হাতিরা কথা বলে তাঁর সঙ্গে। তিনি রাজকন্যা, অসমের গৌরীপুর রাজবাড়ির মেয়ে। ছোটবেলায় তাঁর খেলার সঙ্গী ছিল বাচ্চা হাতি, বাঘের ছানা, হরিণ শিশু। তিনি পার্বতী বড়ুয়া— ওয়াইল্ড লাইফ ফোরাম যাঁকে চেনে ‘কুইন অব এলিফ্যান্ট’ নামে।
তিনি ক্লান্তিহীন। গত পঞ্চাশ বছর তাঁর যাবতীয় ব্যক্তিগত সঁপে দিয়েছেন হাতিদের কাছেই। বছর ছেষট্টির, ছিপছিপে চেহারার এই নারীর চোখে বারুদ আর মায়া দুই-ই: ‘‘যে কাজে আমি ছোটবেলা থেকে যুক্ত সেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ভয়ঙ্কর। কী ভাবে এত দিন জীবিত আছি, ভাবলেই অবাক লাগে। প্রত্যেক বার জঙ্গলে যাওয়ার আগে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে যাই। যে কোনও সময়ে নেমে আসতে পারে চরম বিপদ।’’ কিন্তু জঙ্গলে না গিয়ে থাকতেও পারেন না। ‘‘চতুর্দিকে যে ভাবে আক্রমণ নেমে আসছে বন্য প্রাণীর ওপর, ওদের পাশে না দাঁড়াতে পারলে কষ্ট হয়। তাই এখনও ছুটে যাই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সারা বছর। মানুষকে বোঝাই, ওরা আমাদের বন্ধু। আমাদের পরস্পরকে প্রয়োজন।’’
হস্তিবিশারদ হিসেবে বাবা প্রকৃতীশ বড়ুয়ার (লালজি) পরিচিতি ছাপিয়ে গিয়েছিল দেশের গণ্ডি। শিকারি লালজির ঝুলিতে ৩৪১টি বাঘ, একশোরও বেশি লেপার্ড। কিন্তু তিনি মিথ হয়ে আছেন হাতি শিকারে। ১০০০-এর বেশি বুনো হাতি পোষ মেনেছে তাঁর হাতে। মেয়ে পার্বতী শুধু এ দেশে নয়, কার্যত গোটা বিশ্বে ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরার ক্ষেত্রে অন্যতম মহিলা শিকারি। কলকাতায় এক সাক্ষাতে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনিই কি এই মুহূর্তে বিশ্বের একমাত্র মহিলা হাতি-শিকারি? তাঁর কুণ্ঠিত জবাব, ‘‘ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরার ক্ষেত্রে (যাকে ‘মেলা শিকার’ বলা হয়) এ দেশে আর কেউ নেই। অন্যত্র কেউ আছেন কি না জানি না।’’
পার্বতী বড়ুয়ার জন্ম ১৯৫৩-র ১৪ মার্চ, শিলং-এ। হাতির সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে শৈশবে, মাত্র এক মাস সতেরো দিন বয়স তখন। শিলং থেকে গৌরীপুরের বাড়িতে আনা হচ্ছে ছোট্ট পার্বতীকে, পথে দামরায় এসে দাঁড়াল তাঁদের গাড়ি। সেখানে তখন হাতি শিকারের ক্যাম্প চলছে। তার মধ্যে এসে পড়লেন পার্বতী। সেই যে সম্পর্ক তৈরি হল, আজও অটুট। ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছেন হাতির মাঝে। বাড়ির পিলখানায় তখন থাকত ৪০টির বেশি হাতি। শুধু কি হাতি? শিকারে মৃত বাঘ, লেপার্ড, হরিণ, শজারুর ছোট বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন লালজি। একটু বড় করে তাদের পাঠানো হত চিড়িয়াখানায় বা জঙ্গলে। ছোটবেলায় এরাই ছিল পার্বতীর খেলার সঙ্গী। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘‘এখনকার বাচ্চারা টয় অ্যানিম্যাল নিয়ে খেলে। আমাদের খেলা ছিল আসল জন্তুজানোয়ার নিয়ে।’’ বাবা প্রকৃতীশ থাকতেন গৌরীপুর সংলগ্ন মাটিয়াবাগে, ‘হাওয়াখানা’ নামের বিখ্যাত বাড়িতে। বাড়ির তিন দিক ঘিরে গদাধর নদী, এক দিকে গভীর জঙ্গল। বাড়ির বিশাল চত্বরে হরিণ, ময়ূর, সাপ, নানা ধরনের পাখি নিয়ে আস্ত একটা চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলেন প্রকৃতীশ। এমন পরিবেশে যার শৈশব কাটানো, তিনি বন আর বন্যদের না-ভালবেসে থাকবেন কী করে?
