Bengali Story

ঘরে ফেরা হয়নি যে মেয়ের

তিনি সলমা কুরেশি। আবার জয়া মুখোপাধ্যায়ও। কলকাতার কন্যা। থাকেন করাচিতে। পাক মুলুকে নাতিপুতি নিয়ে ভরা সংসার। সেই বাঙালিনির বুকের মধ্যে সতত বহমান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ত্রিধারা। দেশভাগের জাঁতাকলে আসলে বার বার কিছু সম্পর্ক আর পরিবারই খণ্ডিত হয়েছে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৪৯
Share:

পাকিস্তান থেকে মামা, মামি আসছে! তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর আগে খবরটা তত চমকপ্রদ ছিল না কলকাতার এক ছোট্ট ছেলের কাছে। তবে তার পরে যা ঘটেছিল, তা আজও সে ভুলতে পারেনি। সে দিনের দুই ছোট্ট ভাই-বোন বাবুয়া ও মুনিয়া আপ্লুত হয়, মামা-মামির দেওয়া উপহার বিলেতের ইমপোর্টেড এয়ারগান এবং টকিং ডল পেয়ে। আগুনরঙা আলোর ফিনকি-ছোটা এয়ারগানের সে কী আওয়াজ! আর পুতুলটা যেন জ্যান্ত একটি মেয়ে। এমন খেলনা আগে তাদের অধরা ছিল। বাবুয়া, প্রয়াত ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে এবং তাঁর স্ত্রী নাসিমা বানুর ছেলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের আশুতোষ অধ্যাপক অমিত দে-র মনে পড়ে, মামা-মামি কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছিলেন। গঙ্গার ধারের একটি রেস্তরাঁয় তাঁদের দু’ভাইবোনকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেলে বিল হয়েছিল সম্ভবত শ’দুয়েক টাকা। অঙ্কটা কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনে তখন অবিশ্বাস্য। এ শহরের বিদগ্ধ অধ্যাপকের সংসারেও এমন জীবনযাপন খুব একটা সহজ ছিল না।

Advertisement

পুরনো অ্যালবাম থেকে কী ভাবে সেই সময়ের কিছু ছবি পেয়ে মামি সে দিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে ভাগ্নেকে পাঠিয়েছেন। মামা সালাউদ্দিন মহম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম কুরেশি গত হয়েছেন দশ-বারো বছর হল। মামি সলমা কুরেশির সঙ্গে এখন অমিতের ফেসবুকেই দেখা হয়। পুরনো সাদা-কালো ছবিতে সানগ্লাসধারিণী সেই নারী সুখী, তৃপ্ত। তখনই নানা প্রতিকূলতার উজান ঠেলেছেন। পারিবারিক জীবনের নানা ঝড় শান্ত হলে তবু বরকে নিয়ে কলকাতায় মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে খানিক শান্তিই পেয়েছিলেন। কিন্তু ছবিতে ভবিষ্যৎ লেখা থাকে না! ইতিহাসের ঝড়ঝাপটার আঁচ সহ্য করার তখনও চোদ্দ আনাই বাকি। সমাজমাধ্যমে মিশুকে, আলাপী বৃদ্ধার জীবন গত শতকে উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি প্রধান বাঁকের ধুলো মেখেছে। সলমা এখনও পাকিস্তানেই থাকেন। তবে ১৯৬৮-৬৯’এর পাকিস্তান আর ২০২২-এর পাকিস্তানেও বিরাট ফারাক। অমিতের মামা-মামি সে বার পুব পাকিস্তান, মানে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসেন। এখন একটাই পাকিস্তান। করাচির সংসার থেকে ৮২ বছরের মামির আর কখনও কলকাতায় আসা হবে, এমন আশা নেহাতই দুরাশা মনে হয়।

