চারচাকা গাড়ির চাহিদা আছে, আছে ক্রেতাও। তবু ভারতীয় গাড়ির বাজারে ক্রমশ কমছে ইউরোপীয় গাড়ির চাহিদা। একের পর এক ইউরোপীয় গাড়ির প্রস্তুতকারক সংস্থা পাততাড়ি গোটাচ্ছে ভারত থেকে। ভারতীয় বাজারে চারচাকার বাহনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দামি বিলাসবহুল ইউরোপীয় গাড়ি থেকে।
ভারতের বিশাল বাজার ধরতে একাধিক বহুজাতিক গাড়ি নির্মাণ সংস্থা ভারতের বাজারে প্রবেশ করেছিল। তবে ধীরে ধীরে ব্যবসা পড়তির দিকে ইউরোপীয় গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির। হাতেগোনা বিক্রি অডি, মার্সিডিজ়, ল্যাম্বারঘিনি, ফেরারি, বুগাটি, রোলস রয়েসের।
ভারত থেকে ধীরে ধীরে ব্যবসা গুটিয়েছে শেভ্রলে। একই পথে হাঁটতে চলেছে আমেরিকান গাড়ি সংস্থা ফোর্ডও। গুজরাত এবং তামিলনাড়ুতে দু’টি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
ইউরোপীয় গাড়ির প্রতি কেন এই অনীহা ভারতীয়দের? অতিরিক্ত স্বাচ্ছন্দ্য, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় কারখানায় উৎপাদিত গাড়ি কিনতে কেন বেশি ঝুঁকছেন এ দেশের বাসিন্দারা?
গাড়ি বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপের নির্মাতাদের কয়েকটি মডেল ভারতীয় গ্রাহকদের প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খায় না। তারা অন্যান্য দেশের জন্য নকশা করা মডেলই এখানে নিয়ে এসেছে।
ভারতীয় ক্রেতারা জ্বালানি সাশ্রয়কারী, কম দামি গাড়ি পছন্দ করেন। যে কারণে ভারতীয় বাজারে ছোট গাড়ির চাহিদা বিপুল।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসাবে ভারতের গাড়ির বাজারে বর্তমান বৃদ্ধির হার বাকিদের তুলনায় অনেক বেশি। মূলত দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে আছেন গাড়ির ক্রেতারা। এক দল দু’চাকার বদলে চারচাকার দিকে হাত বাড়াচ্ছেন, আর এক দল আরও ভাল উন্নত মডেল বেছে নিতে চাইছেন।
এই দুই শ্রেণির ক্রেতার মধ্যে বছরে বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ হাজার জন দামি বিলাসবহুল গাড়ির মালিক হচ্ছেন।
ভারতীয় ক্রেতা সঠিক কী চাইছেন, তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি বহুজাতিক সংস্থাগুলি। বিদেশের বাজারে বড় গাড়ি প্রস্তুত করে তারা যেমন মোটা মুনাফা কামায়, তেমনটা ভারতের বাজারেও করতে পারবে বলে মনে করেছিল সংস্থাগুলি।
তবে সবচেয়ে বড় কারণ হল ইউরোপীয় গাড়িরগুলির অত্যধিক দাম। মোটা মুনাফার কথা মাথায় রেখে এই গাড়ি নির্মাণ সংস্থাগুলি যে দামে ভারতে গাড়ির দাম স্থির করে, তা দেশি গাড়ির তুলনায় দ্বিগুণ।
অভাব সঠিক বিজ্ঞাপনেরও। দেশীয় গাড়িগুলির বিজ্ঞাপনের মুখ ছিলেন ভারতীয় তারকারা। সেখানে বহুজাতিক গাড়ি নির্মাতারা বহু দিন ভরসা করেছিলেন বিদেশি বিজ্ঞাপনের উপরেই।
ইউরোপীয় গাড়িরগুলির মূল বৈশিষ্ট্য হল এর সুরক্ষা ব্যবস্থা। দেশি গাড়িতে যে ধরনের সুরক্ষা থাকে তার তুলনায় বহু গুণ বেশি থাকে ইউরোপীয় গাড়িগুলিতে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলিও ক্রেতাদের কাছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে গাড়ি নির্মাণ সংস্থাগুলি।
বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই দেশে গাড়ি উৎপাদন করে ইউরোপের বাজারে রফতানি করার পরিকল্পনাও করেছিল। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জটিলতার কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
গাড়ির ক্ষেত্রে ভারতের আমদানি কর বেশি থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্ভব হয়নি। বিদেশি সংস্থাগুলি দেশি বাজারে ঢুকে যদি দেশি সংস্থাগুলির বাজার পণ্ড করে দেয়, সেই কথা ভেবেই আমদানি করে ছাড় দেয়নি কেন্দ্র।
সে কারণেই আকাশছোঁয়া দাম ইউরোপীয় গাড়িগুলির। গাড়ি বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ৬০-৭০ লাখি গাড়ির দাম এক ধাক্কায় কমে ৫০ লাখের কাছাকাছি এসে যেতে পারে।
উচ্চ আমদানি করের কারণেই এখনও ভারতের বাজারে তাদের ইলেকট্রিক গাড়ি আনতে সক্ষম হয়নি আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা টেসলাও।
প্রায় ৪০ বছর ধরে সস্তার মারুতি সুজ়ুকি গাড়ি ভারতের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে৷ ১৯৮১ সালে জাপানের সুজ়ুকি ভারতের মারুতি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ শুরু করে৷
এই মুহূর্তে বাজারে ‘স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকলের’ (এসইউভি) চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে মাঝারি আকারের এসইউভির। অল্প সময়ের মধ্যে ভারতে এই গাড়ির চাহিদা অনেক বেড়েছে। ভারতীয় রাস্তায় চলাচলের কথা মাথায় রেখে তৈরি এই ধরনের উঁচু গাড়ি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করছেন ক্রেতারা।
জাপানের বহুজাতিক গাড়ি সংস্থা টয়োটার এসইউভির চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ভারতে বছরে চার লাখ গাড়ি উৎপাদন করে টয়োটা।
ছোট গাড়ির বাজারের ক্ষেত্রে মারুতি ছাড়াও ভারতীয় ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে টাটা। মাহিন্দ্রার এসইউভির চাহিদাও ২০২৪ সালে বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে। ব্যবসা বেড়েছে কিয়ারও।
সূত্র বলছে, নতুন এসইউভি নিয়ে ভারতে ফিরে আসতে চলেছে ফোর্ড। সেই গাড়ির স্বত্বও নিয়ে ফেলেছে সংস্থাটি।