ছবি: বৈশালী সরকার
সোজা হয়ে বসে আকাশদীপ কাঙালের মতো তাকাল মঞ্জীরার দিকে, “জানি, আমায় ক্ষমা করতে পারছ না। কিন্তু এই ঘরের কোনও স্মৃতিই কি আর নেই মঞ্জি? আমি সব হারিয়ে তোমার কাছে এসেছি। তোমার আর ডাম্বোর চোখে এই ঘৃণা দেখতে দেখতেই কি ফুরিয়ে যাব? ভাল মন্দ সবটুকু নিয়েই তো আমি, বলো! আজ থেকে আমার সবটুকু শুধু তোমাদের জন্য। তোমার জন্য মঞ্জি। আমাদের ডাম্বোর জন্য।”
মঞ্জীরা অপলকে আকাশদীপকে দেখছিল। এই মানুষটা জানে কতটা সামাজিক গ্লানির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে এই ক’বছরে? বাবার প্রসঙ্গ উঠলেই ডাম্বো নিজের বন্ধুমহলে কতটা কুঁকড়ে থাকে, তা জানে এই লোকটা? কত দিন লাগে সেই গ্লানি মুছে যেতে, কত যুগ পেরোলে ধুয়ে যায় ছোট্ট ছেলের সেই গুমরে গুমরে বাঁচার দিনরাত্রি! মঞ্জীরার ভিতর একটা রাগ গুমরে উঠল। তার ভয় হল, সে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসতে পারে আকাশদীপকে।
সে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগ কাঁধে নিল। খুব সহজ ভাবে বলল, “চলি। সাবধানে থেকো।”
মঞ্জীরা বেরিয়ে যাওয়ার আগেই তার হাত ধরে টানল আকাশদীপ। কাছে টেনে নিয়েছে মঞ্জীরাকে। তার বাহুপাশে ছটফটিয়ে উঠল মঞ্জীরা, “ছাড়ো।”
আকাশদীপ ছাড়ল না, মঞ্জীরার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি চাইনি আমার জন্য তোমার বাকি জীবন নষ্ট হয়ে যাক। ডিভোর্স পিটিশনটা কিন্তু তোমার ভালর জন্যই পাঠিয়েছিলাম। আমার ভুলের মাশুল সারা জীবন কেন দেবে তুমি? ভেবেছিলাম নতুন করে জীবন শুরু করবে। তুমি ইয়ং, অ্যাট্রাক্টিভ, এখন তো চাকরিও করো। তুমি একটা নতুন জীবন শুরু করতেই পারতে। কেন যাওনি মঞ্জি? তুমি কি আমার ফেরার অপেক্ষায় ছিলে!”
আকাশদীপ বিছানায় বসেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মঞ্জীরাকে গভীর আলিঙ্গন করল।
যেন নড়াচড়ার ক্ষমতাও হারিয়েছে মঞ্জীরা। সদ্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত দুর্বল এক পুরুষের আলিঙ্গন থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে আসা কঠিন নয়, তবু
মঞ্জীরা বুঝল সে পারছে না। কিছুতেই পারছে না রুগ্ণ লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।
আকাশদীপ বহু বছর পর বিস্মৃতপ্রায় এক নারীর স্পর্শ নিচ্ছিল। তার শরীরের ভিতর আড়মোড়া ভাঙছে বহু যুগ ঘুমিয়ে থাকা এক আদিম দৈত্য। অথচ এই সামান্য উত্তেজনাতেই তার বুক প্রবল ভাবে ধুকপুক করছে, হাত পা কাঁপছে একটু একটু। আকাশদীপ আরও কাছে টেনে নিল মঞ্জীরাকে। উন্মাদের মতো মুখ ঘষছে মঞ্জীরার পেটে, বুকে। জ্বোরো রোগীর মতো বিকারগ্রস্ত শোনাচ্ছে তার স্বর, “কত দিন মঞ্জি! কত দিন...কত দিন পর...”
