ঐতিহাসিক: ‘সিদ্ধার্থ’ (১৯৭২) ছবির দৃশ্যে শশী কপূর ও সিমি গারেওয়াল।
জার্মান সাহিত্যিক হারমান হেস এর ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। প্রাচীন কপিলাবস্তুর সিদ্ধার্থ নামে এক যুবক মুক্তির সন্ধানে সংসার এবং বাবাকে ছেড়ে পথে বেরোয়। গৌতম বুদ্ধর সঙ্গে দেখা হলেও তাঁর পথ অনুসরণ না করে নিজের মতো করে সন্ধান করে বেড়ায় সে। বাসুদেব নামে এক রহস্যময় মাঝি তাকে নদী পার করে দেয়, বলে সিদ্ধার্থ আবার সেখানে ফিরে আসবে। চলতে চলতে সিদ্ধার্থর দেখা হয় সুন্দরী গণিকা কমলার সঙ্গে। বণিক কামস্বামীর সহায়তায় ধনবান হয়ে সে কমলার সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। তাদের সন্তান হয়।
জীবনের পরম লক্ষ্য, শান্তির সন্ধান করছে সিদ্ধার্থ। শান্তির সন্ধানে তাকে পেরিয়ে আসতে হয় জাগতিক সুখ, সম্পদ, শরীরী প্রেমের এক-একটি ধাপ। আবার সংসার ত্যাগ করে ফিরে আসে সে সেই নদীর কাছে। দেখা হয় বাসুদেবের সঙ্গে। বিশ্বপ্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ বুঝতে পারে সে। অনুভব করে মুক্তির স্বাদ। দেখা হয় কমলা আর তার ফেলে আসা সন্তানের সঙ্গে। কমলা সাপের কামড়ে মারা গেলে। সিদ্ধার্থ তার শিশুপুত্রের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সেই ছেলেও একদিন সিদ্ধার্থকে ছেড়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে, তার বাবার কেমন লেগেছিল যখন সে সংসার ছেড়েছিল। কালচক্রের পূর্ণ আবর্তন অনুভব করে সিদ্ধার্থ।
এই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা পরিচালনা করেন মার্কিন পরিচালক কনরাড রুক্স। লন্ডনে ডি লেন লি স্টুডিয়োতে এই ছবির মিউজ়িকের কাজ চলছে। ছবির সুরকার ভারতীয়। এক দিন কাজের অবসরে সুরকারকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলেন কনরাড, “এই সিচুয়েশনে কোনও ইন্ডিয়ান সং শোনাতে পারো?” ছবিতে দৃশ্যটি ছিল সেই নদীপথের, যেখানে বাসুদেব নৌকোয় পার করিয়ে দিচ্ছে সিদ্ধার্থকে। সুরকার শুনিয়ে দিলেন তাঁর নিজের সুরে একটি বাংলা গান, “ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...” সুর শুনে মুগ্ধ পরিচালক। তার পর গানের অর্থ বুঝিয়ে বলতেই উচ্ছ্বসিত। ছবির সিচুয়েশনে চমৎকার মানাবে এ গান। সুরকার-গায়ক প্রস্তাবটা শুনে একটু দ্বিধায় ছিলেন, গানের কথা তো সাহেব দর্শকরা বুঝবেন না! তা হলে গানটি ইংরেজিতে অনুবাদ করাতে হয়। কিন্তু পরিচালক জেদ ধরলেন। ইংরেজি ছবিতে স্প্যানিশ, ইটালিয়ান ভাষার গান যদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, বাংলা গানই বা হবে না কেন? শেষ পর্যন্ত ওই গানই রেকর্ড করলেন সুরকার-শিল্পী, হারমোনিয়াম আর গিটার সহযোগে, গিটারকে ব্যবহার করলেন দোতারার মতো— যা নিঃসন্দেহে অভিনব। ছবিতে আরও দু’টি ইংরেজি গান গেয়েছিলেন লন্ডনের শিল্পী র্যালফ ম্যাকজেল। কিন্তু মুক্তির আগে নিউ ইয়র্কের এক নামজাদা সমালোচক ছবিটি দেখে মত দিলেন, এর বদলে ইন্ডিয়ান মিউজ়িক ডিরেক্টরের গলায় আরও কিছু গান রাখলেই ভাল হবে। আবার ডাক পড়ল সুরকারের, ছবিতে আর একটি তীর্থযাত্রার দৃশ্যে তিনি গাইলেন ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’। সুরকার-গায়কের নাম হেমন্ত কুমার (মুখোপাধ্যায়), গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ‘ও নদী রে’ গানটি আগে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) ছবিতে, আর ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ ছিল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ (১৯৫৬) ছবিতে।