প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিন কুলদেবী মহামায়ার পূজা সেরে (যাত্রা পূজা) শিকারে বেরোতেন লালজি। বাবার সঙ্গী হতেন পার্বতী-সহ অন্যেরা। স্কুল বলতে শুধু পরীক্ষাটুকু দেওয়া, তার পরেই দে ছুট জঙ্গলে। ক্যাম্পে থাকতেন গৃহশিক্ষকও, ওই অরণ্যেই চলত পড়াশোনা। পার্বতী শিকার শিখতে শিখতেই গ্র্যাজুয়েটও হয়েছেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পড়াও শুরু হয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলের টানে মাঝপথেই ইতি। তত দিনে ওয়াইল্ড লাইফ ফোরামে তিনি পরিচিত নাম। ১৯৬৭-তে মাত্র ১৪ বছর বয়সে শিকার করেন প্রথম হাতি। এত দিন চলছিল হাতি চেনা জানা, হাতির সঙ্গে যুক্ত নানা ধরনের রশি এবং বনজ ওষধির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। নানা রকম রশি অর্থাৎ দড়ি ব্যবহৃত হয় হাতির জন্য। পা বাঁধতে লাগে যে ধরনের দড়ি, তা দিয়ে গলা বাঁধা যায় না। আবার ‘দুলসি’ বা ‘ঝুলটি’ (হাতির গলায় ঝোলানো দড়ি, মাহুতের পা রেস্ট বা সাপোর্ট পাওয়ার জন্য যার ব্যবহার) বানাতে হয় এক বিশেষ ধরনের পাট থেকে। এ সব নিজের হাতে বানিয়ে নিতে হত তাঁদের। লালজি শেখাতেন হাতে ধরে। পার্বতী দ্রুত আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন।
কচুগাঁও ফরেস্টে ‘মহাল’ শুরু হল। বিরাট আয়োজন। ‘‘বাবা উৎসাহ দিলেন, ফাঁদ নিয়ে উঠলাম হাতির পিঠে। আশা আর আশঙ্কায় কাঁপছি তখন। হঠাৎ যেন শক্তি এসে গেল। গভীর জঙ্গল। কুনকির পিঠে আমি, এক পাল বুনো হাতির মধ্যে। এই অবস্থায় নিজের হাতির শক্তি বুঝে টার্গেট ঠিক করে নিতে হয় মুহূর্তে। সঙ্গে দক্ষ কয়েক জন ছিলেন বটে, আমি বাবার উপদেশ মাথায় রেখে মন শান্ত করে এগোতে লাগলাম। এগোতে এগোতে ওদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম আমার টার্গেটকে। ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরার ক্ষেত্রে এই পর্যন্ত ঠিকঠাক হলে পরের কাজে বাড়তি মনের জোর পাওয়া যায়। হলও তাই। টার্গেটে লটকে দিলাম ফাঁদ। হাতি ধরে যখন ফিরলাম মেন ক্যাম্পে, বাবা পিঠ চাপড়ে শাবাশি দিলেন। ওটা আমার কাছে পরম প্রাপ্তি! বাবাই তো আমার গুরু!” তৃপ্তি ঝরে পড়ে পার্বতীর গলা থেকে। তাঁদের পরিভাষায় শিকারের এই পদ্ধতির নাম ‘মেলা শিকার’। লালজি চলে গেছেন ১৯৮৮-তে। কিন্তু পার্বতীর মনে হয়, বাবা তাঁর সঙ্গে আছেন আজও। কী ভাবে ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি? পার্বতীর কথায়, এ বিদ্যার সবটাই হাতেনাতে শিখতে হয়। পরিশ্রম, ধৈর্য আর সাহসই প্রধান অবলম্বন। সঙ্গে লাগে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আর কম্যান্ডিং অ্যাটিটিউড। আর চাই জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। বুনো হাতি ধরে এনে তাদের শিক্ষা দেওয়ার যে পরম্পরা লালজির মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়েছিল, পরম নিষ্ঠায় তা বহমান রেখেছেন তিনি।
শিকারে গেলে গভীর জঙ্গলে কখনও কখনও একটানা কয়েকটা দিন-রাত কাটাতে হয়। মেন ক্যাম্প থেকে স্বভাবতই তা অনেক দূরে। আশ্রয় বলতে বড় গাছের তলা। রোদ, জল, ঝড়ের দাপট সহ্য করতে হয় নীরবে। রাত নামলে চারদিকে আগুন জ্বেলে অপেক্ষা। সঙ্গে অস্ত্র বলতে একমাত্র ‘মিট দা’। নিজের হাতে বানানো কাঠের খাপে যা গোঁজা থাকে কোমরে। বন্দুক ব্যবহার করেন না? “বন্দুক আমরা নিই না। জঙ্গলের একটা আইন আছে, জন্তুরা তা মেনে চলে। ওরা মানুষের মতো হিংস্রও নয়। আমরা, মানুষেরাই প্রতিনিয়ত আইন বানাই আর ভাঙি। ল’ অব নেচার যারা জেনেছে তাদের জঙ্গলে ভয় কিসের!” দৃঢ় পার্বতীর স্বর।
আর খাওয়াদাওয়া? নিজেদেরই বানিয়ে নিতে হয়। সঙ্গে চাল আর নুন থাকে। বাসন বলতে একটা কড়া। তাতেই ভাত হয়। জঙ্গলে মাছ মেলে। লঙ্কা, রসুনও পাওয়া যায়। তেল মেলে না। কোনও রকমে সেদ্ধ বা পুড়িয়ে খাওয়া হয়ে যায়। বুনো হাতি ধরার পর কী ভাবে ট্রেন করা হয়? কয়েকটি ধাপে চলে এই পদ্ধতি। সদ্য-ধরা বুনো হাতিটিকে পাশাপাশি দুটি কুনকিকে দিয়ে জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা হয় মেন ক্যাম্পে। তার চার পা এবং গলায় দেওয়া হয় দড়ির বাঁধন। হাতির বয়স ও শারীরিক শক্তি বুঝে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা তাদের বেঁধে রাখা হয়। আশেপাশে সব সময় কথা বলতে থাকে মানুষ। মানুষের সঙ্গে পরিচিত করার প্রথম ধাপ এটা। এই সময়টায় ভীষণ খেপে থাকে ওরা। খেতে দিলে খায় না। উল্টে ছুড়ে দেয়। তেড়ে আসে। স্ট্রেস রিলিজ় করার জন্য তখন তাকে জলে নামানো হয়। দু’পাশে দুটি কুনকি। তাদের গলা বাঁধা থাকে নতুন অতিথির সঙ্গে। স্নানের পর চলে হাঁটানো।
দিন পনেরো একই রুটিনে চলতে চলতে একটু ধাতস্থ হয় ওরা। মানুষ দেখলে আর তেড়ে আসে না। তখন সরিয়ে নেওয়া হয় একটি কুনকি। এ বার শুরু হয় কম্যান্ড। ৪টি কম্যান্ড শেখানো হয় শুরুতে— আগে, পিছে, দাঁড়া, ঘোর। কুনকিকে দেখে কম্যান্ড ফলো করতে শেখে সে। এত বুদ্ধি, মাসখানেকের মধ্যে সব শিখে ফেলে। এ বার সরিয়ে নেওয়া হয় ওই কুনকিটিকেও। পরের ধাপে শেখানো হয় মাটি থেকে জিনিস তুলে দেওয়ার পদ্ধতি। হাতির পিঠের ওপর মাহুত বসার জন্য যে বস্তা থাকে, তা পিঠ থেকে মাটিতে ফেলা হয়। রশি বাঁধা থাকে সেটির সঙ্গে। মাহুত তোলার কম্যান্ড দিয়ে রশিতে টান মেরে বস্তা তুলে দেয় পিঠে। বারকয়েক দেখতে দেখতে হাতি মাটি থেকে জিনিস তোলার নির্দেশ রপ্ত করে নেয়। খুব বুদ্ধিমান ওরা। কিন্তু মাহুতকেও যত্ন ও ধৈর্য ধরে শেখাতে হয়। একেবারে আমাদের শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার মতো। শুধু বই পড়ে কেউ ভাল মাহুত বা হাতির ট্রেনার হতে পারে না। শিখতে হয় হাতে-কলমে।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পার্বতী আছেন হাতির সঙ্গে। তাঁর ঝুলিতে হাতি নিয়ে নানান গল্প। সে সব ছুঁয়ে যেতে কেটে যাবে রাতের পর রাত। তিনি অনর্গল, ‘‘আমার জীবনটা তো ওদেরই জন্য উৎসর্গ করেছি। ওদের নিজের সন্তান বলে জানি। আমার নিজের মেয়ে আছে মানস অভয়ারণ্যে। ওর নাম লক্ষ্মীমালা। বক্সার নিমতি ফরেস্টে ওকে পেয়েছিলাম, ১৯৭৫-এ। তখন ও বছর পাঁচেকের। আমার সব অনুভূতি ও বুঝতে পারে, মানুষের থেকেও বেশি।’’ হাতির মনের স্পর্শটুকু চিনিয়ে দিতে তিনি কার্যত ছুটে বেড়ান এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। মাহুত আর বন্যপ্রাণ রক্ষকদের শেখান হাতিকে ভালবাসার মন্ত্র। “বাবার সময়ে হাতি পোষা ছিল স্টেটাস সিম্বল। এ দেশের অনেক ধনী মানুষ হাতি পুষতেন। বাবার কাছে ট্রেনিং-পাওয়া হাতির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। আমি আসার কিছু দিন পর, সম্ভবত ১৯৭৮ থেকেই হাতি শিডিউল ওয়ানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। নিষিদ্ধ হয় হাতি ধরা। এখন সরকারি নির্দেশ ছাড়া মহাল হয় না।” ১৯৮০ সালে শেষ মহালে অংশ নিয়েছিলেন পার্বতী। উত্তরবঙ্গের বামনপোখরিতে হয়েছিল সেই মহাল।
এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাক পড়ে হাতি খেদানো বা মাহুত প্রশিক্ষণের কাজে। নিজের রাজ্য অসম তো আছেই, পশ্চিমবঙ্গেও আসেন মাঝেমাঝেই। গত মার্চেও ক্যাম্প করেছেন চালসার কাছে ধূপঝোরায়। সেখানে তাঁর অন্য রূপ। এই ঘরোয়া শাড়ি-পরিহিতার সঙ্গে কোনও মিল নেই! হাতিরাই তখন তাঁর সব। সে প্রসঙ্গ ওঠালে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘সব সময়ই ওরা আমার মনে-প্রাণে। ওদের যেমন বিশ্বাস করা যায়, মানুষকে বোধহয় তেমন নয়।’’
পৃথিবী জুড়ে বন্যপ্রাণের ওপর ক্রমাগত আক্রমণে তিনি ক্ষুব্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কখনও ওদের বন্ধু হিসেবে দেখি না। দেখি না নিজেকে ওদের জায়গায় বসিয়ে। ওরা তো আমাদের ভাবে, কী অসভ্য জন্তু রে বাবা, না বলে আমার বেডরুমে এসে ঢুকেছে!” মানুষ তো তা-ই করছে। ওদের এলাকায় আমরা ঢুকে পড়ছি, জঙ্গল কেটে ওদের বসতভূমি শেষ করে দিচ্ছি। নিজেদের বাঁচাতে ওরা বাধ্য হয়ে আক্রমণ করছে।’’ উন্নয়নের বিরুদ্ধে নন পার্বতী। কিন্তু তিনি চান পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। না হলে আমাদের সন্ততির কাছে ভবিষ্যতের পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে অচিরেই।
তাঁর পরিবারে আর কেউ তো এলেন না এ কাজে। তবে কি হারিয়ে যাবে এই পরম্পরা? ব্যথিত শোনায় পার্বতীর স্বর, “আমার পরিবারে হয়তো আমিই শেষ। কিন্তু যাদের আমি শেখাচ্ছি এই বিদ্যা, তারা এটা ধরে রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।’’ নিয়মিত ডায়েরি লেখেন পার্বতী। সেই ডায়েরির পাতা সামনে এলে হয়তো জানা যাবে, অর্থ, যশ, খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও কেন তিনি চিরকাল ফিরে যেতে চেয়েছেন বন আর বন্যের আশ্রয়ে।