এই পৃথিবীতেই এমন জায়গা আছে যেখানে গেলে মনে হবে যেন অন্য কোনও গ্রহে এসেছি। জায়গাটা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধেরও সবচেয়ে উত্তরে, সোয়ালবার্ড নামে এক দ্বীপপুঞ্জের অংশ— যার পরে আর মানুষের বাসচিহ্ন নেই। মানে অঞ্চলটা মানুষের বাসের অযোগ্য। জায়গাটার নাম নিউ আলেসঁদ, প্রায় ৭৯ ডিগ্রি (৭৮º৫৫' উত্তর/ ১১º৫৬' পূর্ব) উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত।
উত্তর মেরুকে ঘিরে আছে আর্কটিক বৃত্ত, সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি অক্ষাংশ থেকে মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। এটাই আর্কটিক মহাসাগর। উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছে আছে চারটে দেশ— কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে আর রাশিয়া। নরওয়ের উত্তরে নরওয়েজিয়ান সমুদ্র পেরিয়ে সোয়ালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান, ‘স্পিট্জ্বারজেন’ নামেও লোকে চেনে একে। এই দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমে সমুদ্রতীরবর্তী শহরটাই নিউ আলেসঁদ। এর এক ডিগ্রি দক্ষিণে ‘লংইয়ারবিয়েন’ নামে শহরে দু’হাজারের বেশি মানুষের বাস, কিন্তু কেউই স্থানীয় বাসিন্দা নন। ৭৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে এই শহরই মানুষের শেষ স্থায়ী বসবাসের জায়গা। জন মুনরো লংইয়ার ১৯০৬-এ এখানে কয়লা খনন শুরু করেন, তাঁর নামেই এই শহরের নাম।
অসলো থেকে উড়োজাহাজে এসেছিলাম লংইয়ারবিয়েন। সেটা জুলাই মাস, তবু নরওয়েজিয়ান সমুদ্রের অনেকটাই ভাসমান বরফে ঢাকা। অনেক পর্যটক আসেন উত্তর গোলার্ধের এই শেষ শহরে। এখান থেকে নিউ আলেসঁদ যাওয়ার বাণিজ্যিক বিমান নেই। যদিও সেখানে বিমানবন্দর আছে, তবে তা বিশেষ প্রয়োজনে। আমরা নানা দেশের ১৫০ জন পর্যটক আর্কটিক অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে ‘হন্ডিয়াস’ নামের এক জাহাজে লংইয়ারবিয়েন থেকে বেরিয়েছিলাম এগারো দিনের অভিযানে। তারই এক দিনে জাহাজ থেকে নেমে জ়োডিয়াক নৌকোয় চেপে এলাম নিউ আলেসঁদ-এ। যে জাহাজে এলাম তা ভাসমান মোটা বরফের স্তর গুঁড়িয়ে এগোতে পারে, একে বলে ‘ক্রাশার’। কিন্তু বরফ ভেঙে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। সে থাকে কেবল গবেষণাধর্মী জাহাজের, তাকে বলে ‘ব্রেকার’। যে কোনও অভিযানেরই, তা সে পর্যটক-বান্ধব অভিযান হলেও, একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থাকে। আমাদের অভিযানের বিশেষত্ব, জাহাজের এক দল বিজ্ঞানী প্রতি দিন পর্যটকদের এই দ্বীপপুঞ্জের কোনও বিশেষ জায়গায় নামিয়ে সেখানকার উদ্ভিদ, প্রাণী, পাখি, আবহাওয়া, দূষণ, পুরনো খনি, হিমবাহ ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনা করতেন। দ্বীপে যেতে হলে জাহাজ থেকে জ়োডিয়াকে চেপে যেতে হত, জাহাজ থেকে নামলেই বিশেষ জুতো পরতে হত, ফিরে এসে তা স্যানিটাইজড জলে ধুতে হত। স্থলভূমি থেকে কোনও কিছু নিয়ে আসা বারণ।
নিউ আলেসঁদ এখন উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছের বহুজাতিক স্থায়ী গবেষণাকেন্দ্র। নরওয়ে সরকারের বিজ্ঞান ও জলবায়ু বিভাগ এই কেন্দ্রগুলো দেখাশোনা করে। জ়োডিয়াক থেকে যেখানে নামলাম, সেখান থেকে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো গড়ানে জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গবেষণাকেন্দ্রগুলো দেখলে মনে হয় যেন ছোটখাটো একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আর্কটিক সাগর থেকে বরফ-ছোঁয়া কনকনে হাওয়া সাগরতটে আছড়ে পড়ে এগিয়ে যায় ভেতরে, ধাক্কা খায় উঁচু তীক্ষ্ণ পাথরের পাহাড়ের গায়ে। এই তটভূমিতেই গড়ে উঠেছে দশটা দেশের এগারোটা গবেষণাকেন্দ্র— যেখানে আর্কটিক সমুদ্র ও হিমবাহ, জলবায়ু এবং মেরু অঞ্চলের উপরের বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর নিয়ে কাজ হচ্ছে। চারটে দেশের গবেষণাকেন্দ্রে সারা বছর কাজ চলে। মোটামুটি ৩০ থেকে ১৫০ জন মানুষ থাকেন, যাঁদের অধিকাংশই বিজ্ঞানী। ভারতের গবেষণাকেন্দ্রও আছে এখানে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর আন্টার্কটিক অ্যান্ড ওশানিক রিসার্চ-এর অধীনে ‘হিমাদ্রি’ রিসার্চ সেন্টার। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আট বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এখানে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি এই কেন্দ্রের মূল গবেষণার বিষয় বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞান, হিমবাহ, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও দূষণ। জানলাম, ‘চন্দ্রযান’ রকেট উৎক্ষেপণ একমাত্র ভারতের তৈরি স্যাটেলাইট-মাধ্যমেই কেন্দ্রের মনিটরে ধরা পড়েছিল, সব দেশের বিজ্ঞানীরা সেই দৃশ্য দেখে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
সমুদ্র অভিযানের ইতিহাস গোড়ায় মূলত দক্ষিণ গোলার্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল। উত্তর গোলার্ধের কঠিন হিমবাহ এবং সমুদ্রে ভাসমান পুরু বরফের স্তর ভেঙে এগনোর মতো নৌ-ব্যবস্থা ছিল না। তবু গরমের সময় বরফের স্তর পাতলা হয়ে গেলে তিমি শিকারের জন্য কিছু নর্ডিক শিকারি আসা-যাওয়া করতেন। জোনাস পুলে নামে এক শিকারি ১৬১০ সালে এখানকার পাথরে কয়লা দেখতে পান। ব্লুমস্ট্র্যান্ড ১৮৬১-তে খননযোগ্য কয়লার কথা জানালে ১৯০১ থেকে কয়লা খননের উদ্যোগ শুরু হয় এবং বহু হাত ঘুরে ১৯১৬ সালে আলেসঁদবাসী পিটার ব্রান্ডেল-এর কাছে কয়লার স্বত্ব বিক্রি করা হয়। সেই থেকে কয়লা খনন ও জাহাজে করে দেশে পাঠানোর কাজ শুরু হয়। খনি থেকে জাহাজঘাটে কয়লা নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাতা হয় রেললাইন, চলত বাষ্পচালিত রেল। এই রেলপথ উত্তর গোলার্ধে সর্বোচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত রেলপথ। ১৯৬৩ সালে কয়লা উৎপাদন বন্ধ হয়, সঙ্গে রেলও। তবে স্মৃতি হিসেবে একটা ইঞ্জিন-সহ রেলগাড়ি রাখা আছে। খননকার্য চলাকালীন মাঝেমধ্যেই শ্রমিক ধর্মঘট হত। খনিতে প্রায়ই বিস্ফোরণ হত, বহু মৃত্যুও হয়েছে। দ্বীপের বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমে বাড়ে, অধিকাংশই শ্রমিক পরিবার। সাধারণত জাহাজ চলত মে থেকে অক্টোবর, প্রচণ্ড শীতেও শ্রমিকদের অবসর মিলত না।
কিন্তু কয়লার জন্যে তো গাছ চাই। এখানে এত গাছ কী করে হল? ভূতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, পঁচিশ থেকে সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে এই সব দেশ ও দ্বীপ নিরক্ষরেখার কাছে ছিল। তার পর ভূ-গঠনের পরিবর্তনে এরা ক্রমশ উত্তরে সরতে শুরু করে আজকের এই জায়গায় এসেছে। গত কুড়ি লক্ষ বছরে এখানে বহু বার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে, শেষ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হয়েছে ৭০ হাজার বছর আগে। এখানকার কয়লার বয়স? ছ’কোটি থেকে পঞ্চাশ লক্ষ বছর! সোয়ালবার্ড দ্বীপ-সহ নরওয়ে ও ইওরোপের বহু দেশের অবস্থান যখন অনেক নিম্ন-অক্ষরেখায় ছিল, তখন সেখানকার আবহাওয়া বিস্তৃত বনাঞ্চল গড়ে ওঠার পক্ষে উপযুক্ত ছিল। সেই গাছই পরে ভূতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে কয়লায় পরিণত হয়েছে। দ্রুত কয়লা তৈরিতে সাহায্য করেছে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাতও। গত শতকের ষাটের দশকে সব কয়লাখনিই পরিত্যক্ত হয়, কারণ পর পর দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যু ও ব্যবসার ক্ষতি বেড়েই চলছিল। ১৯৬৩-তে সব খনি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমুদ্রতট থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে পাহাড়ে চলার পথেআমরা কয়েকটা পরিত্যক্ত খনি দেখেছিলাম। কয়লাখনি নিয়ে একটা সুন্দর মিউজিয়মও আছে এখানে।
১৯২৫-২৬ সালে এই দ্বীপ থেকেই বায়ুযানে উত্তর মেরু অভিযান শুরু হয়। চারটে অভিযান হয়েছিল— নিউ আলেসঁদ থেকে উত্তর মেরু হয়ে আলাস্কা, সেখান থেকে একই পথে ফেরা। একটায় নেতৃত্ব দেন রোয়াল্ড আমুন্ডসেন। প্রথম বার সফল ভাবে উত্তর মেরু পেরিয়ে যান, কিন্তু অন্য একটি বায়ুযান দুর্ঘটনায় পড়লে সেই উদ্ধার অভিযান থেকে ফেরার সময় এক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। শহরের মাঝখানে আমুন্ডসেনের আবক্ষ মূর্তি আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জেপেলিন-সহ নানা ধরনের বায়ুযান এ সব অভিযানে ব্যবহার করা হত, মিউজিয়মে আছে তাদের ছবিও।
নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউট ১৯৬৬ সালে এখানে প্রথম গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে— মূলত বায়ুমণ্ডলে বায়ুর গতিবিধি মাপা এবং আয়োনোস্ফিয়ার গবেষণার জন্যে। এর পর থেকেই এখানকার পাথর, উদ্ভিদ, পাখি ইত্যাদি দেখতে গবেষকেরা আসতে শুরু করেন। ১৯৯০-এর পর থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই ইটালি, নেদারল্যান্ডস, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, নরওয়ে ও ভারত এখানে গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করে। ভারতীয় গবেষণাকেন্দ্র ‘হিমাদ্রি’ তৈরি হয় ২০০৮-এ। দোতলা কাঠের বাড়ি— ওপরের তলায় চারটে শোবার ঘর, নীচে ল্যাবরেটরি। এই বাড়িটা এবং লাগোয়া বাড়িগুলো এক সময় ছিল খনি শ্রমিকদের ব্যারাক। পরে স্কুল, ডাকঘরও তৈরি হয়। আমরা যখন গিয়েছিলাম, সে সময় ভারতের গবেষণাকেন্দ্রে আটজন বিজ্ঞানী ছিলেন। প্রত্যেকে দেড় থেকে দু’মাসের মতো থাকেন, পরে আবার নতুন দল আসে। শীতে প্রায় তিরিশ ফুট বরফ জমে থাকে, তখন সবাই দেশে চলে যান। কাছেই ব্রিটিশ রিসার্চ স্টেশন। চিনের গবেষণাকেন্দ্রটি দূর থেকেই চেনা যায়, বাড়ির সামনে দুটো বড় পাথরের সিংহ। অসংরক্ষিত ল্যাবরেটরি এবং ঘরদোর, এ যেন এক স্বপ্নের জায়গা। সব দেশের বিজ্ঞানীরা কমিউনিটি ক্যান্টিনে এক সঙ্গে বসে খাবার খান। ভারতীয়ের পাশে চিনা, তার পাশে ইটালিয়ান— এ যেন অন্য এক পৃথিবী।