সলমার জন্ম অবিভক্ত ভারতের ঢাকায়। কিন্তু জীবনের প্রথম দু’দশকে কলকাতা ছেয়ে আছে সেই মেয়ের। সলমা কুরেশি নন, তখন তিনি জয়া মুখোপাধ্যায়। সেটা তাঁর পূর্বজন্ম বললেও ভুল হয় না। পার্ক সার্কাসের পড়শি যুবক সেলিমের সঙ্গে বিয়ের পরে পরিস্থিতির চাপে নিরুপায় হয়েই পুব পাকিস্তানে যেতে হয়েছিল। ঢাকায় তিন ছেলেকে নিয়ে দিব্যি ছিলেন। তখনকার ছবির গা বেয়েও যেন চুঁইয়ে পড়া সুখের স্রোতধারা। সফল ইঞ্জিনিয়ারের ঘরনির জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় যা ঘটল, তা উলটপুরাণ! পাকেচক্রে জীবন টেনে নিয়ে গেল পুব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। উপবীতধারী ব্রাহ্মণরা নাকি দ্বিজ, দ্বিতীয় বার জন্মান। জয়া মুখোপাধ্যায় আগেই সলমা হয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকায় বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোও করেছেন। কমিউনিস্ট বর বাধা দেয়নি। করাচিতে নামের সঙ্গে কুরেশি লেখা শুরু করলেন সেলিম। ছেলেদের নামেও মিশে থাকা পল্লব, নির্মাল্যর মতো বাংলা শব্দ মুছে গেল স্থানীয় রীতি মেনেই। সেলিম অবশ্য আমৃত্যু স্ত্রীকে জয়া বলেই ডেকেছেন। করাচিতে তাঁর কবরেও লেখা ‘হাজ়ব্যান্ড অব সলমা জয়া কুরেশি’! তবু রোমে গেলে লোকে রোমান হয়! বাঙালি ভুবনের পরিসর থেকে দূরে পাকিস্তানে জয়া ওরফে সলমা বাস্তবিক আর এক বার জন্মালেন।

Advertisement

জীবনভর উপমহাদেশের ইতিহাসের টানাপড়েনের চিহ্ন বয়ে বেড়ানো সেই নারীর সঙ্গে আলাপ হল তাঁর ভাগ্নে অমিতের সৌজন্যেই। আজাদির ৭৫ বছরের অমৃত মহোৎসব উদ্‌যাপনের আবহে এমন একটি চরিত্রের সঙ্গে পরিচয়ও চমকপ্রদ বটেই। এই ৭৫ বছরের অমৃত আর বিষের পেয়ালা একযোগে চলকে উঠেছে যে জীবনে। এই পুজোয় সপ্তমীর দুপুরে প্রথম বার হোয়াটসঅ্যাপ কলে কথা হচ্ছিল করাচিবাসিনী কলকাতা-কন্যার সঙ্গে। সে দিন অবশ্য তিনি সিঙ্গাপুরে, মেজো ছেলে ও বৌমার বাড়িতে। বড় ও ছোট ছেলে সপরিবার করাচিতেই থাকেন। তিন জনই সুপ্রতিষ্ঠিত, ইঞ্জিনিয়ার বা বহুজাতিক সংস্থার কর্তা। নাতি, নাতনিরাও ডাঁটো হয়ে উঠেছে। সব থেকে আদরের, পরমাসুন্দরী বড় নাতনিটি বাংলা কথা, বাংলা গানে দুরস্ত। তারও মেয়ে হয়েছে ফুলের মতো। সলমা সগর্বে বলেন, “আমি এখন গ্রেট গ্র্যান্ডমাদার!”

শারদ দুপুর! বাংলা ভাষায় কথা বলার সঙ্গী পেয়ে পাকিস্তানি প্রপিতামহীর কথা ফুরোতেই চায় না। সলমা বলে ওঠেন, “খুব ইচ্ছে ছিল, একটা বাঙালি মেয়েকে ছেলের বৌ করে আনব। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের কত জন বাংলাদেশে! কিন্তু সে আর হল কই! পাকিস্তানে মেয়ের বিয়ে দিতে কোনও বাঙালি তখন রাজিই হয়নি। আমার বড় ও ছোট ছেলের বৌয়ের পরিবার দেশভাগের আগে উত্তরপ্রদেশে ছিল। আর টোকিয়ো ইউনিভার্সিটির পিএইচ ডি, করাচির বিখ্যাত এনইডি ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ার মেজো ছেলের বৌ চাইনিজ়। সিঙ্গাপুরে ওদের বাড়িতেই এসেছি!” তবে বড় বৌমা ভাঙা-ভাঙা বাংলা শেখায় বড় শান্তি পেয়েছেন শাশুড়ি মা! সলমা বলতে থাকেন, “করাচির বাড়িতে আমার কত বাংলা বই জানো! বিমল মিত্র, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা দেবী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র। এখন চশমা চোখেও পড়তে কষ্ট হয়! ছেলেদের বলেছি, বাংলা বই রাখার কোনও লাইব্রেরি পেলে বলিস! এ বার বইগুলো দিয়ে দিতে হবে। ছেলেরা বাংলা বলে। পড়তে তো তেমন পারে না! শুধু গীতবিতানটা কখনও দিতে পারব না! আমার দু’সেট আছে।” পুরনো গীতবিতানটা সেই ঢাকার সংসারের। ছিঁড়েখুঁড়ে গেলেও, আছে! বড় ছেলে পরে বাংলাদেশ মারফত মায়ের জন্য নতুন একখানা আনিয়েছেন। বই তো নয়! করাচির বাঙালিনির সব থেকে আপনজন।

বিজয়ার পরে সলমা কুরেশি ফোনে বাংলায় লেখেন, ‘আশিস রইল’। কিন্তু চিরসখা রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে এখন মুখে ‘টেগোর’টাই আসে সহজে। আর হিন্দু থেকে মুসলিম, ভারতীয় থেকে পাকিস্তানি, কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে করাচিতে নোঙর-ফেলা জীবনে গুলিয়ে যায় দাদা না ঠাকুরদা, কাকা না চাচার সম্বোধন। এ জীবনে ক’বার যে দেশ হারিয়ে নতুন দেশ পেতে হয়েছে তারও হিসাব কষেন সলমা। ভাবেন, দু’বার না তিন বার, কোনটা বলা ঠিক হবে! এত বয়সে এসে মনে হয় বার বার দেশভাগ আসলে ভূগোলের গণ্ডি নয়, কিছু পরিবার আর সম্পর্ককেই খণ্ড খণ্ড করেছে। এর সত্যতা সলমা ওরফে জয়ার মতো জীবন দিয়ে আর ক’জন জানেন!

জীবন-নদীর ঢেউয়ের গ্রাসে মুছে যাওয়া জয়ার শৈশবের মায়াভরা চরের গল্প শুনতে শুনতেই পৌঁছে যাই ১৯৪০-৫০’এর দশকের কলকাতায়। ১৯৪০-এ জয়ার জন্ম অবশ্য ঢাকার হাটখোলা রোডের প্রকাণ্ড পৈতৃক বাড়িটায়। ঠাকুরদা বিপিনবিহারী মুখোপাধ্যায় ডাকসাইটে জেলা জজ। বাবা সুরেশচন্দ্র কলকাতায় ফুড ডিপার্টমেন্টে চাকরিরত। জয়া ওরফে সলমার এখনও মনে আছে, বাবার অফিস ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। সব থেকে ছোট মেয়ে, জয়া! ডাক নাম ছিল বাচ্চু। বাঁশদ্রোণীর বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন ছবি বিশ্বাস! ছবি বিশ্বাসের কোলে উঠে আদরও খেয়েছে একরত্তি মেয়েটি। বেশ মনে আছে, রানিকুঠির দিকে কাননদেবীর বাড়িটাও সে কলকাতার একটা দ্রষ্টব্য স্থান। সেই বয়সে দেশভাগ, স্বাধীনতার মানে অবশ্য কী-ই বা বুঝবেন! তবে মা শান্তিলতা সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়েছিলেন, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে দারুণ সক্রিয়, ঘোর কংগ্রেসি। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও পরিবারটিকে ভাল করে চিনতেন। দক্ষিণ শহরতলির কৈবল্যনগর বলে একটা মহল্লাই গড়ে ওঠে জয়ার মায়ের তৎপরতায়। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায় ঢাকার ১১ কাঠা জমির বাড়িটা কোনও আদম সাহেবের সঙ্গে বদলা-বদলি করে পার্ক সার্কাসে থিতু হওয়ার কথাও মনে করে বললেন আজকের সলমা।

কনভেন্ট স্কুল থেকে তারক দত্ত রোডে শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা, নাচ-গানের চর্চায় শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়ার পর্ব সে যুগের কলকাতায় আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। নিউ এম্পায়ারের প্রোগ্রামেও নেচেছেন। মেট্রো, নিউ এম্পায়ারে দাদা দিলীপ মুখোপাধ্যায় কত সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছেন। ‘কুয়ো ভাদিস’ থেকে লিজ় টেলরের ‘ক্যাট অন আ হট টিন রুফ’, জিনা লোলোব্রিজিদার ‘কাম সেপ্টেম্বর’... ঝামরে পড়ে স্মৃতির সুরভি। ম্যাট্রিক পাশের পরে ১৯৫৭-র একটা ঘটনাই সেই সুরক্ষিত জীবনের ডানায় ঝড়ের হাওয়া এনে দিল। জীবনযুদ্ধের শত ক্লান্তিতে ধ্বস্ত হয়েও সে দিনের জয়া মনে করতে পারেন, ১৯৫৭-র ২৯ মার্চ থেকে ১৯৫৮-র ১০ মার্চ— তাঁর জীবনের সেই উত্তাল পর্ব। প্রথম তারিখটিতে দেখা হয়েছিল সেলিমের সঙ্গে। আর এক বছরের মধ্যেই ঢাকুরিয়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে সিঁদুর পরিয়ে দু’জনের বিয়ে। জয়ার তখনও আঠারো পূর্ণ হতে একটি মাস বাকি। নাটকীয় এই প্রেমপর্বে দু’জনের প্রথম দেখা কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটের প্রচারে। জয়া ছিলেন মায়ের সঙ্গে, পারিবারিক সুহৃদ কংগ্রেস প্রার্থীর সমর্থনে। জয়ার থেকে দশ-বারো বছরের বড় সেলিম কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীর প্রচারসঙ্গী। সুবক্তা, সুদর্শন, সুঠাম যুবকের ইশারায় তরুণীর বুকের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস ঢাক বাজতে শুরু করল। দিলখুসা স্ট্রিটে সেলিমের দিদি-জামাইবাবু, নাসিমা ও অমলেন্দুর বাসা। সেই বাড়ির চাবি নবীন প্রেমিক- প্রেমিকার কাছেই থাকত। সেখানেই নিয়মিত দু’জনের দেখা। সেলিম সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর আবু নাসের মহম্মদ ইউসুফ আলি অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের আদরের ভাগ্নে। চরম সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময়েও পরিবারটি ঐক্য ও সম্প্রীতির আদর্শে দায়বদ্ধ থেকেছে। তবু এই সম্পর্ক মেনে নেওয়ার পথ সে দিন মসৃণ হয়নি। পাড়ার ছেলে সেলিমকে স্নেহ করতেন সুরেশচন্দ্র। কিন্তু জামাই বলে মানা সহজ ছিল না। এই টানাপড়েনের মধ্যেই চুপিচুপি সেলিমের এক বন্ধুর বাড়ি এসে ওঠেন জয়া। পার্ক স্ট্রিটে কোয়ালিটি রেস্তরাঁর সামনে সেলিমের সঙ্গে দেখা হল। জয়ার আঠারো হতে সামান্য দেরি ছিল বলে তখনই কোর্ট ম্যারেজ করা সম্ভব হয়নি। বাড়ি ছেড়ে মেয়ের পালানোর ঘটনা নিয়ে থানা-পুলিশও হয়। স্বাধীন ভারতে লালবাজারের প্রথম পুলিশ কমিশনার সুরেন চট্টোপাধ্যায় জয়াদের কাছের আত্মীয়। তাই ঝুঁকি না নিয়ে খুলনায় গিয়ে নিকা করেন নব দম্পতি। জয়া বলেন, “নানা ঝামেলাতেই আমরা পুব পাকিস্তানে যেতে বাধ্য হই। সয়েল ইঞ্জিনিয়ার সেলিম কাজকর্ম জুটিয়ে ঢাকায় সফলও হয়েছিল। তিন ছেলেকে নিয়ে ভাল ছিলাম। বাবার মনে একটা কষ্ট থাকলেও নাতিদের দেখে হয়তো অনেক কিছু ভুলেছিলেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করেছি। ভেবেছিলাম, এ বার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে! কিন্তু আমার ভাগ্যলিপিতে কী লেখা, তখন কী করেই বা বুঝব!”

পারিবারিক: বাঁ দিক থেকে সলমা (জয়া), সলমার মা শান্তিলতা, সেলিম, সলমার বাবা সুরেশচন্দ্র, বড়দি রেবা। পিছনে জয়ার বড় জামাইবাবু ও বোনঝি।

জীবননাট্যের আশ্চর্য মোচড়ে এ বার ঢাকা থেকে করাচিতে পাড়ি দিতে হল। জয়া ওরফে সলমা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঢাকা ছাড়তেই হত। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও আমার স্বামীর কলকাতায় আসার ঝুঁকি ছিল।” কেন? সলমার ব্যাখ্যা, ঢাকাতেও রাজনীতিতে সক্রিয় সেলিম ছিলেন মৌলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, কলকাতায় যাওয়ার চেষ্টা করলে বাঙালিদের কেউই পাক সেনাকে খবর দিতে পারেন। তাতে প্রাণসংশয় অনিবার্য। উর্দুতে সড়গড় সেলিমের পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুও অনেকে ছিলেন। তাই জয়া-সেলিম ভাবলেন, তিন ছেলেকে নিয়ে কলকাতার বদলে করাচিতে যাওয়াই ঠিক হবে! সেটা ১৯৭১-এর জুন। সামাজিক জীবনে জয়াকে এর পরেই ক্রমশ ঢেকে ফেলবে সলমা। সলমা বলেন, “করাচিতে গিয়ে প্রথমে হোটেলে থেকেছি। তার পরে বাড়ির বন্দোবস্ত হল। পাকিস্তান থেকে সবে জন্মানো বাংলাদেশে ফেরার পরিস্থিতি তৈরি হতে হতে তিন ছেলেই করাচির স্কুলে উর্দু শেখায় মানিয়ে নিয়েছে। তিন ছেলেকে নিরাপদে মানুষ করাই এর পরে আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। ওরা তিন জনই জীবনে সফল, এটাই আমার সব থেকে বড় পাওয়া!”

এই পাওয়ার বিনিময়ে ছিটকে গিয়েছেন পরিবারের কাছের জনেদের থেকে। তাঁরা এখন ছড়িয়ে সারা দুনিয়াতেই। জয়া ওরফে সলমার শ্বশুরমশাই দেশভাগের পরেও ভারত ছাড়তে চাননি। কলকাতার পার্ক সার্কাসেই তাঁর মাটি হয়। দেওর আসফ আলি এখন অশক্ত প্রবীণ। নানা টানাপড়েনের পরে তিনিও কলকাতায়। ননদ নাসিমাদির পুত্র-কন্যা, অর্থাৎ ভাগ্নে বাবুয়া (অমিত) ও ভাগ্নি মুনিয়া (ইতিহাসের অধ্যাপিকা তাপ্তী দে) কলকাতায় থাকলেও, শ্বশুরবাড়ির দিকের অনেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা বা কানাডা, আমেরিকায়। বাংলাদেশের নাট্যজগতের বিশিষ্টজন, একদা শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’-র ফাগুলাল মহম্মদ জাকারিয়া এবং সব থেকে বড় ননদ তাহমিনা বানুর কন্যা, স্নেহের ভাগ্নি সুরমা জাকারিয়া (ঢাকায় ইতিহাসের অধ্যাপিকা) সলমার খুবই আপন। আর আওয়ামি লীগের সদ্যপ্রয়াত নেত্রী, মামাতো ননদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন সলমা ওরফে জয়ার প্রিয় সখী। তিনি চলে যাওয়ার যন্ত্রণা বড় বেশি করে বিঁধেছে। আর জয়ার নিজের ভাইবোনেরা কোথায়?

ছোট ভাই বিপ্লব অকালে বহু দিন গত হয়েছেন। দুই দিদি রেবা, সেবাও নেই। তবু কয়েক বছর আগেও মনে হত, দাদা দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে যদি এক বারটি ছোটবেলার মতো ভাইফোঁটা দিতে ইন্ডিয়ায় আসা যায়! কলকাতার ছোটবেলায় পুজোর পরেই সব থেকে আনন্দের দিন ছিল, ভাইফোঁটা! ২০১৫-য় দাদা পুণেতে গত হয়েছেন। ভাইফোঁটা ঘুচেছে জন্মের মতো! ভাইপো অরিন্দম (জয়ার দাদা দিলীপের পুত্র) দীর্ঘ দিন সপরিবার পুণেবাসী। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানবাসী ছোট পিসির একটি প্রধান সংযোগসেতু তিনিও। সলমা বলেন, “অরিন্দম আমায় কলকাতার পরিবারের অনেক ছবি খুঁজে দিয়েছে।” ফেসবুকে ছোটপিসির সঙ্গে গল্প করা ছাড়াও কয়েক বার ভিডিয়ো কলে কথা বলেছেন অরিন্দম। পিসতুতো দাদাদের সঙ্গেও হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। তিনি বলেন, “আমার পাকিস্তানি পিসির কথা শুনে অনেকেই অবাক হয়! শেষ দিকে বাবা ভাবত, বাংলাদেশে গিয়েও যদি পিসির সঙ্গে দেখা করা যায়, সে আর হল কই!” এক বারই ছোটপিসির সঙ্গে কলকাতায় দেখা হয় অরিন্দমের। এখন আবছা মনে পড়ে, তখন বছর দশেক বয়স। সেটা সম্ভবত ১৯৮৯।এর পরে আর কখনও ভারতে আসা হয়নি জয়া ওরফে সলমার।

শেক্সপিয়রের জীবনের শেষ পর্বের নাটকগুলো ট্র্যাজেডি বা কমেডির বাইরের এক অন্য গোত্রের বলে চিহ্নিত করা হয়। পারিবারিক বিচ্ছেদ, বিপর্যয় থাকলেও তা নিছকই বিয়োগব্যথাতুর নয়। সময়ের জলপটির স্পর্শে বরং পুরনো ক্লেদ মুছে যায়। বয়ে আনে এক ধরনের শান্তিময় স্নিগ্ধতা। জয়া ওরফে সলমার জীবনে কি তা-ই ঘটেছে? ভাইপো অরিন্দম বলেন, “পিসির ভিন্‌ধর্মে বিয়ে নিয়ে কিন্তু বাবার মনে এতটুকু আক্ষেপ দেখিনি! পিসির কথা উঠলেই বাবা বরং সগর্বে বলত, বাচ্চু পড়াশোনায় কত ভাল ছিল। পিসি, পিসেমশাইয়ের সন্তানেরা এত সুন্দর মানুষ হয়েছে বলেও বাবার ভিতরে গর্ব ছিল। আমাদের যা কিছু কষ্ট রয়েছে, দেশভাগের দেওয়ালটার জন্যই!” অল্প বয়সে বিয়ের পরে উচ্চশিক্ষিত শ্বশুরবাড়িতে সংসার, সন্তানের দায়দায়িত্বে পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি জয়ার। তবে গোগ্রাসে বাংলা সাহিত্য পড়ার পাশাপাশি সিডনি শেলডন, বারবারা কার্টল্যান্ডদের বেস্টসেলার পড়েছেন। ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান যৌথ সংস্কৃতির পরিবেশও অক্ষুণ্ণ ছিল। পাকিস্তানে সেলিম চাকরি করেছেন প্রধানত করাচি ও কোয়েটায়। এত বছরে লাহোর, ইসলামাবাদ ছাড়াও সোয়াট উপত্যকা, অ্যাবটাবাদের শৈলশহর নাথিয়া গলি, পাক কাশ্মীরের নানা অঞ্চলে অসাধারণ সব জায়গায় বেড়িয়েছেন। তবে সলমার সামাজিক জীবন কিন্তু পরিবারের ঘেরাটোপেই গুটিয়ে যায়। তিনি হাসেন, “উর্দু আস্তে আস্তে বলতে শিখলেও পড়তে এখনও পারি না। কী করব, বাংলা ভাষা তো আমার রক্তে! ‘জনগণমন’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’ চাইলেও ভুলতে পারব না। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতও মনে রাখার চেষ্টা করি!” তবে বড় ছেলের কাছে শুনে শুনে আর বই পড়ে ইসলামের অনেক কিছু জেনেছেন, শিখেছেন সলমা। এখন ফি-বছর মেজো ছেলের কাছে সিঙ্গাপুরে গিয়ে বুড়ি বয়সে বেশ ক’জন বন্ধু হয়েছে। তাঁরা সকলেই ভারতীয় হিন্দু বা মুসলমান। সলমা হাসেন, “আমি হিন্দু ধর্ম আর ইসলাম, দুটোরই এত কিছু জানি দেখে বন্ধুরা সমীহই করে!”

সিঙ্গাপুরে বন্ধুদের মাঝে খোলা হাওয়ার স্বাদ পেলেও একটি সমস্যা অবশ্য সেখানেও বহাল। করাচি ও সিঙ্গাপুর, দুটোই সমুদ্রপাড়ের শহর। সামুদ্রিক মাছ খেয়ে তৃপ্তি হয় না কলকাতা-কন্যার। সিঙ্গাপুরে ছেলের বাড়ির ফিলিপিনো কেয়ারটেকার আম্মার জন্য বাংলাদেশি ধাঁচে দু’একটা রান্না রপ্ত করে নিয়েছেন। তবু ফুলকপি দিয়ে রুই, সর্ষে ইলিশ, কাতলের কালিয়া আর পাবদার ঝাল শুধু স্বপ্নেই হানা দেয়। এত দূরে বসেও আজকাল পুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজোর গন্ধও মেশে সোশ্যাল মিডিয়ার অলিগলিতে। তখন মনে পড়ে, কলকাতার বাড়ির উৎকলীয় ঠাকুরের রান্না বা ঠাকুরমার বোনের হাতের পার্বণী নারকোলের তক্তি, নাডুর সুবাস।

ভাগ্নে বাবুয়া ফেসবুকে ছবি পাঠায়, ‘মামি দেখো আমাদের বাঘাযতীনের বাড়ির ছাদে থোকা থোকা কামিনীর ছড়াছড়ি!’ সলমা ভাবেন, ‘তাই তো, কত দিন কামিনী ফুল দেখিনি! কী রকম যেন গন্ধটা?’ পথভোলা এক পথিকের মতোই সঙ্গে সঙ্গে চার কুড়ি পার বৃদ্ধার সন্ধ্যাবেলার চামেলি আর সকালবেলার মল্লিকার কথাও মনে পড়ে! ও সব ফুল কোথায় পাকিস্তানে! পাকিস্তানি হিন্দুরা করাচিতে নিজেদের নানা উৎসবে মাতে। রক্তে মিশে থাকা বাঙালিয়ানা এবং পারিবারিক অভ্যাসের বশে সেই জগতের সঙ্গেও নিজেকে মেলাতে পারেন না সলমা। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের পারদের ওঠানামায় দু’দেশের বাসিন্দাদের মানবিক সম্পর্ক মেলে ধরার কথা সব দল বা সরকারই ঘুরে-ফিরে বলে। কখনও শিখদের জন্য কর্তারপুর করিডর খোলা হয়, কখনও বা সমঝোতা এক্সপ্রেসের চাকা গড়াতে থাকে। সলমা ভাবেন, ‘আমারও তো কাছের জনেরা কলকাতা, পুণে, ঢাকা, চট্টগ্রাম কত জায়গায় ছড়িয়ে। দু’দেশের ছিটকে যাওয়া পরিবারগুলির মধ্যে আমি বাঙালিনি ঠিক কোন গোত্রে পড়ব!’ পাকিস্তানি বাঙালিনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে দশ বছর আগে কলকাতার পুজোয় আলাপ হওয়া করাচিরই ট্রাক আর্টের শিল্পী হায়দর আলির একটা কথা মনে পড়ল। হাতিবাগানে পুজোর থিম করতে এসে হায়দর বলেছিলেন বটে, “ভাবুন তো ইউরোপের দেশগুলো শতকের পর শতক নিজেদের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করেছে, কিন্তু এখন দিব্যি অবাধ যাতায়াতে মশগুল। আর আমরা ভারত-পাক যুগ যুগ ধরে শান্তিতে ভাই-ভাই হয়ে থেকেছি, কিন্তু এখন আমাদের মধ্যেই পদে পদে বাধার দেওয়াল।” সলমা না কি জয়া বলেন, “সেই কাঁচা বয়সে জীবনে একটি ছেলের প্রতি ভালবাসাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। অনেকেই দেয়! কিন্তু ক’জনকে এর জন্য বাপ, মা, চেনা পরিবেশ, জন্মভূমি সব কিছু বিসর্জন দিতে হয়? এই উপমহাদেশে জন্মেছি বলেই কি এত বড় শাস্তি বয়ে বেড়াতে হবে?” পাকিস্তানে কৃতী সন্তানদের গরবিনি মাকে সেই মুহূর্তে যতটা পূর্ণ, ঠিক ততটাই নিঃস্ব মনে হয়! শেক্সপিয়রের শেষ দিকের নাটকের শেষ অঙ্কের শান্তিময় পরিণামও নিঃসীম শূন্য ঠেকে।

ঠিক তখনই আবার আদরের বড় নাতনির গল্প শোনান সলমা, মেয়েটার বাংলা গান শুনলে কে বলবে ও কোনও দিন কলকাতা বা বাংলাদেশ দেখেনি! মিষ্টি স্বরে মানবেন্দ্রর গান ধরে তরুণী নাতনি, ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে, আকাশে তারাদের ওই মিছিলে, তুমি আমি আজ চলো চলে যাই, শুধু দু’জনে মিলে’! পাকিস্তানি ঠাকুমা গলা মেলায়! তাঁর জীবনের উপান্তে ফেরার পথ বাধার পাহাড়ে ভরা। তবু করাচিতে ডানা-ভাঙা সে কালের সীমানা ছাড়িয়ে গানে গানে গত জন্মের কলকাতাটাকেছুঁয়ে আসেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement