বেন্দা তখন পাশেই দাঁড়িয়ে বাইকটা রেডি করছিল শেঠের ভাইকে নিয়ে টাটা যাবে বলে। পরিষ্কার দেখতে পেল, বোসস্যরের কপাল কুঁচকে গেল কথাগুলো শুনে। ইশারা করে বড়বাবুকে পাশে ডেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ব্র্যান্ডের কথা হচ্ছে বলুন তো? আমাকে তো বলা হল আপনার ফেয়ারওয়েল, পিকনিকও। কর্মচারীরা অ্যারেঞ্জ করলে তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমাকে কত চাঁদা দিতে হবে শুধু সেটা জানালেই হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা অন্য রকমের প্রোগ্রাম। ঠিক করে বলুন তো, এটার স্পনসর কে, আর কিসের ব্র্যান্ড নিয়ে জানতে চাওয়া হল?”
অপ্রস্তুত বড়বাবু এক বার ওঁর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, আর এক বার শেঠের মুখের দিকে। বড়বাবুকে কিছু বলতে না দিয়ে শেঠ আর এক ধাপ এগিয়ে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করে বলল, “আমি হলাম গিয়্যে সন্দীপ শেঠ, বান্দোয়ান কাষ্ঠ-ব্যবসায়ী সমিতির সেকরেটারি। আজকের পোগরামটা আপোনার সনমানে আমিই বেবস্থা করছি, স্যার।”
ওকে পাত্তা না দিয়ে স্যর বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বড়বাবু, আমি আপনার কাছ থেকে আর একটু দায়িত্বজ্ঞান আশা করেছিলাম। আপনি এখানে বেশ কিছু দিন আছেন। হতে পারে আপনার সঙ্গে অন্যদের নানা সম্পর্কের ইকুয়েশন আছে, কিন্তু আমি তো এখানে নতুন। আমার চলার রাস্তা তো অন্য রকমও হতে পারে! আপনি আছেন বলেই আমি এক কথায় রাজি হয়েছিলাম, এখন সব জেনে আমি নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি। আপনাদের প্রোগ্রাম আপনারা করুন। আমি আমার রাতের খাওয়াটা অন্য দিনের মতো রেস্টশেডেই করব।”
বোসস্যর চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বড়বাবু রাগে ফেটে পড়লেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, এ লোক অন্য ধরনের! এই উজবুক শেঠের জন্যে আজ আমায় অল্পবয়সি অফিসারের কাছে কথা শুনতে হল। তোমরা সবাইকেই নিজেদের মতো ভেবে রেখেছ! আজ আবার বলছি, তোমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে। আমিও আর এই প্রোগ্রামে নেই! অ্যাই বেন্দা হতভাগা... আমার জন্যে একটু মুড়ি-ফলারের বন্দোবস্ত কর, বাপ!”
বড়বাবু তো পরদিন সকালে চলে গেলেন, কিন্তু বাকি সবাই এই ঘটনাটাকে একটা ইজ্জত কা সওয়াল বলে ধরে নিল, বিশেষ করে শেঠ আর ওর এক গেলাসের বন্ধু দুয়ারিবাবু। শেঠ তো সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করল, ‘‘কাজটা কিন্তুন নতুন অফিসার ভাল কইরল্য নাই, আমাদের সবাইকে অপমান তো কইরল্যই... এত ভাল মানুষ বড়বাবুরও সনমানটো রাইখল্য নাই। আমরা লোক্যাল লোক বট্যি। আমাদের চট্যায়েঁ কত্যদিন টিঁকতে পারে, দেখি!” আর দুয়ারিবাবু হায়নার মতো হাসি দিয়ে বললেন, “ভালই হল, এক দিক দিয়ে, এখনও তো কাজকর্মের কিছুই বুঝে উঠতে পারে নাই। এখন তো পায়ে পায়ে আমাদের মদত লাগবে রেঞ্জের খুঁটিনাটি বুঝতে, আমরা কাজের তো কিছু জানিই না! উনিই বরং সব কিছু বুঝে গেছেন দু’দিন আসতে না আসতেই, তা হলে উনিই সমাধান দিক এত বড় একটা রেঞ্জের যাবতীয় ঝামেলির! অ্যাই, তোরা সবেতেই চোখ উল্টে দিবি যখনই কোনও পবলেম হবে কোথাও, বলবি, ‘আমরা তো কিচ্ছুটি জানি না ছ্যার। আপনি যা বলবেন আমরা সেটাই করব’... কী, বুঝলি তো? তোদের কি মনে নাই আগের ম্যাডামের বেলায় কী হয়েছিল? শেষটায় দশ হাজার টাকা গুনোগার দিয়া নাক-কান মুলে ইখান থিকে পলাইছিল... হেঁ, হেঁ!”
পুরাতন লোকেরা তো বটেই, এমনকি অগামার্কা বেন্দাও বুঝে গেল, এর পর রেঞ্জ চালাতে সাহেবের কী হাল হবে! ঘটনাটার সুযোগ নিয়ে দুয়ারিবাবু একেবারে আনকোরা লোকটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিতে চাইছেন। তুমি আমার কথায় চলো, তবে আমি তোমাকে অফিসের কাজের খুঁটিনাটি শেখাব, না হলে তুমি নাকানিচোবানি খাবে আর ট্রেনিংয়ের সময় বদনাম হলে তার দায় সারাটা চাকরিজীবন ধরে পোয়াবে। ওর সঙ্গে একান্ত আলোচনায় মধুদা বলল, “বেন্দা রে, ভাল মানুষ ছোকরাটার কপালে বহুত অসৈরণ লেখ্যা আছে বোধহয়। দুয়ারিবাবু এমন লোক যে, দরকার পইড়ল্যে নিজের বৌ-ছেলের ওপর দাঁও লাগিয়ে দেয়! তুই তো অত্তশত্ত জানিস না, আমি লোকটার কুষ্ঠি-ঠিকুজি জানি। তুই পারলে সাহেবকে একটু নজরে-নজরে রাখিস, তোকে এরা হিসেবের মধ্যে ধরেনি, কিন্তু তোরও তো বাজারের পাশেই বাড়ি। ভালমন্দ খপরগুলান ওনার কানে দিস আর আমি ত্যামন খপর পাইল্যে তোকে জানাইঁ দিব।”
পরদিন সকাল দশটার একটু আগে বেন্দা অফিসে এসে দেখল, স্যর আগেই এসে নিজের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। পুরনো ক্যাশবইগুলো টেবিলের এক পাশে সাজানো, কয়েকটা ফাইল আর রেজিস্টার অন্য পাশে রাখা। ক্যাশবই দেখতে দেখতে দু’-এক বার বাকি দস্তাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন। ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে জানালা দিয়ে ভিতরের দৃশ্যটা অনেক ক্ষণ ধরে দেখছিল, মধুদা ওর হাত ধরে বারান্দা থেকে টেনে কুয়ার পাশে পাঁচিলের কাছে নিয়ে গেল, “হাঁ কইরে ভাইল্যচিস কী? ইনি তো সক্কাল সাড়ে-আটটার সোময় ছান কইরে এখানে বস্যে গ্যাচে। ভাবভঙ্গি দেখ্যে তো মনে লিচ্ছে না কি নতুন লোক, য্যানো এমন কাজকম্ম রোজই করে। এ বার মজাটো জমব্যে, বুঝলি! ইয়ার আগ্যে ভরোদাজ মেডামকে তো ওরই বুদ্ধিতে ফাঁসানো হইঁছিল টেরনিং-এর সোময়। ভাল মানুষ মেয়্যাটা কেন্দেকেটে ওদের পায়ে গড় কইরে নিজের মাইনের দশ হাজার টাকা ঢেল্যে হিস্যাব মিলায়েঁ ইখান থিক্যে কোনও মতে পুরুলিয়্যা যায়েঁ বাঁচে। পরে তো শুনেছি, বাংলা থেক্যেই বদলি হয়্যে চলে যায়। দুয়ারিবাবু ইবারও বোধ হয় ভাইবছিল্য যে, ওর মদত ছাড়া ইঁয়ার চলব্যেক নাই, তো কাজ-জানা লোককে ও নিজের তাঁবে কইরব্যেক কী ভাবে? সরে যা বেন্দা, দুয়ারিবাবু অফিসে ঢুইকছ্যে, দু’জনের মইধ্যে কথাটো কী হয় শুন্যে লিই।”
মধুদা তো এগিয়েই গেল, বেন্দাও ওর সাইকেলের চেন লাগানোর অছিলায় যতটা পারা যায় কাছে গিয়ে কী কথা হয় শোনার চেষ্টা করল। কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হল, বিটবাবু উইশ করতে স্যর বললেন, “আসুন দুয়ারিবাবু, গুড মর্নিং। আশা করি কাল আপনাদের পিকনিক ভালই জমেছিল। অ্যাটাচড অফিসার লোহারবাবুকেও আমি ডেকেছি, কাজ নিয়ে এক সঙ্গেই দু’জনের সঙ্গেই কথা বলব। আপনারা দু’জনই তো এই অফিসে আমার ডান হাত আর বাঁ হাত, এ বার দেখার যে সব্যসাচীর মতো আমারও দু’হাত সমান চলে, না নিজেদের মধ্যেই লড়াই করে!”
