পূর্বানুবৃত্তি: এত দিন বাদে বোস স্যর বান্দোয়ানে আসছেন, বেন্দার খবরও নিয়েছেন, জানতে পেরে পুরনো স্মৃতি তোলপাড় করে বেন্দাকে। মনে পড়ে যায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগের বহু ঘটনা। বোস স্যর যে দিন প্রথম আসেন, ফরেস্ট গার্ড বেন্দাই সে দিন ওঁকে রেঞ্জ চৌহদ্দির শেষ প্রান্তে ছোট্ট ঘরটায় পৌঁছে দিয়েছিল। তার পর অফিসে ফিরে দেখেছিল, বিদায়ী রেঞ্জারবাবু আর সব বিট অফিসারেরা মিটিংয়ে বসেছে— নতুন অফিসার কেমন, ওদের কথামতো কাজ করবেন কি না সেই নিয়ে। বেন্দার মনে হয়েছিল, সব জানিয়ে দেবে বোস স্যরকে।
বেন্দা ওর নিজের বুদ্ধি মতো ঠিক করে স্যরকে এ দিকের কথা না জানালেও ও চোখকান এখন থেকে খোলা রাখবে, বিশেষ করে স্যরকে জড়িয়ে কোনও ষড়যন্ত্র থাকলে— ওর ক্ষমতা অনুযায়ী যদি কোন সাহায্যে আসতে পারে দরকারের সময়! সেতুবন্ধনের সময় কাঠবিড়ালিও তো রামচন্দ্রের কাজে এসেছিল!
হাত থেকে টিভির রিমোটটা খসেই পড়ল পায়ের কাছে। মোটা গালচে থাকায় শব্দ হল না, হলেও বোধহয় শুনতে পেত না ও। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ছোট্ট একটা বিউটি ন্যাপ দিয়ে উঠে রান্নাঘরে চার-চারটে কাজের লোকের এক জনকেও দেখতে না পেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে টিভিটা অন করেছিল অন্নু। প্রীত ওকে ঐ নামেই ডাকে। আজ বলে নয়, গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরেই ওরা পরস্পরকে অন্নু আর প্রীত বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। এ বছরের জন্মদিনে এক দিকের দেওয়াল প্রায় অর্ধেকটা জোড়া বিশাল স্ক্রিনের লেটেস্ট মডেলের টিভিটা ওকে ডেডিকেট করেছে প্রীত— ওর স্বামী মনপ্রীত সিংহ, সুরাটের নামকরা ডায়মন্ড মার্চেন্ট ও ডায়মন্ড অ্যাপ্রাইসার।
অন্নু সুন্দরী। শুধু সুন্দরী বললে কম বলা হয়, এই মধ্য-পঞ্চাশে এসেও ওর নজরকাড়া সৌন্দর্যে পুরোপুরি ভাটা পড়েনি। কর্পোরেট জগতের নিয়ম অনুযায়ী মাঝেমধ্যেই এই পরিবারকে নানা ধরনের পার্টি অ্যারেঞ্জ ও অ্যাটেন্ড করতে হয়। খুব বড় মাপের না হলেও হিরের জহুরি হিসেবে মনপ্রীত ভালই নাম করেছে। কাজের সুবাদেই বছরে ন’দশ মাস ওদের সুরাটে থাকতে হয়— বাকিটা ওদের পটনার পৈতৃক প্রাসাদোপম বাড়িতে। যেখানেই পার্টি হোক, এই বয়সেও অন্নু ম্যা’ম সেখানে মক্ষিরানি। সাজগোজ আর চটকে ওর হাঁটুর বয়সি মেয়েরাও ওর কাছে পাত্তা পায় না। মাঝারি থেকে উপরের স্তরের প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছনো কর্তাব্যক্তিদের নেশাগ্রস্ত লোলুপ চাউনিই শুধু নয়, ওর থেকে দশ-পনেরো বছরের ছোট ও জুনিয়র, ম্যানেজমেন্টের যুবকদের সসম্ভ্রম ও সপ্রেম অনুরক্তির চাউনিও অন্নু ম্যা’ম সমান উপভোগ করেন।
প্রথম দিকে বেশ অস্বস্তি হত ওর। সে জন্য মনপ্রীত ওকে অল্প পরিমাণে হালকা মদ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর ও তাতে অনেকটা অভ্যস্তও হয়েছে। তন্বী চেহারায় অল্প ও আকর্ষণীয় একটু মেদও জমেছে তাতে। সব মিলিয়ে ওই ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মৃদু যৌনতা মেশানো ইশারা-ইঙ্গিতগুলোও মোটের উপর এনজয়ই করে ওরা স্বামী-স্ত্রী মিলে। কিন্তু শুধু— হ্যাঁ, শুধুমাত্র ওই দিনগুলোতেই বাড়ি ফিরে অল্প নেশা-ধরা মাথা ঝিমঝিমানির মধ্যে ও যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়, কেবলমাত্র তখনই সামনের কাচে অন্নু নিজের মুখ নয়, অন্য এক জোড়া চোখের মুখোমুখি হয়।
এলোমেলো চুলওয়ালা, লম্বাটে মুখের সেই মানুষটার দুটো চোখের তীব্র চাউনিতে চাপা কিন্তু প্রবল ভর্ৎসনা, সেই সঙ্গে থেমে থেমে বলা কথাগুলো যেন কানে বাজে— ‘‘চিরদিনের মতো দূরে চলে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই তোমাকে— তোমার জীবনে প্রথম পুরুষ আমি হতে পারিনি, একমাত্র তো নয়ই। সে আমাদের নিয়তি। তবে যদি শেষ পুরুষও না হতে পারি, সেটা হবে আমার দুর্দৈব। তোমাকে নিঃশর্তে ছেড়ে যাচ্ছি শুধু একটা আশা নিয়ে— তোমার এই খেলা তুমি এখানেই শেষ করবে! পুরুষকে সম্মোহিত করে তোমার এই যে এক্সপেরিমেন্ট নিজের ক্ষমতা পরখ করার, তার শিকার যেন আর কেউ না হয়!’’
প্রত্যেক বারই অন্নু আয়নার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে, ‘‘ইয়ে মেরি তকদির হ্যায়, আমি নিজে থেকে কিছু করিনি, ইয়েকিন করো মুঝে! তুমিও জানো, যা ঘটে গেছে আমাদের মধ্যে, তা ভাগ্যচক্র। আমার বা তোমার তাতে কোনও হাত ছিল না। তোমাকে তো আমৃত্যু আমিও ভুলতে পারব না। চিরদিনের মতো বিচ্ছেদের ফয়সালা না করে আবারও তো আমরা...’’
কোনও বারই ওর কথা শেষ হয় না। বিষের ছুরির মতো কথাগুলো কানের ভিতর দিয়ে বুকে এসে বেঁধে: ‘‘যা সত্যি নয়, সেটা তোমার অভিনয় দিয়ে তুমি চাপা দিতে পারো, কিন্তু অত দক্ষ অভিনেতা আমি নই। আমাদের সম্পর্ক সাধারণ বন্ধুত্বের মোড় ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেখান থেকে ব্যাক গিয়ারে তাকে ফিরিয়ে আনা আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করতে বলে আরও প্রবঞ্চনা, আরও অপমান তুমি আমাকে কোরো না। তার থেকে এটাই ভালো— ভুল স্বীকার করে নিয়ে তোমার সুন্দর জীবন, তোমার সাজানো পৃথিবী থেকে আমার অস্তিত্ব পুরোপুরি মুছে দিয়ে যাচ্ছি। মনে কোরো এটা একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন— এই নামে, এই চেহারায় কেউ কোনও দিন ছিলই না, আর থাকলেও দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এমন তো কতই হয়!’’
কথাগুলো শুনেছিল এক বারই। কিন্তু কানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে অজস্র বার, বিশেষ করে ওর দুর্বল মুহূর্তগুলোতে। ইদানিং সে সব আর তেমন ভাবে দাগ কাটে না, শুধুমাত্র একটা ভোঁতা আঘাত করে। বিশেষ করে অপালার কাছ থেকে পাঁচ বছর আগে ছেলেটার শেষ পরিণতির খবর শোনার পর থেকে। মন থেকে হয়তো চায়নি, কিন্তু কথাগুলো শোনার প্রায় পঁচিশ বছর পরে বাস্তবে ঘটেছে জানার পর ওর অবচেতন থেকেই বোধহয় একটা পাষাণভার নেমে গিয়েছিল— যাক, নিজেকে মুছে নিতে চেয়েছিল, তাই নিয়েছে!
গতকাল ওদের ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকী ছিল, প্রতি বছরের মত এ বারও অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি, হইহুল্লোড় মিটিয়ে আয়নার সামনে সেই প্রেতাত্মার আবির্ভাবের জন্য কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করেও এই প্রথম অনুভব করেছিল তার অনুপস্থিতি! এমনটা তো বহু বছর হয়নি! তা হলে কি অবচেতন থেকে নিঃশেষে আর নীরবে সরে গেছে তার জীবনের রাহু-শনির প্রেতছায়া? তা হলে এখন ওর চোখের সামনে কি ঘটছে ?
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা না পেয়ে বাজে মুডে ছিল অন্নু। ড্রয়িংরুমে বসে অন্যমনস্ক ভাবে রিমোট হাতে চ্যানেল সার্ফ করে যাচ্ছিল। খবর, নাচগান, সিরিয়াল, মন বসছিল না কিছুতেই। বেশির ভাগই গুজরাটি, দুএকটা হিন্দিও। হঠাৎ কী ভেবে বাংলা মিডিয়া সিলেক্ট করে পর পর ব্রাউজ়িং করতে গিয়ে একটা চ্যানেলে আচমকাই চোখ আটকে গেল। হাতের চাপ পড়তে পরের চ্যানেল এসে গিয়েছিল, তাই আবার ব্যাক করতে হল। স্ক্রিনে তখন উপস্থাপককে দেখাচ্ছে সঙ্গের লোকটার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতে।
স্ক্রিনে মানুষটার মুখ ভেসে আসতে বুকের মধ্যে দমবন্ধ ভাব আর হাত-পা শিথিল হয়ে আসাটা স্পষ্ট টের পেল ও। এত দিন বাদে এ কোথা থেকে উদয় হল! সেই মুখের ভঙ্গি, সেই হাত নেড়ে যুক্তিজাল খাড়া করা— এগুলো তো ওর ভুল হওয়ার কথা নয়! তবু অন্নু অপেক্ষা করতে লাগল নামটা দেখার জন্য। রিমোটটা তোলার কথা ভুলে গিয়ে অন্নুর বিহ্বল দৃষ্টি এক বার টিভি-স্ক্রিনে, আর এক বার দেওয়াল-জোড়া আয়নার দিকে পর্যায়ক্রমে ঘুরতে লাগল। আয়না না কি কোনও অভিব্যক্তি গোপন করতে পারে না! সত্যি, এই সময়ে চেনা কেউ সামনে থাকলে চরম অস্বস্তিতে পড়ে যেত অনামিকা। মেদহীন দেহবল্লরিতে কোনও পরিবর্তন নেই, অথচ আয়নায় ফুটে ওঠা মুখটা ওর এত দিনের চেনা মুখই নয়। প্রথমে সাদা হাড়ের মত ফ্যাকাশে এক রক্তহীন মুখোশ, আর তার পরই তীব্র বুক ধড়ফড়ানির সাথে সাথে টকটকে লাল মুখ— যেন শরীরের সব রক্ত মুখে এসে উঠেছে।
টিভির পর্দায় মানুষটা কথা বলেই চলেছে। অথচ ও কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, রিমোটে চাপ পড়ে সাউন্ড মিউট হয়ে গেছে বলে। এখনও পর্যন্ত নাম দেখায়নি, তাই গলাটা শোনা খুব জরুরি— বক্তার পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। এক রকম দেখতে দুটো মানুষ কখনও কখনও ভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। তার ওপর ত্রিশ বছর আগে ছাড়াছাড়ি হওয়া, এক মাথা কোঁকড়ানো চুলের, লম্বাটে মুখের, শ্যামলা রঙের, বছর তেইশ-চব্বিশের ছিপছিপে চেহারার যুবকের সঙ্গে সামনের পর্দায় দেখা অনেকটা চওড়া কপাল, ভারী চেহারার প্রৌঢ় ব্যক্তিটিকে মেলানো সত্যি শক্ত। তবু ওর মন বলছে এই-ই সে। অপালার কাছে শোনা কথাটা ভুল হতে পারে, কিন্তু ওর এখনকার দেখাটা আর সেই সঙ্গে ভিতরের অনুভূতিটা ভুল হতেই পারে না।
ঝুঁকে পড়ে মেঝের কার্পেট থেকে রিমোটটা তুলে নেয় অন্নু। একই সঙ্গে ভিতরের দরজা ঠেলে চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকে বিশপাতিয়া, পটনা থেকে আনা ওর খাস মেড— ‘‘স্যরি মেডাম, চায় দেনে মে দের হো গয়ি!’’ অপরাধীর ভঙ্গিতে সামনে ট্রে রেখে দাঁড়াতেই আবার রেগে ওঠে অনামিকা। এত ক্ষণ রাগ বাড়ছিল চা আনতে দেরি হচ্ছিল বলে, আর এখন সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে রাগ হচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়ানোর আর সময় পেলি না? ওর সামনে গলার আওয়াজ শুনে চোখমুখের কেমন অভিব্যক্তি হবে কে জানে! যদিও ওর এই অতীত সম্বন্ধে কাজের লোকেরা তো দূরস্থান, প্রীতও তেমন ভাবে কিছু জানে না। অতীতের এই সম্পর্কটাকে অনামিকা এক গভীর গোপন পাপের মতো চেপে রেখেছে নিজের ভিতরে। ও জানে, ওর এই মানসিকতাতেই ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়ে ওর এক সময়ের ঘনিষ্ঠতম এবং ওর মনেরও গভীরতম তল ছুঁয়ে-ফেলা মানুষটা ওকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেছে, সম্পর্কের চিহ্নমাত্র না রেখে।
বেশ রূঢ় ভাবেই ও বিশপাতিয়াকে তাড়িয়ে দেয়— ‘‘হম বাদ মে বাত করেঙ্গে, আভি ভাগো হিঁয়াসে!’’ বিষণ্ণমুখে কাজের লোক ঘর ছাড়তেই অন্নু সাউন্ড বাটনে চাপ দেয়। টিভিতে শব্দ ফিরে আসে, একই সঙ্গে টিভির পর্দার নীচের দিকে স্ক্রল করে আসে নামটা, সাথে অফিশিয়াল ডেজ়িগনেশনটাও। আলোচনার বিষয়বস্তু: জীবজন্তু, বিশেষ করে পাখিদের আচার-আচরণ ও জীবনচর্যা।
মানুষটার গলার আওয়াজ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে আসে আর এক দফা বুক কেঁপে ওঠার অনুভূতি। এতগুলো বছরেও গলার স্বরে কোনও পরিবর্তন এসেছে বলে ওর মনে হয় না। টিপিক্যাল ব্যারিটোন ভয়েস নয়, আবার খুব সরু গলাও নয়। বরং কিছুটা কিশোরসুলভ কণ্ঠ বলা যায়। ত্রিশ বছর আগেও এমনটাই ছিল! স্বরে উত্থান-পতন বা নাটকীয়তা একদম নেই, অথচ বলার মধ্যে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সুর। যেন যা বলছে, তা মন থেকে বিশ্বাস করে বলেই বলছে— যেমনটা অল্প সময়ের মেলামেশায় দেখেছিল অন্নু। লোকটা বলে চলেছে জীবজন্তুর প্রকৃতি আর অভ্যাস নিয়ে, কিন্তু ভঙ্গিটা এমন যেন প্রতিবেশীদের বিষয়ে নিজের মনে আলোচনা করছে।
ক্রমশ