90's Kids Summer Vacation

স্মৃতিসরণির গ্রীষ্মাবকাশ

সে এক আশ্চর্য সময়। ভরদুপুরে মা ঘুমোলেই এক ছুটে খেলার রাজ্যে পাড়ি। আরও আকর্ষণ, বিকেলের দুধ-বরফ কিংবা তিনমহলা মামার বাড়ি। সে বাড়ির ছাদ কখনও ক্রিকেট পিচ, কখনও কামানের গোলা দাগার আড়াল।

Advertisement

শুভ্রজিৎ দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৮:২২
Share:

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

রাত-দুপুরের লোডশেডিং

Advertisement

সবে মাত্র ‘জ্যোতি’ চলে গেছেন। সন্ধেবেলা বা রাতে তাঁর যাতায়াত সোচ্চারে, সমস্বরে ঘোষিত হত। যাওয়ার সময় রাগ, ঘৃণা, গালি-মিশ্রিত কোরাস-ধ্বনি চড়া থেকে খাদের দিকে থাকত। তিনি এলে হর্ষধ্বনিতে কিংবা করতালিতে মুখরিত হত পাড়া। দুপুরবেলা তিনি যেতেন নিঃশব্দ চরণে। গরমের ছুটি পড়েছে স্কুলে। অনুশাসন অনুযায়ী, দুপুরে ছোটদের ঘুম এবং মা-ঠাকুমাদের একটু গড়িয়ে নেওয়ার সময়। সে সময় ‘জ্যোতি’র যাওয়া আর গলদঘর্ম হয়ে আমাদের খাট থেকে মেঝেতে, মাদুরে নেমে আসা— বিধিবদ্ধই ছিল প্রায়।

অনেক পরে শুনেছি, লোডশেডিং হলেই কিছু পরিহাসপ্রিয় মানুষের কাছে আলো ও জ্যোতি সমার্থক হয়ে যেত! ‘জ্যোতি’ আমাদের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, মাননীয় জ্যোতি বসু। যতদূর জানি, এই গণ-রসিকতার জন্য কাউকে কখনও গ্রেফতার হতে হয়নি বা সরকারি রোষে পড়তে হয়নি।

Advertisement

গ্রীষ্মাসুরকে দমন করতে মা অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিত তালপাতার হাতপাখা। অবশ্য সেটা আমার পিঠেও পড়ত চোখ না বোজার শাস্তিস্বরূপ। তবে মাঝে মাঝেই মায়ের তন্দ্রাচ্ছন্নতার সুযোগে হস্তচ্যুত হত পাখা। গরম হাওয়া কেটে নড়াচড়া করতে করতে সে পাখার পাখনা মেলার সাধ উধাও হত হয়তো, এসে পড়ত মেঝেয়। সেই পতনের শব্দে চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে থাকা আমি সতর্ক হতাম। মা ঘুমোলেই এক ছুটে পাশের ঘরে। আমার গোপন রাজ্যে। খেলার বাক্স আছে আলমারির পাশে। কী নেই তাতে! খেলনা স্টেথোস্কোপ, মেকানো, ব্যাগাডুলি, লুডো থেকে শুরু করে ঢালাই প্লাস্টিকের ছোট ছোট পশুপাখি, রং করা কাঠের তলোয়ার, বিভিন্ন বিচিত্র মুখোশ, জলছবি, স্টিকার, নানা রকমের কাগজ, ছবি, চকলেটের রাংতা। বড়দের বর্জিত নানা অদরকারি বস্তুও নিতান্ত দরকারি জিনিস হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে সেই বাক্সে— অকেজো ব্যাটারি, কেটে যাওয়া বাল্‌ব, জুতোর ছেঁড়া ফিতে, আরও কত কী! যেন ম্যাজিক বাক্স!

সেটার নাগাল পাওয়াও কিন্তু দুষ্কর হয়ে উঠত! মায়ের চোখ যেন কিছুতেই পুরো বন্ধ হত না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ধীর-নিশ্চিত গতি প্রাপ্ত হলেও নয়। এই অতন্দ্র প্রহরায় গরমের ছুটির দুপুরগুলোর গোপন-রাজ্য-বিলাস বাসনা আমার মন থেকে দহন-বাষ্পের মতোই উবে যেত। অগত্যা ক্ষুব্ধ চিত্তে, মনে মনেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সৈনিক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক আরও কত কিছুর ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করতে করতে মায়ের আঁচলের খানিকটা মুঠোয় নিয়েই কখন ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে! এখনও অনেক চেষ্টা করেও, বড় হয়ে যাওয়া আমি জাগরণ ও নিদ্রার নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণটি আবিষ্কার করতে পারিনি!