১২
অনেক দিন এত মেঘ জমেনি। ভরা অঘ্রানে এমন মেঘের পসরা সহসা দেখা যায় না। গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারী মোড় পর্যন্ত যেন এক গুমোট আঁধারে ঢাকা। অথচ এখন ভরা বিকেল। হাজার দোকানপাটের বিকিকিনির ব্যস্ততায় মুখর হয়ে ওঠার কথা ছিল শহর কলকাতার।
তবু আজ সবেতেই বড় কিন্তু-কিন্তু ভাব। হাওয়া অফিস ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছে সন্ধের দিকে। ভিড়টাও তেমন জমে ওঠেনি, সন্ধে নামার আগে যেমন হয়।
কাচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরের শহর দেখছিল মঞ্জীরা। বিচ্ছিরি জ্যাম বেধে আছে। সেই জ্যামে আটকে পড়ে হাঁসফাঁস করছে একটা অ্যাম্বুল্যান্স। মেঘ করে এলে পথচারীদের হাঁটার বেগ বেড়ে যায়। তাদের কেউ কেউ বার বার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে পথ চলছে ফুটপাত ধরে।
আজ বেশ কয়েক মাস পরে এই কাফেটেরিয়াতে এল মঞ্জীরা। আসন্ন ঝড়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। বাইরের ঝড় দেখে সে এতটুকু বিচলিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ভিতরের যে ঝড় মনে চেপে রেখে দিন কাটাচ্ছে সে, এই ঝড় তার তুলনায় নেহাতই ছেলেমানুষ।
মঞ্জীরা ঘড়ি দেখল, আজ সে একটু আগেই পৌঁছে গেছে। কাফের এই সিটটা থেকে উত্তীয়র ব্যাঙ্কের ফ্লোরটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। বেলা পড়ে এসেছে, তবুও মানুষজন এখনও উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছে ব্যাঙ্কের লবি জুড়ে।
এর অর্থ, এখনও ব্যাঙ্কের কাজ ফুরোয়নি। উত্তীয় কি এখনও বেরোতে পারেনি অফিস থেকে?
চেনা ওয়েটার মঞ্জীরার কুশল জিজ্ঞেস করে গেল, “ভাল আছেন ম্যাডাম? অনেক দিন দেখি না। স্যর আসবেন তো?”
মঞ্জীরা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল।
আর বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, ‘স্যর’ হাজির হলেন।
প্রকৃতি তত ক্ষণে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে শুরু করেছে। মঞ্জীরা সোফায় হেলান দিয়ে বাজ পড়ার সংখ্যা গুনছিল, ঠিক তৃতীয় বাজটা দক্ষিণ দিকের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়ামাত্র লম্বা শরীরটা ব্যাগ কাঁধে ঢুকেছে কাফের দরজা দিয়ে।
উত্তীয়কে আসতে দেখে হঠাৎই মঞ্জীরার বুকের ভিতর একটা চিনচিন ব্যথা শুরু হল। কেন এই মানুষটা তাকে এত ভালবেসে ফেলল! হতে পারে মঞ্জীরা নিজেও ভালবাসার কাঙাল, কিন্তু সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে তো অর্ধেক পৃথিবীই ভালবাসার অভাববোধে ভুগছে। এত মেয়ের মধ্যে বেছে বেছে তার জন্যই পাগল হতে হল উত্তীয়কে?
একে দূরে সরিয়ে রাখা বিরাট সমস্যা। মঞ্জীরা নিজেকে চিনতে শেখার পর থেকেই একটু একটু করে লুকোতেও শিখেছে নিজেকে। কোনও ভাবেই যেন উত্তীয় তার ভিতরটা দেখতে না পায়। তবুও এই মুহূর্তে উত্তীয়কে হেঁটে আসতে দেখে তার মনে এক তীব্র মায়ার সঞ্চার হচ্ছে। অদৃশ্য সেই মায়াডোর পাকে পাকে বাঁধছে তাকে। মঞ্জীরা নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তীয়র মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হল।
উত্তীয় সামনের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ল, “উফফ! এই চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না। চাকরিটা আর মনে হয় রাখতে পারব না বুঝলে! সেই সকাল ন’টায় অফিসে ঢুকেছি, তার পর থেকে আর মাথা তোলার সময় পাইনি।”
মঞ্জীরা সহানুভূতির স্বরে বলল, “খাওয়া হয়েছে কিছু, না কি আজও লাঞ্চ স্কিপ করেছ?”
হাত নাড়ল উত্তীয়, “সে নমো নমো করে হয়েছে একটু। দাঁড়াও, কিছু অর্ডার করি।”
খাবার অর্ডার করল উত্তীয়, গুছিয়ে বসেছে তার পর। এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কমফর্ট জ়োন। যেটুকু সময় মঞ্জীরার সঙ্গে থাকে, সেটুকুই তার বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সময়।
এ সব নাটকীয় কথাবার্তা মঞ্জীরার সামনে বলা যায় না, মেনু কার্ড বন্ধ করতে করতে উত্তীয় বলল, “ধুস! আর এখানে আসব না। মনে আছে, আগের বার ঝাল কম দিতে বললেও ‘ড্রাগন চিকেন’ এ কেমন বিষ ঝাল দিয়েছিল! এ বার থেকে ভাবছি মিহিকার কাফেতেই বসব। ওদের কুক একটা মোগলাই পরোটা করে, দ্যাট’স রিয়েলি স্পেশাল। এক বার খেলে আর ভুলতে পারবে না।”
উত্তীয়র কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল মঞ্জীরা, তাকে হাসতে দেখে হাসছে উত্তীয়ও। হাসতে হাসতেই সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মঞ্জীরার দিকে। সে হেসে উঠলে উত্তীয়র মনের কোন গহীনে তোলপাড় হয়, তা কি কোনও দিন জানতে পারবে এই নারী? কী করে একে না দেখে যে এতগুলো মাস বেঁচে ছিল উত্তীয়!
হাসি ফুরোলে দু’জনেই চুপচাপ। আপাত ভাবে মনে হতে পারে তারা কথা খুঁজছে। সম্ভবত বিষয় অন্য রকম, বলার মতো কথা এত জমে গেছে যে, তারা কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
গ্লাসের জলে চুমুক দিয়ে উত্তীয় বলল, “তোমার হাজ়ব্যান্ড কেমন আছে?”
নড়েচড়ে বসল মঞ্জীরা। আজ উত্তীয়কে মুখ খুলতে দিলে চলবে না। এই ছেলে তাকে কথার তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, আজ মঞ্জীরা নিজের হাতে রাশ রাখতে চায়।
সে বলল, “কন্ডিশন আগের চেয়ে বেটার। ফিজ়িয়োথেরাপি চলছে। আসলে শরীরের বাঁ দিকটা ঝিনঝিন করা আর হাঁটার সময় ব্যালান্সের সমস্যা ছাড়া আর কোনও সমস্যা তো ওর নেই।”
উত্তীয় চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে মঞ্জীরার দিকে। বিষয়ের গভীরতা অনুধাবন করার চেষ্টা করছে খুব সম্ভব। তার দিকে এক বার তাকিয়ে নিয়ে আবার কথা শুরু করল মঞ্জীরা, “লাইফস্টাইলটাই ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা। এত অনিয়ম করত! বাড়ি থেকে দূরে থাকলে যা হয়, দেখার কেউ নেই, সকাল থেকে পার্টি পার্টি করে ছুটে বেড়াচ্ছে! দুপুরে একটু খেল কি না খেল আবার মিটিং, ছুটোছুটি। এত পোষায় না কি? এ রকম তো হওয়ারই ছিল। মানুষের শরীর আর কত অনিয়ম সইবে? তার ওপর নাগাড়ে স্মোকিং, ড্রিঙ্কস। আমি তো বলব ওর যা হয়েছে অল্পের ওপর দিয়েই গেছে।”
এক নাগাড়ে অনেক ক্ষণ বলে থামল মঞ্জীরা।
উত্তীয় প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, “যাকগে। দ্য ওয়র্স্ট ইজ় ওভার। এ বার থেকে সাবধানে
থাকলেই হল।”
যত দূর সম্ভব সহমর্মিতা গলায় ফুটিয়ে তুলে মঞ্জীরা বলল, “আর সাবধান! এতটুকু যদি নিজের যত্ন নেয়! আমি আর মা বলে বলে যেটুকু করিয়েছি। যা চেহারা হয়েছে! অত বড় চেহারাটা আজকাল আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না। ওই টকটকে ফর্সা গায়ের রং রোদে রোদে ঘুরে তামাটে।”
উত্তীয় অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, পলিটিক্স খুব খাটনির কাজ। দেশের সেবা বলে কথা।”
মঞ্জীরা যেন উত্তীয়র গলার স্বরে সামান্য শ্লেষের আভাস পেল, তবে পাত্তা দিল না। মনের জোর এনে ফাইনাল কথাটা বলেই ফেলল, “আর কী ছেলেমানুষি করছে জানো তো! একদম বাচ্চাদের মতো। ডাম্বোকে নিয়ে এসো, তুমি ফিরে এসো, সারা ক্ষণ ওই এক কথা।”
উসখুস করছে উত্তীয়, অধৈর্য স্বরে বলল, “বাহ! তা হলে তো তোমার আর চিন্তাই রইল না। বর খুব রেসপন্সিবল হয়ে উঠেছে বলো।”
মঞ্জীরা এ বারও খোঁটাটা গায়ে মাখল না, “না, তেমন কিছু নয়। ওকে নিয়ে খুব সমস্যা। আজ থেকে তো দেখছি না। সেই যখন বাড়িতে থাকত, তখনও এত নেগলিজেন্স ছিল নিজের প্রতি, তুমি জানো উত্তীয়, এক বার...”
“এক বার... হ্যাঁ এক বার ওই ভদ্রলোক ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলেন, তাই না?” চোয়াল শক্ত করে বলল উত্তীয়।
মঞ্জীরা যেন জানত এমন কথা উঠবেই। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “সেটা ও আমায় এক্সপ্লেন করেছে। আকাশ আমার জন্য ওরিড ছিল উত্তীয়। আসলে ওর নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক এটা ও চায়নি। অ্যাট লিস্ট ও এ ভাবেই পোর্ট্রে করতে চাইছে ব্যাপারটা। মানে, ওর ইনটেনশনটা খারাপ ছিল না, এই আর কী!”
“আর সেই লোকই এখন চাইছে তুমি ছেলে নিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে ঘরকন্না করো, তাই তো?”
মঞ্জীরা নীরবে মাথা নাড়ল।
খাবার দিয়ে গেছে ওয়েটার। ওদের পছন্দের মেনু। আগে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু’জন অনেক গল্প করত, চলত কত না খুনসুটি, কখনও কখনও নিবিড় অনুরাগের মুহূর্তে উত্তীয়র মুখে কাঁটা চামচে করে ফ্রাই তুলে দিত মঞ্জীরা।
আজ ছুরি দিয়ে ফিশ ফ্রাই কেটেছে উত্তীয়, ধোঁয়া উড়ছে কাটা জায়গা থেকে। উত্তীয় খাবার মুখে তুলেছে। এই অবস্থায় এত গরম খাবার মুখে তোলা সম্ভব নয় তবুও দ্রুত চিবোচ্ছে, ফুঁ ছাড়তে ছাড়তে যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে বলল, “তার পর? কবে যাচ্ছ তা হলে?”
মঞ্জীরা নীরব রইল, ধীর হাতে কফি কাপ টেনে নিয়েছে কাছে। মন দিয়ে স্যাশে থেকে চিনি ঢালছে ধূমায়মান কফির পেয়ালায়। উত্তীয় গপগপিয়ে ফিশ ফ্রাই খাচ্ছে, যেন আগামী এক মিনিটের মধ্যে তাকে এই ফ্রাই শেষ করার বরাত দেওয়া হয়েছে। সে খাবার চিবোতে চিবোতে বলল, “কী হল? বলো? বলা যাবে? না কি এটা টপ সিক্রেট বিটউইন হাজব্যান্ড ওয়াইফ?”
ইচ্ছে করেই গা জ্বালাচ্ছে উত্তীয়, সম্ভবত নিজেও জ্বলে পুড়ে মরছে বলেই। মঞ্জীরা বড় করে শ্বাস নিল। সব জেনেবুঝেই তো এখানে এসেছে সে। বলল, “দেখা যাক। নেক্সট উইক নাগাদ, সম্ভবত শুক্রবার, পরের দু’দিন ডাম্বোর ছুটি, শিফট করতে সুবিধে হবে।”
উত্তীয়র হঠাৎ শরীর ছেড়ে দিয়েছে। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝেই তার গলা কেঁপে যাচ্ছে। তার সামনে যা যা ঘটছে, তা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
এই সামনে বসা মেয়েটিই কি ছেলের হাত ধরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লড়াই শুরু করেছিল! এই মেয়েটিই কি সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন বাড়িয়ে চলেছিল! এই কি সেই মেয়ে যাকে উত্তীয় ভালবেসেছিল! ভালবাসে! পৃথিবীতে অন্য আর যে কারও থেকে বেশি, যে কোনও কিছুর চেয়ে বেশি করে চায় যাকে উত্তীয়। এত বারের দেখায়, এই নিবিড় পরিচয়ে এক বারের জন্যও মঞ্জীরাকে অন্যের বৌ ভাবতে পারেনি সে। কেন? মঞ্জীরাকে নিজের করে পাওয়ার গোপন ইচ্ছেটুকুর জন্য? না কি মঞ্জীরাকে কারও স্ত্রী নয়, বরং শুধুই তার স্বপ্নের নারী হিসেবে ভালবেসেছিল উত্তীয়!
আজ হঠাৎ অভিরাজের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে তার, আকাশদীপ প্রসঙ্গে সে দিনও মুখে আঁধার ঘনিয়েছিল অভিরাজের: “ইজ় শি স্টিল ইন লাভ উইথ দ্যাট ম্যান?”
মঞ্জীরা একদৃষ্টে উত্তীয়র দিকে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষণ। তার পর একটু কাছে সরে এল। হালকা ছুঁয়েছে তার হাত, “উত্তীয়, যে দিন প্রথম আমায় দেখেছিলে সে দিনের কথাটা এক বার ভাবো। কোনও এক্সপেক্টেশন ছিল না কারও। সেখান থেকে কী সুন্দর একটা ফ্রেন্ডশিপ ডেভলপ করে গেল, আমরা ভাবতেও পারিনি। আসলে যেখানে কোনও এক্সপেক্টেশন থাকে না, সেখান থেকেই অপ্রত্যাশিত ভাবে অনেক কিছু পেয়ে যাই আমরা।”
উত্তীয় কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে, তার অস্থির ভাব বাড়ছে একটু একটু করে।
মঞ্জীরা আবার বলল, “এই পাঁচটা বছর ডাম্বোকে নিয়ে বড় করে তোলার সময়টা আমায় ঘিরে ছিলে তুমি। সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটা সময়। এটাই সব কিছু উত্তীয়। আমি তো আগেও বলেছি, বিয়ে ইনস্টিটিউশনটার ওপর আমার খুব যে শ্রদ্ধা আছে তা নয়। বিশ্বাস করো, এক বছরে পুরনো হয়ে যাবে সব। দু’জন দু’জনকে সহ্য করতে পারব না। এখন যে ভাবে মুখিয়ে থাকি এক বার দেখা হওয়ার জন্য, সে সব কিচ্ছু থাকবে না। তার থেকে এ-ই ভাল নয়? আমি যার কাছেই থাকি না কেন, সব সময় শুধু তোমায় নিয়েই থাকব। এটুকু বিশ্বাস নেই আমার ওপর উত্তীয়? জানো তো, তোমার থেকে কাছের আর কেউ নেই আমার।”
বাইরের জমাট বাঁধা মেঘ গলতে শুরু করেছে, কাফের ভিতর সুন্দর যন্ত্রসঙ্গীতে রবি ঠাকুর বাজছে, বাইরের হাওয়ায় শোঁ-শোঁ শব্দ আর বৃষ্টির অশ্বারোহীদের তেজ এখানে থেকে বোঝা যাচ্ছে না।
মঞ্জীরার গলার কাছটা জ্বালা করে উঠল, সে বলল, “ডাম্বো আর মিহিকার ওপর তোমার প্রভাব সাঙ্ঘাতিক ভাবে পড়েছে। তুমি ওদের জীবনে মস্ত জায়গা নিয়ে নিয়েছ। কিন্তু এটাও ভাবো, ওরা তোমাকে কোচ, মেন্টর হিসেবে চেয়েছে শুধু, নট নেসেসারি যে আমার হাজ়ব্যান্ডের পার্টেও ওরা তোমায় মেনে নেবে। তুমি বুঝতে পারছ উত্তীয়?”
উত্তীয় তবু নির্বাক, কথা সরছে না তার মুখে।
মঞ্জীরা আরও কাছে ঘেঁষে এল তার, কনুই জড়িয়ে ধরেছে উত্তীয়র, “প্লিজ় উত্তীয়, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি। আমি শুধু ডাম্বোর জন্য ফিরছি। তুমি তো জানো কী প্রচণ্ড স্ট্রেস বয়ে নিয়ে বেড়ায় বাচ্চাটা। আমার আর কী বলো? প্রায় ফুরিয়ে এলাম। ডাম্বো যদি ক’দিন বাবাকে পায়...”
উত্তীয় চোখ তুলে তাকিয়েছে হঠাৎই, চোখাচোখি হয়ে চোখ সরিয়ে নিল মঞ্জীরা। কার কাছে জবাবদিহি করছে সে! নিজের কাছেই নিজে আবরণহীন হয়ে পড়ছে না কি?
ওই ঘিয়ে রঙের বাড়ি, ওই ঘরটা, ওই লাল মেঝের বারান্দা, ওই ছাদের বোগেনভিলিয়া আর রান্নাঘরের তাকে থাকা হলুদ-চিনির কৌটোগুলোয় একটা বড় সময় ধরে মিশে ছিল মঞ্জীরা।
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, সে আজও নিজেকে সেই বাঁধন থেকে আলাদা করতে পারেনি। কিছু বন্ধন আশৈশব সংস্কারের, মনের অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দেয় অজান্তেই। সেই শিকড় উপড়ে ফেলা সহজ নয়।