ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
রাজাং নদী ধরে উজানের দিকে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। বড়-বড় ঢেউ আর ছোট-ছোট ঘূর্ণির ধাক্কায় থরথরিয়ে কেঁপে, লাফিয়ে, বেঁকে, পাশ কাটিয়ে— ঘণ্টায় বিশ মাইল বেগে। স্রোতের টানে বড়-বড় গাছের গুঁড়ি স্পিডবোটের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। ওত পেতে আছে কুমির। আরোহীরা প্রাণ হাতে করে বসে।
দু’পাশে ঘন জঙ্গল, ফাঁকে-ফাঁকে রবারের বাগান। স্পিডবোটে আরোহী পাঁচ জন। বোটের মালিক আর চালক, এক চিনে ফিল্ম কোম্পানির দুই ম্যানেজার মিস্টার চং আর মিস্টার চিন। আর এক বাঙালি।
বাঙালি ভদ্রলোকটিকে আগের বছরেই বোম্বাই (এখনকার মুম্বই) থেকে সিঙ্গাপুরে মালে ফিল্ম স্টুডিয়োর ‘ক্রিয়েটিভ হেড’ করে এনেছেন ‘মালয় ফিল্ম প্রোডাকশন’-এর কর্তা রান রান শ। এবং দিন দুয়েক আগে ডেকে বলেছেন— যান না মিস্টার মজুমদার, এক বার দেখে আসুন না, ইবানদের জীবন নিয়ে বোর্নিয়োয় একটা ছবি করা যায় কি না!
নরমুণ্ড শিকারি ইবানদের নিয়ে ছবি! সে যে কেউ পারেনি!
বোর্নিয়োর গহনে ইবানদের ডেরায় পা রাখা আর মুন্ডু বাজি রাখা একই ব্যাপার। অন্তত একটা মুন্ডু কেটে নিয়ে না এলে তাদের মেয়েরা যে পাণিপ্রার্থীকে পুরুষ বলে গণ্যই করে না! ব্রিটিশের প্রজা হয়ে মুন্ডু কাটার অভ্যেস ইদানীং কমেছে ঠিকই, কিন্তু এক বার শত্রু ঠাউরে বসলেই সর্বনাশ!
পরিচালকমশাই করেনই বা কী? এ প্রস্তাব তো তাঁর নিজেরই। বিদেশি কিছু লেখাপত্তর দেখে প্রযোজক মশাইও বুঝেছেন, বানাতে পারলে এ ছবির বাজার আছে। অতএব বেরিয়ে পড়তে হয়েছে ফরিদপুরিয়া ফণী মজুমদারকে।
১৯৫৬ সাল। এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের মালয় উপদ্বীপ তখনও ব্রিটিশের হাতে। উপদ্বীপের শেষে সমুদ্রে ভাসমান এখনকার দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরও তা-ই। তার পূর্বে, দক্ষিণ চিন সাগরে এশিয়ার বৃহত্তম দ্বীপ বোর্নিয়ো। পেট চিরে চলে গিয়েছে বিষুবরেখা। বছরভর গ্রীষ্ম আর অফুরন্ত বৃষ্টি এখানে জন্ম দিয়েছে গহন অরণ্যের। কথিত, ‘বোর্নিয়ো’ কথাটাই নাকি এসেছে জল-বৃষ্টির দেবতা বরুণের নাম থেকে। নিরন্তর বর্ষণস্নাত সেই অরণ্যে বিচিত্র অর্কিড আর ফুলের মেলা। জলে, ডাঙায়, গাছে-গাছে রকমারি পশুপাখি। দ্বীপের উত্তরে, বোর্নিয়োর চার ভাগের এক ভাগ জুড়ে মালে জাতি অধ্যুষিত দুই রাজ্য, সারাওয়াক আর সাবা।
ফণী মজুমদারই প্রথম নন, যাঁকে মালয়ের ছবিওয়ালারা ভারত থেকে ডেকে এনেছে। তাঁর আগে কলকাতা থেকে এসেছেন বি এস রাজহংস, তামিলনাড়ু থেকে বি এন রাও, মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) থেকে এল কৃষ্ণণ বা এস রমানাথনেরা। তাঁদের নির্দেশনায় মালে আর চিনে অভিনেতা-কলাকুশলীরা ক্রমশ চেহারা দিচ্ছেন সে দেশের চলচ্চিত্রকে। কিন্তু প্রায় সকলের বিরুদ্ধেই এক অভিযোগ, ছবিগুলো যেন বড্ড ‘ভারতীয়’।
নাচগান তো বটেই, গল্পের প্লটও জনপ্রিয় বোম্বাইয়া ফিল্ম থেকে টোকা। মালয়ের মানুষের রুচি, সংস্কৃতি সেখানে প্রতিফলিত হয় না।
বছর তেতাল্লিশের ফণীর কাছে যখন মালয়যাত্রার আমন্ত্রণ এল, তত দিনে তিনি হিন্দিতে খান বাইশ ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। গোড়ায় ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার স্টেনোগ্রাফার, তাঁর সঙ্গেই নিউ থিয়েটার্সে ঢোকা। ‘দেবদাস’, ‘মুক্তি’, ‘গৃহদাহ’ ছবিতে ছিলেন প্রমথেশের প্রথম সহকারী। ১৯৩৮ সালে নিউ থিয়েটার্স থেকেই তাঁর প্রথম ‘ডাবল ভার্সন’ ছবি। বাংলায় ‘সাথী’, হিন্দিতে ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। কে এল সায়গল-কানন দেবী জুটি। রাইচাঁদ বড়ালের সুরে সায়গলের গলায় ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়ে’ সুপারহিট। আর থামতে হয়নি। একের পর এক ছবি, গায়িকা-নায়িকা লীলা দেশাইয়ের বোন মণিকার সঙ্গে বিয়ে, বোম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠা। কিন্তু মালয়ের আমন্ত্রণে আরও বড় হাতছানি ছিল।
অভিযাত্রী: ফণী মজুমদার।
১৯৫৬-র অক্টোবরে ফণীকে ডেকে পাঠিয়ে বিমানের টিকিট ধরিয়ে দিলেন রান রান শ। সিঙ্গাপুর থেকে বিমানে সারাওয়াকের রাজধানী কুচিং, সেখান থেকে আর এক শহর সিবু। ছোট্ট শহর। স্পিডবোট রওনা দিল সেখান থেকেই। বিকেলে বোট থামল কানোয়িত শহরে। চিনে রেস্তরাঁয় কফি খেয়ে ফণী হাঁটতে বেরিয়েছেন, দেখেন ইবান মেয়েদের একটি দল চলেছে। কোমর থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা, বাকিটা অনাবৃত। সরল উন্মুক্ত তাদের সৌন্দর্য। প্রথম মোলাকাতেই ফণী কাত!
একটা দোকানের মশা, ইঁদুর, আরশোলা ঠাসা নোংরা ছাদের ঘরে কোনও মতে রাত কাটিয়ে পর দিন ভোরে ফের ভেসে পড়া। কোম্পানির জমানায় ব্রুক রাজাদের গড়া সং শহর ছুঁয়ে কাপিত। সেখানেই একটা হোটেলে ফণীদের থাকার ব্যবস্থা। কাপিতেই নগরের শেষ। এ বার রাজাংয়ের রাজপথ ছেড়ে ধরতে হবে শুঁড়িপথ— রাজাং থেকে বেরিয়ে যাওয়া উপনদী সুংগাই আমাং। কিন্তু তাতে স্পিডবোট যাবে না। কাপিতের পর থেকেই নদীখাত উঁচুনিচু পাথরে ভরা, অবিশ্বস্ত, তায় ঘূর্ণিপাক। জলের এলোমেলো স্রোত বাঁচিয়ে, দু’একটা ছোট ধাক্কা সহ্য করেও সে পথে যেতে পারে এক মাত্র গাছের গুঁড়ি কুঁদে মোটর লাগানো নৌকো ‘টেমাই’।
পরের দিন ফুট চল্লিশ লম্বা একটা টেমাইয়ে বোঝাই হল কাঁড়ি-কাঁড়ি চিনে মদ, বিস্কুট, সিগারেট। এই সবই ইবান সর্দার ‘পুঙ্গুলু’র জন্য ভেট। হালে আর সামনের গলুইয়ে দু’জন স্থানীয় ইবান। সামনের জন নাকি স্রোতের নাড়ি চেনেন। তীক্ষ্ণ নজরে জলের দিকে চেয়ে হাতের ইঙ্গিতে তিনি পিছনের জনকে নানা নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁর অবিন্যস্ত চুল পিঠে ছড়িয়ে, মাথায় ঝুড়ির মতো টুপি, তাতে একজাতীয় ধনেশ পাখির পালক। কাপিত থেকে মাইল দশেক উজানে একটা বাঁক নিয়ে সুংগাই আমাঙে ঢুকে পড়ল টেমাই। আর খানিক এগোতেই ফণীর মনে হল, যেন স্বপ্নরাজ্য! দু’পাশে ঝুঁকে রয়েছে বিশাল সব গাছ, বাঁকে-বাঁকে ফুল আর অর্কিডের চোখ-ধাঁধানো রংবাহার।
এক সময়ে টেমাই গিয়ে থামল ইবানদের একটা লং হাউসের কাছে। ‘লং হাউস’ (ইবান ভাষায় ‘রুমাহ্ পাঞ্জাং’) মানে মাটি থেকে প্রায় আঠারো ফুট উঁচুতে সার-সার খুঁটির উপরে বাঁশ আর কাঠের তৈরি গোটা একটা গ্রাম। সামনে টানা বারান্দা। তার পর ছাদ, ছাদের নীচে ফুট দুয়েক উঁচু বেড়া তোলা ভিতর-বারান্দা। তার পিছনে সার-সার ঘর আর লাগোয়া রান্নাঘর— প্রতিটি পরিবারের জন্য এক জোড়া। বাসিন্দাদের বেশি সময় কাটে ওই ভিতর-বারান্দাতেই। সেটাই তাঁদের বৈঠকখানা। নীচ থেকে বারান্দায় ওঠার জন্য সম্বল খাড়া করে বসানো খাঁজ-কাটা গাছের গুঁড়ি, প্রায়ই বৃষ্টির জল-কাদায় পিছল। এমন করে গড়ার উদ্দেশ্য একটাই, যাতে শত্রু হঠাৎ হামলা চালাতে না পারে।
বুড়ো সর্দার পুঙ্গুলু কুলে এ রকম বারোটি লং হাউসের প্রধান। তাঁর চুল মাথার উপরে ঝুঁটি করে বাঁধা, পরিধানে অন্য পুরুষদের মতোই শুধু নেংটি। হাতের পিছনে কব্জি থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত নীল উল্কি চিহ্নিত। ইবানদের নিয়ম হল, কেউ একটি নরমুণ্ড শিকার করতে পারলে সে আঙুলের একটি গাঁটে উল্কি আঁকাতে পারবে। বীরত্বের নিশান! সেই নেশায় ইবান যুবকেরা ব্লো-পাইপ হাতে কোমরে পারাং (ভোজালি) ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। লক্ষ্য নাগালে এলেই ব্লো-পাইপ থেকে ছুটে যেত ইপো গাছের বিষ-রস মাখানো শজারুর কাঁটার মতো তির। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ত শিকার। তখন পারাং দিয়ে কুচ করে মুন্ডুটা কেটে নিলেই হল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোর্নিয়োর দখল নিতে এসে কম জাপানি এ ভাবে মুন্ডু খোয়ায়নি।
কিন্তু পুঙ্গুলু কুলের ব্যাপারই আলাদা। উল্কি তাঁর আঙুলে আঁটেনি, গড়িয়ে এসেছে কব্জি অবধি! বহু কসরত করে গুঁড়ি বেয়ে উঠে তাঁর সামনে দাঁড়াতেই এক তরুণী এক গ্লাস ফিকে-হলদে ‘তুয়াক’ এনে ফণীর সামনে ধরল। তুয়াক হল চালের চোলাই, যেমন আমাদের ধান্যেশ্বরী বা ধেনো। একে বিদঘুটে গন্ধ, তায় ফণীবাবু বিশুদ্ধ চা-পায়ী। পাশ থেকে চং ইশারা করলেন, কাঁধের উপর দিয়ে তরলটা পিছনে ফেলে দিতে। ফণী তা-ই করলেন। আসলে ইবানেরা বিশ্বাস করে, অতিথি বাড়িতে এলে তাঁর পিছু-পিছু অদৃশ্য প্রেতাত্মা আসে, সে ভাল হোক বা মন্দ। তাকে তুষ্ট করতেই ওই তুয়াক দেওয়া।
সে যাত্রায় ফাঁড়া তো কাটল, কিন্তু সন্ধ্যায় আরও বড় ফাঁড়া অপেক্ষা করছিল। শোনা গিয়েছিল, লং হাউসের সকলে কাজ থেকে ফিরে এলে সন্ধ্যায় অতিথিদের সম্মানে নাচ-গান, খানাপিনা হবে। আর তখন এক তরুণী তাঁকে নিজের হাতে তুয়াক খাওয়াবেই!
বিষুবসূর্য বৃষ্টিঅরণ্যের খোঁপার ভিতরে সেঁধিয়ে যেতেই লং হাউসের ভিতর-বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল। সবাই জড়ো হয়েছে। এ বার বাজনা বেজে উঠবে আর শুরু হবে যুদ্ধের নাচ, মুণ্ড শিকারের নাচ, বাঁদর নাচ। ফণী আর চং এসে বসতেই দু’জন তরুণী এগিয়ে এল। ঝকঝকে তাদের কটিবস্ত্র, গলায় রংবেরঙের মালা। এই সন্ধ্যায় তারা দুই অতিথির ‘আজ্ঞাপালিকা’। এক তরুণী হাঁটু গেড়ে ফণীর সামনে বসে তুয়াক হাতে ঢিমে লয়ে ধরল ‘পানতুন’ গান। আর গান শেষে ফণীর ঠোঁটের কাছে তুলে ধরল পেয়ালা। ফণী চোরা চোখে পুঙ্গুলুর দিকে চেয়ে গ্লাসটি ছুঁয়ে ইবান ভাষায় স্পষ্ট বলে উঠলেন— ‘নিরোপ’। মানে, ‘তুমি পান করো’। মেয়েটি অবাক। সে গ্লাস নামিয়ে নিজের ঠোঁটে ঠেকাল আর তৎক্ষণাৎ ফণী এক হাতে তার মাথা চেপে ধরে অন্য হাতে পুরো গ্লাসের তুয়াক তার গলায় ঢেলে দিলেন। মেয়েটি হতবাক! এক ঢোকে তাকে খাইয়ে দিতে না-পারলে এই তুয়াক যে গিলতেই হবে, সেই রীতি পুঙ্গুলু এই ভিন্দেশিকে শিখিয়ে রেখেছেন, তা সে জানবে কী করে? খানিক তফাতে বসে পুঙ্গুলু তখন মুচকি হাসছেন। বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। এ বার শুটিংয়ের প্রস্তুতি।
পুঙ্গুলুর থেকে বিদায় নিয়ে সিঙ্গাপুরে ফিরে এলেন ফণী। সব শুনে কর্তা উচ্ছ্বসিত। ফণীর ইচ্ছে ছিল সাদা-কালো ছবি করা। রঙিন ছবি করতে যত আলো, জেনারেটর, বিদ্যুৎ লাগবে, তার বন্দোবস্ত করা লং হাউসে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কর্তা শুনতে নারাজ। তাঁর একটাই কথা, ছবি রঙিনই হবে, তাতে খরচ বাড়ে তো বাড়ুক।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে চিত্রনাট্যের খসড়া লিখে ফেললেন ফণী। এক শ্বেতাঙ্গ যুবক আর ইবান তরুণীর প্রেমের গল্প, যাকে ঘিরে ইবানদের জীবনটা ছবিতে বেঁধে ফেলা যায়। নতুন ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি কেনার ব্যবস্থা হল। নায়ক আর ডিস্ট্রিক্ট অফিসার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দু’জন শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাকে নেওয়া হল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাধা দিতে শুরু করল। নানা অসুবিধের কথা বলে নিরস্ত করার চেষ্টা হল। কিন্তু শ’সাহেবও নাছোড়।
বোর্নিয়ো যাওয়ার দিন ঠিক হল ১৮ ডিসেম্বর। ঠিক তিন দিন আগে বেশির ভাগ কলাকুশলী বেঁকে বসলেন। তাঁরা এই ঝুঁকি নিতে রাজি নন। ফণী বললেন, পরোয়া নেই, সিবু থেকে লোক জোগাড় করে শিখিয়ে-পড়িয়ে কাজ চালিয়ে নেবেন। সিঙ্গাপুর থেকে বিমানে চড়লেন মাত্র সাত জন। দুই সাহেব অভিনেতা, চিত্রগ্রাহক ও ব্যবস্থাপক সেই দলে ছিলেন, কিন্তু কোনও শব্দগ্রাহক বা মেকআপ আর্টিস্ট রইলেন না।