সদ্য দুয়ারসিনির ঘটনাটা ঘটেছে, যার ঘোর এখনও কাটেনি বেন্দার। সে দিন থেকে ওর সাপোর্ট তো স্যরের দিকে একশো ভাগ। কিন্তু একে কিনা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, তার উপর অল্প ক’দিনের অভিজ্ঞতা। বেন্দা বুঝে উঠতে পারছিল না, কী ভাবে স্যরকে সাহায্য করবে! তবে দুয়ারসিনি থেকে ফেরার পথে সে দিন স্যরের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ষড়যন্ত্রের কথা ও যতটা খুলে বলা সম্ভব, স্যরকে জানিয়ে দিয়েছে। কানে এল ওর, দুয়ারিবাবু বলছেন, “স্যর, আপনি অ্যাকাউন্টের কাজ জানেন না কি? আমরা তো জানি যে, ট্রেনি অফিসারদের ফরেস্ট কলেজে ট্রেনিংয়ের সময় এ সব কিছু শেখায় না, রেঞ্জ ট্রেনিংয়ে শিখে নিতে হয়।”
স্যর উত্তর দেন, “রিসেন্টলি এক মাস ডিভিশনের বিভিন্ন সেকশনে অ্যাটাচড থেকে কাজকর্মগুলো শিখে নেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে। আর নিয়ম না থাকলেও আমাকে এই ধরনের কাজগুলো শিখে নিতেই হত, কেন না জায়গাটা হল বান্দোয়ান। এখানে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনাগুলোর সম্বন্ধে ডিএফও সাহেব সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল, তাই আমাকে প্রতিটি সেকশনের কাজ নিজে সামনে থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, আপনাদের কারও পক্ষ থেকে যদি কোনও ষড়যন্ত্রের আভাস দেখি তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে ওঁকে জানাতে, উনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। সে যাক, আজ থেকে আপনি বিটের কাজ ছাড়াও রেঞ্জের খরচের দিকটা ক্যাশ বুকে এন্ট্রি করবেন আর লোহারবাবু এন্ট্রি করবেন জমা অর্থাৎ রেভেন্যু-র দিকটা। ঠিক আছে?”
দুয়ারিবাবু নিজেকে তত ক্ষণে সামলে নিয়েছেন। নিজের দর বাড়ানোর জন্যে বলে, “আবার লোহার কেন, স্যর? ও-তো ক্লাস এইট পাশ, কোথা থেকে ক্লাস টেনের স্কুল সার্টিফিকেট জোগাড় করে তিরিশ বছর আগে ফরেস্ট গার্ডের চাকরি নিয়ে ঢুকেছিল। ও কাজকম্মের কিস্যু জানে না, সবটাই বরং আমি করে দেব।” স্যর হেসে বললেন, “সে খবর আপনি জানেন, সরকার তো জানে না। তাই ফরেস্টারের মাইনে আপনার মতো ওকেও দিচ্ছে। এ ধরনের কাজ একটু চেষ্টা করলেই শিখে নেওয়া যায়। লোহারবাবু আসছেন দেখতে পাচ্ছি, এ সব আলোচনা আর না করাই ভাল। আপনি কাজ শুরু করে দিন। বাকিটা আমি দেখছি।”
আর শোনার দরকার হল না। বেন্দা আন্দাজ করতে পারল যে, প্রথম রাউন্ডে স্যর পরিস্থিতি মোটামুটি নিজের আয়ত্তে এনে ফেলেছেন। দুয়ারিবাবু আর লোহারবাবু কাজ শুরু করল ওদের আপসের দুশমনি কিছুটা আড়ালে রেখে। ওদের কাজে বসিয়ে স্যর ওকে ডাকলেন, “বৃন্দাবন, চলো একটু লতাপাড়ার দিকে, কুচিয়া বিটের কাজকর্ম একটু দেখে আসি। লালমোহন মাহাতো তো ওখানকার বিট অফিসার, এদের সবার মধ্যে ওঁকেই আমার ভালমানুষ বলে মনে হয়েছে। দেখি, কাজের কোয়ালিটি কেমন ওঁর বিটের!”
বেন্দাও মনে মনে স্বীকার করে যে ন’জন বিটবাবুর মধ্যে একমাত্র লালমোহনবাবুই সবার প্রিয়। ওঁর ভাল ব্যবহারের জন্যে। উনি শিক্ষিত, বি এ পাশ বলেই নয়— সে তো কুইলাপালের বিটের কাবুল গোলদারও বি এসসি পাশ— লালমোহনবাবু বনেদি পরিবারের ছেলে, অন্যদের মতো নীচতা-নোংরামিতে অভ্যস্ত নয়। মাঝে মাঝে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে এই নিয়ে লেগেও যায়। তখন উনি সাপোর্ট পান নান্নার বিট অফিসার বসরাজ হেমব্রম আর কাবুলবাবুর কাছ থেকে। কথাগুলো বোসস্যরকে জানিয়েও দেয় বেন্দা, যাতে স্যর তাঁর রেঞ্জের লোকদের মধ্যে ভাল-মন্দের ঝাড়াই-বাছাই করতে পারেন।
কয়েকটা দিন বাদেই আরও ভাল করে বাছাইয়ের কাজটা হয়ে গেল একটা ঘটনা থেকে। ধীরেন ধর তখন স্থানীয় সুশাসনিক কর্মকর্তা। রূঢ়ভাষী, উগ্রস্বভাবের জন্যে কুখ্যাত। স্যর স্থায়ী সমিতির মেম্বার হওয়ার সুবাদে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে কর্মকর্তার কাছে গিয়েছিলেন। পরিচিত হওয়ার পর দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরাবার আগে তাতে ফুঁ দিতে দিতে ধীরেনবাবু বললেন, ‘‘আপনি তা হলে নতুন রেঞ্জারবাবু বট্যে, আপনার আগের ব্যক্তিটো বড়ই সজ্জন ছিলেন। মিটিংয়ের দিন দেখা হল্যেই ভাল্য সিগরেটের একটো প্যাকেট আমাকে দিত্যেনই! আপনি নতুন তো, তাই বোধহয়...’’
বেন্দার তো সমিতি অফিস ঘর-ভাত, বাড়ি কাছটাতেই বলে সবাই ওকে চেনে। স্যর কী বলেন শোনার জন্যে ও জানলার পাশ থেকে কান খাড়া করল। স্যরের গলা পেল, “আমি এখানে এগারো মাসের রেঞ্জ ট্রেনিং করতে এসেছি, রেগুলার রেঞ্জারবাবু ঠিক বলা যাবে না। আর আমি নিজে বর্তমানে সিগারেট খাই না, কাউকে দিই না তো বটেই। কারণ, সিগারেট স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, বিশেষ করে আপনার মতো দায়িত্বশীল আর সম্মাননীয় ব্যক্তিকে তো এ সব দেওয়াই যায় না। কী বলেন আপনি?”
মাননীয় কর্মকর্তার দরকচা-মারা মুখটা তখন দেখার মতো! ভাগ্যি চেম্বারে আর কেউ নেই, তবু জানলা দিয়ে উঁকি-মারা বেন্দার মুখটা দেখতে পেয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন, “ক্যা রে নেংটির মতো উঁকি মারে? ভাগ এখান থেকে! অ্যাই, কেউ জানলাটা বন্ধ করে দে। হ্যাঁ, তা বলছিলম কী...’’ ওখান থেকে সরে আসায় বেন্দা আর কিছু শুনতে পেল না। মিনিটপাঁচেক বাদে স্যর বেরিয়ে এসে বাইকে চড়লেন। মুখটা বেশ গম্ভীর, ব্লক অফিস থেকে পিচরাস্তায় উঠে বললেন, “আর-একটা ভিমরুলের চাকে বোধ হয় খোঁচা দিয়ে এলাম। স্থানীয় সুশাসনের পক্ষ থেকে উৎপাত শুরু হওয়া এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। আমি ঝামেলা তৈরি করি, না ঝামেলারা আমার ঘাড়ে এসে পড়ে— বুঝতে পারি না। যাক, বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা...”
