সৃজনশিল্পী: অমৃতা শেরগিল। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)
যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতির আঙিনায় যাঁদের অনায়াস বিচরণ, তেমন নারীদের মধ্যে শিল্পী অমৃতা শেরগিল অন্যতম। গত ৩০ জানুয়ারি পূর্ণ হল তাঁর জন্মের ১১০ বছর। তিনি যে সময়ে শিল্পজগতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তখন মহিলাদের ছবি আঁকার বিশেষ চল ছিল না। ইন্দো-হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত অমৃতা শেরগিল তাঁর চিত্রশিল্পের মধ্য দিয়ে বাঁধন ছেঁড়ার সাধনা করেছিলেন। দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এক অভূতপূর্ব প্রতিস্পর্ধার রূপ। লিঙ্গ-রাজনীতির বেড়াজাল ডিঙিয়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে অমৃতা নিজের জন্য যে স্থান করে নিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে অনেক পরে। জীবনকে তিনি যে ভাবে দেখেছেন, তাঁর ছবিতেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে সে দর্শন। সত্যকে তিনি এমন ভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে ফুটে উঠেছে তাঁর শিল্পীসত্তার ব্যতিক্রমী দিকটি।
অমৃতার জন্ম ১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হাঙ্গেরির বুডাপেস্ট শহরে। বাবা উমরাও সিংহ মাজিথিয়া (শেরগিল) পঞ্জাবের সম্ভ্রান্ত শিখ পরিবারের মানুষ। সংস্কৃত, ফার্সি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অগাধ দখল ছিল। অমৃতার মা মেরি আঁতোয়ানেত গোতেসমান বুডাপেস্টের অভিজাত পরিবারের মেয়ে। তিনিও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পিয়ানো বাজানো ও গান গাওয়ায় পারদর্শী ছিলেন। উমরাও সিংহের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি লন্ডনে পড়াশোনার জন্য যান। সেখানে মেরির সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। সেখান থেকেই প্রণয় ও পরিণয়। বিয়ের পর তাঁরা বুডাপেস্টে যান এবং সেখানেই অমৃতার জন্ম। তাঁর নাম রাখা হয় পবিত্র তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের কথা মনে রেখে।
ছোটবেলা থেকে অমৃতা যে আবহে মানুষ হন, তা তাঁর মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ছোট থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁক। মায়ের কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে নিজে স্কেচবুকে রং-পেনসিল দিয়ে ছবিতে রং করার সঙ্গে সঙ্গে রূপকথার গল্পের অলঙ্করণ করতে শুরু করেন। এর পর তিনি নিজে গল্প, কবিতা প্রভৃতি লিখতে শুরু করেন এবং সেগুলিকেও তুলির টানে জীবন্ত করে তোলেন। তাঁরা যখন বুডাপেস্ট ছেড়ে মারগিট আইল্যান্ডের অভিজাত এলাকায় বসবাস করা শুরু করেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পী, সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে থেকে অমৃতা তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। এ ভাবে শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবনের যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে জীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