পুঙ্গুলু কুলের লং হাউসের কাছেই একটা ছোট লং হাউস তৈরি হল শুটিং-দলের থাকার জন্য। শুটিংয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে জাহাজ এসে পৌঁছল ২৪ ডিসেম্বর। সিবুর কয়েকটি ছেলেকে যন্ত্রপাতি চালানোর তালিম দিয়ে নেওয়া হল দিন তিনেক। ব্রিটিশ রেসিডেন্টের কাছে চেয়েচিন্তে এক দিনের জন্য একটা সরকারি লঞ্চ পাওয়া গেল। ২৭ ডিসেম্বর দিনটা ছিল ঝলমলে। প্রথম দিনের শুটিং হয়ে গেল।
বর্ষশেষের রাতে সকলে কাপিতে। একটা নৌকো ভাড়া করে রওনাও হওয়া গিয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে সুংগাই আমাং গিয়েছে শুকিয়ে। কয়েক টন ওজনের জেনারেটর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কাপিতেই দিন তিনেক শুট করা হল। কিন্তু আর তো বসে থাকা যায় না। শেষে এক ইবানের পাহারায় জেনারেটর রেখে ছোট-ছোট নৌকোয় বাকি যন্ত্রপাতি চাপিয়ে ফণীরা রওনা হয়ে গেলেন। জনা পঞ্চাশ লোক সুংগাইয়ের কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর-জলের মধ্যে দিয়ে নৌকোগুলোকে টেনে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিল লং হাউসে। জেনারেটর না পৌঁছনো পর্যন্ত শুটিং শুরু করা যাবে না। তার মধ্যে বাকি প্রস্তুতি সেরে ফেলতে হবে। নতুন ছেলেদের আরও তালিম দিতে হবে। দুই সাহেব ছাড়া সব অভিনেতাই হবেন ইবান বা স্থানীয় লোক। তবে সবচেয়ে বড় কাজ, নায়িকা ‘লুলি’-কে খুঁজে বার করতে হবে।
ছবির গল্পে সর্দারের মেয়ে লুলি জলের স্রোতে ভেসে আসা শ্বেতাঙ্গ যুবক অ্যালেক্সের শুশ্রূষা করতে গিয়ে প্রেমে পড়ে। আর তাতেই বাধে গোল। সর্দারের মেয়ে ভিন্দেশি যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাবে, এ কেমন কথা? না হলে এমনিতে অবিবাহিত যুবক-যুবতীদের প্রেম বা যৌনতার ব্যাপারে ইবানেরা খুবই খোলামেলা। নানা শয্যাসঙ্গী পরীক্ষার পরে, শরীর-মনের মিলমিশ বুঝে তবেই তারা বিয়ে করে। কাঁচা বয়সের ছেলের দল শোয় লং হাউসের বারান্দায়। মেয়েরা উপরে চাল-ঘেঁষা লম্বা মাচানে, প্রত্যেকে আলাদা মশারির নীচে। বারান্দা থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। রাত ঘন হলে প্রণয়ী যুবক সিঁড়ি বেয়ে উঠে পছন্দের মেয়েটির মশারির পাশে বসে আবহাওয়া বা আর কিছু নিয়ে গুনগুন শুরু করে। মেয়েটি যদি তাকে পান সেজে দিতে বলে, তবে কেল্লা ফতে! আর তার বদলে যদি বিছানার কাছে রাখা প্রদীপ জ্বেলে দেয়, তার মানে মশারিতে প্রবেশ নিষেধ। ফিরে যেতেই হবে। জোর করার প্রশ্ন ওঠে না। ‘অসভ্য’ বনচরেরা নরমুণ্ড কাটতে জানে, কিন্তু ধর্ষণ জানে না।
লুলির খোঁজে জঙ্গলের আনাচ-কানাচে ইবানদের নানা লং হাউস ঢুঁড়ে বেড়াতে লাগলেন ফণীরা। শুধু সুন্দরী হলেই তো হবে না, অভিনয়ও পারা চাই। সে আর মেলে না! এর মধ্যে এক দিন উজানে যেতে গিয়ে ফণীদের নৌকো বিগড়োল। নদীর চরে তাঁরা অপেক্ষা করছেন, যদি অন্য কোনও নৌকো আসে। বহু ক্ষণ পরে গং বাজিয়ে দণ্ড ও পতাকায় সাজানো তিনখানা লম্বা নৌকোয় রণসাজে সজ্জিত ইবানদের আসতে দেখা গেল। ফণীদের বুক প্রথমে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। পরে বোঝা গেল, ওরা বিয়ের দল, চলেছে কনে আনতে। ফণীরা হাত-পা ছুড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নৌকোগুলো এগিয়ে এসে তাঁদের তুলে নিল, সেই সঙ্গে জুটে গেল বিয়ের নিমন্ত্রণও ।
সেই বিয়েবাড়িতে যে সুন্দরী ফণীর সামনে এসে পানতুন শোনাতে বসল, উপস্থিত সব যুবকের নজর তার দিকে। ফণী আর তাঁর চিত্রগ্রাহক মহম্মদ জইন বুঝে গেলেন, লুলিকে তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন। পরের দিন তাঁরা কথাটা পাড়লেন। মেয়েটিও রাজি হয়ে গেল।
এর পরে যে কত কাঠখড় পুড়িয়ে শুটিং হল, কত রকম কাণ্ড ঘটল, কত দুর্বিপাক আর বিপদ জয় করা হল, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ ফণী মজুমদার লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘হিংস্র নরমুণ্ড শিকারীদের দেশে’ বইয়ে। তিন মাস বাদে, ২৪ মার্চ শেষ হল শুটিং। টানা কাজের চাপে ফণী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খুব জ্বর, কাঁপুনি আর থামে না। খবর পেয়ে দেখতে এলেন পুঙ্গুলু কুলের স্ত্রী। বৃদ্ধাকে ফণী ডাকতেন ‘এনায়’ অর্থাৎ ‘মা’ বলে, আর তিনি ডাকতেন ‘আনার’ অর্থাৎ ছেলে বলে। অবস্থা দেখে তিনি কম্বলের মধ্যে ঢুকে আদুড় গায়ে ফণীকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই ওমে ধীরে-ধীরে কাঁপুনি থামল।
১৯৫৭ সাল মানে ‘পিয়াসা’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘দো আঁখে বারা হাত’, ‘পেয়িং গেস্ট’, ‘হারানো সুর’, ‘কাবুলিওয়ালা’। সেই বছরই মু্ক্তি পেল ‘রুমাহ্ পাঞ্জাং’। এর পরে আরও বছর দুই ফণী সিঙ্গাপুরে ছিলেন। দেশে ফিরে ফের হিন্দি ছবি করা শুরু। ছবি করলেন মগধী, মৈথিলি, পঞ্জাবিতেও। ১৯৬৫ সালে ‘উঁচে লোগ’ ছবি করে পেলেন জাতীয় পুরস্কার। ‘রুমাহ্ পাঞ্জাং’ কোথায় হারিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে ইবানেরাও পাল্টে গিয়েছেন। নরমুণ্ড শিকার অতীত। পুরুষেরা নেংটি ছেড়েছেন, শার্ট-প্যান্টেই তাঁরা বেশি সচ্ছন্দ। মেয়েদের পরনে উঠেছে মালয় দেশের সারোং বা টিশার্ট, যার শুরুটা ফণীই দেখে এসেছিলেন কাপিতের মেথডিস্ট মিশন স্কুলে। লং হাউস এখনও আছে, সেখানে নাচও হয়। কিন্তু সে নেহাতই শান্তিনিকেতন বা ঘাটশিলার রিসর্টে সাঁওতাল নাচ যেমন।
ঋণ: চায়না ফরএভার/ দ্য শ’ ব্রাদার্স অ্যান্ড ডায়াস্পোরিক সিনেমা (সম্পাদনা: পোশেক ফু),
শঙ্খজিৎ বিশ্বাস, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ও অমিতাভ দাস