ছবি: কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: গঙ্গার তীরে অমরেন্দ্রনাথের গোপন ডেরায় একে একে এসে জড়ো হন শ্রীশচন্দ্র, জ্যোতিষচন্দ্র, যতীন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ বিপ্লবী। তাঁরা সকলেই সহিংস আন্দোলনে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ায় বিশ্বাসী। এর জন্য সাহসের পাশাপাশি যে প্রভূত অর্থ আর অস্ত্রেরও প্রয়োজন, আলোচনার শুরুতেই উঠে এল সে কথা। কলকাতার ডালহৌসিতে রডা কোম্পানির অস্ত্র-ডাকাতির প্রসঙ্গে বিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যেও যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, সে কথা সামান্য অস্বস্তির রেশ বয়ে আনল। সে আন্দোলন সফল এবং সেই কারণে যে বিপ্লবীদের হাতে কিছু অস্ত্রশস্ত্র এসেছে, সে কথা অস্বীকার করতে পারলেন না কেউই। পরবর্তী সময়ে বিপ্লব পরিচালনা, জার্মান কনসাল থেকে অর্থ সংগ্রহ, বিদেশি অর্থ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ভাঙিয়ে তা বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া, পলাতক যোদ্ধাদের জন্য গোপন আস্তানার বন্দোবস্ত করা— ইত্যাদি যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে সভা শেষ করলেন বিপ্লবীরা। বিপ্লবীদের পুলিশের হাত থেকে লুকিয়ে আশ্রয় দানের প্রসঙ্গে উঠে এল এক সাহসী, সংস্কারমুক্ত বিধবা মহিলার নাম। তিনি ননীবালা।
সভার কাজ শেষ হতে মতিলাল ও অন্যরা গঙ্গার ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছেন। অমরেন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ তাঁদের পিছনে পিছনে চলেছেন। সকলে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়ান। পুব আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঠছে। স্নিগ্ধ রক্তিম আলো এসে পড়েছে গঙ্গার জলে। দূরে একটা-দুটো ডিঙিনৌকো। ভোররাত থেকে বেরিয়ে জেলেরা নদীতে মাছ ধরে। সকাল হতেই সেই মাছ বাজারে চলে আসে বিক্রির জন্য।
“অপূর্ব!” বলে উঠলেন যতীন্দ্রনাথ।
“সত্যিই সুন্দর!” বললেন অমরেন্দ্রনাথ। ও পারে দক্ষিণেশ্বর মন্দির এখন ভোরের আলোয় উজ্জ্বল। নরেন্দ্রনাথ ও অমরেন্দ্রনাথ বাদে সকলের জোড়হাত কপালে ওঠে। যুদ্ধে নামার আগে শক্তিময়ীর কাছে সাফল্য প্রার্থনা। নমস্কার শেষে সবাই দেখেন, তাঁদের মধ্যে কখন নিঃশব্দে এক মধ্যবয়সি শিখ এসে দাঁড়িয়েছেন। কেউ কিছু বলার আগেই অমরেন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, “মতিলাল, এই শিখ ভদ্রলোককে কিছু দিন চন্দননগরে আশ্রয় দিতে হবে।”
“সে না-হয় দিলাম। কিন্তু অমরদা, আমার বাড়িতে তো এক শিখ যুবক আশ্রয় নিয়ে আছেন মাসদুয়েক,” মতিলাল বিনীত ভাবে বললেন।
“ওই শিখ যুবকটিকে সন্ন্যাসী হয়ে রিষড়ায় পিসিমার আশ্রয়ে চলে আসতে বলবে,” অমরেন্দ্রনাথ গম্ভীর ভাবে নির্দেশ দেন।
যতীন্দ্রনাথ শিখ ভদ্রলোকের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “নীলমণিদা না? একদম চিনতে পারিনি। কী মেকআপ করেছ!”
নরেন্দ্রনাথ একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সিগারেটের শেষ অংশটা পায়ের তলায় পিষে বললেন, “বোথ অব দ্য মেক আপস আর পারফেক্ট। গত রাতে পাগলকে কেউ চিনতে না পারলেও,আমি পেরেছিলাম।”
নীলমণি কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু হাসেন।
“গত রাতের পাগলটা তুমি ছিলে? মাই গড, আমাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়েছিলে, নীলমণিদা!” যতীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন।
নীলমণি এ বারও হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, “শুধু তোমাদের নয়, পুলিশকেও বোকা বানিয়েছি। দিন দশেক এই গঙ্গার ঘাটে পাগল সেজে আছি। পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কাছে ঘেঁষেনি। পাগলকে পুলিশও ভয় পায়।”
ভোরের আলো প্রায় ফুটে উঠেছে। মতিলাল তাড়া দিল। একে একে জ্যোতিষ, শ্রীশ ও নীলমণি নৌকোয় উঠে বসলে, মতিলাল নৌকো বাইতে শুরু করলেন। নৌকোটি চোখের বাইরে চলে যেতেই, নরেন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, “আমরাও তবে আসি।”
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “এসো। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বন্দে মাতরম্।”
সকলে বলে উঠলেন, “বন্দে মাতরম্।”
তার পর যে যার বাড়ির পথে যাত্রা করলেন।
অমরেন্দ্রনাথ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিক ক্ষণ। নিস্তব্ধ রামঘাট। শুধু প্রাচীন বটগাছের শাখায় পাখিদের কলকাকলি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অমরেন্দ্রনাথ ধীর পায়ে অগ্রসর হলেন ঘাটের সিঁড়ির দিকে। এখান থেকে ও পারের দক্ষিণেশ্বরের মন্দির অনেক স্পষ্ট। সূর্যদেবও তাঁর রক্তিম, স্নিগ্ধ রূপ ত্যাগ করছেন একটু একটু করে। অমরেন্দ্রনাথ প্রথমে সূর্যপ্রণাম করলেন। এর পর দেবী কালিকার প্রণামমন্ত্র উচ্চারণ করে স্মরণ করলেন তাঁদের গৃহদেবী মা চণ্ডীকে। প্রার্থনা করলেন, এই যুদ্ধে যেন তাঁদের সাফল্য আসে। তার পর ধীরপায়ে জি টি রোড ধরে এগোতে থাকলেন বাড়ির দিকে।
১৫
রমানাথের খুব ইচ্ছে, বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন। বোন নিভাননীকে সে কথা বলতে, নিভাননী বলে উঠলেন, “সে তো ভাল কথা। আমাদের আর দুর্গাবাড়ি যেতে হবে না। হইহুল্লোড় বাড়িতেইকরা যাবে। তবে নীলুকে এক বার জিজ্ঞেস করলে ভাল হত।”
রমানাথ বলেন, “সে কী করে সম্ভব? বড়দা তো এখন ফেরার।”
নিভাননী সিন্নি মাখছিলেন। আটার মধ্যে জল ঢেলে, তাতে বাতাসা আর কলা চটকে একটা আহারের ব্যবস্থা করা। মাঝেমধ্যে এই খাবারটি তিনি খেয়ে থাকেন। ভাত আর নিরামিষ তরিতরকারি খেতে খেতে যখন স্বাদটা একটু বদল করতে চান, তখনই নিজের জন্য এই খাবারটি বানিয়ে নেন।
সিন্নি মাখতে মাখতে বললেন, “সে নেই তো কী হয়েছে, বড়বৌদিকে জিজ্ঞেস করো। আজই তো ফিরলেন উনি কালীঘাট থেকে।”
“তাই নাকি! বড়বৌদি আজ এসেছেন? কে দিয়ে গেল ওঁকে?”
“কে আবার, ওঁর সেই মাতাল ভাই। এসে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। কাজ আছে বলে চলে গেল।”
“সে যাক। আমি এক বার বড়বৌদির কাছে কথাটা পাড়ি।”
রমানাথ উঠতে যাচ্ছিলেন, নিভাননী বললেন, “হ্যাঁ রে রমা, উমানাথের বে-র কথাটা কি এগোল?”
রমানাথ উঠতে উঠতে বলেন, “কী করে এগোবে? বড়দা বিয়ে ঠিক করছিলেন, এখন তিনিই তো বাড়ি ছাড়া। ফিরলেই পুলিশের ভয়।”
রমানাথ উঠে পড়েন। বড়বৌদিকে বলার আগে বাবার মতটা নেওয়া দরকার। বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায় বারান্দার আরামকেদারায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। বার্ধক্য তাঁর সারা শরীরে। হাঁটতে চলতেও কষ্ট হয়। বুকে চাপ ধরে। বয়সও তো কম হল না। এই মাঘে ছেষট্টিতে পড়েছেন তিনি।
রমানাথ বাবার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ান। বনমালী চোখ বুজে শুয়েছিলেন। পায়ের শব্দে চোখ চাইলেন। রমানাথকে দেখে খুশি হলেন বৃদ্ধ।মধ্যম পুত্রটিকে তিনি একটু বেশি স্নেহ করেন। অনেক সময় বিভিন্ন ব্যাপারে রমানাথের সঙ্গেই পরামর্শ করেন।
“কিছু বলবে?” বনমালী বলেন রমানাথকে।
রমানাথ মাথা নাড়েন। বলেন, “বাড়িতে দুর্গাপুজো করবার খুব বাসনা জেগেছে। আপনার অনুমতি পেতে চাই।”
“কেন? দুগ্গাবাড়ির দুগ্গাপুজোয় তোমাদের কী অসুবিধে হচ্ছে?”
“না, কোনও অসুবিধে হয়নি, বরং ওঁদের আদর-আপ্যায়নের কখনও কোনও খামতি দেখিনি।”
“তবে?” বনমালীর ভুরুতে ভাঁজ।
রমানাথ একটু চুপ করে থাকেন। তার পর বলেন, “আসলে ওটা তো মুখুজ্জদের পুজো। ওখানে আমরা আমাদের কোনও আত্মীয় পরিজন, বন্ধুদের নেমন্তন্ন করতে পারি না।”
“তা ঠিক,” বনমালী বলেন, “তবে মুখুজ্জেরা অসন্তুষ্ট হবে। এ বাড়ি থেকে মোটা টাকা যায় কিনা পুজো বাবদ।”
“সে টাকা না-হয় বন্ধ হবে না, যদি আপনি আদেশ করেন,” রমানাথ বলেন।
“বেলঘরে দুর্গাবাড়ি ছাড়া আর কোনও বাড়িতে পুজো হয় না। তুমি করলে, কথা উঠবে না? গ্রামের লোকেরা কি এটা ভাল ভাবে নেবে?”
“গ্রামের অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। তাঁরাও চান আমরা বাড়িতে দুর্গাপুজো করি।”
বনমালী একটু ক্ষণ চুপ করে থাকেন। মুখুজ্জেদের মাথা হরিপদ মুখুজ্জে বনমালীর বন্ধু। রোজ বিকেলে তাসের আড্ডায় এ বাড়ি আসেন। তিনি ক্ষুণ্ণ হন, এমন কাজ বনমালী করেন কী করে?
রমানাথকে বলেন, “আমি একটু হরিপদর সঙ্গে কথা বলি। দেখি, ও কী বলে। কিন্তুরমা, মায়ের পুজো করব বললেই হল না। মায়ের আসন তৈরি করতে হয়। সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?”
রমানাথ উত্তর দেন, “তাও আমি ভেবেছি। আপনার সম্মতি পেলেই, ঠাকুরদালান তৈরিতে হাত দেব। ভেবেছি, পুব দিকে পুকুরপাড়ে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে, ওখানেই ঠাকুরদালানতৈরি করাব।”
বনমালী অবাক হয়ে রমানাথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, “তুমি এত দূর অবধি ভেবে ফেলেছ! বেশ, তোমার যখন এতটাই ইচ্ছে, তবে এগিয়ে যাও। আমি মুখুজ্জেকে রাজি করিয়ে নেব’খন।”
বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বৌদির সঙ্গে দেখা করলেন রমানাথ। প্রায় মাস তিনেক পর বৌদিকে দেখছেন রমানাথ। চেহারা আগের চেয়েও ভারী হয়েছে। খুব কম কথা বলেন। মুখে হাসি দেখা যায় না বললেই চলে। রমানাথকে দেখে আজ একটু হাসলেন। বললেন, “কেমন আছ ঠাকুরপো? তোমার শরীর কেমন?”
উত্তরে রমানাথও একটু হেসে বললেন, “ভাল আছি বৌদি। ভাবছি, বাড়িতে এ বার দুগ্গাপুজো করব। তুমি কী বলো?”
বিভাবতী অবাক হয়ে যান এ কথা শুনে। কী বলবেন ভেবে না পেয়ে বলেন, “সত্যি?”
রমানাথ বলেন, “ভেবেছি। জানি না, সম্ভব হবে কি না। বাবা হরিপদকাকার সঙ্গে কথা বলবেন। উনি যদি একান্ত বিরূপ না হন...’’
“কেন? তোমাদের বাড়িতে তোমরা পুজো করবে, তাঁর বিরূপ হওয়া না-হওয়ায় কী আসে যায়?” বিভাবতীর মুখে এক রাশ বিরক্তি।
রমানাথ একটু কেশে নেন। মনে মনে ভাবেন, বৌদি ভুল বলছেন না। কেন যে বাবা হরিপদকাকার মতামতের উপর নির্ভর করতে বললেন! বৌদিকে হরিপদকাকার পরিচয় দিতেই চিনতে পারলেন।
একটু হেসে বিভাবতী বললেন, “দেখো তা হলে, কী হয়!”
কথা বলে ফিরে আসছিলেন রমানাথ, বিভাবতী ডেকে বললেন, “ওঁর কোনও খবর পেলে?”
রমানাথ দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “না, পাইনি। তবে, পুলিশের হাতে যে ধরা পড়েননি, এ বিষয়ে নিশ্চিত।”
সন্ধেবেলায় তাসের আড্ডা শেষ হওয়ার মুখে বনমালী হরিপদকে বললেন, “মুখুজ্জে, একটু থেকে যেয়ো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
সবাই অবাক হলেন। হরিপদও হলেন।
সবাই চলে গেলে বনমালী হরিপদকে সব বললেন। শুনে হরিপদ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কোনও কথা বললেন না।
বনমালী বললেন, “কী হল মুখুজ্জে, তুমি চুপ করে গেলে?”
হরিপদ বললেন, “আমি আর কী বলব? রমানাথ ভাল আয় করছে। কলকাতার বাবুদের মতো তার শখ হয়েছে বাড়িতে দুগ্গাপুজো করার। আমি বাদ সাধব কেন! তবে, বনমালী, তুমি তো সবই জানো কী ভাবে আমাদের বাড়ির পুজোটা হয়। অর্থের জোগানটা বন্ধ হয়ে গেলে দুগ্গাবাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে যাবে।”
বনমালী উঠে এসে হরিপদর কাঁধে হাত রেখে অভয় দেন, “সে তুমি ভেবো না। রমা বলেছে যে তোমার বাড়ির পুজোর টাকা ও বন্ধ করবে না।”
বাড়িতে দুর্গাপুজো হবে শুনে শশিকান্তর আনন্দ আর ধরে না। সারা দিন দাঁড়িয়ে মিস্তিরিদের কাজ দেখে। সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, কেমন করে ইটের পর ইট সাজিয়ে মিস্তিরিরা ঠাকুরদালান তৈরি করে চলেছে। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কাজ। আর কিছু দিনের মধ্যেই রং হবে। তার পর নিজেদের বাড়িতেই দুর্গাপুজো।
শশিকান্ত কর গুনে দেখে, আর ঠিক কত মাস পরে দুর্গাপুজো। রোজই প্রায় বাবা, কাকা ও দাদু মিলে আলোচনা করেন পুজোর ব্যাপারে। বাবার ইচ্ছে পুজোর এক দিন গ্রামের সব লোককে খাওয়ানো। বাবার এই ইচ্ছের কথা মুখে মুখে গ্রামের সবার কাছে পৌঁছে গেছে, শশিকান্ত তা জানে।
দু’দিন আগে লাবণ্য বলেছিল, “তোমরা অনেক বড়লোক, না?”
শশিকান্ত বলেছিল, “কেন এ কথা বলছিস?”
লাবণ্য বলেছিল, “বড়লোকরাই দুর্গাপুজো করে। বাবা বলছিল, দুর্গাপুজো করতে নাকি অনেক টাকা লাগে।”
“হবে হয়তো। তবে, আমি গরিব মানুষ। আমার কাছে এক আনাও থাকে না,” শশিকান্ত বলে।
“দেখবে, তুমি এক দিন খুব বড়লোক হবে। তখন আমাকে মনেই পড়বে না।”
শশিকান্ত চকিতে লাবণ্যময়ীর দিকে তাকায়। লাবণ্যময়ীও শশিকান্তর চোখে চোখ রাখে। তার পর লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়। বলে, “আমি যাই শশীদা। সন্ধে হয়ে আসছে।”
“এখনই যাবি? আর একটু থাক না...” শশিকান্ত বলে। তার চোখ শান্ত টলটলে পুকুরের জলে।
“খুব সাহস দেখছি! নেহাত পুকুরঘাটে এ সময়ে কেউ আসে না। না হলে, আমাদের দু’জনকে এখানে দেখে কী ভাববে বলো তো? তা ছাড়া আজকে কনকের পাকা-দেখা না? এখানে বসে আমার সঙ্গে গল্প করলে তোমার চলবে?” বলে উঠেপড়ে লাবণ্যময়ী।
শশিকান্তও এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে উঠে পড়ে পুকুরঘাটের সিঁড়ি থেকে। বলে, “তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই গিয়েছিলাম দিদির পাকা-দেখার কথা। যাই, ওরা বোধহয় এসে গেছেন এত ক্ষণে।” শশিকান্ত দ্রুত পা চালায় বাড়ির পথে। লাবণ্য শশিকান্তর চলে যাওয়ার তাকিয়ে থাকে খানিক ক্ষণ। তার পর, মৃদু হেসে সে-ও ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলে তার বাড়ির উদ্দেশে।
বাড়িতে ঢুকে শশিকান্ত দেখল, অনেক লোক। বাবা, কাকা তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। শশিকান্তকে দেখে রমানাথ ডাকলেন। ওকে দেখিয়ে বাকিদের বললেন, “আমার ছেলে।”
যে বয়স্ক লোকটির সঙ্গে রমানাথ কথা বলছিলেন, তিনি শশিকান্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “পড়াশোনা করো?”
শশিকান্ত ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, “এ বার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছি।”
“বাহ্! খুব ভাল। এর পর কলেজে পড়বে, নাকি বাবা-কাকার মতো ব্যবসাতেই যাবে?”
“না না, ওকে আমি কলেজেই পড়াব। ব্যবসায় এনে আর কাজ নেই!” রমানাথ বলেন।
বৃদ্ধ একটিপ নস্যি নাকে গুঁজে বলেন, “কলেজগুলো এখন বিপ্লবীদের আখড়া হয়ে উঠেছে, সেটা খেয়াল রাখবেন দাদা।”
রমানাথ কোনও উত্তর দেন না। শশিকান্তকে বলেন, “তুমি দেখো, ও দিকে এঁদের খাবারের কী ব্যবস্থা হল।”
ক্রমশ