পূর্বানুবৃত্তি: অরণ্যে বিহারকালে হঠাৎই অর্জুনকে এক পরীক্ষার মুখে ফেলেন গুরু দ্রোণ। আশাতীত কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় অর্জুন। অভিভূত অস্ত্রগুরু তাকে বলেন, তার তুল্য ধনুর্বিদ আর কেউ নেই। উদ্বুদ্ধ অর্জুন এই বিবৃতি সম্বন্ধে নিঃসংশয় হতে চায়। তখনই দ্রোণের মনে পড়ে কিছু দিন আগে তাঁর প্রতি প্রকাশিত বসুষেণের বিক্ষোভের কথা। দ্রোণের প্রতি অশ্রদ্ধায় সে ত্যাগ করেছে শিক্ষাসত্র। তবু অর্জুনের একক শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে কেন তাঁর মনে পড়ে গেল বসুষেণের কথা!
অস্বস্তিকর এই নীরবতা অকস্মাৎ কোলাহলে ভেঙে যায়। রাজ-অনুচরেরা চিৎকার করতে করতে এ দিকেই আসছে। অর্জুনকে ছেড়ে দ্রোণ সে দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী?... কী ব্যাপার?”
অনুচরেরা নিয়ে আসছে একটি কুকুরকে। জানা যাচ্ছে, সারমেয়টি কিছু ক্ষণ আগে বনের গভীরে প্রবেশ করেছিল একটি বন্য শশকের পিছু নিয়ে। এইমাত্র সে প্রত্যাবর্তন করেছে... কিন্তু...
“দেখুন, গুরু দ্রোণ! কী অবস্থা করেছে প্রাণীটার!” ক্রুদ্ধ বিস্ময় এক অনুচরের কণ্ঠে।
৯
বিদুর মৃদু হাস্য করলেন। সম্মুখে উপবিষ্টা কুন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন এক মুহূর্ত, তার পর শান্ত কণ্ঠে বললেন, “অতিরিক্ত উদ্বেগের কিছু নেই, ভদ্রে। আপনার সন্তানরা আর নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য নাবালক নয়। কুরু-পুরীতে তাদের অবস্থান এখন দৃঢ়প্রোথিত, শিক্ষাও সম্পন্ন হল যথেষ্ট দীর্ঘকাল, গুরুগৃহবাস প্রায় সমাপ্তির মুখে। তাদের ক্ষতিসাধন করা এখন অত সহজ হবে না। মৃগয়াতে গিয়েছে মানেই তারা নিরাপত্তাহীন, বিপন্ন— এমন ভাবছেন কেন?”
কুন্তীর মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন স্পষ্ট এখনও। যেন আত্মগত ভঙ্গিতেই বললেন, “জানি। আমি বীরমাতা, সে তো ঋষিরাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু, মায়ের মন...! পুত্র যুবক হলেও মা কি তাকে বালক ছাড়া কিছু ভাবতে পারে? যত ক্ষণ দৃষ্টির বাইরে থাকে, তত ক্ষণই আতঙ্কে থাকি। গুরুগৃহে সারা দিন ওই হননেচ্ছু পাপী দুর্যোধনের সংস্রবে রয়েছে আমার সরলমতি পুত্রেরা— এই কথা মনে পড়লেই হাতের তালু শীতল হয়ে আসে। আশ্রমে তো সারা দিন ধরে সমস্ত শিক্ষার্থী একে অন্যের ঘনিষ্ঠ নৈকট্যে আসছে! ক্রীড়া, ভোজন, দ্বন্দ্ব, আলাপ— সব! যে আঘাত করার সুযোগ খুঁজে চলেছে, তার পক্ষে সামান্য রন্ধ্রই তো যথেষ্ট! বিশেষত, মৃগয়া করতে বেরিয়ে গহন অরণ্যগর্ভে অরক্ষিত মুহূর্ত খুঁজে নেওয়া কি খুব কঠিন? ভেবে দেখুন, এক বার যে দুরাত্মা সচেষ্ট হয়েও ব্যর্থ হয়েছে, সে কি দ্বিতীয় বার তৃতীয় বার উদ্যোগ নেবে না? তার তো লোকবলও অধিক। একশত ভ্রাতা, সকলেই তার অনুগত...”