সোয়ালবার্ড দ্বীপের প্রায় ষাট শতাংশ এলাকা হিমবাহে ঢাকা। বরফের হিসেবে ৭০০০ ঘন কিলোমিটার। সবচেয়ে বড় হিমবাহকে ‘আইস ক্যাপ’ বলা হয়, এই দ্বীপের পূর্ব দিকে বিশাল কিছু আইস ক্যাপ রয়েছে। আমরা প্রধানত যে দিকটায় দিয়েছি, সেই দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমে হিমবাহের চেহারা নদীর মতো, সমুদ্রের কাছে থমকে দাঁড়িয়েছে। উত্তর অক্ষাংশের আশি ডিগ্রির উত্তরে জাহাজ এগোতে পারেনি, অত্যধিক পুরু বরফের স্তর আর ঝড়ঝঞ্ঝার জন্য। এ ছাড়াও আর এক ধরনের হিমবাহও উপত্যকা জুড়ে থাবা মেরে বসে আছে। ‘পার্মাফ্রস্ট’। হাঁটতে গেলে মাটি স্পঞ্জের মতো মনে হয়, আসলে এই মাটির নীচে আছে বরফের স্তর। গরমের সময়ে ওপরের বরফ গলে মাটিকে নরম করে রেখেছে। ছয় থেকে আট ফুট নীচেই আছে স্থায়ী হিমবাহের বরফ। জ়োডিয়াক নৌকোয় যেতে যেতে অনেক জায়গায় দেখেছি থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু হিমবাহের গায়ে বরফের গুহাও।
নিউ আলেসঁদ-এ বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র একটা ডাকঘর। এতগুলো ক্যাম্পের চিঠি দেওয়া-নেওয়া হয় তাই ব্যস্ততা খুবই, জানালেন মহিলা পোস্টমাস্টার। সর্বোচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত এই পোস্ট অফিসের দায়িত্ব তাঁর ওপর, তাই গর্বিতা তিনি। থাকেন অফিসেই। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে আন্তরিক কথা বিনিময়ে ভাষা অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে নেন ওঁরা। রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দেখা হলে সবাই মাথা হেলিয়ে বা ঝুঁকিয়ে ‘হ্যালো’ বলছিলেন, তবে ওখানেই শেষ। মোবাইলের ব্যবহার নেই, কারণ মোবাইলের নেটওয়ার্ক এখানে নিয়ম-বহির্ভূত। ব্লুটুথ, ওয়াইফাই চলে না। বিশালাকৃতি এক ডিশ স্যাটেলাইট অ্যান্টেনা এখানে চব্বিশ ঘণ্টা মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কাজ করে চলেছে। এই যন্ত্র খুবই সংবেদনশীল, তাই অন্য যে কোনও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ-তরঙ্গ ব্যবহার এখানে নিষিদ্ধ।
নির্জনতা কী তা বোঝা যায় জনপদ থেকে একটু ভিতরে, পাহাড়ের কাছে গেলেই। এমনিতেই আর্কটিক নির্জনতা বড় কঠোর। পাহাড়ের মাথায় ছুঁচলো পাথরগুলো রুক্ষতার প্রতীক হয়ে আকাশের দিকে হাজার হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এক-দেড় ইঞ্চি উঁচু থোকা থোকা গুল্মগুচ্ছ ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কোনও বড় গাছের দেখা নেই। থাকবে কী করে, বরফেই তো ঢাকা থাকে বছরের আদ্ধেকেরও বেশি সময়। নানা ফুল ও ছত্রাক— গোলাপি ক্যাম্পিয়ন, মেটে রঙের ছত্রাক ‘পোলার ক্যাম্পিয়ন’, ছোট ব্যাঙের ছাতার মতো ছত্রাক, আরও সাদা, হলুদ, নীলাভ, বেগুনি রঙের ফুল। দেখেছি নানা রকমের পাখি। দ্বীপে নেমে একটু ঢুকতেই একটা খোলা জায়গায় গোলাপি পায়ের জোড়া পাতার বার্নাক্ল হাঁসেরা তাদের ছানাপোনা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। পাহাড়ের খাঁজ থেকে ভেসে আসে পাখিদের অবিরাম ঝগড়ার আওয়াজ, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে। এরা আর্কটিক টার্ন— মাথাটা কালো, ওপরের ঠোঁট হালকা কমলা, লেজটা একটু বেশি লম্বা। সুযোগ পেলেই নেমে এসে মানুষের মাথায় ঠোক্কর মারে। এরা ঠান্ডা দেশের পাখি, কিন্তু আর্কটিকে শীতের সময় একটু উষ্ণতার জন্যে পাড়ি দেয় আন্টার্কটিকা, সেখানেই জন্ম দেয় শাবকের আর ওখানে শীত শুরু হতেই আবার ফিরে আসে আর্কটিকে। বছরে প্রায় ৭১,০০০ কিলোমিটার উড়ে পৃথিবী পরিক্রমা করে এরা! প্রাণিজগতে সবচেয়ে লম্বা সফর। দেখেছি সমুদ্রে ভাসমান বরফের মাথায় বসে থাকা সাদা আইভরি সিগাল। ফুলমার পাখিরা সাধারণত সমুদ্রের জলে ঢেউয়ে দোল খেতে খেতে ভেসে থাকে আর সুযোগ বুঝে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে মাছ ধরে। ছিল ছোট কিটিওয়েকস, লেজ-ঝোলা স্কুয়া, আরও কত বিচিত্র পাখি। পাহাড়ের গা বেয়ে নামা আর্কটিক শেয়ালকে দেখেছি আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আপন মনে খাবারের সন্ধানে চলে যেতে। দেখেছি, সমুদ্রে ভাসমান বরফে রোদ পোহাচ্ছে সিল।
এখানে এসে মনে হয়, প্রকৃতির এই সম্ভার শুধু প্রকৃতির জন্যেই, মানুষের জন্য নয়। এই নির্জন শ্বেত মরুর দেশে মানুষের পা পড়েছে মাত্র কয়েকশো বছর আগে। এক সময় এখানে মেরুভল্লুক ঘোরাফেরা করত, চরে বেড়াত বল্গাহরিণেরা। আর্কটিক শেয়ালেরা জলে নেমে মাছ ধরত, পাখির ডিম বা ছানা ধরে খেত, শীতে সমুদ্র জমে গেলে বরফের ওপর দিয়ে চলে যেত গ্রিনল্যান্ড, কখনও আলাস্কায়। দেখলাম পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় পরিত্যক্ত বাড়ির কাছে শেয়াল ধরার ফাঁদ পাতা, সম্ভবত খননকাজ চলাকালীন এখানে বসবাসরত মানুষের কাজ। এই শহরে শেষ মেরুভল্লুককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় ২০১১ সালের ১৯ জুলাই।
আর্কটিক বিশ্ব একটা ভিন্ন পৃথিবী। ভাবাই যায় না, এই পৃথিবীতেই এমন একটা জায়গা আছে যেখানে সূর্য অস্ত যায় না, চাঁদ ওঠে না। ভাবাই যায় না, এমন একটা জায়গা আছে যেখানে মানুষের সৃষ্টি দিক-নির্ণয় এবং দ্রাঘিমা ধরে সময়ের হিসেব, সবই অচল। মেরুতে কোথায় উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ বা পশ্চিম? যেখানে দ্রাঘিমাগুলো সব এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে, সেখানে সময়ই বা কোথায়! এই অনন্ত ও বিশালতার মধ্যে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, মানুষের অস্তিত্বটা আসলে কতটুকু, কত ছোট। হঠাৎ হইহই শুনে সম্বিৎ ফিরতে দেখি, সমুদ্রের জল থেকে উপরে উঠে আবার, বারবার ডুব দিচ্ছে কালো মিঙ্কি তিমি। আমাদের জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে, আমাদের সঙ্গেই চলেছে সেও, যেন নিজের এলাকা পার করে দেওয়ার মহান দায়িত্ব নিয়েছে। ডিনার রেডি, ঘোষণা হল। হাসি পেল, রাতই নেই, গনগনে রোদ্দুর বাইরে, ভিতরে রাতের খাবারের ডাক। আমার ঘড়ির দুটো কাঁটাই বারোটার ঘরে রেখে দিয়েছি প্রথম দিন থেকেই। সময় এখানে বাস্তবিক শূন্য।
কিন্তু কয়লার জন্যে তো গাছ চাই। এখানে এত গাছ কী করে হল? ভূতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, পঁচিশ থেকে সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে এই সব দেশ ও দ্বীপ নিরক্ষরেখার কাছে ছিল। তার পর ভূ-গঠনের পরিবর্তনে এরা ক্রমশ উত্তরে সরতে শুরু করে আজকের এই জায়গায় এসেছে। গত কুড়ি লক্ষ বছরে এখানে বহু বার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে, শেষ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হয়েছে ৭০ হাজার বছর আগে। এখানকার কয়লার বয়স? ছ’কোটি থেকে পঞ্চাশ লক্ষ বছর! সোয়ালবার্ড দ্বীপ-সহ নরওয়ে ও ইওরোপের বহু দেশের অবস্থান যখন অনেক নিম্ন-অক্ষরেখায় ছিল, তখন সেখানকার আবহাওয়া বিস্তৃত বনাঞ্চল গড়ে ওঠার পক্ষে উপযুক্ত ছিল। সেই গাছই পরে ভূতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে কয়লায় পরিণত হয়েছে। দ্রুত কয়লা তৈরিতে সাহায্য করেছে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাতও। গত শতকের ষাটের দশকে সব কয়লাখনিই পরিত্যক্ত হয়, কারণ পর পর দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যু ও ব্যবসার ক্ষতি বেড়েই চলছিল। ১৯৬৩-তে সব খনি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমুদ্রতট থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে পাহাড়ে চলার পথে আমরা কয়েকটা পরিত্যক্ত খনি দেখেছিলাম। কয়লাখনি নিয়ে একটা সুন্দর মিউজিয়মও আছে এখানে।
১৯২৫-২৬ সালে এই দ্বীপ থেকেই বায়ুযানে উত্তর মেরু অভিযান শুরু হয়। চারটে অভিযান হয়েছিল— নিউ আলেসঁদ থেকে উত্তর মেরু হয়ে আলাস্কা, সেখান থেকে একই পথে ফেরা। একটায় নেতৃত্ব দেন রোয়াল্ড আমুন্ডসেন। প্রথম বার সফল ভাবে উত্তর মেরু পেরিয়ে যান, কিন্তু অন্য একটি বায়ুযান দুর্ঘটনায় পড়লে সেই উদ্ধার অভিযান থেকে ফেরার সময় এক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। শহরের মাঝখানে আমুন্ডসেনের আবক্ষ মূর্তি আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জেপেলিন-সহ নানা ধরনের বায়ুযান এ সব অভিযানে ব্যবহার করা হত, মিউজিয়মে আছে তাদের ছবিও।
নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউট ১৯৬৬ সালে এখানে প্রথম গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে— মূলত বায়ুমণ্ডলে বায়ুর গতিবিধি মাপা এবং আয়োনোস্ফিয়ার গবেষণার জন্যে। এর পর থেকেই এখানকার পাথর, উদ্ভিদ, পাখি ইত্যাদি দেখতে গবেষকেরা আসতে শুরু করেন। ১৯৯০-এর পর থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই ইটালি, নেদারল্যান্ডস, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, নরওয়ে ও ভারত এখানে গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করে। ভারতীয় গবেষণাকেন্দ্র ‘হিমাদ্রি’ তৈরি হয় ২০০৮-এ। দোতলা কাঠের বাড়ি— ওপরের তলায় চারটে শোবার ঘর, নীচে ল্যাবরেটরি। এই বাড়িটা এবং লাগোয়া বাড়িগুলো এক সময় ছিল খনি শ্রমিকদের ব্যারাক। পরে স্কুল, ডাকঘরও তৈরি হয়। আমরা যখন গিয়েছিলাম, সে সময় ভারতের গবেষণাকেন্দ্রে আটজন বিজ্ঞানী ছিলেন। প্রত্যেকে দেড় থেকে দু’মাসের মতো থাকেন, পরে আবার নতুন দল আসে। শীতে প্রায় তিরিশ ফুট বরফ জমে থাকে, তখন সবাই দেশে চলে যান। কাছেই ব্রিটিশ রিসার্চ স্টেশন। চিনের গবেষণাকেন্দ্রটি দূর থেকেই চেনা যায়, বাড়ির সামনে দুটো বড় পাথরের সিংহ। অসংরক্ষিত ল্যাবরেটরি এবং ঘরদোর, এ যেন এক স্বপ্নের জায়গা। সব দেশের বিজ্ঞানীরা কমিউনিটি ক্যান্টিনে এক সঙ্গে বসে খাবার খান। ভারতীয়ের পাশে চিনা, তার পাশে ইটালিয়ান— এ যেন অন্য এক পৃথিবী।
