মহাত্মা: মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। ছবি সৌজন্য: গেটি ইমেজেস
ডাক্তার আপনাকে চিপস-প্যাটিস, কোল্ড ড্রিঙ্কস বারণ করেছেন? রেড মিট কিংবা সর্ষে-ইলিশও চলবে না? দুঃখ করবেন না। গাঁধীজির কথা স্মরণ করুন, মনোবল বৃদ্ধি পাবে। না, গাঁধীজির রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করার কথা বলছি না। ভদ্রলোক স্বাস্থ্যচর্চা ও ডায়েটিং নিয়ে এমন সব বই লিখে গিয়েছেন এবং সারা জীবন নিজেকে নিয়ে যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, শুনলে চমকে যাবেন। তাঁর আত্মজীবনীতে যেমন সত্য ও অহিংসা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তেমনই তাঁর ‘কি টু হেল্থ’, ‘মরাল বেসিস অব ভেজিটেরিয়ানিজ়ম’, ‘লন্ডন ডায়েরি’ এ সব বইগুলোয় স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভূরি ভূরি পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন।
মহাত্মা গাঁধী ছিলেন খাঁটি গুজরাতি নিরামিষাশী। লন্ডনে পড়তে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, লন্ডনে গিয়েও আমিষ ছোঁবেন না। অনেকে তাঁকে ভয় দেখালেন, সাহেবের দেশে গেলে মদ-মাংস না খেয়ে থাকা অসম্ভব। লন্ডনে পৌঁছে লন্ডন ঘেঁটে নিরামিষ রেস্তরাঁ খুঁজে বার করলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন, সাহেবদের মধ্যে নিরামিষ খাওয়া নিয়ে বেশ চর্চা শুরু হয়েছে। হেনরি সল্ট সাহেব নিরামিষ খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে বই-টই লিখে প্রায় আন্দোলনই শুরু করে দিয়েছিলেন। গাঁধীজি ‘ভেজিটেরিয়ান সোসাইটি’-র মেম্বার হলেন এবং সেখানে হাজিরা দিতে শুরু করলেন।
গাঁধীজি গরু-মোষের দুগ্ধপান পছন্দ করতেন না। বন্ধু কালেনবাখ এক বার বলেই ফেললেন, তা হলে দুধ খাওয়া ছেড়ে দিন! তা ছাড়া, সেই সময়ে গোয়ালারা যন্ত্রণাদায়ক ‘ফোঁকা’ পদ্ধতিতে গরু-মোষের অতিরিক্ত দুধ দুইয়ে নিত। সেই জন্য তাঁর মনে একটা কষ্ট ছিল। তিনি মনে করতেন, মাতৃদুগ্ধ ছাড়া অন্য দুধ না খাওয়াই উচিত। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর গরু-মোষের দুধ খাবেন না। কিন্তু খেদা আন্দোলনের সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তারের পরামর্শ, দুধই তাঁকে বাঁচাতে পারে। গাঁধীজির প্রতিজ্ঞার কথা শুনে ডাক্তার বললেন, প্রতিজ্ঞা তো গরু-মোষের দুধ না খাওয়ার, ছাগলের দুধে অসুবিধে কী! দ্বিধাগ্রস্ত মহাত্মা অগত্যা ছাগলের দুধেরই শরণাপন্ন হলেন। যদিও নীরদ সি চৌধুরী বলেছেন, ‘কামজ উত্তেজনা হয় বলিয়া মহাত্মাজি গাই এর দুধ খাইতেন না, ছাগীর দুধের সঙ্গে রসুন মিশাইয়া খাইতেন।’
১৯৩৭ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং। গাঁধীজি অতিথি হয়ে উঠলেন কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর বাড়িতে। গাঁধীজির ডায়েট রক্ষার জন্য সবাই ব্যতিব্যস্ত। তিনি রোজ নানা রকম শাক খেতেন। শরৎ বসুর বাড়ির ফ্রিজ শাকে ভরে উঠল। আর উডবার্ন পার্কে শরৎ বসুর বাড়ির বাইরে কুড়িখানা ছাগল এনে হাজির করা হল। নীরদবাবু ঠাট্টা করে বলেছেন, গাঁধীজির ব্যক্তিগত সচিব, স্বয়ং মহাদেব দেশাই নির্বাচন করলেন কোন ছাগল মহাত্মাজির দুধ-মা হবেন— ‘মহাদেব দেশাই আসিয়া গম্ভীরমুখে একটি একটি করিয়া ছাগীর দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করিলেন, এবং যে-ছাগী তাঁহার সেই দৃষ্টিতে চক্ষু নত করিল তাহাকে অসতী বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিলেন। একটিমাত্র ছাগী তাহা না করিয়া কটকট করিয়া তাঁহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল, সেটিই নির্বাচিত হইল।’
গাঁধীজি বলতেন, আমাদের শরীরে যতটুকু চাই, তা-ই খাওয়া উচিত। স্বাদের জন্য নয়, পেট ভরার জন্যই খাওয়া দরকার। বাঁচার জন্য খাওয়া, খাওয়ার জন্য বাঁচা নয়। তিনি অল্প বয়সে লোভে পড়ে খেতেন বলে পরে আক্ষেপ করেছেন। পরবর্তী জীবনে স্বাদের ব্যাপারে এতটাই উদাসীন হয়ে পড়লেন যে, সেদ্ধ তরকারিতে দুর্গন্ধ ইস্ট পাউডার মিশিয়ে নির্বিকার খেয়ে যেতেন। হাই প্রেশার কমানোর জন্য নিয়মিত রসুন খেতেন। লবণ আইন ভঙ্গকারী গাঁধীজি অতিরিক্ত নুন খেতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের খাদ্যের মধ্যেই নুন আছে, তাই অতিরিক্ত নুন নিষ্প্রয়োজন। চিনির বদলে গুড় খেতে বলতেন। তিনি বরাবরই ছিলেন চা, কফি ও মদ্যপানের বিরোধী। বহু ইউরোপীয় ডাক্তারের স্বাস্থ্যবিষয়ক বই পড়ে সেখান থেকে উদ্ধৃতি তুলে তাঁর ‘লন্ডন ডায়েরি’ বইটিতে চা-কফি-মদ-তামাকের অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছেন। ডারবানে থাকাকালীন গাঁধীজি মিলের আটার রুটি নয়, হাতে ঘোরানো জাঁতায় ভাঙা আটার রুটি খেতেন। এই জন্য তিনি একটা জাঁতাও কিনে নিয়ে এসে, নিজেই আটা তৈরি শুরু করলেন। বলতেন, গমজাত খাবার (রুটি) এবং ফলমূল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তবে বিলেতের মিহি ময়দা না খাওয়াই ভাল। এটা একেবারেই অপুষ্টিকর।
গাঁধীজি উপবাসের অভ্যেসকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অনশনের সময়। নিয়মিত একাদশী ও জন্মাষ্টমীতে উপবাস করতেন। শুধু ধর্মীয় কারণেই নয়, এর মধ্যে ডায়েটিংয়ের চিন্তাও কাজ করত। বর্তমানে চিকিৎসাবিদ্যায় উপবাসের মাধ্যমে শরীরকে সতেজ ও নীরোগ রাখার পদ্ধতির নাম অটোফেজি থেরাপি, যে থিয়োরির জন্য ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পেলেন। গাঁধীজির ডায়েটিংয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মিলেমিশে একাকার। তিনি ম্যানচেস্টারের ‘নো ব্রেকফাস্ট আ্যাসোসিয়েশন’-এর কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু দিন প্রাতরাশ বন্ধ করলেন। ম্যাজিকের মতো দীর্ঘ দিনের মাথাযন্ত্রণা কমে গেল!
একটা সময় তিনি শুধু ফলের উপর নির্ভর করা শুরু করলেন। বললেন, শস্যজাত খাবার ছাড়া শুধু ফল খেয়েও থাকা যায়। ১৯৪৫ সালে গাঁধীজি যখন বাংলায় এলেন, নির্মলকুমার বসু তাঁর খাবারের যে তালিকা দিয়েছেন তা সত্যিই চমকপ্রদ। ভোর সাড়ে পাঁচটায় মুসাম্বি বা কমলালেবুর রস, সকাল সাতটায় ছাগদুগ্ধ ও ফলের রস, বেলা বারোটায় ঘন ছাগদুগ্ধ, সেদ্ধ তরকারি আর কাঁচা ধনে বা পালং শাক পাতা, বেলা আড়াইটেয় ডাবের জল, বিকেল পাঁচটায় ঘন ছাগদুগ্ধ ও দুধে সেদ্ধ করা খেজুর, সঙ্গে সামান্য কিছু ফল। নির্মলকুমার বসু বলছেন, মাঝে মাঝে তালিকার সামান্য পরিবর্তন হত। নোয়াখালি জেলার শ্রীরামপুরে যখন ছিলেন, এর সঙ্গে থাকত পেঁপে, মধু, গুজরাতের কড়কড়ে খাকরা রুটি ইত্যাদি। তাঁর জন্য ছোট কুকারে রান্না হত। সব আনাজ-তরকারি কুরুনিতে কুরে শিলে বেঁটে একটা মণ্ড পাকিয়ে সেদ্ধ করতে দেওয়া হত। নির্মলকুমার বসু লিখছেন, ‘তাহাতে নুন, মশলা অথবা তেল কিছুই থাকিত না, গাঁধীজি তেল আদৌ খাইতেন না।’ নোয়াখালিতে থাকাকালীন যখন দেখা গেল খাকরা রুটি বাঙালিরা পছন্দ মতো তৈরি করতে পারছে না, তখন ‘তিনি খড়ম পরিয়া খটখট শব্দ করিয়া রান্নাঘরে উপস্থিত হইলেন এবং চাকি-বেলুন লইয়া পরিপাটিভাবে খাকরা বেলিতে আরম্ভ করিলেন।’
সুতরাং ডায়াবিটিস বা ভুঁড়ি নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। গাঁধীজি আপনার সামনেই আছেন, তাঁকে নির্ভয়ে অনুসরণ করুন।