বিকেলের দুধ-বরফ

গরমের ছুটির আর একটা আকর্ষণ ছিল দুধ-বরফ। নামটা আমারই দেওয়া। মা একটা বাটিতে চিনি-মেশানো দুধ ভরে ডিপফ্রিজে রেখে দিত সকাল থেকেই। আমি মাঝে মাঝে ফ্রিজ খুলে দেখার চেষ্টা করতাম দুধের জমাট বাঁধার অগ্রগতি। বিকেলের দিকে ঘুম থেকে উঠে আমার বরাদ্দ বাটি হাতে পেলে চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তার স্বাদ নিতাম তৃপ্তি করে। অন্য বাটিগুলোর দিকেও যে লোলুপ দৃষ্টি যেত না, তা নয়। হাতে চামচ বাগিয়ে, সকলের অগোচরে ধাবমানও হতাম হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই মোক্ষম সময়গুলোতেই বুকের মধ্যে শুরু হত ঢিপঢিপ— কেন, বুঝতাম না! আজও অন্যের বরাদ্দ বা অপরের জিনিসের প্রতি চিত্ত বিহ্বল হলে, সেটা পাওয়ার ইচ্ছে জাগলে, মনের ভিতর থেকে একটা বাধা আসে। মনের ভিতরের এই অনুভূতিটা যে কে নিয়ন্ত্রণ করে, কী তার পরিচয়, কোথায় তার উৎস— কিছুতেই বোধগম্য হত না। বড় হয়ে বুঝেছি, এই অনুভূতির পোশাকি নামই বিবেক। বুঝতে পেরেছি, মানবজন্ম থেকে মানুষ হয়ে ওঠার সাঁকোটা সে শক্ত করে ধরে রাখে।

আর এক গোয়েন্দারও হাত থাকে হুঁশ ফিরিয়ে আনার জন্য। যে গোয়েন্দা যোজনখানেক দূর থেকেও টের পায় বুকের ধুকপুকানি, মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অন্যায় বাসনা-চাহিদা, যা আমার নয় তা পাওয়ার প্রবল ইচ্ছে-সঙ্কেত। প্রখর ঘ্রাণ, শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি-সম্পন্ন সেই সত্যান্বেষী— মা। ষষ্ঠেন্দ্রিয়, তৃতীয় নয়ন, অলৌকিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ছেলেবেলার গরমের ছুটির চমকপ্রদ স্মৃতিকে চির-উজ্জ্বল করে রাখতেই হয়তো, ফ্রিজের দরজা খোলার পরমুহূর্তে অথবা অন্যের দুধ-বরফের বাটি স্পর্শ করা মাত্রই নিঃশব্দে হাজির হত আমার সামনে। অকুস্থলে ঠিক সময়ে তাঁর এই বার বার উপস্থিতিই হয়তো মনের অন্দরে সংযমের বীজ বপন করে দিয়েছিল। এইটুকু কাজ সব মা-ই পারেন বোধ হয়। সে বীজ গাছ হয়ে উঠবে কি না, হলেও কেমন গাছ হবে, সে ভার তো মাটির, আবহের, মনের, পরিবেশের এবং পরিপার্শ্বেরও।

এখনও গরমে হিমায়িত আইসক্রিমের বিচিত্র স্বাদ নিতে নিতেও আমার স্বাদেন্দ্রিয় মায়ের তৈরি সেই দুধ-বরফের স্বাদের জমাট স্মৃতির সঙ্কেত পাঠায় মস্তিষ্কে। মায়ের কুটিরশিল্প জিতে যায় আন্তর্জাতিক সংস্থার শিল্পকে হারিয়ে!

মামাবাড়ির ছাদ-তেপান্তর

গরমের ছুটির খানিক অংশ বরাবর কাটত মামার বাড়িতে। হাওড়ার ঝাউতলায়। কখনও মায়ের সঙ্গে যাওয়া লঞ্চে করে জলপথে, কখনও মামা অফিস-ফেরত স্কুটারে করে নিয়ে ফিরত মাতুলালয়ে। দাদু ছিল আমার মনের অনেকটা অংশ জুড়ে। শতাধিক বছরের পুরনো, তিনমহলা বিশাল বাড়ি। অনেকটা জায়গা, অনেক বড় বড় ঘর, বিরাট ছাদ। বাড়িতে চার জন। দাদু-দিদা মামা-মামি। ছোটমাসি আর মেসোও আসত। পাশেই থাকত ওরা। তাও অনেকটাই জায়গা, সময় পড়ে থাকত আমার নিজের জন্য। বিশেষ করে, বিকেলে ছাদে কাটানোর সময়টা।

ছাদটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে বেশ কয়েক হাত অন্তর গোল গর্ত। তাতে চোখ রাখলেই বাইরের জগতের স্থির-অস্থির জীবন ধরা পড়ত। পাশের পানাপুকুরে হাঁসেদের সাঁতার, গ্যারাজে গাড়ি সারানোর চঞ্চলতা, যানবাহনের যাতায়াত, তেলেভাজার দোকানে কড়াইয়ের তেলে ফুলুরি বেগুনির ডুব দেওয়া ভেসে ওঠা, পরিচিত আধা-পরিচিত অপরিচিত মানুষজনের গতিবিধির নানা চলচ্ছবি মনে গেঁথে যেত।

পাঁচিলের গর্তগুলো মাঝে মাঝেই হয়ে উঠত কামান বসানোর জায়গা। আমিও ছোটাছুটি করে দুর্গপ্রাকার থেকে থেকে গোলা দাগার হুকুম দিতে দিতে সেনাপতির মতো ছুটে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে পাঁচিলের উপর দিয়ে কোনও রকমে উঁকি মেরে দেখতাম ক্রমাগত গোলাবর্ষণ শত্রুপক্ষের উপরে কী প্রভাব ফেলছে। কল্পনায় বাদ সাধত অপরিবর্তনীয় প্রাণচঞ্চল বাস্তব— আমার এই গোলন্দাজি আক্রমণ সত্ত্বেও সবাই কেমন নির্বিকার— যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাবে হাঁটছে ঘুরছে কাজ করছে! কোনও মানে হয়! কয়েক জন অন্তত কিছু ক্ষণের জন্যও বন্ধ চোখে আহত হওয়ার ভান করে শুয়ে পড়তে পারত!

অগত্যা বল পাঁচিলে মেরে চ্যালাকাঠের ব্যাট দিয়ে খেলা শুরু হয়ে যেত। পাঁচিল জানতই না যে সে কখন বোলিং মেশিন হয়ে উঠেছে! সে খেলা একঘেয়ে লাগলে কাল্পনিক খেলার সঙ্গী ঠিক করে নিয়ে তেপান্তরের ছাদ জুড়ে তাকে ধরার নেশায় ছুটতাম। চিলেকোঠার সিঁড়ি থেকে ঝাঁপ দিতাম ছাদের মেঝেয়, যেন জলোচ্ছ্বাস হত চার দিকে! জলে ডুব দিয়ে অজস্র জলজ প্রাণীর হানা এড়িয়ে কয়েক হাজার ফ্যাদম জলের তলা থেকে উদ্ধার করে আনতাম রত্নপেটিকা! উদ্ধারকার্য সেরে পুনরায় সিঁড়িতে উঠে গা থেকে ঝেড়ে নিতাম কাল্পনিক জল। তবে মন থেকে, মাথা থেকে কোনও দিনও আর ঝেড়ে ফেলা হয়ে ওঠেনি সেই কল্পনাপ্রবণতা। সে রয়ে গিয়েছিল আজীবনের সঙ্গী হবে বলে। সূর্য নেমে যেত নারকেল গাছগুলোর পিছনে রংবেরঙের মায়া ছড়িয়ে, আকাশকে পরের দিন আবার রং মাখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। মামিমার ডাকে আমি নেমে আসতাম তেতলার সেই কল্পরাজ্য ছেড়ে বাস্তবের উঁচু-উঁচু সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায়।

দাদামশাইয়ের ঝুলি

দাদুর হাতের রান্নার স্বাদ ছিল অতুলনীয়। যে কোনও পদ অমৃতে পরিণত হত তাঁর সুচারু তার সুচারু ও স্বকীয় পাকপ্রণালীতে। রাতের মনোরম আহার শেষে দাদুর পাশে শুতে যেতাম। দাদু খুলে দিত গল্পের ঝাঁপি। কখনও পশুপাখি, কখনও মানুষের জীবন নিয়ে কত বিচিত্র কাহিনির সম্ভার দাদুর ঝুলিতে ছিল, আর তাঁর বলার কায়দায় আমিও সশরীরে ঢুকে পড়তাম কাহিনির ভিতর। হাসতাম, কাঁদতাম, রোমাঞ্চ হত, ভয় পেয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরে কাছ-ঘেঁষে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতাম। এ রকম ছোটদের মতো করে তাৎক্ষণিক গড়ে তোলা কাহিনি, আমি আর কখনও কারও কাছে শুনিনি।

দাদু অভিনয় করতেন অ্যামেচার থিয়েটারে। মেয়ে সাজতেন, আবার পুরুষ চরিত্রও করতেন। তাঁদের দলের নাটক করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, শো-এর বর্ণনা শুনতে শুনতেই হয়তো গরমের ছুটির কোনও এক রাতে, অবচেতনে অভিনয়ের অঙ্কুর গজিয়ে উঠেছিল মনোভূমিতে! এখনও জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত হৃদয় অযাচিত যন্ত্রণায় যখন কুঁকড়ে যায়, মন ভার হয়ে থাকে, রাতে ঘুম আসে না, তখন সেই গল্পগুলো খুব শুনতে ইচ্ছে করে, অপাপবিদ্ধ মনে চোখ গোল-গোল করে যে আশ্চর্য কাহিনিগুলো শুনতে শুনতে দাদুর অভয়-স্পর্শে, নিশ্চিন্ত হয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু দাদু যে চিরকালের জন্যই গল্পগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন চরিত্র হয়ে। আলাদা করে তাঁকে বার করে নিয়ে কাছে পাওয়ার সাধ্য তো আমার নেই! বিধাতা সে বন্দোবস্ত করে রাখেননি। হয়তো সেই সোনালি দিনের গল্পগুলো নশ্বর জীবনে অমর করে দিতে চেয়েছিলেন বলেই, কে জানে!

স্বপ্ন-সফরের সঙ্গীরা

উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বসে আছি। মরুজাহাজ ছুটে চলেছে রামদেওরার দিকে। সামনের তিনটি উটে ফেলুদা, লালমোহনবাবু আর তোপসেদা। সাদা রোদে ঝলসানো কাঁটাঝোপ আর ঢেউ-খেলানো বালির স্তর পেরিয়ে যাচ্ছে। চাটুজ্জেদের রক পেরোনোর সময় টেনিদা, প্যালা, হাবুল, ক্যাবলা হাত নাড়ল। কারগালি কোলিয়ারি পেরোনোর সময় দেখলাম হাসিমুখে হাজির বগলামামা ও তার দলবল। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘনাদা, একটু দূরেই গলাগলি করে দাঁড়িয়ে বড়মামা-মেজমামা। উটের দল তীব্র গতিতে পেরিয়ে যেতে লাগল গিরিডির প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ি। জানলা দিয়ে দেখলাম উনি গবেষণায় মত্ত। একে একে পেরোলাম মার্লিনস্পাইক হল। টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর ক্যালকুলাস লনে বসে কী সব আলোচনায় মগ্ন। আমাদের দেখতেই পেল না। তার পর পেরোলাম জ়ানাডু, খুলিগুহা। পাশ দিয়ে চলে গেল হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন। কী আশ্চর্য, সবটাই মরুভূমিতে ঘটছে! ওই তো ট্রেনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে! উত্তেজনায় পড়ে যাই নীচে— বালিতে নয়, মেঝেয়— উট থেকে নয়, খাট থেকে!

সাহিত্যের মজারু-ভূত মাথায় চেপেছে একটু বড় হতে না হতেই! বিভিন্ন বই হাতে এলেই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে দিই। গরমের ছুটিতে তো কথাই নেই, বাড়িতে দুপুরে ও রাতে বিশ্বস্ত সঙ্গী বই। বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব এখনও অটুট আর এই বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছিল মা, ছোড়দা, আমার এক মামা, বাবলিমাসি আর বাপুদাদা। প্রথম টিনটিন, প্রথম ফেলুদা বা প্রথম শঙ্কুর বই উপহার পাওয়া বাবলিমাসির হাত থেকেই। বাবলিমাসি মায়ের ছোটবেলার বন্ধু। বাপুদাদা বাবলিমাসির ছেলে। মনের দরজা-জানালাগুলো খুলে দেওয়া, স্নেহ-আদর, বিদেশি পদ রান্না করে খাওয়ানো— সব কিছুই ভিন্ন রকম আধুনিকতা ও নতুনত্বের ছোঁয়া নিয়ে আসত বাবলিমাসির কাছ থেকে।

ওদের বাড়ি ছিল কাছেই, ফলে অবাধ যাতায়াত চলত গরমের ছুটিতে। দিন নেই রাত নেই, পড়ে থাকতাম ওখানে ছুটির সময়টায়। গান শোনা, ভিডিয়ো ক্যাসেটে সিনেমা দেখা, তাসের ম্যাজিক শেখা, সাহিত্যচর্চা, খেলা দেখা, আরও কত কী! বাবলিমাসি বাপুদাদার সঙ্গে বাইরের জগৎ ধরা দিত অনায়াসে সেই মায়াময় দিনগুলোয়। সেই অনাবিল ভালবাসা-ভরসা-মায়া কাটিয়ে বাবলিমাসি চলে গেল এক দিন আকস্মিক ভাবেই। পঞ্চপ্রদীপের মানুষখেকো আগুন লেগেছিল মাসির পুজোর পোশাকে, উপাসনার সময়ই।

মাসি সবাইকে বলত, আমি তার ছোট ছেলে। আমি জানি, শুধু বলত না, হৃদয় থেকে, মন থেকে সে কথা মানতও। তার সেই মনে-হওয়ার স্পর্শ আমি নিরন্তর পেতাম। এখনও হয়তো স্পর্শ করেন কোনও মায়াতরঙ্গে, যার পরশ অনুভূত হয়, স্মৃতির ঢেউ তোলে হঠাৎ-হঠাৎ নির্জনে, গরমকালের আনমনা অবসরে।

সব খেলার সেরা

আর একটা ব্যাপার চেপে বসেছিল আমার সত্তায়। ছেলেবেলার কোনও এক গরমের ছুটিতে তা আরও পোক্ত জায়গা করে নিয়েছিল মনে। সেটা হল ফুটবল। উন্মাদের মতো ভালবাসতে শিখেছিলাম খেলাটাকে। ডিফেন্সে খেলতাম। গুরু ছিল সুব্রত ভট্টাচার্য, ফ্রাঙ্কো বারেসি, পাওলো মালদিনি। স্বপ্নের দল ইটালি। প্রত্যেক গরমের ছুটিতে পাড়ার ক্লাবের লিগ খেলা হত ভোরবেলায়। সামনের মাঠে। অনেক বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সারা গরমকাল জুড়ে শিল্ড রাখা থাকত বাড়িতে। মাঠে খুঁজে পেতাম নিজের লড়াকু মন, জেদ, প্রাণশক্তি। হার-না-মানা প্রত্যয় নিয়ে বিপক্ষকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা, এগিয়ে চলা প্রতিদ্বন্দ্বীর গোলপোস্টের দিকে— সারা গরমের ছুটির সকাল-বিকেল কাটত এ ভাবেই।

আমার বাবা খেলতে ভালবাসতেন, খেলা ভালবাসতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে রক্তপ্রবাহে সে ভালবাসা প্রবেশ করেছিল নিশ্চয়ই। বাবাকে জ্ঞানত কখনও আমি মাঠে নামতে দেখিনি। বাবার মনের কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। বিষণ্ণতা ক্রমে স্থায়ী রোগের আকার নেয়। গরমের ছুটিতে তিন ভাই মিলে যখন খেলাধুলো নিয়ে আলোচনা করতাম, বাবা মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করতেন মাঠ-ময়দানের সাম্প্রতিক খবর। কখনও ভাবলেশহীন মুখে খেলা দেখতেন টিভিতে। চোখ চিকচিক করে উঠত মাঝে মাঝে। খেলা দেখে নিজের অতীতের কথা মনে পড়ত হয়তো। অসহায়তার বেদনায় কষ্ট পেতেন বোধ হয়। মনের গভীরে ডুব দিয়ে বিষণ্ণতা ছেঁচে তুলে নিয়ে যদি একটু খুশি করা যেত বাবাকে, কত ভাল হত! চিকিৎসাবিজ্ঞান আমার কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিতে এখনও প্রস্তুত নয়, ভবিষ্যতে কোনও দিন হয়তো পারবে!

শৈশবের মনবদল

বয়সে আর একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতেও শুরু করেছিল গরমের ছুটি দুপুরগুলো। দাদাদের ঘরে তখন অমোঘ আকর্ষণ। বিদেশি প্রাপ্তমনস্ক সাহিত্য থেকে শুরু করে সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভার। দাদারা বেরিয়ে গেলে সে সব আমার দখলে। মৃদু কম্পমান হৃদয় দিয়ে সেই সব বইয়ের বিভিন্ন ছত্রে ছত্রে উপলব্ধি করতাম অননুভূত উত্তেজনার, অজানা রোমাঞ্চের হাতছানির বয়ঃসন্ধি। আর ছিল কলের গান, আর তার অজস্র রেকর্ড। এ ছাড়াও ছিল রেকর্ড প্লেয়ার আর তার বড় আর ছোট রেকর্ড। কোনও এক গরমের ছুটিতে ছোড়দা আমায় নিয়ে গিয়েছিল ওয়েলিংটনে। রেকর্ড আর প্লেয়ারের পিন কিনতে। সোনোডাইনের বক্স ছিল মনে আছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুরের মূর্ছনা কানে পৌঁছত মসৃণ ভাবে। দেশি-বিদেশি ধ্রুপদী গান থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি গান, পুরাতনী, ফিল্মি গান— কী না ছিল দাদার সংগ্রহে! গরমের ছুটির অনেক দুপুর কেটেছিল মনোরম সঙ্গীতের সাহচর্যে। যে সুর মনে জায়গা করে নিয়েছিল, তা আজও প্রবাহমান আমার অন্তরতম সত্তায়। ক্রমে ক্যাসেট এল। গরমের ছুটির সুর-গান সঙ্গ ছাড়ল না। অডিয়ো ক্যাসেট সংগ্রহের নেশা সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মধ্যেও।

