Bengali Serial Novel

খরস্রোত

অনেক বাদানুবাদ হয়ে ঠিক হল যে, সমিতির নাম হবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি। সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে নাম ঠিক হল অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইনস্পেক্টর মৌলবি আব্দুল করিম ও মুজফ্ফর আহমেদের।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৯:৩২
Share:

ছবি কুনাল বর্মণ।

উষাপতিকে দেখেই কুমুদরঞ্জন হইচই করতে শুরু করে দিলেন। বললেন, “আরে এসো, এসো। তুমি তো এখন বিখ্যাত মানুষ। যা সব গপ্পো লিখছ, আমি তো পড়ে চমকে যাচ্ছি, হে। কী রসবোধ! সাধে কি রবি ঠাকুর তোমায় এত পছন্দ করছেন!”

Advertisement

“আপনার নাম শুনেছি অনেক। গপ্পোও পড়েছি কয়েকটি। যেগুলো ‘ভারতী’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল আর কী! সত্যিই আপনার লেখার হাত চমৎকার!” উপবিষ্টদের মধ্যে এক জন বলে উঠলেন।

উষাপতি ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের আশপাশে। দীর্ঘ, ঋজু চেহারা। মাথায় একটি লম্বা কালো টুপি পরা। সাধারণত কাশ্মীরের লোকেরা এই ধরনের টুপি পরেন।

Advertisement

“চিনতে পারলে না তো? উনি হচ্ছেন কবি মোজাম্মেল হক। ভারী অমায়িক। খুবই জ্ঞানী মানুষ। বিস্তর পড়াশোনা করেন...” কুমুদরঞ্জন আরও অনেক কথা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলেন হক সাহেব। বললেন, “আরে না মশাই, কুমুদবাবুর ও সব কথা বিশ্বাস করবেন না। মাস্টারমশাই সব সময়ই আমার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেন।”

আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হল উষাপতির। তার মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমেদ অন্যতম। উষাপতির চেয়ে বেশ কিছুটা ছোটই হবেন ভদ্রলোক। কিন্তু বেশ গম্ভীর স্বভাবের বোধ হল। নিজেই আলাপ করলেন বটে, কিন্তু বিশেষ বাক্যালাপে গেলেন না।

উষাপতির কিন্তু ভদ্রলোককে বেশ পছন্দ হল। বেশি কথার মানুষ নন, আবার অনেক কথাই বলে দেন সামান্য কয়েকটি কথায়।

সভা শুরু হল। শিক্ষিত হিন্দুরা, এমনকি শিক্ষিত মুসলমানরাও মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল একটা সাহিত্য সমিতি স্থাপন করে, শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এই বার্তা দেওয়া যে, মুসলমানরাও সাহিত্য রচনায় পিছিয়ে নেই।

অনেক বাদানুবাদ হয়ে ঠিক হল যে, সমিতির নাম হবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি। সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে নাম ঠিক হল অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইনস্পেক্টর মৌলবি আব্দুল করিম ও মুজফ্ফর আহমেদের। একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশেরও সিদ্ধান্ত হল। সমিতির সম্পাদক মুজফ্ফর আহমেদ বলেন, “এই সভায় অনেক জ্ঞানী, গুণী হিন্দু ভাইয়েরা উপস্থিত। তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, এই সমিতিকে আপনারা নিজেদের মনে করুন। সমিতির সাহিত্য পত্রিকায় আপনারাও লেখা দিন। আপনাদের সাহায্য না পেলে এই সাহিত্য পত্রিকা সমৃদ্ধ হবে না...” একটু থেমে আবার শুরু করলেন আহমেদ সাহেব, “আমরা একটি গ্রন্থাগার স্থাপনেরও পরিকল্পনা করেছি। আপনারা আপনাদের মুদ্রিত বই এই গ্রন্থাগারে দান করবেন, এইটুকু আমার আশা।”

উষাপতি মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আমারও মনে হয়েছে যে, শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বেশ কম। তারা ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতি যতটা মনোযোগী, বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রতি ততটা নয়। তাই আপনাদের এই উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এতে মুসলিম সমাজের উপকার হবে। আমি সাধারণত আমার মুদ্রিত বই দান করি না। কিন্তু আপনাদের গ্রন্থাগারে আমি আমার এ যাবৎ মুদ্রিত সব ক’টি বই দান করব।”

উষাপতির বক্তব্য সবে শেষ হয়েছে, এমন সময়ে দরজায় এক দীর্ঘকায় ব্যক্তিকে দেখা গেল। সকলেরই চোখ চলে গেল তার দিকে। মৌলবি সাহেব শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন আগন্তুককে দেখে, “আসেন আসেন নীলমণিবাবু। এই দুর্যোগের দিনে বেলঘর থেকে যে আপনি আসবেন, এটা আমি ভাবতে পারিনি।”

দরজা পেরিয়ে নীলমণি বন্দ্যোপাধ্যায় লাল ফরাসে পা রাখলেন। দীর্ঘদেহী, সুঠাম চেহারা। দেখলেই মনে হয় যে, নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। ধুতির উপর সাদা হাফহাতা শার্ট, চোখে মুখে গাম্ভীর্য।

মৌলবি সাহেবের কথায় কোনও হাসির রেখা ফুটে উঠল না নীলমণির মুখে। ফরাসের এক কোণে বসতে বসতে বললেন, “আপনি কী যে বলেন, করিম সাহেব! এখানে দেখছি সুদূর মজফ্ফরপুর থেকে জলকাদা ঠেঙিয়ে সাহেবসুবো মানুষ চলে এসেছে, আর আমি তো পাশের গ্রামের লোক।”

সকলেরই চোখ চলে গেল উষাপতির দিকে। উষাপতির মুখে মৃদু হাসি। তিনি তার প্রিয় গোঁফের দুই প্রান্তে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন, “কেমন আছেন নীলমণিদা? ভালই হল দেখা হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।”

“নীলমণিবাবু কি আপনার পূর্বপরিচিত?” উষাপতির দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন মৌলবি করিম সাহেব।

নীলমণিই বললেন, “উষাপতি আমার বিশেষ আত্মীয়।”

সভা শেষ হয়েছিল। সভার পর কিছু আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন মৌলবি সাহেব। আহারের পর, সকলেই একে একে উঠলেন। বসে থাকলেন নীলমণি ও উষাপতি।

“বলো কী বলছিলে...” নীলমণি বললেন উষাপতিকে, “আমাকে আর একটি সভায় যেতে হবে। কাছাকাছি বলে এখানে এক বার ঘুরে গেলাম।”

উষাপতি একটু সময় নিলেন। তার পর বললেন, “আপনারা যে পথে এগোচ্ছেন, তাতে দেশ স্বাধীন হবে?”

“অবশ্যই হবে। তবে সময় লাগবে। ছেলেমেয়েদের আত্মাহুতির কোনও দাম নেই বলে মনে করো?” নীলমণির কণ্ঠস্বরে শ্লেষ।

“না না, আমি তা বলিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনাদের এ লড়াই বড়ই অসম। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে কত দিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন?”

“তুমি বুঝবে না উষাপতি। তোমার বোধ সীমিত। অথচ লেখক হিসেবে তোমার বোঝা উচিত ছিল দেশের মানুষের ক্ষমতা কত! যাক সে কথা। তুমি কী যেন বলবে বলছিলে?”

“হ্যাঁ, ওই শশিকান্তর কথা। ওর স্কুলটি বোধহয় তত ভাল নয়। যদিও, শশিকান্তকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, ওর স্কুলে সে রকম অসুবিধে হচ্ছে না, তবু আপনি যদি এক বার স্কুলটির বিষয়ে একটু খোঁজ নেন।”

“তুমি ভাল লোককেই বলেছ। সংসারের কোনও খোঁজ রাখি না বলে আমার যথেষ্ট বদনাম আছে ভাই। তবে তুমি যখন বলছ, আমি নিশ্চয়ই খোঁজ করব। সে ব্যাটা তো দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছে। পড়াশোনা কী করে, কে জানে? সেটাও দেখতে হবে। এমনিতে আমার বিধবা বোনটি ওর খুব খেয়াল রাখে। তা ছাড়া আমার স্ত্রীকেও দেখেছি শশীর প্রতি একটু দুর্বল। যাই হোক আমি দেখব।”

“ধন্যবাদ নীলমণিদা।”

“না না, ধন্যবাদের কিছু নেই। সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় তো আমারই দেখার কথা। কিন্তু কী করব বলো, একটা বিরাট সংসার দেখতে গিয়ে ছোট্ট সংসারটার কথা আর মনে থাকে না। সভা, সমিতি, তহবিল গড়া, পুলিশের তাড়া খাওয়া, এই নিয়েই কেটে গেল এতগুলো বছর।”

“আপনার জেলে যাওয়ার খবরটা পেয়েছিলাম। খুব চিন্তিত ছিলাম।”

“আমার জন্য চিন্তিত হয়ে লাভ নেই উষাপতি। আমাদের জীবন বড়ই অনিশ্চিত। আমরা এর জন্য প্রস্তুত।”

“একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব, নীলমণিদা?”

“হ্যাঁ, বলো...”

“অরবিন্দ ঘোষ কি সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন?”

“সেটা আমি জানি না। তবে তিনি অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী হয়েছেন। কারাগারের নির্জনতা তাঁর জীবনদর্শনটাকেই বদলে দিয়েছে। তিনি এখন অন্য মানুষ, এইটুকুই বলতে পারি। শুধু দেহের স্বাধীনতাই সব নয়, আত্মার স্বাধীনতাই আসল কথা, তিনি মনে করেন। একমাত্র যোগসাধনাই পারে সেই স্বাধীনতা এনে দিতে। তাই তিনি এখন সেই সাধনাতেই ব্যস্ত। তিনি যোগী।”

“হ্যাঁ, আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের কাছে ঠিক এই কথাই শুনেছি। ওঁর উত্তরপাড়ার সভায় এই ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন।”

“কী নাম তাঁর?”

“অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। চেনেন নাকি তাঁকে?”

“বিলক্ষণ। ওই অমরেন্দ্রনাথই তো অরবিন্দ ঘোষকে উত্তরপাড়ায় নিয়ে আসেন। যদিও, উদ্যোক্তা ছিলেন উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন ও ওঁর পুত্র মিসরিবাবু। আমি নিজেও ছিলাম ওই সভায়। দর্শনের কথা, আত্মোপলব্ধি, গভীর আধ্যাত্মিক চেতনার কথা বলছেন, অথচ সভায় উপস্থিত হাজার দশেক মানুষ মৌনব্রতী হয়ে তাঁর কথা শুনছে। ভাবতে পারো!”

“আপনাদের তো খুব ক্ষতি হল। শুনেছি, উনি দক্ষ সংগঠক ছিলেন। ওঁর কলমের জোরও অসাধারণ।”

“তা তো একটু হলই।”

“মূল রাজনীতিতে কি আর ফিরবেন না উনি?”

“কী জানি ভাই। হয়তো ফিরবেন। আমরা বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষেরা আশা ত্যাগ করি না। যাক, তোমার সঙ্গে অনেক কথা হল। আমাকে এ বার উঠতে হবে। তুমি এক বার বেলঘর ঘুরে এসো না এক দিন!”

“এ বার আর হবে না, নীলমণিদা। অনেক কাজ হাতে নিয়ে এসেছি।”

উষাপতি গাত্রোত্থান করেন। নীলমণি আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মৌলবি সাহেব এগিয়ে আসেন। সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন দু’জনকে।

রাস্তায় নেমে নীলমণি উষাপতিকে বলেন, “তোমার গন্তব্য কোন দিক?”

“আমি একটু বালিগঞ্জের দিকে যাব,” উষাপতি উত্তর দেন।

“আমি আবার মানিকতলার দিকে যাব,” বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করেন নীলমণি।

হঠাৎ “বিপ্লবীদের দলে নাম লেখালেন বুঝি?” কথাটা কানে যেতেই ঘাড় ঘোরালেন উষাপতি।

পাশে দাঁড়িয়ে নিবারণ দত্ত। উষাপতি বিরক্তি বোধ করলেন। বললেন, “আপনি?”

নিবারণের মুখে হাসি। পান চিবোনো দাঁতগুলোয় লাল লাল ছোপ। মুখ থেকে খানিকটা পানের পিক রাস্তার উপর ফেলে বলে উঠল, “আমার যাতায়াত সর্বত্র— পাঠশালা থেকে পানশালা। কোথাও বারণ নেই। তাই তো আমার নাম নিবারণ।”

উষাপতির ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হল। বললেন, “দেখুন নিবারণবাবু, আমি পাঠশালাতেও যাব না, পানশালাতেও নয়। আপনি এখন আসতে পারেন।”

নিবারণের হাসিটা এক দিকে বেঁকে গেল। বলল, “মোয়াই আমার উপর চটেছেন দেখছি। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। কী বলতে কী বলে ফেলি! তবে দিব্যি করে বলছি, মিছে কথা আমি কখনও বলি না। নীলমণি বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে দেখলাম কি না, তাই। আলিপুর বোমা মামলায় ধরা পড়েছিল মুরারিপুকুর থেকে। এখনও পুলিশের চোখ আছে ওর উপর। তাই ওর সঙ্গে আপনাকে দেখে, মনে হল আপনিও বোধহয়...”

নিবারণকে কথা শেষ করতে দিলেন না উষাপতি। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের থেকে উঁচুতে নিয়ে গিয়ে বললেন, “আমার অনেক কাজ আছে, নিবারণবাবু। আমাকে যেতে হবে।”

“কোথায় যাবেন?” নিবারণের মুখে আবার হাসি ফিরে এসেছে।

“সেটা কি আপনাকে জানাতে হবে নাকি?” উষাপতির কণ্ঠস্বর যথেষ্টই রুক্ষ।

নিবারণ খানিকটা মাথা চুলকে বলে, “না না... তা কেন? এমনি আর কী, বলতে পারেন কৌতূহল!” তার পর গলার স্বরটা আরও নামিয়ে বলে, “আপনার কাছে গোটা কয়েক টাকা হবে? খুব দরকার।”

উষাপতি মুচকি হাসেন। বলেন, “এই বার বুঝলাম, কেন এত ক্ষণ সেঁটে আছেন আমার সঙ্গে!”

উষাপতি নিবারণের হাতে দু’টি টাকা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।

উমানাথ ভাবতে পারেনি, এ সময়ে মেজদা রমানাথ এসে হাজির হবে। সবে আসরটা জমে উঠেছিল। সুরার নেশা মাথায় হামাগুড়ি দিচ্ছিল। গান ধরেছিল সাতকড়ি হালদার। চটুল গান। আসরের সকলে তাল দিচ্ছিল। উমানাথও। মাঝে মাঝে গেয়েও উঠছিল সে, “আমায় মিথ্যে বলে মার খাওয়ালি ওলো ঠাকুরঝি/ ওই নন্দঘোষের ছেলের সনে আমি কখন কথা বলেছি?”

হঠাৎ গান থামিয়ে দরজার দিকে চেয়ে রইল সাতকড়ি। গান থেমে যেতে উমানাথ বিরক্ত হয়েছে। সাতকড়ির উদ্দেশে একটা গালি দিতে গিয়েও দিল না। কারণ, তারও চোখ গেছে দরজার দিকে। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মেজদা। তার দু’চোখে যেন আগুন ঝরছে।

নেশা ছুটে গেল উমানাথের। বলল, “তুমি... এখানে?”

এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না রমানাথ। বজ্রগম্ভীর স্বরে শুধু বললেন, “ওঠ। বাড়ি চল।”

উমানাথের পাঁচ ইয়ার-বন্ধু রমানাথের অগ্নিমূর্তি দেখে আগেই কেটে পড়েছে। উমানাথ সেই সুযোগ পায়নি। সে শুধু ভাবছে, মেজদা জানতে পারল কী করে!

খবরটা রমানাথের কানে আগেই এসেছিল। ছোটভাই উমানাথ যে বদ সঙ্গে পড়েছে, সেটা তিনি অনুমান করতে পারছিলেন। দু’-এক সপ্তাহ আগে বোন নিভাননীর থেকে এ রকমই একটা আঁচ পেয়েছিলেন। কিন্তু আড্ডার স্থলটা ঠিক ধরতে পারছিলেন না। আজ শরীর একটু খারাপ থাকায়, বড়বাজারের গদিতে না গিয়ে, বাড়িতে থাকাই মনস্থ করেছিলেন রমানাথ। সারা দিন খেয়ালে রেখেছিলেন উমানাথকে। সন্ধের দিকে তিনি বাড়ি থেকে বেরোতেই সন্তর্পণে পিছু নিয়েছিলেন রমানাথ। পিছন পিছন খানিকটা আসতেই, বুঝতে পেরেছিলেন উমানাথের গন্তব্য কোথায় হতে পারে। আর এগোননি। অপেক্ষা করেছিলেন খানিকটা দূরে।

বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণের এই একতলা বাড়িটি রমানাথের জেঠামশাইয়ের। সেই অকৃতদার জেঠামশাই বাড়ির সকলের সংস্রব ত্যাগ করে এই একতলা বাড়িতে বাস করতেন। কাউকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দিতেন না। শোনা যায়, তিনি একা ঘরে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। তাঁর সেই বাড়িতে একমাত্র প্রবেশের অধিকার ছিল রমানাথের বড়দা নীলমণির। নীলমণির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন আদিত্যনাথ। যদিও, কী কথা হ’ত দু’জনের, সেটা অবশ্য জানা যায় না।

আদিত্যনাথের মৃত্যুর পর ঘরটি খালি পড়ে আছে অনেক দিন। জনশ্রুতি, ওই বাড়িতে আদিত্যনাথের প্রেতাত্মা আজও নাকি ঘুরে বেড়ায়। তাই বাড়িটি এক রকম পরিত্যক্ত। আর এই পরিত্যক্ত বাড়িটিই হয়ে উঠেছে উমানাথ ও তার ইয়ার-বন্ধুদের সুরাপানের উত্তম জায়গা।

উমানাথের হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে রমানাথ এগিয়ে আসেন দু’কদম। নিচু হয়ে উমানাথের একটা কান ধরে বলেন, “ওঠ, বাড়িতে চল, তোর মদ খাওয়া দেখাচ্ছি আজ!”

উমানাথ নিঃশব্দে রমানাথকে অনুসরণ করে বাড়ি ফিরে এল।

গড়গড়ায় তামাক সেবন করছিলেন নীলমণি। খানিক আগেই তিনি কলকাতা থেকে ফিরেছেন। আরামকেদারায় আধশোয়া অবস্থায় আছেন তিনি। চোখ দু’টি নিমীলিত। তিনি চান না, বাড়ির কেউ তাকে এ সময় বিরক্ত করুক।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement