পূর্বানুবৃত্তি: কুরুকুলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন পিতামহ ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্রের একশত সন্তান এবং পাণ্ডুর পাঁচ জন— এদের নিয়েই আবর্তিত তাঁর চিন্তাসূত্র। মনে পড়ছিল কুরুকুলের ইতিবৃত্তে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নানা বিচিত্র ঘটনার কথা। এমন সময় তাঁর সমক্ষে হাজির হয় উত্তেজিত রাজপুত্রের দল। তারা একটি কাঠের বীটক নিয়ে খেলা করছিল। সেটি একটি সঙ্কীর্ণ গভীর কূপে পড়ে যায়। ভাইরা সেটিকে উদ্ধার করতে অসমর্থ হওয়ায় এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ তাদের দুরবস্থা দেখে বিদ্রুপ করেন।
উত্তেজনায় ক্ষত্রচূড়ামণি ভীষ্ম জানুতে হাত দিয়ে মৃদু শব্দ করলেন, “পরিহাস! ভরতবংশীয় কুমারদের পরিহাসকরার স্পর্ধা!”
“হ্যাঁ, কুরুশ্রেষ্ঠ। তিনিও বংশের উল্লেখই করলেন বটে। বললেন, ‘ভরতবংশীয় নব্যপ্রজন্মের অস্ত্রশিক্ষাকে ধিক— একটি বীটা উদ্ধারে অক্ষম! আমাকে মাত্র এক-সন্ধ্যার আহার্য দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিলে এই মুহূর্তে ওটি তুলে আনতে পারি...’, এই বলে হাস্যমুখে তিনি নিজের একটি অঙ্গুরীয় খুলে সেটিও কূপে নিক্ষেপ করলেন, তার পর...”
বলতে বলতে এ বার যুধিষ্ঠিরও কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। তার চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছে সামান্য। ভ্রাতাদের দিকে এক বার তাকাল সে, সম্ভবত যে আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছে, তার সমর্থন খুঁজল। ভীষ্ম ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, “তার পর? কী?”
“তার পর, ঈষীকা-তৃণ-সদৃশ সূক্ষ্ম কিছু শলা দিয়ে শর-নিক্ষেপের মতো এক অদ্ভুত কর্ম করলেন সেই বিপ্র। এক শরের পিছনে অন্য শর, তার পিছনে আবার একটি শর— এই ভাবে বিদ্ধ করে-করে একটি সূত্র নির্মাণ করলেন, সেই পদ্ধতিতে বীটা এবং অঙ্গুরীয় দুইই তুলে আনলেন কূপথেকে! আমরা কখনও এমন অলৌকিক শরসন্ধান দেখিনি, পিতামহ!”
চক্ষু তীক্ষ্ণ হল গঙ্গাপুত্রের, প্রশ্ন করলেন, “তাঁকে আহার্য দিয়েছ?”
“সেই অনুমতিই নিতে এসেছি পিতামহ। তাঁর পরিচয়ও চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি বললেন, ‘যাও, কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে এই ঘটনা বিবৃত করো, তার পর আহার্যের আলোচনা হবে!’”
ভীষ্ম দ্রুত শ্বাস নিলেন এক বার। চকিতোত্তেজিত হয়ে উঠেছে তাঁর শরীর, স্নায়ুগুলি সতর্ক। ঈষৎ সম্মুখ-নমিত হয়ে কুমারের নিকটতর হলেন। বললেন, “ব্রাহ্মণ কি শীর্ণকায়, শ্যামবর্ণ? কেশগুলিতে পাক ধরেছে?”
“হ্যাঁ, পূজ্য!” যুধিষ্ঠির আবার একটু বিস্মিতস্বরে উত্তর দেয়।
“ঘন ভ্রু, কোটরগত কিন্তু উজ্জ্বল চক্ষু, নাসা খড়্গবৎ?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে ঠিক,” এ বার ভীম-দুঃশাসন-বিকর্ণ-নকুল-সহদেব-বিবিৎসু-দুর্মর্ষণ-সহ প্রায় দশ-বারোটি বালক মিলিতস্বরে জানায়।...পিতামহের অভ্রান্ত অনুমানশক্তি!
“অগ্রবাহু কিণাঙ্কচিহ্নিত?”
এ বার উচ্ছ্বসিত গর্জনের মতো সমস্বর উঠল; ‘হ্যাঁ, ঠিক, পিতামহ’ ‘একেবারে যথার্থ’ ‘ঠিক, ঠিক’ বলে বিপুল কলরব করে উঠল প্রায় সকলেই।
“আশ্চর্য দৈবনিবন্ধন!” অস্ফুটে বলে উঠলেন গঙ্গানন্দন। তার পর দ্রুতপদপাতে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে এলেন। যুধিষ্ঠিরের স্কন্ধে হাত রেখে, অন্যদের উদ্দেশে বললেন, “চলো, দ্রুত চলো কুমারগণ! আশা করি তিনি এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন!”
“ওই বিপ্র কে, পিতামহ?” অর্জুনের প্রশ্নভেসে এল।
অপরাহ্ণ শেষ হয়ে আসছে। অস্তায়মান ত্বিষাম্পতির তির্যক রশ্মি হস্তিনাপুরের প্রাসাদ-চূড়াকে সুবর্ণরঞ্জিত করে বিদায়োন্মুখ। এক বার সেই আলোকচ্ছটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে, কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম মৃদু হাসলেন। বললেন, “তোমাদের সৌভাগ্য!”
৩
হস্তিনা-প্রাসাদের ব্যাপ্তি বিপুল। তার প্রাচীর-সন্নিবিষ্ট মহাবর্ত্মের দুই ধারে ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গের হর্ম্যরাজি— গৃহস্বামীদের পদাধিকার ও ধনাধিকার অনুযায়ী বৃহৎ, মধ্যম অথবা ক্ষুদ্র। মূলত প্রস্তর বা দারু-নির্মিত সেই সব ভবনের শেষে ব্যবসায়ীদের বিপণি। তারও পরে উৎসব-আলয়, নটীদের নিবাস, মদ্যশালা। একেবারে প্রান্তে, নগর যেখানে গ্রামে মিশেছে— রাজপথ এবং দু’টি শাখাপথের সংযোগস্থলে কিছু-পরিমাণ পতিত ভূমি অব্যবহৃত ছিল দীর্ঘকাল। সেই ভূমি সংস্কার করে, সেখানে একটি মৃন্ময় গৃহ নির্মিত হয়েছে সদ্যই। বেশ শান্ত নিরিবিলি অঞ্চল, অদূরে অরণ্যভূভাগ, জলাশয়, কৃষিজীবীদের বসতি ও শস্যক্ষেত্র। মাটির গৃহ বেশ উপযুক্ত হয়েছে পরিপার্শ্বের সঙ্গে।
নাগরিকরা মাটির বাড়িটিকে যথেষ্ট সমীহের চোখে দেখে। তারা সবিস্ময়ে দেখেছে, কুরুপ্রধান ভীষ্ম স্বয়ং এসে তত্ত্বাবধান করেছেন এই গৃহনির্মাণের সময়! গৃহ মাটির হলেও যথেষ্ট সুপরিসর, পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর। মৃৎ-প্রাচীরবেষ্টিত একটি মনোরম উদ্যান, সম্মুখ-অঙ্গনে ধান্যভান্ডার, গোশালা, এমনকি ভৃত্যের আবাসের পর্যন্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে রাজ-নির্দেশে। এই বাড়ির কর্তাটি তবে যে-সে নন!
আরও লক্ষ করেছে সকলে, সেই গৃহেরই অনতিদূরে— অরণ্য-প্রান্তে, গুল্ম বীরুৎ জঙ্গল পরিষ্কৃত করে, প্রস্তুত করা হয়েছে অতি দীর্ঘ-প্রশস্ত এক চতুষ্কোণ সমতলক্ষেত্র। বৃক্ষকাণ্ড দিয়ে উঁচু প্রাচীর তৈরি হয়েছে তাকে ঘিরে। প্রবেশপথে কাষ্ঠ ও ধাতু-নির্মিত কবাট, রাজপুরী থেকে নিযুক্ত প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকে দ্বারদেশে। সাধারণ জনতার প্রবেশের সুযোগ একেবারেই নেই। সেই সুরক্ষিত মহা-প্রাঙ্গণের মধ্যে মধ্যে পরিকল্পিত দূরত্বে কয়েকটি ছায়াদানকারী বিটপ, বাকি অংশ উন্মুক্ত। এক কোণে খড়ে-ছাওয়া এক বৃহৎ কক্ষ। সেখানে ধাতুব্যবসায়ী ও কর্মকারদের নিত্য আনাগোনা। রাজসভার প্রতিনিধিরাও আসেন প্রায়ই। আর আসে, গো-শকটে নানা সরঞ্জাম ও সামগ্রী বোঝাই করে, অস্ত্র-বণিকেরা। এই গৃহের কর্তা তাদের সঙ্গে সেখানে বহুক্ষণ নিভৃতে সময় কাটান। নানা রকমের ধাতব ঘাতশব্দ ও যন্ত্রের ঘর্ঘর শোনা যায় দূর থেকে।
ভারী অদ্ভুত এই গৃহস্বামী। হস্তিনার আদি বাসিন্দা নন, এসেছেন পাঞ্চাল-দেশ থেকে। নানা অদ্ভুত জনশ্রুতি আছে এঁর নামে। ইনি নাকি অযোনিসম্ভূত। এঁর ঋষি-পিতা ভরদ্বাজের শুক্র স্খলিত হয়ে তণ্ডুল-পাত্র বা দ্রোণের মধ্যেসঞ্চিত ছিল; সেখান থেকেই সরাসরি জন্ম। তাই এঁর নাম দ্রোণ।
প্রাকৃতজনেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, “হ্যাঃ, দ্রোণের মধ্যে পড়ল জল, ন’মাস পরে ফলল ফল! হে হে। অত মুখ্যু এখন আর কেউ নেই হে। নির্ঘাত কোনও অতি নীচ-বংশের কন্যার উদরে জন্ম, বামুনঋষির কুলমানরক্ষার জন্যে সেইটি গোপন করে গালগল্প ছড়িয়ে দিয়েছে...”
তবে, প্রকাশ্যে বলবে এমন দুঃসাহস নেই কারও। এ ব্যক্তি এ দেশে নবাগত হলেও বিপুল প্রভাবশালী, সে তো স্পষ্টই। শোনা যায় রাজকুমারদের শিক্ষাগুরু কৃপাচার্যের ভগ্নীপতি এই কৃষ্ণকায় শীর্ণ ব্রাহ্মণ। কিন্তু ইনি ব্রাহ্মণোচিত ক্রিয়াকর্ম কিছু করেন না। যজন যাজন পূজার্চনা বিদ্যাদান চিকিৎসা এমনকি দান-প্রতিগ্রহণে পর্যন্ত এঁর কোনও উৎসাহ নেই। সারা দিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতিবাহিত করেন। ক্ষত্রিয়দের মতো এঁর অঙ্গুলি ও পুরোবাহু জ্যা-ঘর্ষণের দাগে ভরে গিয়েছে। প্রতিবেশী-জনের সঙ্গে একেবারেই মেলামেশা করেন না, এমনকি এঁর অল্পকেশী খর্বকায়া পত্নীটিও প্রায় মৌনব্রত পালনের মতো নিঃশব্দ। কিশোরবয়স্ক পুত্রটিও স্থানীয় সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলোর বদলে পিতার সঙ্গেই ছায়ার মতো ফেরে অহর্নিশ— সেই প্রাচীরবেষ্টিত ক্ষেত্রে আর সেই রহস্যময় কক্ষে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে ধাতুকর্মী ও অস্ত্র-ব্যাপারীদের সঙ্গে সারা দিন কামারশালায় দ্রোণ-ব্রাহ্মণের কী কাজ? এত রাজপুরুষের আনাগোনা কেন ওই প্রাচীর-বেষ্টিত উদ্যানে? কিসের প্রস্তুতি চলছে ওখানে? কী কারণে স্বয়ং মহাত্মা শান্তনব এত গুরুত্ব দেন বিদেশাগত এই আগন্তুককে?
উত্তর পাওয়া গেল বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে, যখন রাজকীয় শকটে চড়ে স্রোতের মতো তরুণ রাজকুমারের দল এসে প্রবেশ করতে লাগল উদ্যানে। শুধুই রাজপুত্র নয়, হস্তিনা-নগরীর অভিজাতবর্গ, বরিষ্ঠ রাজপুরুষ, মন্ত্রিমণ্ডলী ইত্যাদি প্রভাবশালী ক্ষত্রিয়পরিবার থেকেও আসছে কিশোর-বালকরা। তাদের চিৎকারে কোলাহলে হাস্যপরিহাসে মুখরিত হল চতুর্দিক। তার পর কাষ্ঠপ্রাচীরের ও পার থেকে শোনা যেতে লাগল অস্ত্রের ঝনঝনা। তরবারির আস্ফালনধ্বনি, ধনুকের টঙ্কার, গদার সংঘাত, তোমরের ঝনৎকার, শর ও ভল্লক্ষেপণের শব্দ।
এবং, সব শব্দ ছাপিয়ে, তীব্র গম্ভীর এক পুরুষ-কণ্ঠ— তার নির্দেশ, আহ্বান, নিষেধ, প্রশংসা, ভর্ৎসনা! এখন আর নিছক ধানুকী ব্রাহ্মণ নন— তিনি গুরু দ্রোণ! দ্রোণাচার্য!
রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষাকেন্দ্র! বিস্ময়-স্ফুরিত চোখে দেখল সবাই। এমন পৃথক গুরুকুলের আয়োজন তো কখনও ছিল না হস্তিনানগরীতে!
অবশ্য এর পূর্বে কখনও তো এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর একত্র সমাবেশ হয়নি এ রাজবংশের কোনও প্রজন্মে। গঙ্গানন্দন মাতার অধীনে থাকাকালীনই গুরু পরশুরামের কাছে যাবতীয় অস্ত্রবিদ্যা শিখে এসেছিলেন। সত্যবতীর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য দু’জনেই অকালমৃত—ভীষ্মই তাদের কিছু কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন নিজের হাতে। পরের প্রজন্মে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ও পাণ্ডু জন্ম-দুর্বল, তাঁদের জন্যেও খুব বিপুল উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল না। যদিও রাজ-প্রচারক ও চারণদের মাধ্যমে প্রাক্তন রাজা পাণ্ডুকে দিগ্বিজয়ী বলে অনেক ঢক্কা-নাদ হয়েছিল— তবু এ-কথাই সত্য যে, মহান পৌরব-বংশ গত দুই প্রজন্ম ধরে বীরশূন্য। উপযুক্ত পুরুষই জন্মাননি। মহাবীর দেবব্রতর অতুল কীর্তির ছায়া, তাঁর কিংবদন্তি-প্রতিম বাহুবলই এখনও ছত্র ধরে আছে হস্তিনার সিংহাসনের উপর।
সৌভাগ্যক্রমে, নতুন প্রজন্ম আবার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে শক্তিমান বালকে-কিশোরে। নগরে গুঞ্জন শোনা যায়— এদের মধ্যে অনেকেই প্রবল বীরত্বের সম্ভাবনাময়। দূরদর্শী রাজ্যপালক তথা অভিজ্ঞ অভিভাবক হিসেবে ভীষ্ম যে এই কুমারদের জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন তা খুবই স্বাভাবিক।
এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই তবে পররাজ্য থেকে আনা হয়েছে অস্ত্রবিদ ব্রাহ্মণ ভারদ্বাজ দ্রোণকে! গুঞ্জনে-জল্পনায় মুখরিত হয়ে ওঠে হস্তিনানগরী।
৪
কৃশকায় গম্ভীর তীক্ষ্ণনেত্র ব্রাহ্মণের উপর জনতার সমীহ বৃদ্ধি পেল। পথে-ঘাটে-চবুতরায়-মধুশালায় আলোচিত হতে লাগল নতুন আশ্রম-ব্যবস্থার কথা।
হস্তিনা-রাজসভায় কালেভদ্রে যাতায়াত করে এমন কিছু ব্যক্তির মুখ থেকে শোনা গেল আরও কিছু খণ্ড-ছিন্ন সমাচার।
বালকদের অস্ত্রশিক্ষাদানের জন্য এই দ্রোণের শ্যালক, শারদ্বত কৃপাচার্যকেই নাকি প্রথমে নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রাসাদ-অঙ্গনেই চলত সেই প্রশিক্ষণ। কিন্তু ভীষ্ম সেই শিক্ষাপ্রণালীতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই দ্রোণের নিয়োগ। শোনা যাচ্ছে, কৃপ স্বয়ং তাঁকে আনিয়েছেন পাঞ্চাল-প্রদেশ থেকে। শ্যালকের স্থলাভিষিক্ত হতে দ্রোণ সম্মত ছিলেন না শুরুতে; কৃপকেও সমান মর্যাদায় নিযুক্ত রাখা হবে— ভীষ্মের কাছে এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবে স্বীকৃত হয়েছেন। প্রাসাদ থেকে দূরে, একান্ত নিজস্ব প্রশিক্ষণ-আশ্রম নির্মাণের প্রস্তাবও দ্রোণেরই— ভীষ্ম তা মান্য করেছেন।
“মহান ভীষ্মের সঙ্গে এত কষাকষি শর্ত করেছে... লোকটার এত কী গুণ, কী-এমন ব্যতিক্রমী বিদ্যে আছে যাতে এত...!” গুঞ্জন ওঠে সাধারণ্যে।
তথ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সে-উত্তরও নিয়ে আসে ক্রমে। গোপন সূত্রে জানা গিয়েছে বিচিত্র ও বিচিত্রতর সব গূঢ়বার্তা। দ্রোণ কেবল অস্ত্রনিপুণই নন, তাঁর আছে বিশেষ গুপ্তবিদ্যা, যা অতীতেও একমাত্র শ্রুতকীর্তি ভার্গব পরশুরাম ব্যতীত আর কারও অধিগত ছিল না সমগ্র আর্যাবর্তে। সাধারণ অস্ত্রগুরুরা— যেমন কৃপ— কেবল প্রথাগত পদ্ধতিতে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োগ বা সঞ্চালন-বিদ্যা শেখাতে জানেন। দ্রোণ সে-বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব তো অর্জন করেছেনই, কিন্তু অতিরিক্ত হিসাবে তিনি জানেন আরও কিছু মন্ত্রসিদ্ধ কলা। তার চর্চায় নাকি নানাবিধ জাদু-আয়ুধ লাভ করা যায়, অতি দুর্লভ বলে যে-সমস্ত মহাস্ত্রের গৌরব সমরশাস্ত্রে প্রচারিত, তেমন সব অভাবিত প্রহরণ ও তার প্রয়োগ আয়ত্ত হয়! বিপক্ষের ভয়ঙ্করতম অস্ত্রশস্ত্রকেও অক্লেশে নিবারণ করার প্রতিকৌশল হাতের মুঠোয় আসে।
জল্পনা অতিরঞ্জিত হতে হতে গগনচুম্বী রূপ ধারণ করে। বিরাট ব্যাপার! এই বিদ্যাটিকে গোপন রাখার জন্যই তবে শিক্ষাকেন্দ্রে এত সুরক্ষার ব্যবস্থা।
“কিন্তু দরিদ্র বামুন এমন গূঢ়বিদ্যা পেল কী করে? এ তো যাগযজ্ঞও করে না, তপস্যা-টপস্যাও...”
সে-ও জানা যায় অচিরেই। গুরু পরশুরামের কাছ থেকে একপ্রকার ভিক্ষাবৃত্তি করেই আহৃত এই সম্পদ। পরশুরাম তাঁর সমস্ত সঞ্চিত ধন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করছিলেন, সেই সংবাদ পেয়ে তাঁর কাছে যাচক হয়ে গিয়েছিলেন দ্রোণ। কিন্তু ততক্ষণে সব ধন নিঃশেষিত। শুধু কিছু অস্ত্রশস্ত্র অবশিষ্ট। দ্রোণের করুণ মিনতি শুনে দ্রবহৃদয় জামদগ্ন্য তাঁকে অস্ত্রগুলির সঙ্গে সঙ্গে এই গুপ্ত মন্ত্রঃপূত বিদ্যাটিও নাকি দান করেন।
“তবে তো বড় সাংঘাতিক কথা হে! এক পরশুরাম ভিন্ন আর কেউ জানেন না... তা সে-মুনিও তো সেই কোন মহেন্দ্র না বারেন্দ্র পর্বতের আশ্রম বিনা অন্য কোথাও যান-টান না শোনা যায়। সেখানে গিয়ে শিক্ষা সংগ্রহ করে আনা বড়ই দুরূহ...”
“বটেই তো। তা ছাড়া, জানো নিশ্চয়, সেই আগের পরশুরামও তো আর নেই। পূর্বতন গুরু বৃদ্ধ হয়ে অবসর নিয়েছেন, কেউ বলে মারাই গিয়েছেন নাকি। এখন তাঁর উত্তরাধিকারী নতুন পরশুরাম, তিনিও কড়া ধাতের ব্যক্তি। আরও শুনি, সে গুরুকুলে নাকি বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ আর ত্যাগী সন্ন্যাসী ছাড়া কাউকে আসল জিনিসটি দেওয়া হয় না। হ্যাঁ, খুব হাতে-গোনা জনাকয়েক অতি-সদাচারী বিশুদ্ধচরিত্র ক্ষত্রিয়কেও বেছেগুছে দেওয়া হয়, তবে সে খুব ব্যতিক্রম; সাধারণের জন্যে নয়।”
ক্রমশ