গরমের ছুটির নির্জন দুপুরগুলোয় পাড়ায় শোনা যেত বিভিন্ন ফেরিওয়ালার হাঁক। হয়তো তাঁরা সারা বছরই আসতেন, আমরা সেই সময় বাড়িতে থাকতাম বলে টের পেতাম। ‘পু-রা-না হারমোনিয়া-আ-ম... ঘড়ি বিক্রি করবে-এ-এ-ন’, ‘এ-পেপসি বলবেন’ কিংবা ‘হরেক মাল পাঁচ টাকা’ শোনা যেত অহরহ। দোতারা কিংবা বাঁশির সুরের টানে দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতাম। মায়ের কাছে জেদ করে কিনতাম বটে, তবে ছড়ের হাজার টানাটানিতে দোতারা বাজত না, শত ফুঁ দিয়েও সুর লাগত না বাঁশিতে। ভাবতাম, খারাপ জিনিসটা গছিয়ে গেল বোধ হয়। পরের বার এলে ও নিজে যেটা বাজায়, ঠিক সেটাই চেয়ে নেব! তখন বুঝবে মজা!

রাতের দিকে মালাই-বরফের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাণ ঠান্ডা হয়েছে কত বার! মনে আছে, কোনও এক গরমের ছুটিতে জানতে পেরেছিলাম, মালাই-বরফওয়ালার কাছে সিদ্ধি আছে। তবে ‘সিদ্ধিদাতা’ খুবই সচেতন! ‘সিদ্ধিলাভ’-এর অধিকার নাকি শুধু প্রাপ্তবয়স্কদেরই।

যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে ছোটবেলাতেই। ঠাকুমাকে নিয়ে বাবা-মা, আমাদের তিন ভাইয়ের হাঁড়ি আলাদা হয়ে যায় কাকা-জেঠাদের থেকে। মামলা শুরু হয় সম্পত্তি-বাড়ি ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে। তার আঁচ এসে পড়ে ভাই-বোনদের মধ্যেও। খুড়তুতো-বোনেদের সঙ্গে যে হাসি মজা আনন্দ হত, তা হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। তবে পিসতুতো আর মাসতুতো ভাইরা আসত মাঝে মাঝে। সেই সব ছুটিতে বাড়ির দালান হয়ে যেত খেলার মাঠ। আমাদের দাপাদাপিতে গমগম করত গ্রীষ্মকালীন ছুটির সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। টিউবলাইট, বাল্‌ব, জানালার কাচ— কোনও কিছুর নিস্তার ছিল না। ভঙ্গুর জিনিস তো ভাঙবেই! বলের গতিপথে রয়েছেই বা কেন সেগুলো! বড়দের বকাবকির বিপক্ষে এই ছিল আমাদের অকাট্য যুক্তি।

ছুটির রোমাঞ্চ ও অভিযান

বাবা অসুস্থ, তাই ছোটবেলায় অন্য অনেক পরিবারের মতো সব গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া হত না আমাদের। কাছেপিঠে যাওয়া হত। হুগলি ঘাটে বাবার পিসির বাড়িতে যেতাম মা আর দাদার সঙ্গে। আমার বাড়ির পাশে গঙ্গা, তবে ওখানে গঙ্গা আরও চওড়া। কোনও এক গরমের ছুটিতেই বাগবাজার বটতলা ঘাটে পাড়ার দাদাদের হাত ধরে সাঁতার শেখা। দিব্যি জগন্নাথ ঘাট থেকে লঞ্চ জেটি অবধি চলে যেতে পারতাম অক্লেশে। তবে হুগলি ঘাটের গঙ্গায় কোনও দিন সাঁতার দেওয়া হয়নি। জানি না কেন যেন মনে হত, কিছুটা গিয়েই টুপ করে ডুবে যাব গভীরে! হয়তো চেনা গঙ্গা নয় বলেই। জীবনের চেনা বাঁকেও যে ভরসা থাকে না সব সময়। ডুবে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া এমন কিছু অত্যাশ্চর্য ব্যাপার নয়, সেটা পরে বুঝেছি।

গ্রীষ্মের ছুটিতে হুগলিতে অনতিদূর সম্পর্কের ভাই আর তাদের বন্ধুদের সঙ্গে হুজুগে পড়েই গাছে চড়ার প্রথম পাঠ। শেখা সম্পূর্ণ হয়নি সময়াভাবে, তাও পেয়ারা গাছে প্রথম বার কিছুটা উঠে পেয়ারা করায়ত্ত করার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়নি। সমস্ত যুদ্ধাভিযানেই ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ থাকে। এই ধরনের অভিযানেও তার অন্যথা হয়নি। গাছে চড়তে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটেছে, ছড়েছে, পাখিরা ঠোক্কর-সহ প্রতিবাদ করেছে, কাঠপিঁপড়ের কামড়ে তীব্র জ্বালা ধরেছে হাতে-পায়ে নানা জায়গায়। অধিকারে আসা অতি ডাঁশা পেয়ারায় কামড় দিয়েও কষাটে বিস্বাদে থু-থু করে ফেলে দিতে হয়েছে। পেয়ারা অভিযানের অপকীর্তি ধরা পড়ে যাওয়ায় গাছের মালিক আমাদের বহু পুরাতন আদিপুরুষের সঙ্গে তুলনা করে প্রবল বকাঝকা করলেও বিভিন্ন মালিকের বাগানে আমাদের শ্রেণিসংগ্রাম অব্যাহত থাকত। যদিও স্থায়ী বিপ্লবের সম্ভাবনা অচিরে বিনষ্ট হত বাড়ির বড়দের কানমলা গাঁট্টা চাঁটি হুমকি ইত্যাদি দমন-পীড়নমূলক অত্যাচারে। তবু নতুন আশায় বুক বেঁধে সাময়িক বিরতির পরই দামাল দল ঝাঁপিয়ে পড়ত আম্রকুঞ্জ অভিযানে। ইন্দ্রনাথদের এই দুরন্ত অভিযানে কলকাতা থেকে আসা বহিরাগত শ্রীকান্ত, মানে আমি বাদ পড়তাম। আমার নিরাপত্তার কারণেই ঝুঁকি নিতে চাইত না ওরা। রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ হাতছাড়া হলে যারপরনাই আফসোস হত, সে তো সহজেই অনুমেয়।

সাগরতীরে বার বার

ক্লাস এইটে গরমের ছুটিতে দিঘা যাওয়ার কথা মনে আছে। জ্ঞানচক্ষু মেলার পর সম্ভবত সেই প্রথম সমুদ্র দর্শন। আমি, মা, বড়দার বন্ধু— আমার অঙ্ক স্যর পার্থদা। স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মেজাজ বদলের জন্য। বাস যখন বাঁক নিয়ে পুরনো দিঘার সমুদ্রতীরের সমান্তরাল রাস্তা ধরেছিল, অবাক হয়ে দেখেছিলাম— আকাশ জল মিশে গিয়েছিল নীল রঙের কারসাজিতে। ঘন নীল, গাঢ় নীল, তুঁতে, আসমানি, সমুদ্রনীল, হালকা নীল, ফিরোজ়া নীল, গাঢ় সবজে নীল, বৈদ্যুতিক নীল, রাজকীয় নীল— মনে নীল রং ধরিয়ে দিয়েছিল। নীল আমার প্রিয় রং। এই দৃশ্যকল্পগুলোই হয়তো আমার নীলপ্রিয়তাকে গভীরতা দিয়েছে সচেতনে, অবচেতনে।

মনে পড়ে, কবিরাজ মশাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী, বাবা বালিতে পায়ের পাতা পুঁতে দাঁড়িয়ে, সাগরের নোনা জল বাবার পা স্পর্শ করে যাচ্ছে, আসছে। মা বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে অসীম জলরাশির দিকে। চোখে ভাল লাগার সঙ্গে যেন মিশে আছে পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা, বাবার দুরারোগ্য ব্যাধির আরোগ্য লাভের অনিশ্চয়তা। অদূরে পার্থদার পাশে বালুতটে বসে কাগজ, পেনসিল, মোমরং নিয়ে আমি সমুদ্র, নৌকো, সমুদ্রপাখি, নুলিয়া, ভ্রমণার্থীদের গতিময়তাকে স্থির ছবিতে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছি। সে বারই পার্থদার সঙ্গে প্রথম সমুদ্রে নৌকো চড়া। বিপদের আশঙ্কা যে মনে একদম জন্মায়নি তা নয়, তবুও ঢেউয়ের মাথায় নৌকোর ওঠা আর ঢেউ সরলে নৌকোর পড়ার ছন্দে সে আশঙ্কা মিলিয়ে গেছিল খানিক বাদেই। সমুদ্রতট থেকে খানিক দূরে যেতেই উথালপাথাল বন্ধ হল, নিস্তরঙ্গ জলরাশিতে নুলিয়া মাঝিদের দক্ষতায় ভেসে যাওয়ার অপার অজানা আনন্দ টের পেলাম।

সাগরপাড়ে ঝিনুক কুড়োনো, ছোট ছোট লাল কাঁকড়াদের তাড়া করে তাদের বাঙ্কার-বাড়ির অনুসন্ধান করা, ভিজে বালি জমিয়ে ক্যাসল তৈরি করা, বালুতটে দৌড়োদৌড়ি, ছোট ফুটবল নিয়ে খেলা, ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিমানী আমাকে আর বাবাকে রেখে দাদাদের স্পিডবোটে চড়া, জলে পা ভিজিয়ে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গীতপাগল মায়ের গুনগুনিয়ে গান, তরঙ্গের পর তরঙ্গে সূর্যোদয়ের ঝিলিমিলি, শরীরে হঠাৎ উতলা হাওয়ায় বালির সুড়সুড়ি, স্বল্প মৃদু কথায় বাবার হিউমারের ঝলক, ছোট দুই হাতের আঁজলা ভরে ফেনিল জল ধরতে চাওয়া— আরও কত অজস্র টুকরো স্মৃতি মনে এখনও ভিড় করে আছে।

ক্রমে বড় হয়েছি। অনাত্মীয়রা পরমাত্মীয় হয়েছে, তথাকথিত আত্মীয়রা অনেকেই দূরে সরে গেছে। আবহমান মানবতায় বিশ্বাস করেই প্রকৃত বন্ধু পেয়েছি। তাদের সঙ্গী করেই গরমের ছুটিতে ফিরে গেছি সাগরের কাছে। বিধির আগল শিথিল হয়েছে, অজানা অচেনার প্রতি কৌতূহলে বেপরোয়া হয়েছি, নতুন প্রাণশক্তির উদ্দামতায় নিয়মের তোয়াক্কা করিনি। সে গরমের ছুটির স্বাদ অন্য রকম। তারুণ্যের তেজে বন্ধুরা মিলে তোলপাড় করেছি সাগরতট। খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, চলাফেরায় ছড়িয়েছি দৃপ্ততা। নিষিদ্ধ যা কিছু, তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছি। স্কুলের গণ্ডি ছাড়ানোর সন্ধিক্ষণে গরমের ছুটি অন্য মানে, অন্য উপলব্ধি নিয়ে আসতে শুরু করেছিল। বইতে শুরু করেছিল প্রেম ভালবাসা বন্ধুত্বের সুবাতাস। তবে সে অন্য কাহিনি, অন্য অধ্যায়।

অবকাশ এখন ‘ভেকেশন’

আমাদের স্কুলের ডায়েরিতে লেখা থাকত গ্রীষ্মাবকাশ। এখন থাকে ‘সামার ভেকেশন’। চাকচিক্য, ঔজ্জ্বল্য, ‘সামার ক্যাম্প’, ফরেন টুর বা সামার প্রজেক্টের বাহারি হোমওয়ার্কে সামার ভেকেশন যেন আরও আধুনিক। তবু মনে হয়, ‘অবকাশ’ কথাটায় যেন ছুটির নিমন্ত্রণ আছে। সময় আছে, স্থিরতা আছে, আরাম আছে, মাধুর্যের প্রলেপ আছে, দাবদাহে শীতল ছায়া আছে, জড়ানো আছে মায়া। আছে নিজেকে, অপরকে, পারিপার্শ্বিককে দেখার চেনার জানার হাতছানি। আবার ‘সমুখ’পানে এগিয়ে চলার আগে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ক্লান্তিহরণ বিরতি আছে, আছে ক্ষণিক বিশ্রাম ও কল্পনার অবসর।

আমার মেয়ে এখন স্কুলে পড়ে। বয়ঃসন্ধির দোরে কড়া নেড়েছে বেশি দিন আগে নয়। আমার বিশ্বাস, ওরা নিজেদের মতো করে জীবনকে দেখতে, জীবনকে উপলব্ধি করার তাগিদে সামার ভেকেশনের মধ্যেই ‘অবকাশ’ খুঁজে নেবে। হয়তো ঠিক আমার মতো করে নয়, ওদের নিজেদের মতো করে গরমের ছুটি কাটাবে হাসি-কান্নায়, সুখে-দুঃখে, মাধুর্যে-বেদনায়, আনন্দে-অভিমানে, বন্ধুত্বে- ভালবাসায়। জনস্রোতে নানা মতে মনোরথের ঠিকানা খুঁজবে, স্বপ্নকে মিলিয়ে দেবে প্রাণের মোহনায়। ‘সামার ভেকেশন’ থেকেই অবকাশকে পরম যত্নে সেঁচে নিয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল করে রাখবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement