উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্বপ্নের ঠিকানা আমেরিকা। প্রতি বছর ভারত থেকে বহু পড়ুয়া আমেরিকায় পাড়ি দেন। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ খোঁজেন।
ভারত থেকে যাঁরা আমেরিকায় পড়তে যান, অধিকাংশই বৃত্তি পেয়ে থাকেন। সেই টাকায় লেখাপড়া চালান, অনেকে গবেষণাও করেন।
আমেরিকায় গিয়ে খরচ জোগানোর জন্য ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের অনেককেই আংশিক সময়ের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে দেখা যায়। রোজগারের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হয় তাঁদের।
আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করার পরে ভারতীয় পড়ুয়ারা অনেকেই আর দেশে ফেরেন না। বিদেশের মাটিতেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থিতু হতে চান তাঁরা। পাতেন স্বপ্নের সংসারও।
আমেরিকা প্রথম বিশ্বের দেশ। আমেরিকা উন্নত দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির নাম আমেরিকা। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তাই ভারত থেকে সেখানে গিয়ে বাকি জীবন বিদেশের মাটিতেই কাটিয়ে দিতে চান অনেকে।
দীর্ঘ দিন আমেরিকায় থাকার পর ভারতীয়দের অনেকেই সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়ে যান। তার পর প্রথম বিশ্বের দেশটিতে বিলাসবহুল জীবন কাটান।
ভারতের ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকায় যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকলেও আমেরিকা কি তাঁদের আপন করে নেয়? সেখানে ভারতীয়দের কী চোখে দেখা হয়? কতটাই বা স্বাচ্ছন্দ্য পান ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা?
আমেরিকায় যাওয়া ভারতীয় পড়ুয়ার সংখ্যা ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে গত নভেম্বরে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত থেকে আরও ২০ লক্ষ পড়ুয়া বিদেশে পাড়ি দেবেন উচ্চশিক্ষার জন্য। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আমেরিকায় যাবেন।
এই পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকায় গিয়ে কাঙ্ক্ষিত আতিথেয়তা পাচ্ছেন না সব ভারতীয় পড়ুয়া। গত কয়েক সপ্তাহের পরিসংখ্যান রীতিমতো আতঙ্কের।
একের পর এক ভারতীয় ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসছে আমেরিকা থেকে। গত কয়েক দিনে এমন পাঁচ জনের মৃত্যুর কথা জানা গিয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই লুকিয়ে আছে রহস্য।
জর্জিয়ায় একটি কনভেনিয়েন্স স্টোরে আংশিক সময়ের জন্য কাজ করতেন বিবেক সাইনি। বিটেক পাশ করে দু’বছর আগে আমেরিকায় গিয়েছিলেন তিনি। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন।
গত ১৬ জানুয়ারি এক গৃহহীন ব্যক্তি বিবেককে খুন করেন বলে অভিযোগ। তাঁর নাম জুলিয়ান ফকনার। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, গভীর রাতে দোকান থেকে ওই ব্যক্তিকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন সাইনি। সেই কারণেই হাতুড়ি দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়।
স্থানীয়েরা জানান, ওই গৃহহীনকে প্রায়ই খাবার, জল দিতেন ভারতীয় ছাত্র। রাতে আশ্রয়ও দিতেন। এক দিন দোকান থেকে রাতে বেরিয়ে যেতে বলা হলে তিনি রাজি হননি। এর পর পুলিশ ডাকার কথা বলেছিলেন বিবেক। তাঁর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে ৫০ বার আঘাত করা হয় বলে অভিযোগ।
ইন্ডিয়ানা প্রদেশের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করছিলেন ভারতীয় ছাত্র নীল আচার্য। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ‘নিখোঁজ’ থাকার পর তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়।
নিখোঁজ থাকাকালীন নীলের মা গৌরী আচার্য সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কর্তৃপক্ষ তাঁকে আশ্বস্তও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশার কথা শোনাতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের পক্ষ থেকে নীলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। বিভাগের অন্তর্বর্তী প্রধান ক্রস ক্লিফটন জানান, ‘‘নীল এক জন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সকলের সঙ্গেই ভাল ব্যবহার করতেন, মিষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের কাছে বড় ধাক্কা।’’
আমেরিকার ওহায়ো প্রদেশের সিনসিনাটিতে আরও এক ভারতীয় পড়ুয়ার দেহ উদ্ধার হয় ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। তাঁর নাম শ্রেয়স রেড্ডি বেনিগেরি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে আমেরিকায় তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
শ্রেয়স হায়দরাবাদ থেকে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। ওহায়োর লিন্ডনার স্কুল অব বিজ়নেস থেকে বিজ়নেস স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
এক সপ্তাহের মধ্যে আমেরিকায় মৃত ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে শ্রেয়স ছিলেন তৃতীয়। নিউ ইয়র্কের ভারতীয় কনসুলেট জেনারেলের তরফে শ্রেয়সের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। এই মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করে কনসুলেট।
গত বছরের নভেম্বরে আরও এক ভারতীয় পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর নাম ছিল আদিত্য আদলাখা। সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন তিনি। গাড়ির ভিতরে তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ মিলেছিল।
ইন্ডিয়ানা প্রদেশের পাহ্জু ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন সমীর কামাথ। একটি পার্ক থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়।
২৩ বছর বয়সি সমীর ২০২৩ সালের অগস্টে পাহ্জু ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতকোত্তর হন। এর পর তিনি গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন।
আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন সমীর। ২০২৫ সালে তাঁর গবেষণার কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাঁর মৃত্যুর তদন্ত শুরু করে পুলিশ, দেহ ময়নাতদন্তের জন্যও পাঠানো হয়।
গত ২০ জানুয়ারি অকুল ধাওয়ান নামে এক ভারতীয় পড়ুয়ার দেহ উদ্ধার হয় আমেরিকায়। ‘ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেন’-এর পড়ুয়া ছিলেন অকুল।
২০ তারিখ সকাল ১১টা নাগাদ ইউনিভার্সিটির পিছনের একটি বারান্দা থেকে অকুলের দেহ খুঁজে পান তাঁর বন্ধুরা। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রহস্য এবং বিতর্ক দানা বাঁধে।
‘হাইপোথার্মিয়া (প্রচণ্ড ঠান্ডা)’-র কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে তদন্তে দাবি করা হয়েছিল। তবে অকুলের পরিবারের দাবি ছিল, রহস্যজনক ভাবেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের দেশে তথাকথিত উন্নত সমাজে ‘প্রদীপের তলার অন্ধকারের’ মতো থেকে গিয়েছে বর্ণবিদ্বেষ। কৃষ্ণবর্ণের মানুষের প্রতি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের বিদ্বেষ বার বার শিরোনামে উঠে এসেছে।
ভারতীয়েরাও আমেরিকায় সেই বিদ্বেষের শিকার বলেই মত পর্যবেক্ষকদের। ভারত থেকে আমেরিকায় যাওয়া পড়ুয়াদের নিচু চোখে দেখেন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের একাংশ। দাবি, সেই বিদ্বেষের ফলশ্রুতি পর পর এই মৃত্যুমিছিল।