সৃজনশিল্প: এই ধরনের নকশি কাঁথার ধারক ও বাহক বাংলার মহিলারাই
পল্লিকবি জসীমউদ্দিনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কবিতায় নিরুদ্দিষ্ট রূপাইয়ের উদ্দেশ্যে সাজু তার মা-কে বলে, তার মরণের পরে, কবরের উপরে যেন তার নকশি কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনও দিন রূপাই ফিরে আসে, তাকে যেন বলা হয়, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নীচে অপেক্ষা করে আছে। সাজুর মৃত্যুর বহু দিন পর গ্রামবাসীরা এক দিন দেখতে পায়, নকশি কাঁথায় ঢাকা দেওয়া কবরের পাশে রূপাইয়ের মৃতদেহ পড়ে আছে। প্রতীক্ষা ও যত্নের মিশেলে বোনা নকশি কাঁথাটির ছবিও যেন ভেসে ওঠে আমাদের মানসচক্ষে।
বাংলার নিজস্ব শিল্পসম্পদ এই কাঁথাশিল্প। অঞ্চল ভেদে কাঁথাকে কখনও ‘খেতা’, কখনও বা ‘কেন্থা’ অথবা ‘সুজনি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের আঁতুড়ঘর থেকে শ্মশানযাত্রা পর্যন্ত কাঁথা মানুষের সঙ্গী। ১৩৮৫ সনে জসীমউদ্দিন ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় ‘পূর্ববঙ্গের নক্সীকাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন— “কাঁথা তৈরির বড়কা-ফোঁড়, তিরসী-ফোঁড়, বাঁশপাতা-ফোঁড় ইত্যাদি নিয়ে এবং ব্যবহারিক উদ্দেশ্যগত ভাবে কাঁথাকে সাত ভাগে ভাগ করা যায়, যথা, জপমালা বা তসবি রাখার থলি কাঁথা, আয়না-চিরুনি রাখার আরশিলতা কাঁথা, বালিশের বেটন কাঁথা, ফকিরের ভিক্ষার ঝুলি-কাঁথা, সারিন্দা-দোতারা রাখার আবরণী-কাঁথা, কোরআন শরীফ রাখার ঝোলা-কাঁথা এবং গায়ে দেওয়ার কাঁথা।”
‘দ্য আর্ট অব কাঁথা’ গ্রন্থে গুরুসদয় দত্ত লিখেছিলেন সাত ধরনের কাঁথার কথা, যথাক্রমে আরশিলতা, ওয়ার, বেটন, দুর্জনি, ঝুলি বা ঝোলা, সুজনি-কাঁথা এবং লেপ-কাঁথা। গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন কাঁথা, গোলাপ ও বটুয়া নামক তিনটি শ্রেণির কথা। কাঁথা তৈরিতে পুরনো ও অব্যবহৃত বস্ত্রাদি যেমন লুঙ্গি, শাড়ি, ধুরি ইত্যাদি কাপড়কে প্রয়োজনীয় মাপে কেটে নিয়ে পেতে সমান করে কাঁথার ‘জমি’ তৈরি করা হয়। দক্ষিণবঙ্গে একে ‘জমি’ বললেও পূর্ববঙ্গে একে বলা হয় ‘জমিন’। তার পর শাড়ির পাড়ের সুতো বা কেনা সুতোর চার-পাঁচটি গুটিকে একত্রিত করে পাকিয়ে সেলাই করা হয়। এই কাজে সুচের ফোঁড়কেই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে কাঁথার ‘জমি’র চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা ও প্রতিচ্ছবিকে ফুটিয়ে তোলা হয়। ব্যবহারের ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন নামে কাঁথার প্রচলন আছে। যেমন, ‘রুমাল’ কাঁথা হল সাধারণত এক বর্গফুট আকারের কাঁথা। ‘সুজনি’ কাঁথা বিছানার উপর বিছিয়ে ব্যবহার করা হয়, ‘লেপ-কাঁথা’ ব্যবহৃত হয় গায়ে ঢাকা দেওয়ার কাজে, ‘ছাপা’ ও ‘খোল’ ব্যবহৃত হয় বালিশের আবরণী হিসাবে, ‘দস্তর’ খাবার খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। তেমনই ‘আরশিলতা’ আয়না চিরুনি রাখতে অতীতে ব্যবহৃত হত, আবার ‘বটুয়া’ ও ‘বুগইল’ ব্যবহার করা হত পান-সুপারি রাখার কাজে। ‘গাঁটরি’ ও ‘বস্তানি’ ব্যবহার করা হয় বই ও তৈজসপত্রকে সযত্নে রাখতে। ‘আসন’ কাঁথা বসার কাজে ব্যবহৃত হয়। উপরোক্ত প্রতিটিই নকশি কাঁথার অন্তর্ভুক্ত, অথচ আকার-আকৃতিতে একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। কাঁথা, সুজনি, গাঁটরি আকারে বেশ বড়। লেপ-কাঁথা আকারে বড় ছোট দু’রকমই হয় এবং পুরু ও প্রশস্ত হয়। বটুয়া ও দুর্জনি আকৃতিতে ছোট হয়।