বিদুর কিছু ক্ষণ নিরুত্তর রইলেন। কুন্তী স্নেহশীলা মাতার মতোই উদ্বেগগ্রস্তা— কিন্তু এই উদ্বেগ নিতান্ত অমূলক অতি-চিন্তা বলে উপেক্ষা করা চলে না। অল্পে ব্যাকুলা হবেন তেমন নারী পাণ্ডুজায়া শৌরসেনী নন, প্রচুর উত্থানপতন পেরিয়ে এসেছেন জীবনে। এই প্রসঙ্গটি তাঁকে উদ্বেল করেছে, কারণ পূর্ব-ইতিহাসটি যে সাংঘাতিক! অনেক বর্ষ অতিক্রান্ত হল, কিন্তু বিস্মরণীয় নয় আদৌ! কোনও মাতার পক্ষে সে ইতিবৃত্ত ভোলা দুষ্কর, তা তিনি যতই দৃঢ় ব্যক্তিত্বময়ী হোন।
বনবাস থেকে হস্তিনায় আসার স্বল্প দিন পরেই সদ্য পিতৃহারা পাণ্ডবদের উপরে নেমে এসেছিল ধার্তরাষ্ট্রদের জিঘাংসু আঘাত!
কোপটি পড়েছিল মধ্যম পার্থ ভীমসেনের উপর। ক্রীড়াচ্ছলে সেই বলবান বালক দুর্যোধনের কোন ভ্রাতাকে কবে প্রহার করেছে, কবে কোন বৃক্ষ থেকে ফেলে দিয়েছে, নিষ্পেষণের মাধ্যমে পীড়ন করেছে, সন্তরণকালে জলের মধ্যে চেপে ধরেছে— এ নিয়ে কয়েক বার অভিযোগ উঠেছিল রাজপুরীতে। পুত্রকে বহু বার ভর্ৎসনাও করেছিলেন কুন্তী। গান্ধারীপুত্রদের কাছে টেনে, আদর-প্রবোধ দিয়ে, ক্ষোভ-প্রশমনের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু এও বুঝেছিলেন, খুব যে কিছু পরিকল্পিত আক্রোশে বৃকোদর এ সব কর্ম করে থাকে, তা নয়। অন্তত প্রথম পর্যায়ে তো একেবারেই নিষ্পাপ ছিল তার কাণ্ডগুলি। জ্ঞাতিভ্রাতাদের সঙ্গে সাধারণ বালসুলভ কৌতুক করতে গিয়েই ঘটে যেত নিপীড়ন; তার শারীরিক শক্তি যে অন্যের তুলনায় কয়েকগুণ অধিক— তা স্মরণে রাখতে পারত না অতিকায় বালক।
কিন্তু ক্রুদ্ধ কুরু-কুমারেরা দ্রুত শত্রুভাবাপন্ন হল তার প্রতি। তার আকার-আকৃতি নিয়ে, তার অতিরিক্ত ভোজন-নিদ্রার লোভ নিয়ে, এমনকি তার জন্মরহস্য নিয়ে পর্যন্ত শুরু হল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। রুষ্ট হয়ে ভীম তখন ইচ্ছাপূর্বক তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। মাতা কুন্তী তখনও যথেষ্ট শাসন-সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পুত্রটি তেমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি নয়, তদুপরি ক্ষণক্রোধী। মাতৃবাক্য সে মনে রাখতে পারত না, রেগে যেত পরিহাস শুনলেই, নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিত।
তবু, এত অশান্তি সত্ত্বেও, ক্রীড়াঙ্গনের এই বালকোচিত বৈরটুকুই দুর্যোধনকে এত নীচ প্রতিহিংসা-সাধনে প্ররোচিত করবে, কেউই প্রত্যাশা করেনি। রীতিমতো পূর্বপরিকল্পনা করে গঙ্গাতীরের প্রমাণকোটিতে জলক্রীড়ার আয়োজন করেছিল সে, সঙ্গে আহার ও প্রমোদ নানাবিধ। পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর, খাদ্যপ্রিয় ভীমসেনকে সবার অলক্ষ্যে সে বিষমিশ্রিত মিষ্টান্ন খাইয়ে দেয়। অচিরে ভীম অচৈতন্য হয়ে পড়লে, ভ্রাতাদের সহায়তায় সে গোপনে ভীমের নিশ্চেষ্ট দেহটিকে নদীজলে নিক্ষেপ করে!
ঘটনাটি স্মৃতিপটে জাগরূক হওয়া মাত্র পৃথা শিহরিত হয়ে চক্ষু মুদ্রিত করলেন। কত দিন হয়ে গেল! তবু এখনও যত বার মনে পড়ে সেই কাল-অপরাহ্ণের কথা— সেই প্রায়ান্ধকার প্রদোষে যুধিষ্ঠির উদ্ভ্রান্তের মতো এসে জানতে চাইছে, “মা, ভীম কি আগেই ফিরেছে? তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না!”— তত বার যেন নতুন করে বজ্রাঘাতে পঞ্জর দুলে ওঠে মাতার, যেন হৃৎপ্রকোষ্ঠে রক্তস্রোত স্তব্ধ হয়ে যায়!
কী ভাবে যে কেটেছিল সেই ভয়ঙ্কর নিশি! তাঁর আদরের ভীম, অতিকায় অতিভোজী মূঢ় বালক— ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না, অল্পেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, “মা খাদ্য দাও” বলে ক্রন্দন করে এখনও— সারা রাত মাতৃক্রোড়বিচ্যুত হয়ে কোথায় রইল! দেহটি বিপুল, কিন্তু চেতনা যে এখনও শিশুর মতো তার! মা ছাড়া কিছু জানে না সে। রাতে মায়ের বুকের কাছে তার বিরাট দেহটিকে কুণ্ডলীকৃত করে তবে সে নিদ্রা যায়। কোথায় কোন অজানা বিপদে জলে-জঙ্গলে-গুহায়-প্রান্তরে অন্ধকারে পড়ে রইল সে, অরক্ষিত, অভুক্ত! ভাগ্যের কোন দুর্বিপাক ঘিরে ধরেছে তাকে এত ক্ষণে! জীবিত আছে কি না...
না! না! নিজের চিন্তাপথটিরই শ্বাসরোধ করতে চাইছিলেন জননী!
এক রাতের দুশ্চিন্তায় অর্ধোন্মাদের মতো হয়ে উঠেছিলেন কুন্তী, বালিকার মতো ক্রন্দন করছিলেন আর জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠিরকে কেবলই বলছিলেন, “আমার বৃহৎ পুত্তলি, আমার অবোধ দৈত্য, আমার সরল সাদা ভীম! তাকে না দেখা পর্যন্ত আমি স্থির ভাবে শ্বাস নিতে পারছি না! এনে দে তোরা যেখান থেকে পারিস, তুই জ্যেষ্ঠ... কী বিবেচনায় এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছিস! যা, সন্ধান কর— বাছার ক্ষুধা পেয়ে থাকবে, মা’র কাছে এনে দে...”
উফ্, বাস্তবিকই সে স্মৃতি অসহ্য! এই শীতল দক্ষিণবায়বিধৌত সায়াহ্নেও কুন্তীর ললাটে ঘাম দেখা দিল, কণ্ঠ শুষ্ক হল।
১০
“প্রণাম, আচার্য! আপনি নিজে পায়ে হেঁটে আমার সামনে আসবেন, এ আমি কখনও কল্পনা করিনি। এ আমার আশার অতীত!”
ভূম্যবলুণ্ঠিত প্রণিপাতের মুদ্রা থেকেই আবেগাপ্লুত কিশোর-স্বর শোনা গেল।
দ্রোণ কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “স্বস্তি।”
তাঁর কৌতূহলী চক্ষু চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এই বিজন অরণ্যভূমিতে, যেখানে দিবাভাগেই অন্ধকার— সেখানে এ কী চমৎকার আয়োজন! অরণ্যের একদম কেন্দ্রে অনেকগুলি বনস্পতি কেটে ফেলে একটি চক্রাকার মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু বনভূমির বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। সেই ফাঁকা ও আলোকিত ভূখণ্ডের এক প্রান্তে একটি পর্ণকুটির। অপর প্রান্তে শরক্ষেপ-অনুশীলনের জন্য লক্ষ্যবেধ-চিত্র। কাঠের ফলক সংযুক্ত করে একটি বৃত্তাকার পট, বৃক্ষকাণ্ডে ঝুলছে।
দ্রোণের দৃষ্টি এও এড়াল না যে, সেটির পরিকল্পনা অবিকল তাঁর আশ্রমের লক্ষ্যবস্তু-আলেখ্যটির অনুকরণে চিত্রিত। কেন্দ্রে লাল, তাকে ঘিরে হরিদ্রা, তার বাইরে গাঢ় নীল বেষ্টনী— এই ভাবে মোট পাঁচটি বর্ণে অলঙ্কৃত লক্ষ্যপট। এই বর্ণবিন্যাসের একটি বিজ্ঞান আছে, মানুষের দৃষ্টিক্ষমতার প্রাবল্য-দৌর্বল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি খুব পরিচিত তত্ত্ব নয়, দ্রোণের নিজস্ব গবেষণালব্ধ নির্মাণ। কোনও সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে নিতান্ত অপ্রশিক্ষিত অনুশীলনের জন্য এই নিখুঁত বিন্যাসটি উদ্ভাবন করা অসম্ভব।
লক্ষ্যবেধ-পটের ঠিক কেন্দ্রস্থলে— রক্তিমবর্ণের ক্ষুদ্রতম বৃত্তটিতে, বিদ্ধ হয়ে রয়েছে তিনটি বাণ। বাইরের হলুদ অংশে মাত্র একটি। দ্রোণ একেবারে নিকটে গিয়ে, সমগ্র পটে বেধ-চিহ্নগুলি গণনা করে দেখলেন। প্রায় সব ক্ষেপণেই অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদ হয়ে থাকে এখানে, লাল বৃত্তটি তাই ছিদ্রে পরিপূর্ণ। আলেখ্যর অবশিষ্ট অংশ প্রায় অক্ষত।
“এখানে কে ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করে? কুকুরকে তির কে মেরেছে? তুমি?”
সারমেয়টি অরণ্য-গভীর থেকে ফিরেছিল বাণবিদ্ধ অবস্থায়। তার মুখে বিঁধেছিল সাতটি বাণ। পশুটির রক্তপাত হয়নি এক বিন্দুও, প্রাণ বিপন্ন হয়নি, এমনকি খুব যন্ত্রণাকাতরও তাকে দেখাচ্ছিল না। দিব্য হেঁটে-ছুটে বেড়াচ্ছিল সে। শুধু তার স্বর রুদ্ধ হয়েছিল, সে ডাকতে পারছিল না। এমন অদ্ভুত কৌশলে সাতটি তির নিক্ষিপ্ত হয়েছে, স্বর-হরণ ব্যতীত এতটুকু ক্ষতি হয়নি জীবটির।
সস্নেহ ও সতর্ক পরিচর্যায় তিরগুলি কুক্কুরের মুখ থেকে মোচন করেছিলেন দ্রোণ। তাঁর চক্ষু সুতীক্ষ্ণ হয়েছিল, নাসাপুট বিস্ফারিত। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল অর্জুন। তার ভ্রু দু’খানি কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। সে বলেছিল, “গুরুদেব, এই শরগুলি কী অদ্ভুত... এমন তো আমাদের আয়ত্তে নেই!”
দ্রোণ স্তব্ধ হয়ে ছিলেন কিছু ক্ষণ। যুধিষ্ঠির খুব কাছ থেকে নিরীক্ষণ করে বলেছিল, “আচার্য, এমনই সূক্ষ্ম শর আপনি ব্যবহার করেছিলেন আমাদের কাষ্ঠ-বীটা উত্তোলনের সময়, তাই না?”
“ঠিক! আমরা কখনও অত সরু তির দেখিনি বলে ভেবেছিলাম ঈষীকা-তৃণ বুঝি!” ভীম বলে উঠেছিল, “বনের মধ্যে এ বস্তুর ব্যবহার করল কে? এমনকি অর্জুনের পর্যন্ত অধিকারে নেই যা...”
দ্রোণও ভাবছিলেন একই কথা... না, আরও কিছু প্রশ্ন, আরও কিছু সংশয়। শুধু সূক্ষ্ম শরই নয়, এর মধ্যে আছে আরও কিছু রহস্য। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে— এই শরের অগ্রভাগে খুব মৃদুমাত্রায় লিপ্ত আছে স্নায়ু-অবশকারী লঘু-বিষ। যার প্রভাবে বিদ্ধ পেশির সংলগ্ন অংশটুকু কয়েক দণ্ডের জন্য নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। কুকুরের মুখ ও জিহ্বা তথা বাগিন্দ্রিয়কে স্বল্প সময়ের জন্য অসাড় করে দেওয়া হয়েছে, অথচ তার স্থায়ী ক্ষতি বা বেদনা না হয়--- ভাবা হয়েছে তা-ও!
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন দ্রোণ। জানতে হবে এই রহস্যের মূল। কিন্তু অধিক প্রচার যেন না হয়। তাই কেবল যুধিষ্ঠির, অর্জুন, দুর্যোধন, যাদবকুমার সাত্যকি আর পুত্র অশ্বত্থামা— এই পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অরণ্যাভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন, অবশিষ্ট শিক্ষার্থীদের রাজরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন বনের বাইরে।
অটবীর কেন্দ্রস্থলে অতঃপর আবিষ্কৃত হল এই চমকপ্রদ ব্যাপার! ধনুর্বিদ্যা-অনুশীলনের নিভৃত আয়োজন। এই চর্ম-বল্কলাবৃত শীর্ণকায় কৃষ্ণবর্ণ কিশোর যে কর্মকাণ্ডের নায়ক!
“হ্যাঁ, প্রভু! কুকুরটা বড় শব্দ করছিল। তির ছোড়া অভ্যাস করছিলাম, চিৎকার শুনে হাত নড়ে যাচ্ছিল। তাই কিছু ক্ষণের জন্যে চুপ করিয়ে দিয়েছি শুধু, মরবে-টরবে না। দেখতে-দেখতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অপরাধ হয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি প্রভু!”
“তোমার নাম?”
“প্রভু, আমি একলব্য। জাতিতে নিষাদ।”
“নিষাদ?” দ্রোণের ভ্রুকুটি দেখা দিল, “না! তোমার মুখের গঠনে তো অনার্য-লক্ষণ নেই! তুমি ক্ষত্রিয়কুলজাত বলে বোধ হচ্ছে আমার। অনৃত-পরিচয় দিচ্ছ কেন?”
১১
বিদুর রাজমাতাকে লক্ষ করছিলেন। সামান্য গাঢ় স্বরে বললেন, “বিগত দুঃস্বপ্ন থেকে নিজেকে উদ্ধার করে আনুন আর্যা। ভীমের বিপদ হয়েছিল, কিন্তু সে বিপদ যে ভাবেই হোক অতিক্রান্ত হয়েছে, উপরন্তু তার লাভই হয়েছে ওই ঘটনায়। নদীতীরবর্তী বন্য নাগ উপজাতির চিকিৎসকরা তার বিষ-নিষ্কাশন করার পরে তাকে যে বিরল ওষধিটি খাইয়েছিল, তার গুণ অসামান্য। আর কোনও বিষ সহজে তাকে অসুস্থ করতেই পারবে না। আমি রাজপুরীর বিশেষজ্ঞ বিষবৈদ্যকে দিয়ে ভীমের শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি।”
“কিন্তু আমার অন্য পুত্রেরা? তারা যদি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়? আর, হে মহাত্মন্, বিষই তো একমাত্র বিপদ নয়। পাপমতি দুর্যোধন তো অস্ত্রেও পটু হয়ে উঠেছে শুনতে পাই। যদি দ্বন্দ্বের ছলে, বা নিতান্ত গোপনেই কখনও...”
“না, সে-বিষয়ে আমার সদাজাগ্রত অবেক্ষণ আছে, আপনি নিশ্চিন্ত হোন। রক্ষীদের মধ্যে অন্তত দু’জন আমার বিশ্বাসী। তারা অষ্টপ্রহর দুর্যোধনাদির গতিবিধি লক্ষ করে। আর, পঞ্চপাণ্ডবও এখন অনেক বেশি সতর্ক, তেমনই পরামর্শ দিয়ে রেখেছি। তারা সর্বদা একত্র থাকে, বিচ্ছিন্ন ভাবে কোথাও যায় না, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উপর সাবধানী দৃষ্টি রেখে চলে। আচার্য দ্রোণ স্বয়ং রয়েছেন তাদের অভিভাবক, তাঁকেও আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত করে রেখেছি। তাঁর আশ্রমে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার আশঙ্কা নেই। তদুপরি, পঞ্চভ্রাতাই অত্যন্ত দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠছে দিন দিন। দ্বন্দ্বের ছলেও তাদের অঙ্গে আঘাত করা দুরূহ।”
ক্রমশ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।