ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
মল্লার বলল, “ও ভাবে দেখছেন যে!”
“ইচ্ছে হচ্ছে,” চিরশ্রীর চোখ আর ঠোঁট জুড়ে রহস্যময় হাসি, “আপনাকে দেখছি।”
“দেখার কিছু নেই। অতি সাধারণ দেখতে এই যন্ত্রীকে খুব খুঁটিয়ে দেখলে বিকর্ষণ তৈরি হবে,” মল্লার বলল।
“সময় তা বলবে,” চিরশ্রী তার দিকে এগিয়ে এল। চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল মল্লারের গলা। মল্লার ঘন চুলের মায়াবী ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। চিরশ্রী দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেল। আবেগে উষ্ণ হয়ে উঠল মল্লার।
চিরশ্রী ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি পাথর? এসো, ভালবেসে আমাকে ভরিয়ে দাও।”
মল্লার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিরশ্রীকে দু’হাতের শক্ত বেষ্টনীতে বন্দি করে ফেলল। চিরশ্রীর শরীর, তার মনমাতানো সুগন্ধ তাকে প্রবল ভাবে টানছে। বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে পাগলের মতো সে চিরশ্রীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখল। তৃপ্তি ও অনুরাগে চিরশ্রী এক ভরা ঢেউ হয়ে উঠল।
কিছু ক্ষণ পরে চিরশ্রী বলল, “ছাড়ো। ও এ বার এসে পড়বে।”
মল্লার চিরশ্রীকে ছেড়ে দিল। এ বার চিরশ্রী উপরে উঠে গেল। কয়েক মিনিট পরে চুল বেঁধে ফিরে এল।
মল্লার বলল, “আজ কোন গান তুলবে?”
চিরশ্রী মৃদু হাসিতে বলল, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।”
মল্লার নিচু গলায় বলল, “সর্বনাশ তো শুরুই হয়ে গেল।”
“তুমি পুরুষ। ব্যাচেলর। আমি এক জনের ঘরনি। সর্বনাশে তাই আমারই অধিকার।”
“তা হলে কেন করলে এ সব?”
চিরশ্রী উদাস চোখে বলল, “কী যে হয়ে গেল! তুমি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে। মন কঠিন করেও ভেসে যাওয়া আটকাতে পারলাম না।”
“তুমি কি অসুখী ছিলে?”
চিরশ্রী মাথা নাড়ে, “সুখী বা অসুখী কোনওটাই নই। ও প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত, আমি সারা দিন একা একা ঘরে বন্দি। আমি এই জীবনে হাঁপিয়ে উঠছি। এক দিন আমাকে নিয়ে যাবে বাইরে? তোমার সঙ্গে থাকব, ঘুরব।”
চিরশ্রীর ব্যাকুল চোখের দিকে তাকিয়ে মল্লার বলল, “আমার অসুবিধে নেই। তুমি এ ভাবে বাইরে আমার সঙ্গে ঘুরলে ঝুঁকি হয়ে যাবে না?”
চিরশ্রী বলল, “কিছু পেতে হলে সাহসী যে হতেই হয়। কেউ দেখে ফেললে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ও নিয়ে ভেবো না।”
“ঠিক আছে। তবে ওই গানটা থাকুক। ওটা সিন্থেসাইজ়ারে তোলা বেশ কঠিন। ওটা না বাজানোই ভাল। তার চেয়ে এই গানটাই হোক— ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’। পছন্দ?”
চিরশ্রীর মুখে খুশির রেণু, “হ্যাঁ, আজকের জন্য এই গানটাই ঠিক।”
রাতে ইনবক্সে গেল না মল্লার। চিরশ্রী বারণ করে দিয়েছে। ঘুম এল না কিছুতেই। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকল। স্বপ্নের রঙে উজ্জ্বল হয়ে এল গভীর রাত, মনের ভেতর হাজার জোনাকি জ্বলে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। তারা দু’জনেই আজ নিজেদের অজানতেই একে অপরকে ‘তুমি’ বলা শুরু করেছে।
ভোররাতের স্বপ্নটা মনে পড়তেই রুমকি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে এক বার হোঁচট খেল সে।
স্বপ্নটা মন থেকে সরছে না কিছুতেই।
সে অভ্রর সঙ্গে শহর ছাড়িয়ে কোথাও যাচ্ছে। যেতে যেতে গভীর এক শালবন পড়ল। হু-হু করে ছুটছে অভ্রর বাইক। অভ্রর চুল উড়ছে, উড়ছে তার আঁচল, সে জড়িয়ে ধরতে চাইছে অভ্রকে। অভ্র বাইক থামিয়ে নেমে দাঁড়াল, হাত বাড়িয়ে ডাকল তাকে, সে ছুটে যাচ্ছে। কিছুতেই সে অভ্রর কাছে পৌঁছতে পারছে না। আশ্চর্য, অভ্র দূরে চলে যাচ্ছে,
তাদের দু’জনের মধ্যে ক্রমশ ব্যবধান বাড়ছে। পিছিয়ে যেতে যেতে ভারসাম্য হারাল অভ্র। একটি বিশাল পাথরখণ্ডে ধাক্কা খেয়ে অভ্র ছিটকে পড়ল। রক্তাক্ত শরীরে উঠে দাঁড়াতে চাইছে অভ্র, কিছুতেই পারছে না।
অসহায় চোখে তাকিয়ে অভ্র বলছে, “আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। তুই ঘরে ফিরে যা রুমকি। নীলার্ণবের কাছে ফিরে যা।”
বাকিটা আর মনে নেই তার। কত বছর পরে অভ্র তার স্বপ্নে এল! এক হিসেবে অভ্র এখন পরপুরুষ, তা-ও স্বপ্নে সে এসেছে। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ কি এতটাই সহজ? আসলে অভ্রকে সম্পূর্ণ ভাবে স্বাবলম্বী দেখলে, সংসারী দেখলে সে নিশ্চিন্ত হত। বুকের ভার লাঘব হত, অস্বস্তি কাঁটা হয়েও ফুটত না। আগে মাঝেমধ্যে মনে অভ্র উঁকি দিলেও সে তাড়িয়ে দিয়েছে। অভ্র কি নিজের পায়ে কখনওই দাঁড়াতে পারবে না? এই প্রশ্নটা ইদানীং তার মনে এসেই যাচ্ছে। যে নিরাপত্তার মোহে সে নীলার্ণবের হাত ধরেছিল, আজকাল তা অলীক বলে মনে
হয়। নিশ্চিত নিরাপত্তা বলে জীবনে কি সত্যিই
কিছু আছে?
রুমকির মনে হল, মেয়েদের জীবনে দুটো অংশ থাকে। একটা অংশ বিয়ের আগে, আংশিক স্বাধীন। আর একটা অংশ শুরু হয় বিয়ের পরে, আংশিক পরাধীন। নীলার্ণব তাকে শেকলে বাঁধেনি, তেমন স্বভাব তার নয়। কিন্তু সমাজ-সংসার একটা অদৃশ্য বেড়ি পরিয়েই দেয়। বিয়ে করে গড়ে তোলা সম্পর্কটাই একমাত্র এবং চূড়ান্ত সম্পর্ক হতে পারে না। অন্য কারও জন্য বুকের গভীরে কিছু অনুভব থাকতেই পারে। এই যে অভ্রর জন্য তার মন কেমন করছে, ইচ্ছে করছে তার কাছে ছুটে যেতে, ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে কিছু, তা সে প্রাণপণে চেপেই রেখেছে। কারও কাছেই তা বলা যাবে না। চরিত্রহীনার তকমা দিয়ে দেবে। অভ্রকে সে একটি বার উদ্দীপ্ত করতে চায়, বলতে চায়—‘জেগে ওঠ অভ্র, তুই অন্য ভাবে জেগে ওঠ। তুই না মাস্টার্স ডিগ্রিতে ইউনিভার্সিটির থার্ড? তোর এই বর্তমান আমাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে জানিস? কেন যে এত বছর পরে আবার আমাদের দেখা হচ্ছে বার বার?’
ডিপার্টমেন্ট স্টোর্সের দরজা ঠেলে ঢুকল রুমকি।
তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চোখ কুঁচকে তাকাল রুমকি। সকাল সাড়ে দশটায় নীলার্ণবের কোন দরকার পড়ল তার সঙ্গে? অন্য সময় হলে সে ধরতই না। হাত খালি আছে বলেই সে কলটা ধরল।
“হ্যালো।”
“কোথায় আছ?”
“কাজের জায়গায়। সংসারের জিনিসপত্র কিনতে এসেছি ডিপার্টমেন্ট স্টোর্সে।”
“প্রচুর হ্যান্ডসাম ছেলে আছে আশপাশে?”
রাগ চেপে রুমকি বলল, “ইয়ার্কি করার
সময় এটা নয়। থাকলেও দেখার ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই নেই।”
“রাগছ কেন ডার্লিং? নিজের বৌয়ের সঙ্গে ইয়ার্কিও করব না?”
নিচু গলায় রুমকি বলল, “তোমার সঙ্গে ঠাট্টা-রসিকতার মুড নেই, বুঝেছ?”
“কেন?”
“তোমার মায়ের জ্বালায়।”
“কেন? মা আবার কী করল?”
“টিপিক্যাল শাশুড়িরা যা করে, তা-ই করছে। ঘোড়া দেখে খোঁড়া। আমি এখানে আসতেই রান্নাবান্না থেকে রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে। দু’বেলা হাঁড়ি ঠেলতে হচ্ছে আমাকে। এ দিকে রান্নার লোকও রাখবে না। তারা নাকি অজাত-কুজাত, তাদের হাতে খাওয়া চলবে না। তোমাকে বার বার বলেছিলাম যে গুয়াহাটিতে গিয়েই থাকব। কষ্ট বা অভাব হলেও মানিয়ে নেব। তুমি রাজি হলে না।”
নীলার্ণব বলল, “আর তো ক’টা দিন। একটু মানিয়ে নাও।”
“মানিয়েই তো নিচ্ছি। এই যে তোমার মায়ের গল ব্লাডার অপারেশন হবে, সমস্ত ঝক্কি আমাকেই সামলাতে হবে। সামলে নিতে অসুবিধেও হবে না। কিন্তু তোমার মা সেই টিপিক্যাল শাশুড়িই রয়ে গেলেন। মান্ধাতা আমলের মানসিকতা নিয়ে বসে থাকবেন কেন? নিজেকে একটু বদলানো যায় না? তা ছাড়া আমিই বা কত মিথ্যে বলে বেড়াব? চার দিকে মানুষের প্রশ্নবাণ। এত দিন, চার মাস হল, এখানে আছি কেন? আমি কি তা হলে সেকেন্ড ইস্যু নিয়েছি? অজুহাত কত শোনাব বলতে পারো? কী ভাবে বলব যে, তোমার নাগপুরের চাকরিটা চলে গেছে? এ দিকে তুমি কাউকে সত্যিটা বলতে বারণ করেছ। তাতে নাকি তোমার প্রেস্টিজ চলে যাবে!”
“বি কুল, ডার্লিং। আমি বি গ্রেডের ইঞ্জিনিয়ার নই, শিবপুর থেকে বি টেক করেছি। যে কোনও মানুষের লাইফে ব্যাড প্যাচ আসতেই পারে। আমারও এসেছিল। কেটে গিয়েছে। পরের মাসেই আমি একটা কোম্পানিতে জয়েন করছি। নভেম্বর দু’হাজার বাইশ থেকে নীলার্ণব নন্দীর কর্মক্ষেত্র হবে সল্ট লেক।”
রুমকি অবিশ্বাসের স্বরে বলে, “সত্যি?”
“চাকরির ব্যাপারে মিথ্যে বলব? সারপ্রাইজ়টা দেব বলেই তো ফোন করেছিলাম। সেটা বলার আগেই তুমি কিঁউ কি সাঁস ভি কভি বহু থি সিরিয়াল চালু করে দিলে।”
রুমকির গলা আনন্দে কেঁপে গেল, “তা হলে ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। এত দিনে আমাদের দুঃসময় কাটল। কেমন দেবে?”
“আঠারো লাখ পার অ্যানাম। প্রত্যাশার তুলনায় কম, তবে ভাল ভাবে চলে যাবে। জয়েন তো করি আগে, তার পর সময়-সুযোগ বুঝে বেটার কোনও অপশনে যাব। তাই বলছিলাম যে, আর ক’টা দিন কষ্ট করে মানিয়ে নাও।”
রুমকি বলল, “ঠিক আছে। ও নিয়ে ভেবো না। আজই মায়ের কাছে যাব।”
“কোন মা?”
“মা সিদ্ধেশ্বরী কালীর কাছে।”
“দেবদ্বিজে অচলা ভক্তি তোমার। কষ্ট করে একটা ভাল জব জোগাড় করলাম আর মাঝখান থেকে ক্রেডিট হল মা কালীর!”
রুমকি কপট রাগে বলল, “ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না। মা আসলে এত দিন পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। তা কলকাতায় থাকব কোথায়?”
“প্রথমে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেব। কিছু দিন পরে দেখেশুনে ফ্ল্যাট কিনতেও পারি। বাকি জীবন কলকাতায় থাকব এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। সময় হলে ভাবব।”
রুমকি আনন্দে বেরিয়ে এল বাইরে। তার এখন প্রজাপতি হয়ে উড়তে ইচ্ছে করছে। বেচারা ঋক দু’মাস হল বাবাকে দেখেনি। নভেম্বর মাস থেকে আবার তারা তিন জন এক সঙ্গে থাকবে, জীবন আবার আগের মতো ছন্দে ফিরবে। এত দিনে বুকের জমাট দুঃখ সরে গিয়ে নিজেকে হালকা লাগছে। দু’হাজার কুড়ির ডিসেম্বরে তাদের জীবনে দুঃসময় নেমে এসেছিল অতর্কিতে। কোভিড পরিস্থিতির জন্য কোম্পানি বেশ কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করে দিল। নীলার্ণবও ছিল তাদের মধ্যে এক জন। কর্পোরেট জগৎ বড় নিষ্ঠুর, মানবিকতার তোয়াক্কা করে না, স্বার্থটাই শুধু বোঝে। মাত্র দশ দিনের নোটিসে কোম্পানির দেওয়া সুসজ্জিত ফ্ল্যাট তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তখনই নীলার্ণব নিজের শহরে ফিরে এসেছিল। মরিয়া হয়ে অন্য চাকরির খোঁজ করেছিল সে। একেই করোনার জন্য বাজারে ডামাডোল, চাকরি পাওয়ার থেকে চাকরি চলে যাওয়ার সংখ্যাই বেশি, নীলার্ণব কোনও চাকরিই জোটাতে পারছিল না। শেষে একটি মাঝারি কোম্পানিতে কাজ পেল, মাইনে কম, আগের চাকরিতে যা মাইনে ছিল তার অর্ধেকও নয়। অন্য কোম্পানিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চললেও এখানে তা চলবে না। কারখানার প্রোডাকশনের কাজ দেখতে হবে। ওই মাইনেতে গুয়াহাটিতে সংসার চালানো সম্ভব নয়। রুমকি আর ঋককে রেখে নীলার্ণব উড়ে গেল গুয়াহাটি। গত তিন মাসে বাড়ি আসেনি ঋকের বাবা, পুজোর সময়ে হয়তো আসবে। মাঝেমধ্যেই নীলার্ণব বলত, “ভাবছি বাড়ি গিয়ে আর ফিরব না। বাড়িতে বসেই অনলাইন কনসালটেন্সির কাজ করব।”
ক্রমশ