বিপদটা হাজির হল পরের দিনই। স্থানীয় সমিতির পিওনের হাত দিয়ে একটা চিঠির চেহারা নিয়ে। কর্মকর্তা শ্রীযুক্ত ধীরেন ধর মহাশয় অফিশিয়াল চিঠি লিখেছেন বান্দোয়ান রেঞ্জের রেঞ্জারকে। সেই সময় অ্যাকাউন্টের কাজ করতে সব ক’জন বিট অফিসারই রেঞ্জ অফিসে উপস্থিত। তাদের সামনে স্যর একটু জোর গলাতেই চিঠিটা পড়লেন, ‘‘ডিয়ার রেঞ্জারবাবু, ধাদিকা বিটের শেষ প্রান্তে এই সমিতির অন্তর্গত ঢ্যাঙাডুংরি নামের মৌজা আছে। পুরো গ্রামটাই একটা টিলাকে ঘিরে। টিলার মাঝামাঝি থেকে উপরের সব অংশটাই বন দফতরের এক্তিয়ারে থাকার কথা। এলাকাটি আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায় সুন্দর সবুজ বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল। কিছু দিন যাবৎ লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বেশ কয়েক জন দুষ্কৃতী সেই সবুজ ধংস করে সেখানে বেআইনি বাড়িঘর তৈরি করছে, অথচ আপনি ও আপনার দপ্তর নাসিকায় সর্ষপতৈল দিয়া নিদ্রাভিভূত! আমরা তা হলে কোনটা ধরে নেব, আপনারা ন্যস্ত দায়িত্বপালনে অপারগ, না কি আপনি ও আপনার কর্মচারীগণ ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করিয়া বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের নিকট থেকে কিছু উপার্জন করে নিচ্ছেন? পত্রপ্রাপ্তির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ফলাফল আমাকে জানান। অন্যথায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাইতে বাধ্য হব। ভবদীয়—’’
পড়া শেষ করে স্যর বললেন, “কিছুটা গুরুচণ্ডালী প্রয়োগ বাদ দিলে এই চিঠিটার বাক্যবিন্যাস বেশ, ভদ্রলোক পলিটিক্সে ঢোকার আগে বোধহয় স্কুলে বাংলার টিচার ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কথাগুলো কতটা সত্যি আর এ ক্ষেত্রে আপনাদের মতামত কী? বিশেষ করে শ্রীগোপাল মাহাত, বিট অফিসার অব ধাদিকা। আপনি কী বলেন এ বিষয়ে?”
রগচটা গোপালবাবু গাঁ-গাঁ করে ওঠেন, “ও জায়গাঠো বহুত দিন ধরেই ফরেস্টের হাতে নাই, উঠা এমসিসি-র মুক্তাঞ্চল বঠ্যে। পুরাতন লোকেরা বল্যে, উখান্যে সেন্টারের লোকে হামাদের এক গার্ডকে ক্যুপাইছিল্য ফারসা দিয়্যা। জায়গাঠোয় যাওয়া নাই যাব্যেক, আপনি বরং একঠো সিগ্রেটের প্যাকেট নিয়ে ধরসাহেবকে সেলাম দিয়ে আস্যেন!”
বোসস্যরকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে দেখে লালমোহনবাবু ব্যাপারটা পরিষ্কার করেন, “স্যর, এমসিসি হল মাওয়িস্ট কমিউনিটি সেন্টার আর ফারসা হল এক ধরনের লম্বা হাতলওলা টাঙির মতো অস্ত্র যার ফলা ক্ষেত্রবিশেষে দু’ফুটেরও বেশি। মানে সঠিক লোকের হাতে পড়লে ভিড়ের মধ্যে এক সঙ্গে তিনজনের গলা নামিয়ে দেওয়া যায় ওটা দিয়ে। বাকি রইল সিগারেট আর ধরসাহেব। কালকে স্থানীয় সুশাসনিক সমিতিতে যা কিছু হয়েছে, সব জানাজানি হয়ে গিয়েছে। ধরসাহেবকে সবাই ভয় পায় ওঁর মেজাজের জন্য। কাল উনি নাকি বলেছেন, ‘এমন টেঁটিয়া অফিসার আমি দেখিনি, একে আমি সোজা করেই ছাড়ব।’ এ বার আপনি ঠিক করুন, কী করবেন, স্যর। দশ মাসের জন্যে ট্রেনিংয়ে এসে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ কি ঠিক হবে? আমার মতে সন্ধিই ভাল।”
৬
সকাল থেকেই মেজাজটা খারাপ অন্নুর। একে তো গত রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তার উপর সাতসকালেই অফিস থেকে ফোন আসা শুরু হয়েছে। একটা এনজিও-র সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে জড়িত আছে ও। যারা বিশেষ এক ধরনের সোশ্যাল ওয়র্ক করে প্রধানত স্প্যাস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে। ও অর্গানাইজ়েশনের চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার। সেই সুবাদে অ্যানুয়াল অডিটের সময় ছোট-বড় সব বিষয়েই হেড ক্লার্ক থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট— সকলেই ওর মতামতের দিকে তাকিয়ে আছে। এই সময়টাতেই নানা ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্নু এমন ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, ওর একেবারেই মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না কোনও বৈষয়িক কাজকর্মে।