সোয়ালবার্ড দ্বীপের প্রায় ষাট শতাংশ এলাকা হিমবাহে ঢাকা। বরফের হিসেবে ৭০০০ ঘন কিলোমিটার। সবচেয়ে বড় হিমবাহকে ‘আইস ক্যাপ’ বলা হয়, এই দ্বীপের পূর্ব দিকে বিশাল কিছু আইস ক্যাপ রয়েছে। আমরা প্রধানত যে দিকটায় দিয়েছি, সেই দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমে হিমবাহের চেহারা নদীর মতো, সমুদ্রের কাছে থমকে দাঁড়িয়েছে। উত্তর অক্ষাংশের আশি ডিগ্রির উত্তরে জাহাজ এগোতে পারেনি, অত্যধিক পুরু বরফের স্তর আর ঝড়ঝঞ্ঝার জন্য। এ ছাড়াও আর এক ধরনের হিমবাহও উপত্যকা জুড়ে থাবা মেরে বসে আছে। ‘পার্মাফ্রস্ট’। হাঁটতে গেলে মাটি স্পঞ্জের মতো মনে হয়, আসলে এই মাটির নীচে আছে বরফের স্তর। গরমের সময়ে ওপরের বরফ গলে মাটিকে নরম করে রেখেছে। ছয় থেকে আট ফুট নীচেই আছে স্থায়ী হিমবাহের বরফ। জ়োডিয়াক নৌকোয় যেতে যেতে অনেক জায়গায় দেখেছি থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু হিমবাহের গায়ে বরফের গুহাও।
নিউ আলেসঁদ-এ বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র একটা ডাকঘর। এতগুলো ক্যাম্পের চিঠি দেওয়া-নেওয়া হয় তাই ব্যস্ততা খুবই, জানালেন মহিলা পোস্টমাস্টার। সর্বোচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত এই পোস্ট অফিসের দায়িত্ব তাঁর ওপর, তাই গর্বিতা তিনি। থাকেন অফিসেই। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে আন্তরিক কথা বিনিময়ে ভাষা অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে নেন ওঁরা। রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দেখা হলে সবাই মাথা হেলিয়ে বা ঝুঁকিয়ে ‘হ্যালো’ বলছিলেন, তবে ওখানেই শেষ। মোবাইলের ব্যবহার নেই, কারণ মোবাইলের নেটওয়ার্ক এখানে নিয়ম-বহির্ভূত। ব্লুটুথ, ওয়াইফাই চলে না। বিশালাকৃতি এক ডিশ স্যাটেলাইট অ্যান্টেনা এখানে চব্বিশ ঘণ্টা মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কাজ করে চলেছে। এই যন্ত্র খুবই সংবেদনশীল, তাই অন্য যে কোনও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ-তরঙ্গ ব্যবহার এখানে নিষিদ্ধ।
নির্জনতা কী তা বোঝা যায় জনপদ থেকে একটু ভিতরে, পাহাড়ের কাছে গেলেই। এমনিতেই আর্কটিক নির্জনতা বড় কঠোর। পাহাড়ের মাথায় ছুঁচলো পাথরগুলো রুক্ষতার প্রতীক হয়ে আকাশের দিকে হাজার হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এক-দেড় ইঞ্চি উঁচু থোকা থোকা গুল্মগুচ্ছ ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কোনও বড় গাছের দেখা নেই। থাকবে কী করে, বরফেই তো ঢাকা থাকে বছরের আদ্ধেকেরও বেশি সময়। নানা ফুল ও ছত্রাক— গোলাপি ক্যাম্পিয়ন, মেটে রঙের ছত্রাক ‘পোলার ক্যাম্পিয়ন’, ছোট ব্যাঙের ছাতার মতো ছত্রাক, আরও সাদা, হলুদ, নীলাভ, বেগুনি রঙের ফুল। দেখেছি নানা রকমের পাখি। দ্বীপে নেমে একটু ঢুকতেই একটা খোলা জায়গায় গোলাপি পায়ের জোড়া পাতার বার্নাক্ল হাঁসেরা তাদের ছানাপোনা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। পাহাড়ের খাঁজ থেকে ভেসে আসে পাখিদের অবিরাম ঝগড়ার আওয়াজ, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে। এরা আর্কটিক টার্ন— মাথাটা কালো, ওপরের ঠোঁট হালকা কমলা, লেজটা একটু বেশি লম্বা। সুযোগ পেলেই নেমে এসে মানুষের মাথায় ঠোক্কর মারে। এরা ঠান্ডা দেশের পাখি, কিন্তু আর্কটিকে শীতের সময় একটু উষ্ণতার জন্যে পাড়ি দেয় আন্টার্কটিকা, সেখানেই জন্ম দেয় শাবকের আর ওখানে শীত শুরু হতেই আবার ফিরে আসে আর্কটিকে। বছরে প্রায় ৭১,০০০ কিলোমিটার উড়ে পৃথিবী পরিক্রমা করে এরা! প্রাণিজগতে সবচেয়ে লম্বা সফর। দেখেছি সমুদ্রে ভাসমান বরফের মাথায় বসে থাকা সাদা আইভরি সিগাল। ফুলমার পাখিরা সাধারণত সমুদ্রের জলে ঢেউয়ে দোল খেতে খেতে ভেসে থাকে আর সুযোগ বুঝে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে মাছ ধরে। ছিল ছোট কিটিওয়েকস, লেজ-ঝোলা স্কুয়া, আরও কত বিচিত্র পাখি। পাহাড়ের গা বেয়ে নামা আর্কটিক শেয়ালকে দেখেছি আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আপন মনে খাবারের সন্ধানে চলে যেতে। দেখেছি, সমুদ্রে ভাসমান বরফে রোদ পোহাচ্ছে সিল।
এখানে এসে মনে হয়, প্রকৃতির এই সম্ভার শুধু প্রকৃতির জন্যেই, মানুষের জন্য নয়। এই নির্জন শ্বেত মরুর দেশে মানুষের পা পড়েছে মাত্র কয়েকশো বছর আগে। এক সময় এখানে মেরুভল্লুক ঘোরাফেরা করত, চরে বেড়াত বল্গাহরিণেরা। আর্কটিক শেয়ালেরা জলে নেমে মাছ ধরত, পাখির ডিম বা ছানা ধরে খেত, শীতে সমুদ্র জমে গেলে বরফের ওপর দিয়ে চলে যেত গ্রিনল্যান্ড, কখনও আলাস্কায়। দেখলাম পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় পরিত্যক্ত বাড়ির কাছে শেয়াল ধরার ফাঁদ পাতা, সম্ভবত খননকাজ চলাকালীন এখানে বসবাসরত মানুষের কাজ। এই শহরে শেষ মেরুভল্লুককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় ২০১১ সালের ১৯ জুলাই।
আর্কটিক বিশ্ব একটা ভিন্ন পৃথিবী। ভাবাই যায় না, এই পৃথিবীতেই এমন একটা জায়গা আছে যেখানে সূর্য অস্ত যায় না, চাঁদ ওঠে না। ভাবাই যায় না, এমন একটা জায়গা আছে যেখানে মানুষের সৃষ্টি দিক-নির্ণয় এবং দ্রাঘিমা ধরে সময়ের হিসেব, সবই অচল। মেরুতে কোথায় উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ বা পশ্চিম? যেখানে দ্রাঘিমাগুলো সব এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে, সেখানে সময়ই বা কোথায়! এই অনন্ত ও বিশালতার মধ্যে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, মানুষের অস্তিত্বটা আসলে কতটুকু, কত ছোট। হঠাৎ হইহই শুনে সম্বিৎ ফিরতে দেখি, সমুদ্রের জল থেকে উপরে উঠে আবার, বারবার ডুব দিচ্ছে কালো মিঙ্কি তিমি। আমাদের জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে, আমাদের সঙ্গেই চলেছে সেও, যেন নিজের এলাকা পার করে দেওয়ার মহান দায়িত্ব নিয়েছে। ডিনার রেডি, ঘোষণা হল। হাসি পেল, রাতই নেই, গনগনে রোদ্দুর বাইরে, ভিতরে রাতের খাবারের ডাক। আমার ঘড়ির দুটো কাঁটাই বারোটার ঘরে রেখে দিয়েছি প্রথম দিন থেকেই। সময় এখানে বাস্তবিক শূন্য।