ছবি: সৌমেন দাস
আমি বলাকা। একটা অটোর জন্য অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অটোর দেখা নেই। পা ব্যথা হয়ে গেল, আর কত ক্ষণ দাঁড়াব রে বাবা! অবশ্য যে কাজে যাচ্ছি, তাতে একটু-আধটু দেরিতে কিছু এসে যায় না, হলেই হল। গুটিগুটি গিয়ে বাসস্ট্যান্ডের একটা বেঞ্চিতে বসলাম। আপনারা বলবেন তাড়া নেই যখন, একটু অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী! আসলে মুশকিল হচ্ছে, আমার খুব খিদে পেয়েছে। এই শীতের ভোরেও কয়েকটা দোকান খুলেছে, কিছু কিনে খেতে পারি, কিন্তু আমার কাছে গোটা দশেক টাকা আছে। সেটা দিয়ে বিস্কুট কিনলে ভাড়া দিতে পারব না। অটো করে যাব স্টেশনে, সেখান থেকে… যাকগে। কোথায় যাচ্ছি বলার আগে কেন যাচ্ছি বলি বরং। এই কুয়াশামাখা সকালে, সময় কাটাতে আমার গল্পটাই বলি।
জন্মেছিলাম এ রকমই এক শীতের ভোরে, তার এক বছর বাদে আর এক শীতের সকালে মা মারা যায়। যে বাড়িতে থাকতাম সেটা আধা-বস্তি ধরনের। বাবা সেলসম্যানের কাজ করত, মানে যেমন দিনদুপুরে, বাড়িতে মলিন জামাকাপড় অথচ টাই পরা লোকেরা আসে, আরে ওই যাদের দেখে আপনারা ‘‘কী চাই? না, না কিচ্ছু লাগবে না... বিরক্ত করবেন না তো’’ বলে হাঁকিয়ে দেন, তেমন। কখনও কাপড়কাচা সাবান, কখনও গ্যাস লাইটার, কখনও আবার শ্যাম্পু, তেল। বাবার কোম্পানি পাল্টে পাল্টে যেত, কিন্তু আমাদের অবস্থা পাল্টাত না। সামান্য কমিশনে কাজ, নুন আনতে পান্তা ফুরনো অবস্থা। পাশের ঘরের ভাড়াটে ঝুনিঠাকুমা আমাকে দেখত। ঠাকুমার কাজ ছিল সস্তা দরে নারকেল নাড়ু তৈরি করে প্যাকেটে ভরে দোকানে দোকানে দেওয়া। খুব স্বাদ ছিল সেই নাড়ুর, তাই সবাই ঠাকুমার কাছ থেকেই নিত।
আমার সাত বছর বয়সে ঠাকুরদা মারা গেল, ঝুনিঠাকুমাও ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দেশে ফিরে গেল। বাবা পড়ল বিপদে, ওইটুকু মেয়েকে একা রেখে কী করে কাজে যায়। আমার এক দূর সম্পর্কের পিসি জোর করে বাবার একটা বিয়ে দিয়ে দিল। নতুন মায়ের নাম শিখা। প্রথমে একটু ভয় পেলেও, পরে দেখলাম মানুষটা মন্দ নয়। গরিবের মেয়ে, বেশি বয়সে দোজবরে বিয়ে, তবুও হাসিমুখেই থাকত। জানলায় শাড়ি কেটে পর্দা, টবে তুলসী গাছ, বিছানায় কাচা চাদর। আমি আর বাবা বড্ড খুশি ছিলাম। বাবার সামান্য রোজগার বেড়েছিল। নতুন মা-ও বাড়িতে বসে ইমিটেশন গয়না বানিয়ে বিক্রি করত, কিন্তু বলাকার কপালে সুখপাখি বসে না।
এক দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছে। বাসে উঠতে গিয়ে ভারী ব্যাগ নিয়ে বাবা সোজা বাসের চাকার তলায় চলে গিয়েছে। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যেতে শিখা ক’দিন গম্ভীর হয়ে রইল। দশ বছরের আমিও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছিলাম। বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমায় দেখার আর দায় নেই শিখার, সামান্য গয়না তৈরি করে দুজনের সংসারও চলবে না। আমি স্কুলে খাবার পাই, শিখা মুড়ি খায়। রাতে আলুসেদ্ধ ভাত দুজনে অল্প অল্প। তার পর আমার সকালের স্কুলের পরে একটা কাজের ব্যবস্থা হল। একটা কেটারিং কোম্পানি ছিল পাড়ায়, তাদের ওখানে তরকারি কাটা, পান সাজা— এই সব করতাম দুজনে। সকাল এগারোটা থেকে বেলা দুটো। বিনিময়ে তারা দুপুরের খাবার আর কিছু টাকা দিত। ছোট হলেও আমি কাজ শিখে নিয়েছিলাম। শিখাও গয়নার ব্যবসা বাড়িয়েছিল। সারা দিন পরিশ্রম করত। আমাদের এক রকম চলে যাচ্ছিল।
মাধ্যমিক পাশ করলাম খুব ভাল নম্বর পেয়ে। অনেক খবরের কাগজ থেকে এসে, আমার আর শিখার ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিল, বেরিয়েছিল কি না, তা অবশ্য জানি না। টুয়েলভে পড়ার সময়ে শিখার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখলাম। একটা লোক ঘন ঘন আসছিল বাড়িতে। টাকমাথা, চালাক চালাক চেহারা। বিকেলের দিকে আসত। হাতে তেলেভাজার ঠোঙা নিয়ে। দেখতাম শিখা চুল বেঁধে, টিপ পরে মুখে পাউডার দিচ্ছে। খুশি-খুশি হাবভাব। লোকটা এলে আমি ঘরে থাকতাম না, কেমন অস্বস্তি হত। প্রত্যাশিত ভাবেই এক দিন শিখা বলল, ‘‘বলু, আমি অলকেশকে বিয়ে করতে চাই, তোর আপত্তি নেই তো?’’ ভেবে দেখতে গেলে শিখার বিয়েতে আমার আপত্তি করার কোনও জায়গাই নেই। কেনই বা আপত্তি করব? শিখা আর টাকুর নতুন জীবনে আমার ভূমিকা কোথায়! তবু বলেছিলাম, “হ্যাঁ মা, তুমি বিয়ে করো। আমার আপত্তি নেই।”
অলকেশের বাড়ি কোথায় জানি না, ও এসে আমাদের বাড়িতেই উঠল। এক ফালি ছোট ঘরে নতুন বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী আর একটা আঠেরো বছরের মেয়ে— কল্পনা করতে পারেন সেই অবস্থা? ঘরের বাইরে একটা ছোট খোলা বারান্দা ছিল, আমি সেখানে শুতে আরম্ভ করলাম। অর্ধেক রাতে ঘুমোতেই পারতাম না। ক’দিন পর ওরা নতুন বাড়ি ভাড়া নিল, দেড়খানা ঘর আলাদা বাথরুম। অনেকটা ভাল ব্যবস্থা। শিখা বলল, “বলু, তুই আর কেটারিং-এর কাজ করিস না। বাড়িতে বসে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য লেখাপড়া কর। আমি চালিয়ে নেব।” শিখার মনটা সত্যিই ভাল, কিন্তু অন্য দিকে বিপদ বাড়ছিল। শিখার অনুপস্থিতিতে টাকু আমায় জ্বালাতন করতে শুরু করল। টুকটাক উপহার দিত, কাছে ঘেঁষে আসত। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি, তার পর মেয়েমানুষের সহজাত বুদ্ধিতে সবটাই বুঝলাম।
মুশকিল হল, শিখাকে এক বার আভাসে বলতে গিয়ে সুবিধে হল না। শিখার টাকুর ব্যাপারে বড্ড দুর্বলতা ছিল, উল্টে আমাকেই সন্দেহ করতে আরম্ভ করল! বলুন তো, আমি কী করতাম! বেড়াল-মা যেমন তার বাচ্চাকে সাবধানে রাখে, আমিও তেমনই সাবধানে থাকতে লাগলাম। একটা কৌটোয় লঙ্কাগুঁড়ো ভরে কাছে রাখতাম। রাতে বার বার উঠতাম। যদিও শিখা আছে, তবু ওই বদমাশকে বিশ্বাস নেই। তার পর গত রাতে চরম বিপদ ঘটল। কী বলছেন? আপনারা বুঝতে পেরেছেন কী বিপদ? না মশাই, আপনারা বোঝেননি!
*****
আজ চার দিকে কুয়াশা, দু’হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটছে। ওই যে অটো আসছে। আপনাদের বলা হয়নি কোথায় যাব। যেতে চাই স্টেশনে, সেখানে রেললাইনে আত্মহত্যা করব, এটাই আমার প্ল্যান। তাই দেরি হলেও কিছু এসে যায় না, কাজটা হলেই হল। হয়তো আগামী কালের কাগজে বেরবে, কৃতী ছাত্রীর আত্মহনন, আপনারা পড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবেন। যাকগে, অটোয় উঠে বসলাম। আর কেউ নেই, আমি একা। হয়তো শীতের সকালে প্যাসেঞ্জার পায়নি। এখান থেকে মিনিট দশেক গেলেই স্টেশন, কিন্তু অটো কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারছি না। ঠান্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠছি আমি, দু’পাশে বড় বড় গাছ, এটা কোন রাস্তা! বললাম, “দাদা, স্টেশন যাব,” কোনও উত্তর নেই, কালা না কি? বেশ কিছুটা চলার পরে অটো থামিয়ে বলল, “একটু হাঁটুন, স্টেশন পাবেন।”
হাঁটছি। জায়গাটা গাছগাছালিতে ভরা, পাশে পুকুরে এক জন মহিলা জল তুলছেন। বললাম, “স্টেশন কোন দিকে বলুন তো?” উনি বেশ অবাক হয়ে বললেন, “কাদের ঘরের মেয়ে বাছা? এ দিকে আবার স্টেশন কোথায়!” তার পর কী ভেবে বললেন, “এস, ঘরে এস।”
পুকুরের পাশেই টালির চালের বাড়ি, চার দিকে দারিদ্রের ছাপ, বিছানায় একটি ছেলে ঘুমোচ্ছে।
“আমার স্টেশন যাওয়ার খুব দরকার, কাজ আছে। অটোওয়ালা এখানে নামিয়ে দিল।”
“তুমি একটু চা খাবে?”
দুটো বিস্কুট আর চা খেয়ে বাঁচলাম। বড্ড খিদে পেয়েছিল, কাল রাত থেকে খাওয়া নেই। তার পর আবার জিজ্ঞেস করলাম, “এখান থেকে স্টেশন যাব কী করে?”
উনি হাসলেন। বললেন, “বাড়ি ফিরে যাও মেয়ে। এই দেখো আমার ছেলে, পঙ্গু, দাঁড়াতে পারে না। আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। খুব খারাপ লোক ছিল। আমিও আত্মহত্যা করব ভেবেছিলাম, কিন্তু তার দরকার হয়নি।”
আমি ইতস্তত করে বললাম, “সে কী! আত্মহত্যা করবেন কেন? সে যে মহাপাপ!”
উনি আবার হাসলেন, “মানো সেটা? বাহ্!”
আমার ঘুম পাচ্ছিল, শীত করছিল, মনে হচ্ছিল বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি, কিন্তু তবুও উঠে পড়লাম। টেবিলে একটা ছবি ছিল বাঁধানো, চেনা-চেনা লাগল। হাতে তুলে দেখি, ওই মহিলা, পাশে টাকু অলকেশ।
“এই আমার স্বামী, বিকাশ।”
“বিকাশ!” আমি অবাক হয়ে বললাম, “বিকাশ? অলকেশ না?”
“না, বিকাশ। বিকাশ ভক্ত। ও এখানে দুটো খুন করে পালিয়ে গিয়েছে, পুলিশ ওকে খুঁজে পায়নি। মনে হয়, অন্য নামে কোথাও লুকিয়ে আছে, এক বছর হয়ে গেল।”
হিসেব করে দেখলাম, ও রকম সময়েই শিখাকে বিয়ে করেছিল লোকটা। গতকাল রাতে শিখা আমার কাছে এসেছিল, আমার হাত ধরে বলল, “বলু, তুই ঠিক বলেছিলি, অলকেশ খুব খারাপ লোক, আজ রাতেই তোকে বেচে দেবে। আমি জানতে পেরেছি। তুই পালিয়ে যা।”
আমার মাথা কাজ করছিল না, শিখাকে বললাম, “আর তুমি? এখানেই থেকে যাবে?”
শিখা বলল, “আমি যেতে পারব না রে বলু, আমি মা হতে চলেছি। এখন কী করে যাই! শোন, তুই আমার এই চুড়িটা রাখ, এটা বিক্রি করে যা পাবি নিয়ে পিসির বাড়ি চলে যাস, তার পর যা হোক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
টাকু বাড়ি ছিল না, আমি তখনই দুটো জামা আর দশটা টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শিখার দেওয়া চুড়িটা নিয়ে আসিনি, ওটা ওর অনাগত সন্তানের জন্য রাখা থাক। সারা রাত শনিমন্দিরের এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসেছিলাম, কেউ আমায় দেখতে পায়নি। ভোরের আলো ফুটতেই বড় রাস্তা। সারা রাত ভেবেও বাঁচার কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। পিসি আমায় রাখবে না জানি, তাই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু নিয়তি আমায় অলকেশের বাড়িতেই নিয়ে এল, সে যে খুনের ফেরারি আসামি, সেটাও জানা গেল।
হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই গাছগাছালি ভরা রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, কিন্তু ফেরার কোনও গাড়িই তো নেই, হঠাৎ পিঠে কে হাত দিল। চমকে উঠে দেখি, আমি আমাদের বাসস্ট্যান্ডে বেঞ্চিতে বসে, আর এক জন বুড়ি তরকারিউলি আমায় ডাকছে, “ও দিদিমণি, একটু চেপে বোসো তো, আমরাও বসি। কখন থেকে ডাকছি, কী ঘুম রে বাবা!”
কিছু ক্ষণ সব গুলিয়ে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, অটো করে কোথাও যাইনি? তা হলে বিকাশ, দুটো খুন, সব স্বপ্ন! পয়সার ব্যাগে দেখলাম দশ টাকা আছে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, অটোয় না উঠে আমি হাঁটতে লাগলাম, একটু এগিয়েই থানা। সামনে এক জন সেপাই হাই তুলছে। আমায় দেখে কড়া চোখে তাকাল, “কী চাই?”
“আমি একটু বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
বড়বাবু চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন, সামনে বসে বললাম, “আচ্ছা, আপনারা কি বিকাশ
ভক্ত বলে কাউকে জোড়া খুনের মামলায় খুঁজছেন?”
উনি চমকে তাকালেন, “আপনার কাছে কোনও খবর আছে? লোকটা এই অঞ্চলেই গা ঢাকা দিয়ে আছে, কিন্তু ধরা পড়েনি। নিজের বৌ সোনালি আর পালিত ছেলে সবুজকে খুন করে গা ঢাকা দেয়!”
“দেখুন, এই বিকাশ ভক্ত এখন অলকেশ নামে আমার সৎমাকে বিয়ে করেছে। যদি ধরতে চান, তাড়াতাড়ি চলুন।” উনি জরিপ করার চোখে আমায় দেখছেন। তার পর একটা ফাইল খুলে দেখালেন। ভিতরে সেই মহিলা আর পঙ্গু বাচ্চাটার ছবি। ছবি দুটো দেখিয়ে বললেন, “এই যে এরা হলেন সোনালি আর সবুজ ভক্ত, বিকাশ ভক্তর বৌ আর ছেলে। এদেরকে খুন করে বিকাশ নিরুদ্দেশ হয়। এঁদেরকেও চেনেন না কি?”
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম, তার পর ইতস্তত করে বললাম, “না, এঁদের চিনি না।”
*****
সেই ভোরটা একটা ধাঁধা হয়েই রয়ে গিয়েছে আমার কাছে। কুয়াশাঘেরা রাস্তায় সোনালির গলা আজও কানে বাজে। আমার আর আত্মহত্যা করা হয়নি। সেই দিনই গ্রেফতার হয় টাকু। আমরা উকিলের ব্যবস্থা করিনি। সরকার থেকেই উকিল দিক। আমি আর শিখা আবার একটা এক ঘরের বাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছি। পরীক্ষার পর আমি অনেক টিউশন শুরু করেছি, একটা কোচিং সেন্টারেও পড়াই। মাসখানেকের মধ্যেই শিখার বাচ্চা হবে, তাকে নিয়েই আবার একটা নতুন গল্প তৈরি হবে আমার জীবনে... শোনাব আপনাদের।