নকশি কাঁথার চিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি জসীমউদ্দিন বলেছিলেন, “কাঁথাতে সাধারণত মাছ, পাতা, চাঁদ, তারা, হাতি, ঘোড়া, দেব-দেবীর চিত্র বা বিভিন্ন গ্রাম্য ঘটনাও বুনট করা হয়।” দীনেশচন্দ্র সেন নকশি কাঁথার চিত্রবর্ণনায় পদ্ম, ধানের শিষ, পাতা, ফুল প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়াও রাজা, প্রজা, হাতি, ঘোড়া এবং বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনার উপাখ্যান প্রভৃতির উল্লেখ করেছিলেন। চিত্রের রকমফেরে বিভিন্ন স্থানীয় নামেও কাঁথাকে ডাকা হয়, যেমন খুব ঘন বুননের কাঁথা হলে তাকে ‘চট-কাঁথা’ বলা হয়, ত্রিভুজ নকশা দিয়ে কাঁথার জমি অঙ্কিত হলে তাকে ‘বিট-কাঁথা’ এবং চার চালবিশিষ্ট ঘরের চিত্র ফুটিয়ে তুললে তাকে ‘চার-চাল কাঁথা’ বলা হয়। আবার পায়রা থাকার ঘরের মতো চিত্রিত হলে তাকে বলে ‘কবতর-খুপি’। তেমনি ঢেউ খেলানো ফোঁড়ের কাঁথার নাম ‘লহরি-কাঁথা’। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমা ও কেতুগ্রাম অঞ্চলে বেশি দেখা যায় ‘পিঁপড়ে-সার কাঁথা’, এতে নকশাগুলি পিঁপড়ের সারের মতো হয়ে থাকে। গুরুসদয় দত্ত কাঁথার বিবরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন কাঁথার জমিতে শতদল পদ্ম, শঙ্খলতা এবং কলসলতার চিত্রের কথা। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসরণে তিনি শতদল পদ্মচিত্রকে ‘পদ্মমণ্ডল’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার দীনেশচন্দ্র সেন একে ‘মানস-পদ্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, কাঁথার মাঝখানে পদ্ম ও তাকে বেষ্টন করে কলসলতা বা কলমিলতার চিত্র ফোঁড় দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় এবং ছোট ফাঁকগুলি ভরাট করতে মাছের ও পাতার চিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়। কাঁথার ধারগুলিতে শঙ্খলতা, মোচাকৃতি, কলস-লতা প্রভৃতি চিত্রপট দ্বারা সুন্দর করে ফোঁড়ের কাজ করা হয়। কাঁথার জমিতে কলমিলতা নকশা করলে তাতে চার কোণে চারটি মাছ, কখনও ছোট আকারের পাখি এবং পানপাতার অবস্থান দেখা যায়। এ সব কাঁথার বাইরে দিকে থাকে চারটি কলকাচিত্রের সমাহার।
এ ছাড়াও কাঁথার ধারগুলিকে সজ্জিত করতে জ্যামিতিক ছকের প্রয়োগও দেখা যায়। এতে লাল, সাদা, হলুদ, নীল প্রভৃতি সুতো দিয়ে নকশাগুলিকে তোলা হয়। এতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া চিত্রের স্পষ্টতা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায়, যাতে লতাসমেত পুরো চিত্রটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কখনও মাঝখানে ময়ূরের অবয়ব চিত্রিত করে তার চার দিকে আয়তক্ষেত্রের মধ্যে পুঁতির মালার মতো পরিলেখ ফুটিয়ে তোলা হয়। কখনও সূর্যমুখী ফুলের পাশে পানগাছ, আনারস, পাখির অবয়ব আঁকা হয়।
মনে করা হয়, মধ্যযুগে ভক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সুফি আন্দোলনের প্রভাবে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে, তাতে কাঁথাশিল্পেরও পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। সুফি সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু ঐতিহ্যের মিলনের ফলে নকশি কাঁথা দুই সম্প্রদায়ের শিল্প-সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছিল। তার প্রমাণস্বরূপ ফকির ও বৈষ্ণবরা কাঁথার ঝুলি নিয়ে মাধুকরী করতেন। সেই মধ্যযুগের পর থেকেই, জপমালা ও তসবি রাখার স্থান হিসেবে উভয় সম্প্রদায় কাঁথার থলি ব্যবহার শুরু করেছিলেন।
গবেষকদের মতে কাঁথার জমিতে নারী মননের প্রাত্যহিকী ও ব্যবহারিক চিত্ররূপ ফুটে উঠত। গ্রামীণ সমাজে সেই প্রাচীনকাল থেকে নারীরা প্রথাগত শিল্পশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, তাঁরা মা, ঠাকুমা, শাশুড়িদের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এই শিক্ষা পেয়ে নিজেদের ফোঁড়ের কাজে রপ্ত করে তুলতেন। শীতের দুপুরে, বর্ষার দিনে বা গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দু’-তিন জন স্ত্রীলোক মিলিত হয়ে কাঁথা বোনার কাজে হাত দিতেন। এ ছাড়াও বাড়ির মেয়ে গর্ভবতী থাকলে আসন্ন সন্তানের কথা ভেবে, বা কার্তিক মাসে হেমন্তের দিনে পুরনো কাঁথাকে মেরামত করা হয় আজও। এই বয়নে প্রিয়জনের প্রতি অসীম ধৈর্য ও মমত্বের বুননে নিখুঁত একটি শিল্পের জন্ম হয়। তাই একটি কাঁথা তৈরিতে যত সময় বা শক্তিই ব্যয় হোক না কেন, প্রিয়জনকে তা সমর্পণ করার সুখ আজও অনুভব করেন গ্রামীণ নারীরা, যেমন জসীমউদ্দিনের কবিতায় সাজু চেয়েছিল তার কবরের উপরে রূপাইয়ের প্রতীক্ষা, আর স্পর্শের নকশি কাঁথাটুকু।