ঐতিহাসিক: বর্তমান কালে শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে পূজিতা দেবী দুর্গা
রাত তখন অনেকটাই। অধিকাংশ হোগলা পাতায় ছাওয়া মাটির বাড়িগুলিতে এমনিতেই রাতে আলো জ্বলে না বিশেষ। এরই মধ্যে একটা বাড়ি ব্যতিক্রমী। তোষাখানা, নহবতখানা, ঠাকুরদালান নিয়ে জমজমাট। আধঘুমন্ত অন্ধকার পল্লির মধ্যে সে দিন যেন আরও ঝকমক করছে বাড়িটা। বহির্বাটীর একটি ঘরের বহুবর্ণী বেলোয়ারি ঝাড়বাতি থেকে ঠিকরে পড়া আলো কাচের সুরম্য নাচঘরে বিকিরিত হচ্ছে। বেয়ারা পানপাত্র নিয়ে ঘুরছে। বাজনার তালে নাচতে নাচতে লখনউ থেকে আসা নর্তকী শ্বেতপাথরের মেঝেয় ছড়ানো গোলাপি আবির দিয়ে এঁকে দিচ্ছে চমৎকার ছবি। পানোন্মত্ত শ্বেতাঙ্গ অতিথিরা ঢলে পড়ছে তার গায়ে। উইলিয়ামস আর মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার-এর দোকান থেকে এসেছে মাংসের হরেক আয়োজন। মুসলিম আর পর্তুগিজ খানসামারা বানিয়েছে শুয়োর আর টার্কির সুস্বাদু পদ। গৃহকর্তা বসে আছেন ঘরের মাঝখানে। মাথায় খিড়কিদার লাল পাগড়ি। পরনে জরির কারুকাজ করা জোড়। সাহেবসুবোরা এলে উঠে দাঁড়াচ্ছেন সসম্ভ্রমে। দীনবন্ধু মিত্র এই স্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “বসে আছে বাবুগণ করি রম্য বেশ/ মাথায় জরির টুপি বাঁকাইয়া কেশ/ বসেছে সাহেব ধরি চুরুট বদনে/ মেয়াম চকিছে ওষ্ঠ মোহন ব্যঞ্জনে। নাচিছে নর্তকী দুটি কাঁপাইয়া কর/ মধুর সারঙ্গ বাজে কল মনোহর…”।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সী নবকৃষ্ণ দেব সে বছর প্রথম দুর্গাপুজো করছেন। এই চিত্র তাঁর বাড়ির নাচঘরের। লর্ড ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের উদ্যাপন তাঁর বাড়িতেই করছেন, সেই উপলক্ষেই দুর্গাপুজো। ‘কলকাতার ইতিবৃত্ত’ বইয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখেছিলেন, “মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর পলাশীর যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসিয়া ঘোরঘটায় দুর্গোৎসব শুরু করিবার জন্য উত্তরের রাজবাটী এত সত্ত্বর নির্মাণ করিয়াছিলেন যে শুনিলে আশ্চর্য হইতে হয়। তাঁহার দুর্গোৎসবের উদ্বোধন হইতে বাঈনাচ আরম্ভ হইত। তাহা দেখিবার জন্য শহরের বড় বড় সাহেব নিমন্ত্রিত হইতেন, এবং এখনও হন। সাহেবরা এই দুর্গোৎসবে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতি উৎসব বলিয়া সাদরে যোগদান করিতেন এবং এখনও করেন।” এই পুজোয় সাহেবদের নাম এতটাই জড়িয়ে গিয়েছিল যে, শোভাবাজার দেববাড়ির দুর্গাপুজোর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘কোম্পানির পুজো’। তবে গোঁড়া হিন্দু উৎসবকর্তা বিধর্মী ম্লেচ্ছদের ঠাকুরদালানে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কোনও কোনও গবেষকের মতে ঠাকুরদালানের উল্টো দিকে নির্মিত নাচঘর থেকেই প্রতিমা দর্শন করতে হয়েছিল সাহেবদের। যদিও সেই সময়কার কিছু লেখা পড়ে জানা যায়, ঠাকুরদালানে গিয়ে ক্লাইভ দেবীর পায়ে পদ্মফুল দিয়েছিলেন।
বস্তুত পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই পরস্পরকে টেক্কা দিয়ে ইংরেজদের নেকনজরে পড়ার প্রচেষ্টায় দুর্গাপুজো পরিণত হল বাৎসরিক মোচ্ছবে। এই বাবু-সম্প্রদায়ের নাম ইংরেজরা দিল ‘জেন্টু’ অর্থাৎ জেন্টলম্যান। তৎকালীন সংবাদপত্রে দুর্গাপুজোর ছবি ও বিবরণ থেকে জেন্টুদের পুজোর বিশদ চিত্র পাওয়া যায়। সেই সময়ের নামী ব্যবসায়ী ছিলেন চোরবাগানের রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁর বাড়িতে পুজো শুরুই করেছিলেন ইংরেজদের কাছে নিজের মান রক্ষা করতে। ‘জিলেস্টো অ্যান্ড অ্যান্ডারসন’ নামে যে ইংরেজ কোম্পানিতে তিনি কাজ করতেন, তার বড়কর্তা বিলেত থেকে এসেছিলেন জেন্টুদের পুজো দেখতে। অ্যান্ডারসনের সঙ্গে গিয়ে শ্যামবাজারের কীর্তি মিত্রের বাড়ির পুজোর আড়ম্বর দেখে পরের বছরই নিজের বাড়িতে পুজো শুরু করলেন রামচন্দ্র। সাহেবদের চোখে প্রতিদ্বন্দ্বী বেনিয়ার থেকে নিজেকে অধিকতর ধনবান প্রমাণের চেষ্টায় সে পুজো জাঁকজমকে ছাড়িয়ে গেল কীর্তি মিত্রের পুজোকে। ১৮৬০ সালে এই পুজোর কথা জানা যায় ‘ক্যালকাটা ক্রনিকল’ থেকে। দেশীয় জেন্টুদের দুর্গাপুজোয় সাহেবদের নিয়ে আসার প্রতিযোগিতার ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, এক বাড়িতে দুর্গাপুজোয় কোনও এক গোরা লুচি ভাজছেন শুনে অন্য বাড়িগুলিতে সাহেবদের নিয়ে লুচি ভাজানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল, নয়তো যে মান থাকে না। ১৮২৯ সালে ‘হরকরা’ কাগজ লেখে, শোভাবাজার রাজবাড়িতে শিবকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ দেবের আতিথ্য গ্রহণ করেন লর্ড এবং লেডি উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তাঁরা উপস্থিত হলে ‘গড সেভ দ্য কিং’ বাজানো হয়, তাঁরা প্রীত হয়ে নাচঘর মধ্যস্থ একটি সোনার কারুকাজ করা সোফায় অধিষ্ঠিত হন। চুঁচুড়ার বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেন যে, তাঁর বাসভবনে ন’দিন ধরে নাচের জলসা চলবে, সেই দিনগুলিতে গণ্যমান্যরা উপস্থিত থাকলে তিনি বাধিত হবেন। অাপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখা হবে না বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। অতিথিদের টিফিন, ডিনার এবং ওয়াইন পরিবেশন করা হবে।
ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্য নবকৃষ্ণ দেব বাইনাচের ব্যবস্থা করেন দুর্গাপুজোয়। এক-এক জন বাইজিকে এক হাজার থেকে দু’হাজার টাকা বায়না দিয়ে এক রাতের জন্য নিয়ে আসা হত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম ছিল নিকি বাইজির। সে এতই সুকণ্ঠী ছিল যে, তাকে ইটালীয় অপেরা গায়িকা অ্যাঞ্জেলিকা ক্যাটলানির সঙ্গে তুলনা করতেন সাহেবরা। নিকিকে নিয়ে এমন রেষারেষি চলত সেই সময় যে, তা সম্ভ্রমের সীমা লঙ্ঘন করে যায়। দুর্গাপুজোর এক জলসায় উপস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী ফ্রেডরিক উইন-এর লেখা থেকে জানা যায়, গান তো ভাল গাইতেনই, লাস্যেও নিকি অতুলনীয়া ছিলেন। সেই সময়ে সুপনজান, আশরুন, বেগমজান, হিঙ্গুল, মিশ্রি, নুরবক্স-সহ বেশ ক’জন বাইজির কথা শোনা যায়। এঁরা কখনও সুখরাম রায়, নীলমণি মল্লিক, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, গোবিন্দরাম মিত্র, দর্পনারায়ণ ঠাকুর-সহ আরও বেশ কিছু ‘জেন্টু’-র বাড়িতে দুর্গাপুজোয় মুজরো করতে যেতেন। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৭৯২ সালে মহারাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে হিন্দুস্থানি গান বিলিতি ঢঙে গেয়ে অভিনবত্ব দেখানো হয়। ইউরোপের অনুকরণ বাঙালির দুর্গোৎসবে পর্যন্ত বিকট রূপে প্রকট হয়ে উঠেছিল।
সাধারণ মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থাও হত দুর্গাপুজোয়। বাইনাচ মান্যগণ্যদের জন্য পরিবেশিত হওয়ার পর শুরু হত খেমটা। এ ছাড়া যাত্রা, কবির লড়াই, বুলবুলি বা মোরগের লড়াই তো ছিলই, সঙ্গে ছিল মনোরঞ্জনের এমন সব উপায় যা এখনকার বিচারে রীতিমত অশ্লীল। নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে আমন্ত্রিত রেভারেন্ড ওয়ার্ড সাহেবের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ভোররাতে ইউরোপীয় অতিথিরা চলে যাওয়ার পর বাড়ির মূল দরজা খুলে দেওয়া হত। তার পরই পিলপিল করে সাধারণ ইতরজন ঢুকে পড়ত বাড়িতে। শুরু হত কুৎসিত গান আর বিকট অঙ্গভঙ্গির নাচ। পুজোর সময় ঠাকুরদালানের সামনে পাঁঠা কিংবা মোষ বলির পর সেই রক্তমাখা উঠোনে হত কুস্তি, মল্লযুদ্ধ। এর পর রক্তমাখা গায়েই অংশগ্রহণকারীরা বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। চলত সং সাজা, অশ্লীল খেউড়, গান। সপরিবার বাঙালি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করত সেই দৃশ্য। পৌত্তলিকতা আর বলি-বিরোধী সাহেবরাও এই বীভৎস দৃশ্যের রসাস্বাদন করত। ছিল ট্র্যাপিজ় আর জিমন্যাস্টিকের খেলাও। খোলা তরবারির উপর পা রেখে কসরত করত আর নাচত বাচ্চারা।
তখনকার দুর্গাপুজো উপলক্ষে যে খরচের বিবরণ পাওয়া যায় তা চমকপ্রদ। পুজোয় মোট খরচ হত পঁচিশ থেকে তিরিশ লক্ষ টাকা। রেভারেন্ড গ্রান্টের হিসেবে অবশ্য এক-একটা বাড়িতেই পুজোয় গড়ে খরচ হত ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা। জানা যায়, সিংহবাড়িতে রেশমের কাপড় এসেছিল হাজার জোড়া। মিষ্টি এসেছিল ৩৭ হাজার কিলো। দেবীকে দেওয়া চাল এবং নৈবেদ্যর সামগ্রী দালানের মেঝে থেকে ছাদ ছুঁয়ে যেত।
আড়ম্বরের মধ্যে খানিকটা গৌণ হয়ে যাওয়া দেবীকেও কৌতূহলভরে দেখে যেতে ভুলতেন না সাহেবরা। বিতর্কিত অন্ধকূপ হত্যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হলওয়েল সাহেব পুজো দেখতে এসে তাঁর বই, ‘ইন্টারেস্টিং হিস্টোরিক্যাল ইভেন্টস রিলেটিভ টু দ্য প্রভিন্সেস অব বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য এম্পায়ার অব ইন্দোস্তান’-এ লেখেন, দুর্গাপুজো জেন্টুদের সব থেকে বড় উৎসব। উৎসবের কেন্দ্রে থাকেন ড্রাগনের ওপর অধিষ্ঠিতা দেবী দুর্গা। তিনি সৃষ্টির তিন দেবতার অন্যতম শিবের স্ত্রী। বাহন-সহ অন্যান্য দেবদেবীর সঙ্গে তিনি রাম এবং তাঁর বাহন বানরের কথা বলেছেন। মনে হয় হলওয়েল কোনও বৈষ্ণব বাড়ির পটচিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে সিংহের মুখ ঘোটকাকৃতির এবং যেখানে দুর্গার সঙ্গে রামের অধিষ্ঠান সম্ভব। ফরাসি সৈন্যবাহিনীর আধিকারিক ডি গ্র্যান্ড প্রে দুর্গাকে সম্বোধন করেছেন ‘ম্যাডাম দুর্গা’ বলে। ফরাসি এবং ইংরেজ দুই ব্যক্তিই দেবীর অপরিসীম আভিজাত্য এবং মহিমার কথা লিখেছেন। গ্র্যান্ড প্রে লিখেছেন, পুজোর সময় আনন্দে ভেসে যায় সাধারণ মানুষ। তারা একে অপরের বাড়ি যায়, সামর্থ্য মতো নতুন জামাকাপড় কেনে। ফ্যানি পার্কস লিখেছেন, বাবুর চারমহলা বাড়ি, মধ্যিখানে বিরাট উঠোন। সেই উঠোনের এক পাশে উঁচু মঞ্চের উপর দেবী দুর্গার সিংহাসন। মঞ্চের দু’ধারের সিঁড়িতে ব্রাহ্মণেরা উপবিষ্ট, পূজার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত।
শুধু লিখিত বর্ণনা নয়, বিদেশি চিত্রকররাও যে ভাবে পুজো দেখেছেন, ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন যত্নে। সেই সময়ের বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায়। শিল্পী উইলিয়াম প্রিন্সেপ সম্ভবত জোড়াসাঁকো সিংহবাড়ির ছবি এঁকেছেন। চার খিলানের বাড়িতে দুর্গার উজ্জ্বল মূর্তি। চমৎকার ঝাড়বাতি জ্বলছে দালান জুড়ে। অতিথি অভ্যাগতদের সামনে বসে আছেন গৃহকর্তা। নৃত্যরতা বাইজি মনোরঞ্জন করছে সবার। তাকে সঙ্গত করছে বাজনদাররা। উপরের বারান্দা দিয়ে বাড়ির মেয়েরা পুজো দেখছেন। দালানের পিছনে পাঁঠাবলির প্রস্তুতি চলছে। সশস্ত্র দ্বারীরা পাহারা দিচ্ছে দালানে। ১৮৫৯ সালে রাশিয়ান প্রিন্স আলেক্সিস সলটিকভ শোভাবাজার রাজবাড়ির ছবি আঁকেন। এই ছবিতে দুর্গামূর্তির সামনে একই ভাবে বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের ভিড়। নর্তকীকে ঢোল নিয়ে সঙ্গত দিচ্ছেন ঢুলি। পাশে বসে আলবোলা খাচ্ছেন এক মহিলা। এর অনেক আগে ১৭৯৯ নাগাদ বেলজিয়ামের আঁকিয়ে ফ্রাঁস বালথাজ়ার সলভিন্স পুজোর প্রায় নিখুঁত ছবি এঁকেছেন। পুরনো পুজোর মতো এই ছবিতেও সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। অসুরের রং সবুজ। নবাবি পোশাকে কোমরে খঞ্জর গুঁজে দুই ব্যক্তিও উপস্থিত। পুরোহিত পুজো করছেন। এখানে সাহেব অতিথিদের ভিড় নেই। দেশীয় মানুষরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুজো দেখছেন।
পুজোর এই বিপুল অর্থব্যয়, রেষারেষি কিছু মানুষের আমোদের কারণ হলেও আস্তে আস্তে ব্যাপক ভাবে সমালোচিত হতে থাকে সব মহলেই। ১৮৩৫-এ ‘সমাচার দর্পণ’ লেখে, শ্রীযুত মহারাজ কালীকৃষ্ণ বাহাদুর পুজোয় যে অর্থ ব্যয় করেছেন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলে মঙ্গলজনক হত। ঈশ্বর গুপ্ত লেখেন, “...রাখ মতি রাধাকান্ত রাধাকান্ত পদে/ দেবীপূজা করি কেন টাকা ছাড় মদে/ পূজা করি মনে মনে ভাব এই ভাবে/ সাহেব খাইলে মদ মুক্তিপদ পাবে?” ১৮২১ সালে ‘বসন্তক’ নামে একটি পত্রিকা লিখছে, “আর এক সাধ মনে জাগে অবিরত/ বড় বড় লাল মুখ সাহেব বিবী যত/ নিমন্ত্রণ করিয়া আনিব সে সভায়/ পা দিয়ে সিংহের ঘাড়ে দেখিবে দুর্গায়...” রাধারমণ রায় ‘কলকাতা বিচিত্রা’ গ্রন্থে লিখেছেন, সাধারণ লোক বাবুদের পুজোয় প্রবেশ করতে পারত না। দারোয়ান লাঠি, বেত নিয়ে পাহারা দিত সিংহদ্বারে। কেউ ঢুকতে গেলে বেতের বাড়ি খেয়ে ফিরত। রাজনারায়ণ বসু ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর পুজোর সময় সাহেবদের নিমন্ত্রণ করতেন বলে অন্যান্য হিন্দুরা তাঁর উপর বড় বিরক্ত হয়েছিলেন। এক সময় খ্রিস্টান মিশনারিরাও বিরোধিতা করেন পৌত্তলিকতায় সাহেবদের অংশগ্রহণে। এরই মধ্যে রানি রাসমণির সঙ্গে নবপত্রিকা স্নানের সময় রাস্তা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। শেষ পর্যন্ত ভাবমূর্তি নষ্ট, অর্থের অপব্যয়, নেটিভদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি নানা কারণে ১৮৪০ সালে দেশীয়দের পূজা পার্বণ ইত্যাদিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের যোগদান নিষিদ্ধ হল।
আস্তে আস্তে সময় বদলাল। মজলিশের রংঢংও বদলাল। স্বদেশি আন্দোলনের সময় কোনও বাড়িতে অসুরের চেহারা হল সাহেবের মতো, কোনও বাড়ির বাবুরা আবার প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরত। সে এক অন্য গল্প।