ইজ়রায়েল বনাম হামাস চলতি সংঘাতে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হল গাজ়া ভূখণ্ড। মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হানায় কার্যত ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এই ছোট জনপদ।
প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলার পর ইজ়রায়েলের তরফে যে প্রত্যাঘাত করা হয়, তার সরাসরি অভিঘাত এসে পড়ে গাজ়ার উপরে। সেখানকার স্বাস্থ্য দফতরের তরফে জানানো হয়, ৮৩০ জন বাসিন্দা ইজ়রায়েলি হামলায় মারা গিয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়তে চলেছে বলে জানা যাচ্ছে। হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং শিশু।
৩৮৪ বর্গকিমি এলাকাবিশিষ্ট গাজ়া ভূখণ্ড ইজ়রায়েলের ভূরাজনীতিতে সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকেছে। কিন্তু তার পরেও গাজ়ায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়নি ইজ়রায়েল।
ঐতিহাসিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ গাজ়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের প্যালেস্তাইন ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। তুরস্কের পরাজয় গাজ়ার বাসিন্দাদেরও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে যেতে বাধ্য করে।
ইজ়রায়েল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই গাজ়ার উপর প্রভুত্ব বিস্তারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব বাঁধে ইজ়রায়েল এবং আরব দেশগুলির মধ্যে। মূলত গাজ়ার ভৌগোলিক অবস্থানই এই ভূখণ্ডকে যুযুধান রণক্ষেত্র করে তোলে।
১৯৪৮ সালের আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধে গাজ়া দখল করে মিশর। ইজ়রায়েল রাষ্ট্র হিসাবে গঠিত হওয়ার পর হঠাৎই ছিন্নমূল হয়ে প্যালেস্তিনীয়রা আশ্রয় নিতে বাধ্য হন এই গাজ়াতেই।
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত গাজ়া আরব জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু ওই বছরই ‘ছয় দিনের যুদ্ধে’ মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডনের মিলিত বাহিনীকে হারিয়ে গাজ়ায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ইজ়রায়েল।
বিংশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত গাজ়ায় মোটের উপর স্থিতাবস্থা বজায় থাকলেও ২০০০ সাল নাগাদ নতুন করে অশান্ত হয়ে ওঠে এই ভূখণ্ড।
ঘরে-বাইরে চাপের মুখে ২০০৫ সালে গাজ়ার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয় ইজ়রায়েল। সেখান থেকে সমস্ত বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় ইহুদি-প্রধান রাষ্ট্রটি।
ইতিমধ্যেই সেখানে যে ৯০০০ ইহুদি বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের সরিয়ে আনে ইজ়রায়েলি প্রশাসন। আরও এক বারের জন্য গাজ়ার অধিকার হারায় তেল আভিভ।
২০০৭ সাল থেকে গাজ়ার উপরে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করে হামাস। তার আগের বছরই গাজ়া-সহ প্যালেস্তিনীয় অধ্যুষিত এলাকাগুলির নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায় হামাস।
নির্বাচনী ফল এবং প্রভাব ও প্রসারের নিরিখে কার্যত প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয় একদা প্যালেস্তাইন জাতিসত্তার একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃত ‘প্যালেস্তাইন অথরিটি’ বা পিএ।
‘প্যালেস্তাইন অথরিটি’ ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েই তাদের সঙ্গে দর কষাকষির পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু হামাস ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তো স্বীকার করেন না, উল্টে ওই রাষ্ট্রের উচ্ছেদসাধনকে একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করে।
চলতি সংঘাতে ইজ়রায়েলের অভিযোগ, হামাসের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালিত হচ্ছে এই গাজ়া থেকেই। তাই গাজ়াকেই নিশানা করেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দেশ।
গাজ়ার সঙ্গে রয়েছে ইজ়রায়েল এবং মিশরের সীমান্ত। অন্য দিকে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গেও সীমান্ত ভাগ করছে এই ভূখণ্ডটি।
গাজ়াকে হাতে এবং ভাতে মারতে জল এবং বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বন্ধ করেছে ইজ়রায়েল। কারণ জল, বিদ্যুৎ সংযোগ এবং টেলি সংযোগের জন্য মূলত ইজ়রায়েলের উপর নির্ভরশীল গাজ়া।
গাজ়ার মূল কৃষিজ ফসল লেবু এই ইজ়রায়েলের মাধ্যমেই পৌঁছে যায় বাকি ইউরোপে। আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ইজ়রায়েলের মাধ্যমেই ঢোকে এই ভূখণ্ডে।
ছোট জনপদ হলেও প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এখানে থাকতে বাধ্য হন। অথচ, জল, স্থল এবং আকাশ— তিন পথেই গাজ়াকে অবরূদ্ধ করে রেখেছে ইজ়রায়েল। অনেকেই তাই এই জনপদকে ‘খোলা জেলখানা’ বলে থাকেন।
গাজার মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশের বয়স ১৪-র নীচে। নিত্যসঙ্গী দারিদ্র, বেকারত্ব। এমনিতেই এক বেলা করে বিদ্যুতের জোগান পায় গাজ়া।
কিন্তু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বেপরোয়া এবং অবাধ্য গাজ়া। পালিয়ে পালিয়েই অর্ধজীবন কাটলেও বিদ্রোহে শান দিতে ভোলেন না গাজ়ার বাসিন্দারা। তাই দূরের রামাল্লায় নাম কা ওয়াস্তে ‘প্যালেস্তানিয়ান অথরিটি’ থাকলেও, গাজ়ায় জনসমর্থনের ঢল হামাসের দিকেই— যে হামাসের বিরুদ্ধে শতসহস্র অভিযোগ ইজ়রায়েল তো বটেই, পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের বড় অংশেরও।
ইতিমধ্যেই গাজ়ার ভূখণ্ড বদলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে হামাসও।
বেক আরব জাতীয়তাবাদী দেশগুলির একাংশ এই দীর্ঘ সংঘাতে মধ্যপন্থা নিতে শুরু করলেও এই গাজ়াকে কুম্ভ করেই ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে হামাস।
রাষ্ট্রপুঞ্জের আর্জি মেনে ইজ়রায়েল গাজ়াতে ‘মানবকেন্দ্রিক সাহায্য’ করে ভাবমূর্তি রক্ষায় সচেষ্ট হবে নাকি উগ্র দক্ষিণপন্থায় ভর করে পুরোই ধ্বংসস্তূপ করে দেবে এই ভূখণ্ডকে, তা-ই এখন দেখার।