Kolkata Book fair

চেনা-অচেনা বইমেলা

অলিগলিতে ঘোরেন বহু লেখক। স্টলের তাকেও সাজানো থাকেন অনেকে। তাঁদের ঘিরে থাকে পাঠক। লেখকের ভাবপ্রকাশের বিধিনিষেধ থাকে। পাঠক মুক্তসত্তা। অসংখ্য বইপ্রেমীর নানা স্মৃতির কোলাজ গেঁথে এগিয়ে চলে ভালবাসার বইমেলা।

Advertisement

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:২৯
Share:

ফাইল চিত্র।

লেখকের বইমেলা

Advertisement

সন্ধে হয়ে এল, অথচ আজ চার পাশের আলোগুলো তত স্পষ্ট নয়। একটা বড় স্টলের পাশের গলিতে অনেকগুলো চেয়ারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছেন ওঁরা। ওঁদের মুখগুলো একটু দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও কথাগুলো পরিষ্কার কানে আসছে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “কত কিছু লিখেছি, কোনওটাই কিছু হয়েছে কি না কে জানে!”

Advertisement

বিমল মিত্র বলে উঠলেন, “‘গণদেবতা’ আর ‘পঞ্চগ্রাম’-এর লেখক এ কথা বলছেন! তবে সাহেব হোক বা গোলাম, সবাই অন্ধ পৃথ্বীরাজের মতো শব্দের উপর ভরসা করেই তির ছোড়ে।”

“যেখানে তিরটা লাগে, সেই বিন্দুটার নামই হয়তো মহাকাল,” বললেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় উদাস কণ্ঠে বললেন, “মহাকালের বিচারে টিকে থাকতে গেলে এমন কিছু সৃষ্টি করে যেতে হবে, প্রতিটি অমাবস্যায় যা দীপাবলি, প্রতিটি অকালবোধনে নীল পদ্ম।”

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এত ক্ষণ নীরবে শুনছিলেন। এ বার চায়ে একটা বড় চুমুক দিয়ে বললেন, “নেমন্তন্ন বাড়িতে নীল হয়ে যাওয়া শিঙাড়া খেতে আমায় বারণ করেছিল অনেকে। না শুনে ভুল করেছিলাম। তা বলে বইমেলায় এসেও আমায় চারটে গরম শিঙাড়া খাওয়াবে না কেউ?”

সৈয়দ মুজতবা আলী মজার গায়ে রাগের ছিটে দিয়ে বললেন, “বিভূতিভূষণ খেতে চাইলে আমি কাবুলেও শিঙাড়া জোগাড় করে ফেলতাম।”

ওঁর কথা শেষ হতেই গজেন্দ্রকুমার মিত্র বলে উঠলেন, “আনানো যায় কাকে দিয়ে বলুন তো?”

আশাপূর্ণা দেবী এবং লীলা মজুমদার পাশাপাশি হাঁটছিলেন। মুক্তমঞ্চে একটু আগে আশাপূর্ণার দিকে ছুটে এসেছে জনৈক শ্রোতার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন— পালিতা কন্যা সুহাসিনীর সঙ্গে নবকুমারের (সত্যবতীর স্বামী) চেয়েও বয়সে বড় ভবতোষ মাস্টারমশাইয়ের বিয়ে সহজে গ্রহণ করেছিলেন সত্যবতী; তা হলে সুবর্ণর সঙ্গে প্রবোধচন্দ্রের বিয়েতে এত আপত্তি কেন? সুবর্ণ নিজের মেয়ে, তাই?

দু’জনের পরিস্থিতি একেবারেই এক ছিল না, তবু নিজের দেওয়া উত্তর নিয়ে আশাপূর্ণা যে সন্তুষ্ট নন, বুঝতে পারছিলেন লীলা। এক সময় আশাপূর্ণা ওঁর কাছে জানতে চাইলেন, “সত্যিই কি আমরা নিজেদের কাউকে যত ভালবাসতে পারি, অন্য কাউকে ততটা পারি না?”

লীলা আড্ডার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “এই অক্ষর-সমুদ্রের মধ্যে প্রতিটি ঢেউই তো নিজের লোক। তোমার বইকে যে জীবনের সমতুল ভেবে প্রশ্ন করছে, তার প্রশ্নটাই কেন শুধু দেখতে যাব আমরা? তার প্রেমটাকে দেখতে হবে না?”

আশাপূর্ণা তাকালেন লীলার দিকে। স্টলে স্টলে ভিড় করা মানুষের মধ্যে বইয়ের ঘ্রাণ আর তরঙ্গের প্রাণ সম্মিলিত হচ্ছে ভেবে চমক জাগল তাঁর।

আড্ডায় নতুন যোগ দেওয়া অদ্বৈত মল্লবর্মণ বলছিলেন, দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে আছড়ে পড়া অগুনতি জেলেকে কেমন করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দণ্ডকারণ্যের মালকানগিরিতে; জলের দোলনায় দোল খাওয়া মানুষগুলোকে সেখানে এক কলসি জলের জন্য হেঁটে যেতে হত সাত মাইল।

দূরে গির্জায় ঘণ্টা বাজল। বিমল কর বললেন, “জীবন হয়তো মালকানগিরির মতোই রুক্ষ, তবু শ্রাবণের ধারার মতো কী যেন ঝরে চলে। তোমায় নিয়ে লেখা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পটি পড়েছিলে?”

অদ্বৈত এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “‘যাত্রাপথ’ গল্পটা আমি পড়েছি। ‘অনন্ত মালো’ নাম আমার সেখানে। মালোকে নিয়ে গল্প! নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কলম অন্তত জাত খোয়াবার ভয় করেনি।”

মহাশ্বেতা দেবী কখন আড্ডায় এসেছেন, খেয়াল করেননি কেউ। অদ্বৈতর কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন, “আপনি আমার ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ পড়লে দেখবেন, কবি প্রশ্ন করছেন, মুক্তাকে শুধাও না, আগে কেন ঝিনুক হয়ে জন্মালি?... কবি কেন বিধাতার দেওয়া জন্মকেই শেষ কথা মনে করছেন?”

শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় একযোগে বলে উঠলেন, “সমুদ্রে বাস করার অভিজ্ঞতা থাকলে বোঝা যায় প্রতিটি সমাপ্তিই আসলে নতুন কোনও আরম্ভ।”

নবনীতা দেব সেন হেসে উঠলেন, “ভালবাসা কারে কয়? সেও কি ঢেউ নয়?”

“যা অলীক তাই বাস্তব। আবার বাস্তবও অলীক হয়। অনুভব করার জন্য লেখা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়,” সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বললেন।

“এগিয়ে না গেলে যে বিষের পাত্র মন্থন করে অমৃত উঠে আসে না,” সমরেশ বসু মন্তব্য করলেন।

এমন সময় জয়দেব বসু এসে বসে পড়লেন ঠিক মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়। বসতে বসতেই বলে উঠলেন, “ইদানীং বিষের অভ্যন্তরে যতখানি অমৃত, আসল অমৃতে ততটা নেই।”

“পুড়তে আমি ভালবাসি, ভালইবাসি...” বললেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের নীরব প্রশ্নের উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলে উঠলেন, “এই ছেলেটি ‘মেঘদূত’ নামে চমৎকার একটি সুদীর্ঘ কবিতা লিখেছে। আমার ধারণা বাংলা কবিতার ইতিহাসে ওই কবিতাটি থেকে যাবে।”

“আপনারা কি ইতিহাস নিয়েই মগ্ন থাকবেন? পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বলেই ফ্যাতাড়ুরা উড়ছে, আপনারা বুঝতে পারছেন না?” নবারুণ ভট্টাচার্যের গলা উচ্চগ্রামে পৌঁছল।

“মগ্নতা মানে কিন্তু অতীতবিলাস নয়...” নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেন।

“অতীতের আলোয় বর্তমানের স্পন্দনকে চিনে নেওয়া,” বলে রমাপদ চৌধুরী সিগারেট ধরালেন।

“চিনতে তো চাই। সুভাষদা, বীরেনদা কিংবা শঙ্খবাবুর মতো কারা আছেন এখন?” সুকান্ত ভট্টাচার্য জানান দিলেন নিজের উপস্থিতি।

“এখন আমরা আছি,” পৌলোমী সেনগুপ্ত বললেন। শুনে সুনীল বললেন, “এই ঔদ্ধত্য কবির আইডেন্টিটি। আমরা যখন ‘কৃত্তিবাস’ শুরু করেছিলাম, পুরনো সব ধ্যানধারণা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।”

“কিন্তু কবিকে যখন এর সঙ্গে মতাদর্শের প্রতিও আনুগত্য দেখাতে হয়?” প্রশ্ন পৌলোমীর।

“দুটো এক সঙ্গেই আছে, এমনও দেখেছি। এক পিঠে ঔদ্ধত্য, অন্য পিঠে আনুগত্য,” ভাস্কর চক্রবর্তী স্বর্গের বদলে মাথা ধরার ওষুধের মোড়ক খুললেন।

“থাকলেই বা ক্ষতি কী? জীবন মানে কি শুধু প্রলেতারিয়েতের জীবন?” জয়দেব বললেন।

“এ যে দেখছি আমার কথা আমাকেই ফেরাচ্ছে,” মণিভূষণ ভট্টাচার্যর গলায় বিস্ময়।

“নিজের কথা, নিজেদের ঢঙে বলতে চাইছি, আমরা সবাই...” পিনাকী ঠাকুরের মৃদু গলা স্পষ্ট শোনা গেল।

“কথাগুলো একই থাকে, বলার লোক পাল্টে যায়। কিন্তু আসল কথা হল, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের পক্ষে আনুগত্যের স্লোগান মানেই দমবন্ধ করা বুলি,” বুদ্ধদেব বসু এ বার মুখ খুললেন।

“আবার এটাও সত্যি যে, আনুগত্যের একটা কাঠামো না থাকলে কোনও রাজনৈতিক দলই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তাই সৃষ্টিশীলদের জায়গা সব সময় দলের বাইরে। জীবন দিয়ে আমি এইটুকু বুঝি,” সুভাষ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।

‘খরচ করার মতো নিঃশ্বাস আমার এত কম যে, আমি কখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলি না। শুধু খারাপ লাগে, যখন দেখি আপনাদের আলোচনাও সেই পুরুষদের কেন্দ্র করেই পাক খায়। অনন্তকাল ধরে মেয়েরা কি বিপ্লবের মতো সাহিত্যেরও সেবাদাসী থেকে যাবে নাকি?” মল্লিকা সেনগুপ্ত প্রশ্ন করলেন।

“একদমই নয়। কবিতা বা বৃহৎ অর্থে সাহিত্যই যে ‘সুখদুখমন্থনধন’, শ্যামা না থাকলে বজ্রসেন তা বুঝত কেমন করে?” আবু সয়ীদ আইয়ুব বললেন।

“আমরা কি উত্তীয় না বজ্রসেন?”

কে জানতে চাইলেন, ঠিক বোঝা গেল না কারণ অজস্র মানুষ তত ক্ষণে ঘিরে ফেলেছেন, আড্ডা যাঁরা দিচ্ছিলেন তাঁদের। তাঁরা সই চাইলেন, কথা কইতেও চাইছিলেন, কিন্তু যে মুহূর্তে সেলফি চাইলেন কেউ কেউ, কর্পূরের মতো উবে গেল লেখকদের অবয়ব। রাত্রির আকাশে ভোরের গন্ধের মতো, লেখাগুলো আবিরের মতো উড়তে লাগল ভিড়ে, বাজতে থাকল স্পন্দনের গভীরে।

পাঠকের বইমেলা

লেখকের ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার দায় থাকতেই পারে, কিন্তু পাঠক এ সবের ঊর্ধ্বে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লেখকের কলম যদি কখনও কেঁপেও যায়, পাঠক নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবেনই অকপটে। ঈশ্বর যখন বলেছিলেন যে, তিনি এক থেকে বহু হবেন, তখন তিনি লেখক থেকে পাঠক হওয়ার কথাই ভেবেছিলেন সম্ভবত। লেখক তো সেই নদী, যার দুই তীরে গড়ে ওঠে শহর, ঘাট, মন্দির, জনপদ। কিন্তু অন্য নদীও তো থাকে। যে নদী প্রলয়ঙ্করী, যার দেওয়া আশ্রয়, প্রেম আর নির্মমতায় গড়া।

সে শুধুই ভাসিয়ে দেয়, তলিয়ে দেয়, আবার পলিও দেয় নতুন সৃষ্টির জন্য। তার উচ্ছ্বাস তাকে দিয়ে ‘আমি’ করেই কথা বলায়, কারণ আমি মানেইতো ‘আমরা’।

এই ‘আমরা’র মধ্যে শান্তিপুরের অমৃত বসাক-এর নাম প্রথম দিকেই আসবে। নিজের হাতে শাড়ি বানাতেন অমৃত। ওঁদের পারিবারিক পরম্পরাই ছিল শাড়ি সৃষ্টি। যখন মেশিন গিলে নিচ্ছে সব, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে প্রাণ-পাওয়া জন হেনরির মতো অমৃত দিনের পর দিন মাকুতে বুনে চলতেন একের পর এক শাড়ি। ‘মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী’ এমনটাই হয়তো ছিল ওঁর সঙ্কল্প। কিন্তু সংসার তাতে চলত না বলেই অমৃতর স্ত্রী কল্পনা একটি স্টলে বই দেখানোর কাজে ব্যস্ত থাকতেন প্রতিটি বইমেলায়। এক বার বইমেলার মাস দুই আগে তিন দিনের জ্বরে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলেন তিনি। কেউ ভাবেনি যে, সেই বইমেলাতেই অমৃত এসে দাঁড়াবেন বইমেলার মাঠে, নিজেই বসবেন সেই স্টলে, যেখানে প্রতি বছর কল্পনা থাকতেন। অনভিজ্ঞ অমৃত অল্প দিনেই শিখে নিয়েছিলেন, স্টলে ঢোকা পাঠকের মন পড়তে হয়; নিজে থেকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হয় সেই বই, যা এক বার পাতা ওল্টাতে শুরু করলেই মনে ধরে যাবে। কলকাতা বইমেলা শেষ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে জেলা বইমেলাগুলোতেও বিক্রেতা হিসেবে যেতে শুরু করেন অমৃত। তত দিনে হাতে বানানো শাড়ি দিয়ে মেশিনের মোকাবিলা কার্যতই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাতে মুষড়ে পড়েননি উনি। বরং বুঝে গিয়েছিলেন যে, চানাচুর বিক্রি করতে হলে চানাচুর খেতে হয় না, সোনা গলায় না থাকলেও বিক্রি করা যায় অলঙ্কার, কিন্তু বইয়ের সেলসম্যান হতে গেলে বই পড়া আবশ্যক। তাই শাড়ির রং, জমি, ডিজ়াইন নিয়ে ডুবে থাকা মানুষটা ধীরে ধীরে ডুবতে শুরু করলেন কাহিনি, প্লট, সংলাপে।

“কী পান যে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে ছুটে আসেন?” কেউ এক বার জিজ্ঞেস করেছিল অমৃতকে।

অমৃত মুচকি হেসেছিলেন। কোনও জবাব দেননি। কী ভাবেই বা উনি বোঝাতেন যে ওঁদের সংসারে দুটো গন্ধ ছিল! নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ উনি হারিয়েছেন পাওয়ারলুমের কাছে। কিন্তু ওঁর স্ত্রী, মেগাসিটি থেকে যে নতুন বইয়ের গন্ধ বয়ে আনত? না, পৃথিবীতে এমন কোনও পাওয়ারলুম এখনও জন্মায়নি, যা বই নামক ‘হ্যান্ডলুম’কে মেরে ফেলতে পারে।

অমৃত বলেননি যে, ওই নতুন বইয়ের গন্ধের জন্য তিনি স্বল্প টাকায় কাজ করতে ছুটে যেতেন বিভিন্ন বইমেলায়। কিন্তু অনেকে দেখেছেন, স্টল খোলার পর পরই অমৃত বসাক, বাঁধাই হয়ে মেলায় ঢোকা বইগুলোর গন্ধ নিচ্ছেন প্রাণ ভরে।

শিল্পের থেকে শিল্পীকে কত ক্ষণই বা আলাদা রাখা যায়?

বইয়ের থেকে আলাদা রাখা যেত না প্রতাপ রক্ষিতকেও। বইয়ের নেশার জন্য বড় নেতাদের কাছে প্রচুর বকুনি খেতেন পার্টির সব সময়ের কর্মী প্রতাপ। বইয়ের টানেই জীবনের একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছিলেন বলে আমৃত্যু মনে করতেন উনি। ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের সব্যসাচী সেন, ১৯৭৬ সালে ময়দানে গাড়ি থেকে নামিয়ে ছুটতে বলা পুলিশের গুলি এড়িয়ে, ঘুমের রাজ্যে ঢুকে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর ওই ১৯৭৬ সালেই প্রথম বইমেলা দেখতে কলকাতায় এসে কলঙ্ক কিনেছিলেন প্রতাপ।

বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর সাল অবধি অসংখ্য বাম কর্মী-সমর্থক, পাড়াছাড়া শুধু নয়, রাজ্যছাড়া ছিলেন। প্রতাপ রক্ষিত তাঁদেরই এক জন। কিন্তু সত্তর দশকের প্রায় পাঁচ বছর মধ্যপ্রদেশের কয়লাঞ্চলে কাটিয়ে দেওয়া প্রতাপ আচমকা একটি পোস্টকার্ড মারফত জানতে পারেন যে, কলকাতায় বইমেলা হচ্ছে। প্রতাপের মনের মধ্যে তখন তীব্র যুদ্ধ। বিজয়গড়ে বারোভূতের মেলায় প্যান্ডেল অবধি বেঁধেছেন, আর কলকাতায় বই নিয়ে একটা আস্ত মেলা হচ্ছে, এক বার যাবেন না?

প্রবল ইচ্ছে থাকলেও উপায় কী? এ বার বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার একটাই রাস্তা ছিল আর তা হল, সিপিআই সমর্থক বনে যাওয়া। বামেদের মধ্যে একমাত্র সিপিআই যে-হেতু ‘জরুরি অবস্থা’কে সমর্থন করেছিল তাই ‘সিপিআই’ হিসেবে ব্র্যান্ডেড হলে পাড়ায় ঢুকতে অসুবিধে হত না তখন। বেশ কিছু সিপিআই(এম) বা আরএসপি সমর্থক ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সেই সময়। প্রতাপ রক্ষিতও তাঁদের দেখানো পথে হেঁটে কলকাতায় বই দেখা আর ছোঁয়ার সুখ করে গেলেন কয়েক দিন।

কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হল কষ্টের কাল। জবলপুরে ফিরে টের পেলেন যে ওঁর ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র খবর পৌঁছে গেছে ওখানে। আর সাতাত্তর সালে কলকাতা ফেরার পর থেকে তো সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে রইলেন। ‘ওই একটা ভুল না করলে তুমি মন্ত্রী হতে,’ অনেকের কাছে শুনেছেন প্রতাপ। কিন্তু নতুন বইয়ের স্পর্শের কাছে মন্ত্রিত্ব কী?

ক্যান্সার-আক্রান্ত প্রতাপ রক্ষিত যখন নিঃসঙ্গ শুয়ে থাকতেন সরকারি হাসপাতালের একটি বেডে, তখনও ভিজ়িটিং আওয়ারে হাতে বই নিয়ে কেউ এলে হাজার ওয়াট আলো জ্বলে উঠত ওঁর ভাঙাচোরা মুখে। শোনা যায়, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি নার্সকে বলেছিলেন, “এ বারের বইমেলা কবে শুরু হচ্ছে, তারিখটা বলতে পারবেন?”

গভীর-গোপন বইমেলা

বন্দনা কাকিমা আমাদের পাড়ায় থাকত বলেই কাকিমা বলতাম, আত্মীয়তা কিছু ছিল না। স্বামী নেই, ছেলেটা বাউন্ডুলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও দিন খালি হাতে আসত না কাকিমা। সয়াবিন দিয়ে চিঁড়ের পোলাও বন্দনা কাকিমার হাতেই প্রথম খেয়েছিলাম আমি। সেই চিঁড়ের পোলাওকেই বইমেলার মাঠে দশ টাকায় বিক্রি হতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। খেয়েওছিলাম, কিনে। বন্দনা কাকিমা জানিয়েছিল যে, অনেক মেয়ে মিলে তৈরি করছে, বিক্রিও করছে সবাই মিলে। বইমেলায় যে দিনই যেতাম, এক বার বন্দনা কাকিমাদের স্টলে ঢুঁ মারার চেষ্টা করতাম। আর কাকিমা আমায় দেখলেই দশ টাকার বিনিময়ে কুড়ি টাকার খাবার গছিয়ে দিত। কলেজবেলায় এত খিদে পেত যে, অতিরিক্ত পেলে কোনও জটিল প্রশ্ন মাথায় আসত না।

কিন্তু ঠিক ছাব্বিশ বছর আগে এক দিন বইমেলায় আগুন লাগল, পুড়ে ছাই হয়ে গেল হাজার-হাজার বই আর শুনলাম যে ওই খাবারের স্টল থেকেই নাকি গ্যাস লিক হয়ে আগুন লেগেছে। কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকেও, তার পর থেকে বইমেলায় গিয়ে আর কখনও খাবারের স্টলে যাইনি পারতপক্ষে। কিন্তু বছরখানেক পর বন্দনা কাকিমার শরীর খারাপ শুনে খোঁজ নিতে গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম, ঘরে দশ-পনেরোটা আধপোড়া বই দেখে।

প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, সে দিন আগুন লাগার পর পরই যখন হুলস্থুল চতুর্দিকে, তখন বাইরে বেরিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাওয়া কাকিমার হাতে কেউ এক জন অনেকগুলো অল্প-পোড়া, বেশি-পোড়া বই ঝোলায় করে ধরিয়ে দিয়ে যান। যাওয়ার মুহূর্তে ভদ্রলোক বলেছিলেন, “আপনি এগুলো ভাল করে রাখুন। আমি গিয়ে দেখি আরও কয়েকটা বই বাঁচাতে পারি কি না।”

তিনি আর ফেরেননি। বন্দনা কাকিমা জানতেও পারেনি, সেই ভদ্রলোক লেখক, প্রকাশক না কি পাঠক! যেমন খবর পায়নি তিনি আরও বই বাঁচাতে পেরেছিলেন কি না! তবে ওই আগুনের দাগ লাগা বইগুলো খুব যত্নে রেখেছিল। মাঝে মাঝে হাত বোলাত মলাটগুলোর উপর, পৃষ্ঠাগুলোর গায়েও। জ্যোৎস্না যে রকম এক-এক রাতে পোড়াবাড়ির চালে নিজের স্পর্শ রেখে যায়।

বছর দশেক পরে বন্দনা কাকিমা আমায় বলেছিল, “খবরের কাগজে তোর ছবি দেখলাম, তুই না কি লেখক হয়েছিস? তা হলে আমার যে কোনও বইয়ের একটায় সই করে দিস।” কাকিমার বই মানে তো ওই পোড়া বইগুলোর একটা। এখনও জীবিত আছে তারা? ভেবে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল, ‘ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান’ নতুন করে লিখতে হবে আবার। রে ব্র্যাডবেরি কিংবা অন্য কাউকে।

লিখতে এসে অল্পবিস্তর অটোগ্রাফ কে দেয় না? আমিও দিয়েছি। তার ভিতরে সেই বার-কাম-রেস্তরাঁর ওয়েটারকে মনে আছে, যে আমার একটা উপন্যাস চোখের সামনে ধরে বলেছিল, “এক জন রেগুলার গেস্ট পুজোয় একটা গিফট দেবে বলেছিল। তাকে বললাম আপনার এই বইটা দিতে।” মনে আছে সেই সন্তানহারা বাবাকেও, যিনি আমার একটি কাব্যগ্রন্থে সই নিতে নিতে বলেছিলেন, “আমার ছেলের খুব পছন্দ ছিল তোমার এই বইটা। তাই আমিই এটা দু’-তিন কপি করে কিনি, উপহার দিই একে-ওকে।”

কিন্তু বন্দনা কাকিমার কথায় আমি এমন এক বইতে সই করেছিলাম, যা আমার লেখা না হয়েও আমারই লেখা। আমাদের সবার।

পোড়া বইয়ের চেয়ে বড় ফিনিক্স আর কে আছে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement