সংগ্রামী: নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। ডান দিকে, তাঁর হাতে প্রকাশিত হয়েছিল সাঁওতালি ভাষায় লেখা বাবাসাহেব আম্বেডকরের জীবনী
বাবাসাহেব আম্বেডকর না থাকলে আমি হয়তো আজ এখানে আপনাদের সামনে এই ভাবে আসতে পারতাম না। হয় জঙ্গলে কাঠ কাটতাম, নয়তো কলকাতায় রাস্তা তৈরি করার কামিন হিসেবে আসতাম...”
কলকাতায় ভারত সরকারের সংস্কৃতি দফতরের ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর কালচারাল রিসার্চ’-এর প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত সকলের চোখ সে দিন ছলছল করছে। কথাগুলি বলেছেন দ্রৌপদী মুর্মু, তিনি তখন ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল। তারিখটি ১৭ এপ্রিল, ২০১৯। উপলক্ষ, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকরের সাঁওতালি ভাষায় জীবনীগ্রন্থ উদ্বোধনের অনুষ্ঠান। হল-ভর্তি বিশিষ্ট মানুষের সমাবেশ থেকে বেরিয়ে আয়োজকদের বললেন, “দারুণ হয়েছে কাজটা। এই সাঁওতালি ভাষার বইটি যদি বাংলা হরফে না করে অলচিকি হরফে প্রকাশ করেন তবে, বাংলা, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার আর অসমের প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষ নিজের মাতৃভাষায় বাবাসাহেবের কথা জানতে পারবেন।”
দ্রৌপদী মুর্মুর এই কথায় ওখানে উপস্থিত যুবকদের মনে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কলকাতাতেই অলচিকি হরফে লেখার যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া গেল। আমার সহকর্মী সুরাই মান্ডি এই সময় খুব সহযোগিতা করেছিলেন। ছাপার ব্যবস্থা হল রাজেন্দ্র মুর্মুর সাগুন কম্পিউটার প্রেস থেকে। পাঁচ মাস পরেই নতুন বই নিয়ে পার্থ বিশ্বাস, শুকদেব টুডু আর শুভদীপ পাল গেলেন রাঁচীতে। রাঁচীর রাজভবনে পৌঁছে দেখা গেল সে দিন মহামহিমের সারা দিনের কার্যক্রম আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে।
এই রাজভবনেই আছে অড্রে হাউস। এখনসেটি সংগ্রহশালা।
১৮৫০ নাগাদ তৈরি এই বাড়িতেই ছোটনাগপুরের ডেপুটি কমিশনার থাকতেন। সেই সময় হয়তো ছোটনাগপুরেই গয়া জেলার কোনও জঙ্গলে রাজা দোবরু পান্না বীরবর্দীর অভিষেক হয়েছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ‘আরণ্যক’-এর কাহিনি শুনিয়েছিলেন। রাজা দোবরু পান্নার পূর্বপুরুষরা মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধেও সর্বপ্রথম বিদ্রোহ তো তাঁদেরই। সারা দিন রাজভবনের বাগানে আর জঙ্গলে কাটল পার্থদের।
রাজ্যপালের সারাদিনের তুমুল ব্যস্ততা সাঙ্গ হলে প্রায় সন্ধেবেলায় ডাক এল তাঁদের। ওঁদের হাতে অলচিকি হরফে সাঁওতালি ভাষায় বাবাসাহেবের জীবনী দেখে একেবারে আপ্লুত তিনি। সে দিন দ্রৌপদী মুর্মু ওই ছেলেদের রাতে খাওয়াদাওয়া করিয়ে তবে ছেড়েছিলেন। অনেক দিন পরে বাড়ির ছোট ছেলেপুলেরা কাছে এলে স্নেহশীলা মাতৃস্থানীয়ারা যেমন ব্যবহার করেন, তেমনই আন্তরিক ছিল তাঁর ব্যবহার।
বাবাসাহেব আম্বেডকরের জীবনীগ্রন্থ সাঁওতালি ভাষায় প্রকাশ করার ভাবনা প্রথম এসেছিল এক কিশোরীর মাথায়। দুর্লভ টুডুর মেয়ে নীলামালা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। ওকে ধনঞ্জয় কীড়-এর লেখা আম্বেডকরের জীবনী উপহার দিয়েছিলাম। বইটা পেয়ে খুব খুশি নীলামালা, বলল, “জানো, সাঁওতালি ভাষায় বাবাসাহেবের উপরে লেখা কোনওবই নেই।”
কথাটা শুনে একটু খোঁজাখুঁজি করলাম। সত্যিই সাঁওতালি ভাষার পরিচিত পণ্ডিতরা হদিস দিতে পারলেন না। অধ্যাপক অচিন্ত্যকুমার বিশ্বাস তখন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। নীলামালার গল্পটা শুনে বললেন, হয়তো ছাপা হয়েছিল কিন্তু গ্রন্থাগারের সংগ্রহে নেই বা এখন আউট অব প্রিন্ট। তার পর মুচকি হেসে আমেরিকান লেখিকা বেভারলি ক্লেরির উদ্ধৃতি শুনিয়েছিলেন, “যে বইটা শেল্ফে খুঁজছ সেটা যদি না পাও, তবে লিখে ফেলো।”
অচিন্ত্য স্যরকে ঘিরে আমাদের বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের একটা আড্ডার দল আছে। বিদেশে থেকে তথ্যপ্রযুক্তির কাজকর্ম করে সেই দলে তখন সবে যোগ দিয়েছে শুভদীপ। তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি, নিয়েই নেওয়া হোক মিশনটা!
রমেশ পতঙ্গের লেখা ‘আম্বেডকর: দ্য গ্রেট মিশন ইন মেকিং ইন্ডিয়া’ বইটি অনুবাদ করলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক সাগেন মান্ডি। ‘আম্বেডকর: ভারত বেনাও রাকাব রিনিচ উদগাইয়া’— বলে রাখা ভাল, ‘উদগাইয়া’ বানানটি একেবারে ঠিক হল না। আসলে ‘ওহত’ বর্ণটি বাংলা বর্ণমালাতে নেই, তাই বাংলা হরফে সাঁওতালি লেখার সময় ওই ‘গহল’ মানে অতি গভীর স্বরবর্ণের জন্য ঔ-কার এর এ-কার অংশটা বাদ দিয়ে লেখা হয়। সেটা এখানে লেখা সম্ভব হল না। বইটি প্রকাশে একটু দেরিই হয়ে গেল। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঁওতালি ভাষার বিভাগীয় প্রধান তখন অধ্যাপক মাঝি। উনি পাণ্ডুলিপি দেখে সন্তুষ্ট হলেন।
সকলেরই ইচ্ছে ছিল বেশ ধুমধাম করে প্রকাশ হোক সাগেন মান্ডির বইটি।
হঠাৎ তখনই কলকাতায় ভগিনী নিবেদিতার সার্ধশতবর্ষের এক অনুষ্ঠানে এলেন দ্রৌপদী মুর্মু। শুকদেব টুডু, পার্থ বিশ্বাসরা আন্তরিক অনুরোধ করেছিলেন, “আপনাকে আসতেই হবে ম্যাডাম!”
কাজ হল। ওঁর আপ্তসহায়ক আর এডিসির সঙ্গে কথাবার্তার পরে দিন ঠিক হল, ১৭ এপ্রিল, ২০১৯। সেখানেই বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের শুরুর কথাগুলো বলেন তিনি। বলেছিলেন অলচিকি ভাষায় বাবাসাহেবের জীবনী লেখার কথাগুলিও।
পঞ্চদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন দ্রৌপদী মুর্মু। আটটি রাজ্য ও আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গণনা বাকি থাকতেই, দ্রৌপদী পেয়ে গিয়েছেন প্রয়োজনীয় ভোট। হিসেবমতো আজই শেষ হচ্ছে বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মেয়াদ। দ্রৌপদীর শপথগ্রহণ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রাংপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আজও ভাঙাচোরা জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় উপেরবেড়া গ্রামে। দ্রৌপদী মুর্মুর জন্মভিটে এখনও এক অজগ্রাম। মাটির বাড়ি, খাপরা আর খড়ের ছাউনি। দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় বিদ্যুৎও থাকে না। তবে গ্রামের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক আছে তাঁর। তাঁর উঠে আসা গল্পকাহিনিকেও হার মানায়। বহু চড়াই-উতরাইয়ের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে উঠে আসতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৫৮ সালের ২০ জুন তারিখে এক সাঁওতাল পরিবারে জন্ম দ্রৌপদীর। গ্রামেই স্কুলশিক্ষা। প্রাথমিক স্কুলে বরাবর লেখাপড়া ও খেলাধুলোয় প্রথম হতেন। গ্রামের প্রথম মহিলা হিসেবে ভুবনেশ্বরে পাড়ি দেন স্নাতক স্তরে শিক্ষালাভের জন্য। সেখানকার রামদেবী উইমেন্স কলেজে কলা বিভাগের স্নাতক। তার পর ওড়িশা সরকারের সেচ ও বিদ্যুৎ বিভাগে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি, পরে রায়রাংপুরের শ্রীঅরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা।
কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা শ্যামচরণ মুর্মুর সঙ্গে। পরে তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন সন্তানের জন্ম হয়। ২০০৯ সালে এক ছেলে মারা যায়। যোগাভ্যাস শিক্ষা করে নিজেকে সামলে ওঠেন তিনি। কিন্তু আবার বছর চারেক পরই ছোট ছেলের মৃত্যু। তার মাসখানেকের মধ্যেই মা ও ছোট ভাই, পরের বছরেই স্বামীকেও হারান দ্রৌপদী। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে পুরোপুরি আধ্যাত্মিকতার পথ গ্রহণ করেন তিনি।
ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে এবং তার ৭৫ বছর পূর্তিরও আর দেরি নেই। স্বাধীনতার পর সাড়ে সাত দশক খুব একটা কম সময় নয়। কিন্তু যাঁদের জন্য শাসন, শাসনব্যবস্থায় তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কতটা? না খেতে পাওয়ার কষ্ট, অস্পৃশ্য হওয়ার কষ্ট, হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে আসার কষ্ট এবং সবেতে প্রান্তিক হওয়ার বিচ্ছিন্নতা ভোগ করার যে কষ্ট, তা কি যাঁরা নীতি নির্ধারণ করেন তাঁরা বোঝেন? তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া যায় যে বোঝেন, এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, তাঁরা প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী নন। দ্রৌপদী নিজে অনেকটা দেখেছেন, জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন। তাই আজকের ভারতের প্রথম নাগরিক অনেক কিছু শেখাতে পারবেন শাসনতন্ত্রকে। যেমন এপিজে আবদুল কালাম ক্লাস নিতেন সাংসদ, রাজনীতিবিদ আর প্রশাসনিক আধিকারিকদের। এ বার হয়তো আর এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। বঞ্চিত, দলিত, নিপীড়িত সমাজের সহজপাঠ নিতে পারবেন কর্তাব্যক্তিরা।
এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ‘আরণ্যক’-এ দোবরু পান্নার পৌত্রী রাজকুমারী ভানুমতীর সেই কথা আজ বার বার মনে আসছে,
“‘আমরা কোন দেশে বাস করি তার নাম জান?’
‘আমরা গয়া জেলায় বাস করি।’
‘ভারতবর্ষের নাম শুনেছ?’
ভানুমতী মাথা নাড়িয়া জানাইল সে শোনে নাই। কখনও কোথাও যায় নাই চকমকিটোলা ছাড়িয়া। ভারতবর্ষ কোনদিকে?”
দ্রৌপদী মুর্মু দেখিয়ে দিয়েছেন কতটা পথ হাটলে দোবরু পান্না বীরবর্দীর অরণ্যবাস থেকে রাইসিনা হিল্স-এ যাওয়া যায়।