঁয়ের গরিবগুর্বোর চিতাবাঘ নেই। তা বলে কি সে রগড় করবে না? করবে বলেই এই খেলায় তাদের চিতার ডামি বনবিড়াল। সাহেব যাকে বলছেন, ‘শাই গুজ়’। আমাদের চেনা পোষ্য বিড়ালের দ্বিগুণ তার বহর। লম্বা কান। পাখির পালকের মতো লোম। এ দিকে, গেঁয়ো মানুষজন হরিণ কোথায় পাবে? তাই তাদের খেলায় বনবিড়ালের শিকার কখনও ছাগলছানা। কখনও বা খরগোশ। এমনকি সারমেয়ও।
শুধু তো বনবিড়ালের কথা বললেন না আমবাগানে যুদ্ধু করা সাহেব। মানুষখেকো বাঘ, কুমির, ভোঁদড় এমনকি তোপসে মাছের গল্পও শোনালেন। আমরা অবশ্য শুনতে চেয়েছিলাম, ক্লাইভকে দেওয়া মিরজাফরের সেই ভেটের কথা। কিন্তু করনেলির ডায়েরিতে তার বেত্তান্ত মোটে নাই!
সে না থাকুক, এটুকু দিব্যি বোঝা গেল যে, জীবজন্তুর নিষ্ঠুর বিচিত্র এক খেলার জন্য সাধারণ গ্রামবাসীরাও রীতিমতো নিজেদের কাছে ধরেবেঁধে রাখত বনবিড়াল। যাকে মনে ধরেছিল ক্লাইভেরও। না হলে কেন বিলেতে ফিরে চতুর্থ জর্জকে উপহার দিতে ভারত থেকে একটা বড় হাতি পাঠানোর জন্য সাধাসাধি করবেন বাংলার নতুন গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্ট-কে। আর না পেয়ে হতাশ হয়ে বলে বসবেন, না পাওয়া গেলে একটা বনবিড়ালই অন্তত পাঠাতে! যার মানে, বুনো মার্জারদের তাঁর রীতিমতো কৌতূহল উদ্রেককারীই মনে হয়েছিল। এবং সেই কারণেই ধরে নিয়েছিলেন, পিটের মতো বড়কর্তাও এমন উপঢৌকনে বর্তে যাবেন। যদিও বাস্তবে আদৌ তা হয়নি। হয়নি বলেই ওয়ালশের হাত হওয়া সে জীব পেয়েই পত্রপাঠ তা রাজাকে উপহার দিয়ে বসলেন।
আমরা আবার ভাবছি, ভাগ্যিস পিট রাজাকে উপহারটা দিলেন! দিলেন বলেই টাওয়ারে বসে কোনও অজানা শিল্পী অমন নিখুঁত একটা ছবি এঁকে রাখলেন। আমাদের আফসোস অন্য জায়গায়। সে কালে বাঙালি আত্মকথা, স্মৃতিকথা লেখেনি এমন তো নয়। কিন্তু বনবাদাড়ে হামেশাই দেখা যায়, এমন এক প্রাণীর কথা তার কেন যে সে ভাবে মনে পড়ল না কে জানে!
স্বামীজির মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের কথাই ধরা যাক। তাঁর ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ ওইটুকু চটি বই। কিন্তু সেখানেও জায়গা পেয়েছে না জানি কত না জীবজন্তু। বাড়ির পিছনের খালি জমিতে কাঁটানটে গাছের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গোখরো সাপেরা গৃহস্থের বাড়িতে দিব্যি ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। ডোমপাড়ার সর্দার এসে তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মহেন্দ্রনাথের মনে পড়েছে, ছেলেবেলায় দেখা এঁদো পুকুর আর বাঁশঝাড়বাসী শিয়ালের উৎপাতের কথাও। তারা নাকি দত্তবাড়ির উপরের ঘর থেকে হাঁড়ি মাথায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেত। অনেক বাড়ি থেকে ‘ছিনতাই করত’ ছোট বাচ্চাদেরও। শেষে তল্লাটে-তল্লাটে ‘নেড়ে কুকুর’ এসে যাওয়ায় শিয়ালেরা আর পেরে উঠল না।
খালধার আর মানিকতলা বাগানের বাদুড়ের কথাও বেশ রসিয়ে বলেছেন তিনি। সঙ্গে টিপ করে নরেন্দ্রনাথের ঠাকুর দালানে ঝুলে থাকা বাদুড় মারার গল্প। কিন্তু কেন কে জানে মহেন্দ্রবাবুর মনে পড়েনি কলকাতার বনবিড়ালের কথা। তা হলে তত দিনে কি ঝোপঝাড়ের কলকেতা থেকে তারা পাততাড়ি গুটিয়েছিল? হবে হয়তো! স্বামীজির ভাইয়ের কাল তো আর ক্লাইভের জমানার মতো অত প্রাচীন নয়।
শিয়ালদের কথা রয়েছে ক্লাইভের শাগরেদদের লেখাতেও। পলাশি-জনিত ছলচাতুরি মিটিয়ে দেওয়ানি লাভের মোক্ষে নতুন করে বিলেত থেকে ক্লাইভ সাহেব যখন এলেন, তখন তাঁর শরীর মোটে ভাল যাচ্ছে না। ফোর্ট উইলিয়ামের থেকেও সে সময় নাকি তাঁর দমদমার বাড়িই বেশি ভাল লাগত। এ বার আর স্ত্রী মার্গারেট সঙ্গে এলেন না। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। এলেন তাঁর ভাই এডমন্ড। ক্লাইভের ছায়াসঙ্গীর বাইরে এডমন্ডদের আর একটা পরিচয়, তাঁরা ইংল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নেভিল মাসকেলিনের ভাই-বোন। যিনি কি না দুই বন্ধুকে নিয়ে পৃথিবীর ভর মাপার উপায় বাতলে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।
এই পর্বে ‘নাবোব’-এর অন্য দুই ছায়াসঙ্গী চিকিৎসক স্যামুয়েল ইংহ্যাম ও ব্যক্তিগত সচিব রবার্ট স্ট্র্যাশি। তাঁরাই দমদমের কান্ট্রি হাউস, যাকে সে সময় লোকে চিনত ‘বড়া কুঠি’ আর ‘দমদম হাউস’ নামে, সেখানে বিশাল বড় মাটির পাত্র ভর্তি করে জল রেখে দিতেন শিয়ালদের তৃষ্ণা নিবারণ করতে। তবে মার্গারেটের শিয়ালে বিতৃষ্ণাই থাকার কথা। ফোর্ট উইলিয়ামে এক বার তাঁর পোষ্য ময়ূরকে ঝোপঝাড় থেকে এসে এই প্রাণীটিই এমন জখম করেছিল যে তাকে বাঁচানো যায়নি। কাঁদতে কাঁদতেই ইংল্যান্ডে চিঠি লিখে মার্গারেট জানিয়েছিলেন সে কথা!
এহেন আখ্যানে শিয়ালকাঁটায় আটকে গেলে চলবে না। সব বললে আস্ত একটা পশুশালাই বানিয়ে ফেলতে হয়। তবু বলি, শুধু কলকাতাতেই ক্লাইভ দম্পতির সংগ্রহে ছিল একটি শান্ত ময়না, ব্যাঘ্রশাবক, ভল্লুক, ময়ূর, বড় সাইজ়ের পেঁচা, দু’টি শজারুও। মেমদের পরচর্চায় অনাগ্রহী মার্গারেট সারা দিনটাই কাটতেন একটা মস্ত টেবিলে প্রিয় ময়নার সঙ্গে। এ হেন ভার্যার মনতোষের তাগিদে কি না করেছেন লর্ড ক্লাইভ? শুধু কি ইংল্যান্ড থেকে হার্পসিকর্ড বাদ্যযন্ত্র আনালেন? মোটেই না। ১৭৬৪-তে ভারতে আসার সময় রিয়ো দে জেনেইরোতে প্রায় দু’মাস আটকে ছিল ক্লাইভদের জাহাজ। শোনা যায়, তখন তিনি মার্গারেটের জন্য একটা মারমোসেট বাঁদরও জুটিয়ে ফেলেছিলেন।
ক্লাইভের কাছিমের কথা কে না জানে! যা তাঁকে ভেট দিয়েছিলেন ব্রিটিশ নাবিকেরা। একটি নয়, ভারত মহাসাগরের তিনটি কচ্ছপ। যাঁদের মহামান্য এক জন এই তো সে দিন, বছর পনেরো আগে দেহ রাখলেন আলিপুর চিড়িয়াখানায়। ওই যে বললাম, ধরে ধরে সবার কথা বললে সত্যিই পশুশালা হয়ে যাবে! কত বলা যায়? ১৭৬০-এ তিনি মোটেই শুধু মার্গারেটকে নিয়ে বিলেতগামী জাহাজে ওঠেননি। সঙ্গে নিয়েছিলেন একটা বিশাল সাপও।
সবাই জানে, ক্লাইভ ভেট নিতে ভালবাসতেন। এমনি এমনি ইংরেজরা ‘নাবোব’-এর বৈভব আর প্রাচুর্য দেখে ভিরমি খেয়ে ‘চুরির মাল,’ ‘চুরির মাল’ বলে চেঁচামেচি করেনি। ক্লাইভ জানতেন ইংল্যান্ডে কল্কে পেতে তাঁকে ভেট দিতেও হবে। আর সব সময় যে তা পাউন্ড-শিলিং-সোনাদানা হতে হবে এমন নয়। নজরানা হতে পারে বাঘ-সিংহও। এমনকি সে সব চড়া দামে বিক্রি করাও কিছু নয়। ব্যক্তিগত চিড়িয়াঘর বানিয়ে ঠাটবাট বাড়ানোর তাগিদ থাকা খদ্দেরও জুটে যেত। দ্য ডিউক অব মার্লবরো তো ক্লাইভের বার্কলে স্কোয়ারের বাড়ি থেকেই অক্সফোর্ডশায়ারে নিয়ে গেলেন এক হৃষ্টপুষ্ট শার্দূল। হতে পারে সে সোঁদরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারই। যাকে সবাই মার্লবরো টাইগার নামে সে সময় এক ডাকে চিনত। রানির দেওয়া গর্দভের সঙ্গে সে-ও এক দিন চিড়িয়াখানার দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠল।
বাঘ তো নয়, এই আখ্যানে নায়ক যে বাঘের মাসি! বাঘ বাঁচাতে চার দিকে কত আয়োজন। কিন্ত বনবিড়াল? তার কথা আর কে কবে কোন কালে ভেবেছে। বঙ্কিমের মতো কাতর এক জনকেও কি পাওয়া গিয়েছিল? ক্লাইভের মার্জারের পরিণতি জেনে কারও গালে এক ফোঁটা জলও কি গড়িয়েছিল?
হতে পারে কান্নাকাটি করেছিলেন এক জনই। বিলেতে পাঠানো সেই সারভেন্ট। জাহাজের খোলে অত মাস প্রাণীটির সঙ্গে কাটানোর স্মৃতি বা নবাবের বাগানে দেখভালের না জানি কত মুহূর্ত তাঁকে দুঃখে অভিভূত করতেই পারে। তাঁকেই যে চোখের সামনে দেখতে হল লন্ডনের ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে পোষ্যের মারা পড়া। দুর্গের ঘরে আগুন রেখেও যার যন্ত্রণার ছটফটানি লাঘব হয়নি।
সান্ত্বনা বোধহয় একটাই। অজানা শিল্পীর অলঙ্করণে পোষ্য আর পালকের অমরত্ব লাভ। যে ছবির উপর বেশ কায়দা করে লিখে দেওয়া হল ‘The Shah Goest’। করনেলির বানানটা অবশ্য একটুখানি আলাদা। তিনি লিখলেন ‘Shy Goose’। সাহেবরা যে যেমন শুনেছিল, তেমন করেই লিখেছে। এমনিতে ইংরেজরা বলে থাকে ‘ক্যারাক্যাল ক্যাট’। ফ্রান্সের এক প্রকৃতিবিজ্ঞানী জানলেন তুরস্কের লোকেরা বলছে ‘কারা-কুলাক’। যার অর্থ কালো কানের জংলি মার্জার। মনে হয়, সেখান থেকেই হয়ে গেল ক্যারাক্যাল।
আর এ দেশে তার আর একটা নাম খাগড়া বিড়াল। খাগড়া হল বড় ঘাস বা শর। হতে পারে, সেখানেই গা ঢাকা দিত বলে এমন নামকরণ। হতে পারে কোনও শরবন থেকেই ধরা হয়েছিল ক্লাইভের ভেট। কাকতালীয় ভাবে মিরজাফরের মুর্শিদাবাদে একটা জায়গার নামও খাগড়া। পিতলের বাসনকোসন যেখানে তৈরি হয়।
ইংরেজরা যে ‘Shah Goest’ ইত্যাদি লিখলেন তার মোটামুটি ঠিকঠাক প্রতিবর্ণীকরণ ‘Siyah Gus’, এটি পারসিক শব্দ। উর্দু বা হিন্দিতেও প্রায় একই উচ্চারণ। বৃক্ষ উৎপাটনের ঘোর কলিতে শহর দূরস্থান, গাঁ-গঞ্জে ঝোপঝাড় থেকেও কার্যত হারিয়ে যাওয়া বনবিড়াল এখন যেন নিছকই একটা শব্দ। যে শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়েই শুধু কথা চলতে পারে। অথবা বিলুপ্তপ্রায়দের আপদগ্রস্ত পরিণতি সংক্রান্ত সম্মেলন। প্রেক্ষাপটে প্রতিপালকের হাতে ধরা লর্ড ক্লাইভের অরণ্যচারী মার্জারের সেই ছবিটিও রাখা যেতে পারে! যে দেহ রাখতেই দুঁদে শল্য চিকিৎসক, অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিদ্যায় পারদর্শী জন হান্টার ছুরি-কাঁচি নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। ব্যবচ্ছেদ পর্ব মিটতে লিখলেন, ‘টাওয়ার থেকে পাওয়া মেটে রঙের ক্যাট।’ ক্যাটের হাড়গোড় আবার রাখা হল রয়্যাল কলেজ অব সারজেনস-এ। সেখানে লেখা হয়েছিল ‘Bones of Shargoss’। এক দিন অস্থিও অদৃশ্য হল। ভাগ্যবান পথের কবি তবু তো তার দেখা পেলেন! আমাদের হাতে রইল ‘লন্ডন’ ম্যাগাজ়িন!