Novel

বৃশ্চিকবৃত্ত

পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের চেম্বারে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ডিসি মিস্টার রাহা। মিনিট পাঁচেক বাদে রিসেপশন থেকে ফোন এল, ইনস্পেক্টর মজিদ আলি এসেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৪৮
Share:

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।

এই রাক্ষুসে চেহারার জন্যই ভেতরে ভেতরে কিষানকে খানিকটা ভয়ও পায় কৌশল্যা। যদিও ওপরে সেটা বুঝতে দেয় না কখনওই।

Advertisement

কিষানের দিকে তাকিয়ে ছোট করে হাসল কৌশল্যা, “সব কুছ ঠিকঠাক হ্যায় তো?”

মুখে কিছু না বলে ঘাড়টা সামান্য হেলাল কিষান। তালা খুলে হ্যাঁচকা একটা টান। হাট হয়ে এক ধারে সরে গেল ভারী লোহার দরজাটা। ভেতরে উঠে এল কৌশল্যা।

Advertisement

আপাতদৃষ্টিতে নিরীহদর্শন একটা ফার্নিশড ফ্ল্যাট। ফ্রিজ, টিভি, এসি মেশিন, সোফা সেট, কার্পেট, কিচেন চিমনি, দু’ঘরে দুটো বিশাল বিশাল খাটের তলায় দুটো বক্স। এক-একটা বক্সে চাইলে গোটা ছয়েক মেয়েকে অনায়াসে শুইয়ে রাখা যায়। দেয়ালে টাঙানো এক-মানুষ সাইজ়ের দেবীমূর্তির ছবি। ছবির নকশাতোলা ফ্রেমের আড়ালে লুকনো বোতামটা টিপতেই দরজার মতো খুলে গেল ছবিটা। পেছনে একটা চোরাকুঠুরি। চার জন ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেখানে। পুরো ব্যবস্থাটার ওপর ভাল করে নজরদারি চালিয়ে সন্তুষ্টির ঘাড় নাড়ল কৌশল্যা। তার পর ঘুরে তাকাল কিষানের দিকে, বলল, “সব কুছ ঠিক হি তো লাগ রহা। শুন, উও শালা ভাড়ুয়া সদানন্দ, কাল আসছে মাল নিয়ে। উসমান ভাই কা মাল। বহোত কিমতি চিজ় হায়। সামহালকে রাখনা সবকো। সমঝা?”

জবাবে শুধু একটা ‘ঘোঁত’ শব্দ বেরোয় কিষানের মুখ থেকে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কৌশল্যা সিং।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের চেম্বারে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ডিসি মিস্টার রাহা। মিনিট পাঁচেক বাদে রিসেপশন থেকে ফোন এল, ইনস্পেক্টর মজিদ আলি এসেছেন।

“ওদের পাঠিয়ে দাও,” বলে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন ডিসি সাহেব। একটু পরেই আর্দালি কনস্টেবলের পিছন পিছন ঢুকলেন মজিদ, সবার শেষে রুদ্র। ঢুকেই প্রথামতো টানটান হয়ে
বুক চিতিয়ে স্যালুট করল নিজের সুপিরিয়রকে। রুদ্রকে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে সটান উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার রাহা।

“হোয়াট আ প্লেজ়্যান্ট সারপ্রাইজ়! ইনক্রেডিবল মিটিং আফটার সো লং টাইম, মাই বয়!” বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছিল না ডিসিসাহেবের। নিজেই এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন রুদ্রকে। পরমুহূর্তেই ঘুরে তাকিয়ে অর্ডার করলেন আর্দালিকে, “তিনটে কফি, সঙ্গে স্ন্যাক্স।”

“ইয়েস স্যর,” ঘাড় নেড়ে চলে গেল আর্দালি।

বিশাল মেহগনি কাঠের টেবিলের ওপর রাখা ট্রে-তে বিস্কুট, চানাচুর, প্যাটিস আর জাম্বো সাইজ় তিনটে কফি মাগ। কফিতে চুমুক দিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন মিস্টার রাহা, “নাও টেল ইয়োর স্টোরি মাই বয়। মজিদের কাছে শুনে তো আমি অবাক, তুমি নাকি ওখানে পৌঁছনোর আগেই তোমার ফোনদুটো নদীর জলে ফেলে দিয়েছিলে! হোয়াট আ স্পোরাডিক ডিসিশন! আই জাস্ট কুডন্ট বিলিভ ইট! মডার্ন আরবান লাইফস্টাইলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে অভ্যস্ত দু’জন মানুষ, ও রকম একটা গড ফরবিডেন প্লেসে এত দিন ধরে আছ কী করে? এখানকার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না রেখে…” বিস্ময় কাটছিল না ডিসিসাহেবের।

বড়কর্তার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসল রুদ্র, “প্রথমে আমিও একই কথা ভেবেছিলাম স্যর। পরে দেখলাম, আসলে অভ্যেসই সব কিছু মানিয়ে নিতে শেখায়। শুধু মানিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকা দরকার।”

“দ্যাটস রাইট, অভ্যেসই মানুষকে গড়েপিটে নেয়। নাও, লেট আস কাম টু দ্য পয়েন্ট,” টেবিলের ওপর দু’হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়লেন রাহা, “আলি তো তোমাকে ডিটেলে বলেইছে পুরো ব্যাপারটা। আমার সুপিরিয়র, মানে কমিশনার সাহেব চাইছেন এমন কেউ এই মিশনটা টেকওভার করুক, যে শুধু ফোর্সের ফিক্সড অ্যান্ড রুটিন ফরম্যাটেই কাজ করবে না, প্রয়োজনে তার বাইরেও যাবে। আমি তোমার নামটাই রেফার করেছি। বড়সাহেবকে বলেছি, এ ব্যাপারে ইউ আর দ্য বেস্ট। কিন্তু তুমি তো রিজ়াইন করেছ অনেক দিন হল। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন কথা চালাচালি হল। ফরমাল অ্যান্ড লিগ্যাল কিছু কমপ্লিকেশনও অ্যারাইজ় করেছিল, তবে সে সব সল্ভ করা গেছে মোটামুটি। এ বার তুমি যদি রাজি থাকো…” রুদ্রর দিকে তাকালেন ডিসিসাহেব। চোখে চাপা অথচ তীব্র একটা আর্তি, “এ ক্ষেত্রে তুমি অন জব যে পজ়িশন, রেমুনারেশন অ্যান্ড আদার ফেসিলিটিজ় এনজয় করতে, যত দিন মিশনটা চলবে, ইউ উইল এনজয় অল দোজ় সেম ফেসিলিটিজ়। এভরিথিং উইল বি ইন রিটন। যারা এত দিন ধরে কেসটায় এনকোয়ারি চালাচ্ছে, তারা সব ডকুমেন্টস তোমাকে হ্যান্ডওভার করে দেবে। এ কাজে একটা টাফ অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট টিম প্রোভাইড করা হবে তোমাকে। তা হলে আমি কি ধরে নিতে পারি যে দ্য ডিল ইজ় ফিক্সড?” ডান হাতটা রুদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলেন রাহা।

জবাবে সরাসরি ডিসিসাহেবের চোখে চোখ রাখল রুদ্র, তার পর বলল, “এ ব্যাপারে আমার মাত্র তিনটে কথা বলার আছে স্যর। আপনি আমাকে বলেছেন, ডিপার্টমেন্টের চেনা সিস্টেম অথবা ফরম্যাটের বাইরে গিয়েও কাজ করতে পারব আমি। কিন্তু যদি কখনও দেখি যে, আমার সেই অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, তখনই এই মিশন ছেড়ে চলে যাবার রাইট আমার থাকবে। দ্বিতীয়ত, এ মিশনে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে রিপোর্ট করব না আমি। লাস্ট অব অল, রেজ়িগনেশন লেটার জমা দেবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যাদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম, আই ওয়ান্ট দ্যাট সেম ওল্ড টিম।” শোনামাত্র তীব্র বিরক্তিতে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন রাহা, “রুদ্র, অ্যাজ় আ কপ তুমি ভাল করেই জানো যে, তোমার লাস্ট কন্ডিশনটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া নেক্সট টু ইম্পসিবল! মজিদরা সবাই যে যার ডিপার্টমেন্টে এনগেজড, চাইলেই তাদের সবাইকে হুট করে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনা যায় না। সেই সব হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টদের পারমিশনেরও একটা ব্যাপার আছে। ইটস আ লং ড্রন প্রসেস।” ডিসিসাহেবের কথাটা শেষ হবার আগেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র, “তা হলে আমি আসি স্যর। এখনই রওনা দিতে পারলে সন্ধে নাগাদ গ্রামে পৌঁছে যেতে পারব মনে হয়। দয়া করে আমায় ভুল বুঝবেন না। আমার টিমের সঙ্গে একটা আলাদা বন্ডিং ছিল আমার। একে অন্যের কাছে আমরা ছিলাম ঝরঝরে মুখস্থ বইয়ের মতো। পাতা না দেখেও একে অপরকে পড়ে ফেলতে পারতাম আমরা। এত দিন পর ফিরে এসে নতুন টিমে নতুন করে সব কিছু ফিক্স করা অসম্ভব আমার পক্ষে। মিসকমিউনিকেশন হয়ে যেতে বাধ্য। আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ়।”

বিস্ফারিত চোখে রুদ্রর দিকে দিকে তাকিয়ে ছিলেন মিস্টার রাহা। বিরক্তি আর বিস্ময় মিলেমিশে একাকার তাঁর অভিব্যক্তিতে, “এ তো তুমি আমায় মহা মুশকিলে ফেললে দেখছি! দাঁড়াও, দেখি কিছু করা যায় কি না...” মজিদের দিকে ঘুরে তাকালেন ডিসিসাহেব, “সাউথে আমাদের ওই গেস্টহাউসটায় একটা ফার্নিশড ওয়ান রুম ফ্ল্যাট অলরেডি অ্যালট করা রয়েছে রুদ্রর নামে। তুমি ওকে নিয়ে ওখানে চলে যাও। দরকারে আমার গাড়িটা নিয়ে নাও। আমি দেখি বড়সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।”

“ইয়েস স্যর!” বলে উঠে দাঁড়ালেন মজিদ।

চেম্বার ছেড়ে বেরনোর মুখে ডিসিসাহেবের ডাকে পিছনে ফিরে তাকাল রুদ্র। চাপা স্নেহ-মাখানো হাসি ডিসিসাহেবের মুখে, “চাকরিটা তুমি ছেড়ে দিয়েছ অনেক দিন হল। কোনও দায় ছিল না তোমার, তবু ফোর্সের নর্ম মেনে সুপিরিয়রকে স্যালুট দিতে ভোলোনি, দেখে ভাল লাগল,” বলতে বলতে গলা গাঢ় হয়ে এল মিস্টার রাহার। “আমার রিটায়ারমেন্টের আর তিন মাস বাকি। মজিদেরও বোধহয় ওই রকমই কিছু একটা। আমি চাই এর মধ্যে কেসটার সুরাহা করে আমাদের দু’জনকে ফেয়ারওয়েল গিফট দাও তুমি।”

জবাবে বড়কর্তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল রুদ্র, “আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট টু কিপ ইয়োর ফেথ অ্যান্ড অনার অ্যালাইভ, স্যর। আর আপনি স্যালুটের কথা বলছিলেন, ‘ওয়ান্স আ কপ অলওয়েজ় আ কপ’— ফোর্সের পুরনো প্রবাদটা আজও ভুলিনি আমি।”

পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটা। কমিশনারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার রাহা। একটু দূরে লম্বা কাঠের চেয়ারে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন মজিদসাহেব। ডিসিসাহেবকে বেরোতে দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। মজিদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ডিসিসাহেব। একটা স্বস্তির ছাপ চোখেমুখে, “যাক, অনেক কষ্টে রাজি করানো গেছে কমিশনারসাহেবকে। আলি, তুমি আর রুদ্রর পুরনো টিমের লোকেরা, টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্সের মধ্যে তোমাদের ডিপার্টমেন্টকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে রুদ্রর টিমে জয়েন করে যাবে। বড়সাহেবের দফতর থেকেও ইমিডিয়েট ইনটিমেশন যাবে তোমাদের ডিপার্টমেন্টে। তুমি এখনই তোমাদের ওল্ড টিমের সবাইকে মেসেজটা দিয়ে দাও। ও কে?”

“ইয়েস স্যর!” খুশিতে চকচক করছিল মজিদের মুখ। দেখে মুচকি হেসে চলে গেলেন রাহাসাহেব।

দুপুর বারোটা বাজতে দশ। লেক গার্ডেন্সে রাস্তার ধারে একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ মর্গের রং চটে যাওয়া পুরনো গাড়িটা। বাড়ির একটা ছেলে, ড্রাগ-অ্যাডিক্ট, সুইসাইড করেছে গত রাতে। গাড়ির সামনে ড্রাইভারের সিটে তারক। পুরনো কথা ভাবছিল বসে বসে। কী দিনকাল ছিল সে সব! ডি ডি ডিপার্টমেন্ট। রুদ্রস্যর বস। সঙ্গে মজিদসাহেব। যে কোন অ্যামবুশ, এনকাউন্টার, অ্যাকশনে সাধারণ কনস্টেবল বা এএসআই-দের এগিয়ে না দিয়ে সব সময় সামনে থেকে লিড করতেন দু’জনে। বুকের খাঁচায় দম ছিল বটে লোকদুটোর। রাস্তায় অকারণে স্পিড বাড়ালে ধমক দিতেন রুদ্রস্যর। আবার অন্য দিকে একশো, একশো কুড়ি কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি ছুটিয়ে পালাচ্ছে হাইলি ওয়ান্টেড কোনও ক্রিমিনাল গ্যাং, লাল সিগন্যালে আটকে গেছে ডি ডি-র গাড়ি, পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠেছেন স্যর, “সিগন্যাল ভাঙ তারক! স্পিড বাড়া। ট্র্যাফিক-ফাফিক আমি বুঝে নেব।” স্পিডোমিটারের কাঁটা মুহূর্তে লাফিয়ে একশো কুড়ি! কেসও খেতে হয়েছে বহু বার। প্রত্যেক বার সামনে দাঁড়িয়ে ফেস করেছেন। বড়কর্তাদের মুখের ওপর সপাট বলে দিয়েছেন, “ড্রাইভারের কোনও দোষ নেই। আমিই ওকে অর্ডার দিয়েছিলাম। যা চার্জ দেওয়ার আছে আমাকে দিন।” কোথায় এ রকম একটা বাঘাটে লোকের আন্ডারে ডিউটি আর কোথায় শালা হররোজ এই মর্গের ধ্যাদ্ধেড়ে পুরনো মড়া-টানা গাড়ি চালানো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement