নিজের আত্মজীবনী নিয়ে অকপট ইলা অরুণ। ছবি: সংগৃহীত।
কপালে বড় টিপ, পরনে হাতে বোনা তসরের জামা, সঙ্গে মানানসই ওড়না। হাতে গোছা চুরি।বছর শুরুর প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় ইলা অরুণ। এসেছেন শহরের এক সাহিত্য উৎসবে। সদ্য তাঁর আত্মজীবনী ‘পর্দে কি পিছে’ প্রকাশিত হয়েছে। শীতের শহরে নরম রোদ গায়ে মেখে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডা দিলেন লোকসঙ্গীত শিল্পী, তথা অভিনেত্রী, গায়িকা ইলা।
প্রশ্ন: শিল্প ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকে আপনার অবাধ বিচরণ,লোকসঙ্গীত, নাটক, সিনেমা...
ইলা: আপনি ঠিক বলেছেন। দর্শক আমাকে দেখলেই ‘চোলি কে পিছে’ গানের কথা বলেন। ভাল লাগে না। কিন্তু আমার এই বই সেই মানুষটার সঙ্গে পরিচয় ঘটায়, যিনি রয়েছেন সেই ‘চোলি কে পিছে’র নেপথ্যে। আমি তো মঞ্চ থেকে ছোট পর্দা, বড় পর্দা, ওটিটি সব ক’টি মাধ্যমেই কাজ করেছি । এই বই শুধুই যে আমি মানুষটার সঙ্গে পরিচিতি ঘটাবে তেমন নয়। এতগুলো বছর ধরে আমার চারপাশে থাকা বিভিন্ন মানুষের কথাও জানাবে। এই বই একটা সময়ের দলিল।
প্রশ্ন: এটা তো আপনার আত্মজীবনী। নিজের জীবনের সবটাই কি লিখেছেন, নাকি কিছুটা ঢাকা চাপা দিয়েছেন?
ইলা: না না, কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। সব বলেছি। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি আত্মজীবনী যখন কেউ লিখবেন সেখানে মিথ্যে ভান-ভণিতা করা উচিত নয়। আমার জীবনে অনেক দ্বৈত অর্থের গান গিয়েছে, কিন্তু তা বলে নিজের লেখাকে অতিরঞ্জিত করে মুচমুচে করার চেষ্টা করিনি। আসলে জীবনে একটা লম্বা সময় ধরে এত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি, এত ধরনের গান গেয়েছি এত ধরনের সঙ্গীত পরিচালক, সেই সময়কার রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় কাটানো নানা মুহূর্তকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: মেয়ে হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যে কোনও সময়ে খুব সহজ কাজ নয়, আপনার জীবনে সফরটা কেমন ছিল?
ইলা: হুম, আমাকেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু আমি দুঃখবিলাসী নই। কারণ, আমি মনে করি জীবনের যাত্রাপথে কষ্ট করাটা দরকার। তাই আমি এই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বলতে চাই, যা-ই হয়ে যাক, জীবনে সময়ের মূল্য দিতে শেখো এবং নিজের প্রতিভার উপর আস্থা রাখো। সব সময় ইতিবাচক থাকো। আমাদের সময় শুধুই দেখেছি ‘ব্রেক’ পাচ্ছি, মানে বিরতি। কিন্তু অর্থ সে ভাবে উপার্জন করতে পারিনি। তাই এখনকার প্রজন্মকে বলব তাড়াহুড়ো করো না।
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে ফেসবুক, ইনস্টার মতো মাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আপনার কী মত?
কলকাতায় ইলা। নিজস্ব চিত্র।
ইলা: আমি বলব না যে সমাজমাধ্যমের সব কিছুই খুব খারাপ। এই ধরনের মাধ্যম নতুন একটা রাস্তা খুলে দিয়েছে, আবার অনেকে এগুলোর অপব্যবহারও করছে। তবে সমাজমাধ্যমে যাঁদের বেশি অনুসরণকারী, তাঁদের অনেক সময় আজকাল শিল্পীদের কাজ দেওয়া হয় শুনেছি, যার ফলে বর্তমান প্রজন্ম সারা দিন এগুলোর পিছনেই পড়ে আছে। ভিডিয়ো করছে, রিল্স বানাচ্ছে। আমার মনে হয় কোথাও একটা ভারসাম্যের প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা খুবই বুদ্ধিমান, কিন্তু শেখার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করে বরং একটু ধৈর্য ধরলে তাদেরই ভাল হবে।
প্রশ্ন: আচ্ছা, আপনি বইয়ের নামটা ‘পর্দে কি পিছে’ দিলেন কোনও বিশেষ কারণে?
ইলা: যখন আমি বইটা লিখছিলাম সেই সময় থেকেই বইটা নাম নিয়ে ভাবছিলাম। আসলে তখন সকলে বলেছিল ‘চোলি কে পিছে’ নাম দিতে। কিন্তু আমার মনে হল কেন আমি ‘চোলি কে পিছে’ নামটা দেব? আমার মনে হয়, পর্দার পিছনে একটা নারী কেমন সেটা জানা উচিত। চোখে দেখার যেন পর্দা আছে তেমনই লাজ-লজ্জাও রয়েছে। সেই পর্দার বাইরে একজন নারী যে সাহসী হতে পারে, আবার সে সুন্দরী হতে পারে আমি সেই নারীকে দেখাতে চেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনার কাছে সৌন্দর্য কী?
ইলা: আসলে একজন মানুষ কতটা অনুভূতিপ্রবণ সেটাই তাঁর সুন্দরকে ব্যাখ্যা করে। বাহ্য সৌন্দর্য নয়, বরং একটা মানুষ কী ভাবে নিজেকে সকলের সামনে উপস্থাপন করেছে সেটা জরুরি। তার বুদ্ধিমত্তা তাকে অন্যের চোখে সুন্দর করে তোলে। আমার মনে হয় প্রতিটি নারীই সুন্দর।
প্রশ্ন: আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যেটা সব সময় জুড়ে রয়েছে সেটা আপনার কপালের বড় টিপ।
ইলা: আসলে আমার কপালটা বেশ চওড়া, আর আমি আমার ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভীষণ ভালবাসি তাই নিজেকে টিপ ছাড়া ভাবতেই পারিনা। তবে আমি একা নয়, উষা উত্থুপও বড় টিপ পরেন।
প্রশ্ন: কলকাতার সঙ্গে কতটা একাত্মবোধ করেন?
ইলা: কলকাতা এমন একটা জায়গা, যা এক সময় সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল। আমার মনে হয়,কলকাতায় পুরনো গৌরব যেমন ছিল তেমনই ভাবেই তাকে রাখা উচিত। আমার চোখে এই জায়গা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এপিজে কলকাতা লিটারারি ফেস্টিভ্যালে এসে তাই শহরের সংস্কৃতি, গান, সাহিত্যের কথাই বার বার মনে পড়ে। এখানে উগ্রতার কোনও স্থান না থাকাই সমীচীন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই ফুচকার। কালীমায়ের।
প্রশ্ন: বর্তমান প্রজন্মের সম্পর্ক প্রেম ভালবাসার ধরন বদলেছে, আপনি এই ধরনগুলো সম্পর্কে কতটা অবগত?
ইলা: আমাদের সময় ভালবাসা অন্য রকম ছিল, এখনকার যুগের ভালবাসার সংজ্ঞা বদলেছে। তাই আমি কাউকে উপদেশ দিতে চাই না। কিন্তু আমার মা একটা কথা বলতেন, প্রেম করতে গিয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজে বুদ্ধি খুইয়ে বসবে না।