সেই ঐতিহাসিক ইন্দো-আমেরিকান ছবি ‘সিদ্ধার্থ’ (১৯৭২) পঞ্চাশে পা দিয়েছে; আর ১৯২২ সালে প্রকাশিত, নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক হারমান হেস-এর যে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি, সেটিও একশোয় পা দিল এ বছরই। ছবিটি ইংরেজিতে, কিন্তু বিষয়বস্তু ও পটভূমি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি। গভীর দার্শনিকতায় ঋদ্ধ এ ছবির মূল আকর্ষণ অনবদ্য সিনেম্যাটোগ্রাফি (ক্যামেরায় স্বেন নিকভিস্ত, যিনি ইঙ্গমার বার্গম্যানের সহকারী ছিলেন) আর অবশ্যই সঙ্গীত। মুখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সকলেই ভারতীয়। ‘ও নদী রে’ এবং ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ ছাড়াও, এ ছবিতে ‘মায়ের গান’টি গেয়েছিলেন শান্তি হীরানন্দ, তিনি মায়ের চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। প্রধান ভূমিকায় ছিলেন শশী কপূর (নায়ক সিদ্ধার্থ), সিমি গারেওয়াল (কমলা), রমেশ শর্মা (গোবিন্দ, সিদ্ধার্থর বন্ধু), অমৃক সিং (সিদ্ধার্থর বাবা), জুল ভেলানি (নৌকোচালক বাসুদেব), কুনাল কপূর (সিদ্ধার্থ-কমলার সন্তান) প্রমুখ। নায়িকা সিমি ছিলেন হেমন্তের গানের নিবিষ্ট অনুরাগী। এ প্রসঙ্গে হেমন্ত রসিকতা করে বলেছেন, ভক্তের কাজই দেশে-বিদেশে প্রভুর নাম প্রচার করা। আর সেই ভক্ত নিজেই যদি বিশিষ্ট হন, তা হলে তো কথাই নেই! এ হেন ‘ভক্ত’ সিমির সূত্রেই হেমন্তর সঙ্গে যোগাযোগ হয় পরিচালকের। কনরাড তখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন এমন এক জন ভারতীয় সুরকার, যিনি তাঁর ছবিতে কাহিনির উপযোগী সাঙ্গীতিক আবহ এনে দিতে পারবেন। তখন সিমি গারেওয়াল তাঁকে শোনান ‘আনন্দমঠ’ (১৯৫২) ছবিতে হেমন্ত কুমারের কম্পোজিশন ‘জয় জগদীশ হরে’। এই গান শুনে কনরাড বুঝে গেলেন, এই সুরকারকেই তাঁর চাই। মজার কথা, ‘সিদ্ধার্থ’ ছবির আর একটি দৃশ্যে ‘জয় জগদীশ হরে’ স্তোত্রগানটিও রাখতে চেয়েছিলেন কনরাড; হেমন্ত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করেন, কারণ ওই দৃশ্যের সঙ্গে তা একেবারে মানাত না!
কনরাডের আগের ছবি ‘চাপাকোয়া’র সুরকার ছিলেন রবিশঙ্কর। কিন্তু সে ছিল শুধুই আবহ। বিদেশি ছবিতে ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা বাংলা-র গান, বাঁশি আর দেশি লোকসুরের আমেজমাখা আবহের মেলবন্ধন ঘটল ‘সিদ্ধার্থ’তেই— যে কারণে ছবিটি ঐতিহাসিক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আরও জানিয়েছেন, কনরাড তাঁর কণ্ঠ সারা ছবি জুড়ে ব্যবহার করেছিলেন। একাধিক মরমিয়া দৃশ্যের আবহে শোনা গেছে তাঁর অবিস্মরণীয় কণ্ঠে হামিং আর ছোট ছোট আলাপ— যা ছবির জীবনবোধকে এক অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। ছবিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিলনদৃশ্যের আবহে যে ভাবে দ্রুতলয়ে স্বকণ্ঠে ‘ঝালা’ ব্যবহার করেছেন হেমন্ত, তা ছবির অন্যতম মূল বক্তব্য— অর্থাৎ দেহ থেকে দেহাতীতের দিকে যাত্রাকে কাব্যিক রূপ দেয়। দু’টি গান বা বহু গুরুত্বপূর্ণ আবহে কণ্ঠ ব্যবহার তো ছিলই, এ ছবিতে সিদ্ধার্থর বাবার নেপথ্য সংলাপেও হেমন্ত-কণ্ঠ চিনতে পেরেছেন অনুরাগীরা।
‘সিদ্ধার্থ’-র শুটিং হয়েছিল উত্তর ভারতে, হৃষীকেশে আর ভরতপুরের মহারাজার প্রাসাদ আর এস্টেটের কিছু অংশে। সেন্সর বোর্ডের কল্যাণে সে সময় ছবিটি মুক্তি পায়নি এ দেশে। কয়েক বছর পরে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সিদ্ধার্থ’ প্রদর্শিত হয়। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সিলভার লায়ন’ সম্মানে ভূষিত ছবিটি ১৯৯৬ সালে আবার নতুন করে মুক্তি পায়, এবং ছবি দেখার শেষে ইংরেজ-আমেরিকান দর্শকরা ‘আও নাডিরে’ গুনগুন করতে করতে হল থেকে বেরোচ্ছেন, এমন কথাও লিখেছিলেন এক বিদেশি সমালোচক। এর রিজিয়ন ওয়ান ডিভিডি প্রকাশ পায় ২০০২ সালে। অর্ধশতবর্ষের সূচনায় যদি ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রক এই বিখ্যাত ইন্দো-মার্কিন ছবিকে যোগ্য সমাদরের কথা ভাবেন, তা হতে পারে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তথ্যঋণ: ‘আনন্দধারা’ (সপ্তর্ষি প্রকাশন)— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘আমার স্বামী হেমন্ত’ (সাহিত্যম)— বেলা মুখোপাধ্যায়
কৃতজ্ঞতা: শুভজিৎ সরকার