তামিল জনজীবনে স্বাজাত্যবোধের প্রতীক এই বই
গত বছরের ঘটনা। তামিলনাডুর তামিল ভাষা সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব দফতরের মন্ত্রী কে পন্ডিয়ারাজন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানালেন একটি বইকে জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়ার। এর অন্তত বারো বছর আগে তামিলনাড়ু বিধানসভায় এ বিষয়ে প্রস্তাব পাশ হয়ে গিয়েছে। বইটির জন্য ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেটাস’ দাবি করে প্রস্তাব যায় ইউনেস্কোতেও। প্রথম ইউপিএ জমানাতেও রাজ্যসভায় বইটিকে জাতীয় সাহিত্যের মর্যাদা দিতে কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবছে জানতে চান রাজনীতিবিদ এসজি ইন্দিরা।
‘স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম সন্ত্রাসবাদী এক জন হিন্দু, নাথুরাম গডসে।’ কমল হাসনের এই মন্তব্যের জেরে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল এ বছরেই। তাঁর আগাম জামিনের আবেদন শুনতে গিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি একটি বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ‘সন্ত্রাসবাদীকে তাঁর ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না।’
এখানেই শেষ নয়। চেন্নাইয়ের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার আর থিরুনাভুক্কারাসু তাঁর সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিদিন এই বই থেকেই একটি করে স্তবক পড়ে শোনান।
তামিল জনজীবনে স্বাজাত্যবোধের প্রতিভূ এই বই। রাজনীতি থেকে প্রশাসন, জনমানসে বারবার ফিরে আসে। বইটির নাম ‘তিরুক্কুরল’। লেখক তিরুবল্লুবর।
‘তিরু’ শব্দের অর্থ ‘শ্রী’। এই অর্থ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। পবিত্র, সুন্দর, সম্মাননীয়— নানা অর্থে ব্যবহৃত হয় শব্দটি। ‘কুরল’ শব্দের অর্থ সংক্ষিপ্ত। বইটিতে ১৩৩টি পরিচ্ছেদ, দু’পঙ্ক্তির ১৩৩০টি স্তবক। পরিচ্ছেদগুলি ধর্ম, অর্থ ও কাম— তিন পর্বে বিন্যস্ত। মানবজীবনের তিন পুরুষার্থ নিয়েই বইটির চলাচল। আশ্চর্য ভাবে বইয়ে নেই চতুর্থ পুরুষার্থ মোক্ষের কথা। বইটির সময়কাল নিয়েও মতান্তর রয়েছে। কারও মতে তা রচিত ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্টাব্দ পঞ্চম শতকের মধ্যে। ১৮১২-য় মাদ্রাজের কালেক্টর ফ্রান্সিস এলিসের উদ্যোগে বইটি মুদ্রিত হয়। এ যাবৎ অন্তত ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তিরুক্কুরল এমনই জনপ্রিয় যে তাকে ‘সর্বজনীন বেদ’ বলা হয়। সমসময়ের দৃষ্টিতেও দেখা যেতে পারে এই বই। চেন্নাইয়ের জল-সঙ্কট দেশ জুড়ে এখন চর্চার বিষয়। জলের গুরুত্ব সম্পর্কে এই বইয়ের ‘ধর্ম’ অংশে বৃষ্টি ও মানবচরিত্রকে এক সুতোয় বেঁধে বলা হয়, ‘জল বিনা জগৎ অচর— তাই/ মানুষ-চরিত্র বৃষ্টি-নির্ভর।’ এও জানানো হচ্ছে, আকাশ শুকিয়ে গেলে দেবপুজোও বন্ধ হয়!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই বই পড়েছেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্রকবিতায় আছে ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি’র প্রতি অনীহা। তিরুক্কুরলেও একই ভাবনা, ‘গার্হস্থ্যে যার দৃঢ় অবস্থান/ লাভ করে সে দেবতাদের মধ্যে স্থান।’
শাসনযন্ত্রের সুষ্ঠু পরিচালনা সংক্রান্ত উপদেশও আছে এখানে। আর তাই বোধহয় করুণানিধি থেকে এ পি জে আব্দুল কালাম, সকলেরই অন্যতম প্রিয় বই এটি। করুণানিধি এই বই নিয়ে টীকা লিখেছেন। বইয়ের ‘অর্থ’ অংশে রাজার (প্রশাসকের) যা যা গুণ থাকা দরকার, তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। প্রশাসককে সমালোচনা শুনতে হবে, সে প্রসঙ্গে এই বই বলছে, ‘কটু আলোচনাও সহে যে রাজা/ আশ্রয়ে তার সুখে থাকে প্রজা।’ লেখকের মতে, শূল নয়, ‘ঋজু রাজদণ্ড’ই রাজাকে প্রকৃত বিজয় এনে দেয়। পেশাগত ক্ষেত্রে কর্মীই যে আসল সম্পদ, তা সম্পর্কে তিরুবল্লুবর বলেন, ‘দক্ষ কর্মীকে উপেক্ষা করে যে জন/ তাকে লক্ষ্মী করে বর্জন।’ ব্যক্তি মানুষের উদ্দেশেও আছে বন্ধু নির্বাচন, যৌনতা, জ্ঞান, শত্রুতা-সহ নানা বিষয়ে উপদেশ।
বইটির ‘কাম’ অংশ তুলনায় ছোট, কিন্তু সেখানে নর-নারীর সম্পর্ক, বিরহ ও প্রেমের নানা স্তরের নিপুণ বর্ণনা, সে বিষয়ে উপদেশও দেন তিরুবল্লুবর। প্রেমিকার উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘সে সর্বদা আমার হৃদমাঝারে থাকে/ তবু লোকে বলে, সে নিষ্ঠুর ছেড়ে গেছে আমাকে।’
এই বইয়ের লেখকের নাম প্রথমে জানা যায়নি। পরে নামটুকু জানা যায়, কিন্তু তাঁর ধর্মবিশ্বাস আজও অজানা। বৈষ্ণব, শৈব, জৈন, বৌদ্ধ
ধর্ম প্রভাবিত ছিলেন তিনি, দাবি বিভিন্ন জনের। জন্মকাল, খ্রিস্টপূর্ব ৩১ অব্দে। তবে এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। মনে করা হয়, তিনি মাদুরাই এবং মাইলাপুরমের বাসিন্দা ছিলেন। জনশ্রুতি, এক কৃষকের ফসল বাঁচিয়ে তাঁর কন্যা বাসুকির সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। পরে ‘তৃতীয় সঙ্গম’-এর সময়ে পাণ্ড্য রাজা ও কবিদের সামনে তাঁর সৃষ্টি উপস্থাপন করেন। তার পরেই বইটি নিয়ে জয়ধ্বনি ওঠে।
তিরুবল্লুবরের ছবি আবিষ্কৃত হওয়ার পরে তা নিয়ে উৎসাহ কিছু কম ছিল না। সংসদে তাঁর ছবির পুনরাবিষ্কৃত রূপটির উন্মোচন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন। তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের নির্দেশে রাজ্যের সব সরকারি দফতরে এই মানুষটির ছবি রাখা বাধ্যতামূলক হয়। হালে তাঁর গোটা বইটিকে ১৬ ঘণ্টার সুরে বাঁধা হয়েছে। কন্যাকুমারী থেকে নয়াদিল্লি পর্যন্ত চলে একটি ট্রেনও—‘তিরুক্কুরল এক্সপ্রেস’।
এই বইয়ের গুণগ্রাহী বহু কৃতী মানুষ— লিও টলস্টয়, মোহনদাস গাঁধী, আলবার্ট শোয়াইটজার, ঋষি অরবিন্দ। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ করতে গিয়ে অরবিন্দ তিরুক্কুরলের প্রথম পর্বের দশটি ও দ্বিতীয় পর্বের পাঁচটি স্তবকের অনুবাদও করেন। ১৯৩৭ সালে এই বইয়ের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন নলিনীমোহন সান্যাল। ভূমিকা লিখেছিলেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
তামিল রাজনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই এই বইটিকে তুলে ধরতে তৎপর। বাঙালিরও তো আছে একান্ত নিজস্ব ‘চর্যাপদ’। হোক তা চরিত্রগত ভাবে আলাদা, কিন্তু তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না কেউ। এও কি আত্মবিস্মৃতি নয়?