শিমলায় থাকাকালীন ছবি আঁকার প্রতি তাঁর নিষ্ঠা দেখে তাঁকে প্রথমে মেজর হুয়িটমার্শ এবং পরে বেভান পেটম্যান-এর কাছে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হল। ইটালির ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন সেখানে সান্তা আনুনসিয়াতা স্কুলে ভর্তি হন এবং নগ্ন প্রতিকৃতি আঁকার জন্য রোষের মুখে পড়েন। প্যারিস যাত্রা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পর্যায়। প্যারিসের শিল্পগগনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এদুয়ার মানে, অগস্ত রেনোয়া, এডগার দেগা, আমেদো মদিলিয়ানির ছক-ভাঙা বৃত্তের বাইরের জীবনকেন্দ্রিক ছবি; বিশুদ্ধ রঙের ব্যবহার, মুক্ত বাতাসে প্রকৃতির বুকে ছবি আঁকা, ন্যুড পেন্টিং এই সব কিছু অমৃতাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ইম্প্রেশনিস্ট স্কুলের প্রভাব অমৃতা যে ভাবে ছবিতে ব্যবহার করলেন, তা তাঁকে এক ভিন্নধর্মী শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। টানা তিন বছর প্যারিসে থাকাকালীন ন্যুড স্টাডি, পোর্ট্রেট, সেলফ-পোর্ট্রেট, স্টিল লাইফ মিলিয়ে ষাটটিরও বেশি ছবি আঁকলেন।
১৯৩৪ সালে দেশে ফিরে দেশীয় বিভিন্ন বিষয়ের উপর ছবি আঁকলেন অমৃতা। ইওরোপীয় পোশাক ছেড়ে শাড়ি পরা শুরু করলেন। দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর অঙ্কনশৈলীতে বিশেষ মাত্রা যোগ করল। দেশে ও বিদেশে থাকার সময় তাঁর আঁকা কিছু উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ‘স্ট্যান্ডিং ন্যুড’, ‘ইয়ং গার্লস’, ‘প্রফেশনাল মডেল’, ‘হিল উইমেন’, ‘হলদি গ্রাইন্ডারস’, ‘ব্রাইড’, ‘রেস্টিং’, ‘সাউথ ইন্ডিয়ান ভিলেজারস গোয়িং টু মার্কেট’-এর নাম করা যায়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নানা সময়ে তাঁর শিল্পকীর্তি যেমন প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনই রক্ষণশীল সমাজে নিন্দার ঝড়ও তুলেছিল।
অমৃতার তুলির টানে নারী স্বাধীনতার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে বারবার। নারীকে কখনও তিনি বালিকাবধূ রূপে এঁকেছেন আর ছবির মধ্যে তার মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কখনও এঁকেছেন প্রেমাসক্ত যুবতী, কখনও বা নৃত্যপটীয়সী গণিকার নানা দেহভঙ্গি, কখনও এঁকেছেন গৃহকর্মে ব্যস্ত নারী কিংবা ক্লান্ত পরিচারিকা। গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্ত নারী ও তাদের উপর পুরুষের ক্রমাগত শোষণের চিত্র তাঁর তুলির টানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অভিজাত নারীর জীবনের বিলাসবহুল দিক যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই আবার তাদের জীবনে পুরুষের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণও তাঁর ছবিতে নানা ভাবে ধরা পড়েছে। তাঁর ছবির প্রাণ ছিল রং। তিনি অ্যাসিড গ্রিন, লেমন ইয়েলো, ভারমিলিয়ন রেড, কোবাল্ট ব্লু-এর মতো উজ্জ্বল সব রঙের ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
পারিবারিক জীবনের নানা অশান্তি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব বিস্তার করেছে। শুধু নারী স্বাধীনতার চিত্র নয়, ভিক্টোরীয় নৈতিকতার বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছেন অমৃতা। প্রেম তাঁর জীবনে এসেছে বারবার। প্রেমের আবেদনে সাড়া দিতে তিনি কখনও কুণ্ঠা বোধ করেননি। অবাধ সম্পর্ক তাঁর জীবনে নানা দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। যে সমাজ পুরুষের বহুগামিতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নারীর ব্যক্তিগত জীবনে নানা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, ছবির মাধ্যমে তিনি সেই সমাজকে ধিক্কার জানিয়েছেন। বর্ণবৈষম্যের তীব্র বিরোধিতা তাঁর ছবির প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছে। তাঁর শিল্পীসত্তা সব সময়ই ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্ক ও দ্বিধাদ্বন্দ্বকে। তুলির জাদুস্পর্শে নিজস্ব দর্শন ও প্রতিবাদ এঁকে যে বিস্ময় তিনি চিত্রিত করে গিয়েছেন, সেটাই শেষ পর্যন্ত অমৃতা শেরগিলের প্রধান পরিচয়।