Environment

রুক্ষ রাঢ়বঙ্গে প্রথম বনসৃজন

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে বৃক্ষরোপণের সূচনা করেন। তাঁর বনমহোৎসব বোলপুর থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

Advertisement

 সুরজিৎ ধর

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩ ০৬:২১
Share:

সবুজায়ন: শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণের আয়োজক রবীন্দ্রনাথ। —ফাইল চিত্র।

গাছকে দেবতাজ্ঞানে পূজার্চনা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। বট-অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বাঁধানো ঠাকুরের স্থান, উঠোনে তুলসীমঞ্চ, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষের তলায় বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষ ইত্যাদি হাজারো উদাহরণের কথা আমরা জানি। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, দার্জিলিং-এর মহাকাল পাহাড়ের শৈবক্ষেত্রে ভুটিয়ারা গাছের ডালে বৌদ্ধধ্বজা ওড়ানোর মতো করে কাপড়ের টুকরো বেঁধে দিত।

Advertisement

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সখ্যের অবনতি ঘটে। প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার ফলে ভূমিক্ষয়, ধস, বৃষ্টিপাতের অসাম্য, উষ্ণায়ন একে একে প্রকট হয়। মাটিকে মরুগ্রাস থেকে রক্ষার জন্য, নীচের জলাধারকে অক্ষত রেখে, তার সরসতা বজায় রাখার প্রয়োজনীতা দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুধাবন করেছিলেন বহু যুগ আগে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “... মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। … মানুষ অমিতাচারী... প্রকৃতির সহজ দানে তার কুলোয়নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ করেছে।”

গাছ কবির কাছে কখনও ‘গৃহহারা আনন্দের দল’, কখনও ‘মরুবিজয়ের কেতন’, আবার কখনও ‘মাটির বাঁশি’। এক বার কবি মাদ্রাজ, সিংহল ও মহীশূরে দু’মাস কাটিয়ে বর্ষার মুখে শান্তিনিকেতনে ফিরেছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, এ বারে বর্ষামঙ্গলের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে ‘বৃক্ষরোপণ’। কারণ রাঢ় অঞ্চলের রুখু মাটিতে সরসতার জন্য গ্রামে গ্রামে বৃক্ষরোপণ অতি প্রয়োজনীয়। বালিদ্বীপ ভ্রমণের সময় কবি সেখানকার নৃত্যশীলা মেয়েদের শোভাযাত্রা দেখেছিলেন। সেটি এ দেশে বনমহোৎসবে চালু করবেন বলে মনস্থ করলেন।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে এগিয়ে এলেন কালীমোহন ঘোষ, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নিশাপতি মাঝি প্রমুখ। সকলে ভুবনডাঙার দিঘির পাঁক পরিষ্কারে হাত লাগালেন। ‘জলোৎসর্গ’ প্রবন্ধে কবি তাঁদের এই প্রয়াসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কবির বনসৃজনের প্রয়াসে কালীমোহন ঘোষ ও সুকুমার চট্টোপাধ্যায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৃক্ষরোপণে হাত লাগিয়ে ছিলেন। ১৯২৫ সালে কবির জন্মদিনে উত্তরায়ণ-এর উত্তর দিকে আমলকী, অশোক, অশ্বত্থ, বট ও বেল— এই পাঁচটি গাছ পুঁতে ‘পঞ্চবটী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২৮ সালে ১৪ জুলাই গৌরপ্রাঙ্গণে তাঁর পৌরোহিত্যে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব সূচিত হয়েছিল।

সেই দিনের বর্ণনা আমরা অমিয়া সেনের একটি নিবন্ধে পাই। সে দিন কিশোরীরা লালপেড়ে শাড়ি আর খোঁপার বিনুনিতে ফুলের মালা জড়িয়ে, শালবাগানের মধ্যে মেঠো পথ দিয়ে ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ গানটি গাইতে গাইতে হেঁটে ছিলেন। একটি শিশুবৃক্ষকে চতুর্দোলায় বসিয়ে সেই পদযাত্রায় সামিল করা হয়। গানের সঙ্গে মৃদঙ্গ, ঘণ্টা, মন্দিরা, এস্রাজ, শাঁখ আরও নানা বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়েছিল। নন্দলাল বসু আর সুরেন্দ্রনাথ করের উদ্যোগে কাঁচা বাঁশ কেটে তৈরি হল সেই চতুর্দোলা। রংবাহারি কাপড় আর কাগজসহ ফুল লতাপাতা দিয়ে সাজানো হল। সেই শিশুবৃক্ষের মাথায় ধরা হল নানা ফুল ও সবুজ পাতা দিয়ে সাজানো তালপাতার বিশাল ছাতা। তার কিনারায় ছোট ছোট ফুল ঝোলানো। চতুর্দোলাটি বহনের দায়িত্ব পান কলাভবনের অধ্যাপক বিনায়ক মাসোজি, অপর দিকে তাঁরই মতো দীর্ঘদেহী আর্যনায়কম। তাঁরা সে দিন রঙিন উত্তরীয় আর মাথায় রঙিন উষ্ণীষ ধারণ করেছিলেন। চতুর্দোলায় বরবেশী সেই বকুলচারা কবি সংগ্রহ করেছিলেন বৌমা প্রতিমা দেবীর টব থেকে। কবিও সে দিন উৎসবের সাজে সেজেছিলেন। কালো রেশমের ধুতি, গায়ে রঙিন জামা, কাঁধে জরির পাড়ের জমকালো চাদর। শিশুবিভাগের ‘সন্তোষালয়’ আর ‘বীথিকা’ ঘরের মাঝের মাঠে চারাটি পুঁতে কবি জলসেচন করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সিংহসদনে তাঁর ‘বলাই’ গল্পটি পড়ে শোনান।

কবি বর্ষা নিয়ে অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলিই বৃক্ষরোপণ নিয়ে রচিত। ১৯৪০ সালে ৩ সেপ্টেম্বর সকালে বৃক্ষরোপণ ও সন্ধ্যায় বর্ষামঙ্গলে গাওয়া ‘এসো এসো ওগো শ্যামছায়া ঘন দিন’-ই তাঁর শেষ বর্ষাসঙ্গীত বলে স্বপনকুমার ঘোষের একটি নিবন্ধ থেকে জানতে পারি। ১৯৪১ সালে কবির মৃত্যুর মাসখানেক পরে আয়োজিত বৃক্ষরোপণ ও বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠানে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ করেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের কালীমোহনের সহযোগী সুকুমার চট্টোপাধ্যায় পরে অবিভক্ত বাংলার উন্নয়ন বিভাগের আইসিএস এইচ এস এস ইশাক সাহেবের সহযোগী হিসেবে ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট কমিশনারের পদে নিযুক্ত হন। কবিগুরুর থেকে অনুপ্রাণিত সুকুমারবাবু বৃক্ষসম্পদ পুনরুদ্ধারের কাজ তখনও ভোলেননি। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে, বৃক্ষরোপণকে আন্দোলনের রূপ দিতে পারছিলেন না। তিনি তৎকালীন ছোটলাটের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ছোটলাট প্রথমে এ সবে জড়াতে চাইছিলেন না। সুকুমারবাবু বেদসহ ভারতীয় শাস্ত্রের সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তিসহ তার ইংরেজি অনুবাদ করে বোঝালেন ভারতীয় আবেগে বৃক্ষের স্থান কতখানি জুড়ে আছে। অতঃপর ছোটলাট সম্মত হন।

লাটসাহেবের সমর্থন পেয়ে ইশাকসাহেব ও সুকুমারবাবুর নেতৃত্বে দুই বাংলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে উন্নয়ন বিভাগের সব কর্মীরা উঠেপড়ে লাগলেন। গ্রামবাংলায় আষাঢ়ের রথের মেলায় ফলফুলের চারাগাছ লাগানোর রেওয়াজ আছে। বিভিন্ন বাড়িতে উন্নয়ন বিভাগের কর্মীরা কয়েকটি করে চারা দিতেন। সেগুলি বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে পোঁতার জন্য সুপারিশ করা হত। যাতে তারা উৎসাহী হয়ে ভবিষ্যতে তার যত্ন নিতে পারে।

বাংলার এই বৃক্ষরোপণ আন্দোলন আন্দোলন পণ্ডিত নেহরুর মনে ধরে। তাঁর পরামর্শে কৃষিমন্ত্রী কে এম মুন্সি ১৯৫০ সালে ১ জুলাই থেকে, বৃক্ষরোপণকে সর্বভারতীয় স্তরে সর্বত্র প্রয়োজনীয় হিসেবে ঘোষণা করেন। ষাটের দশক পর্যন্ত প্রায় সকল ব্লক অফিসগুলিতে নৃত্য-গীত-আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চারা লাগানো হত। অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে, কোনও উচ্চপদস্থ আধিকারিক বৃক্ষরোপণ গাছ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতেন। ব্লক থেকে প্রচুর গাছ বিতরণ করা হত। সেই রকম গাছ আজও প্রতি বছরে লাগানো হয়। আবার তার পরিণতিও যে খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সে করুণ সত্যও আমাদের অজানা নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement