দিল্লির আবগারি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের নির্দেশে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা তিহাড়। জেল কর্তৃপক্ষ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর জন্য দু’নম্বর সেল বরাদ্দ করেছেন। আর সেখানেই কেজরীওয়ালের প্রতিবেশীদের নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
জেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, কেজরীওয়াল তিহাড়ের যে অংশে রয়েছেন, তার আশপাশেই রয়েছে ডন, গ্যাংস্টার এবং জঙ্গিরা! গত ১ এপ্রিল কেজরীওয়ালকে তিহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার এক বিশেষ সেলে থাকবেন আম আদমি পার্টির (আপ) প্রধান।
জানা গিয়েছে, তিহাড়ে দু’নম্বর সেলেই রয়েছেন ডন দাউদ ইব্রাহিমের এক সময়ের সঙ্গী ছোটা রাজন। শুধু তিনি একা নন, সেই সেলেই রয়েছেন আরও দুই কুখ্যাত অপরাধী। এক জন গ্যাংস্টার নীরজ বওয়ানা এবং অন্য জন জঙ্গি জিয়াউর রহমান। তবে এঁদের সকলকেই জেলের ‘হাই রিস্ক’ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।
দাউদের ডানহাত ছিলেন রাজন। জানা গিয়েছিল, ডি-কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন তিনি। রাজনের ভয়ে এক সময় মুম্বই তটস্থ ছিল। শুধু মুম্বই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই তার দলের লোকজন ছড়িয়ে ছিল। দাউদের প্রায় সব কাজই একার হাতে সামলাতেন রাজন। সেই রাজনকে ২০১৫ সালে বালি থেকে গ্রেফতার করে ভারতে আনা হয়েছিল।
রাজনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে-কে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১১ সালের জুন মাসে প্রকাশ্যে খুন হন ওই সাংবাদিক। তাঁর খুনে ছোটা রাজন ছাড়াও সাংবাদিক জিগনা ভোরা-সহ মোট ১২ জনের নাম জড়িয়েছিল। ২০১৮ সালে জিগনা ভোরা বাদে বাকি সকল অভিযুক্তকে এই খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আপাতত তিহাড় জেলে রাখা হয়েছে রাজনকে। সম্প্রতি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি ওয়েব সিরিজ় ‘স্কুপ’ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কেজরীর অপর প্রতিবেশী গ্যাংস্টার নীরজেরও অপরাধের সংখ্যা কম নয়। প্রায় ১৮ বছর আগে অপরাধ জগতে পা দেন তিনি। দিল্লি-এনসিআর এলাকা ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। দিল্লির বওয়ানা গ্রামের বাসিন্দা নীরজ। পরে সে নিজের পদবি হিসাবে গ্রামের নামই ব্যবহার করা শুরু করে। দিল্লি-সহ একাধিক রাজ্যে খুন, ডাকাতি, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন নীরজ। খুন, অপহরণ-সহ একাধিক ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। বর্তমানে তিহাড় জেলেই রয়েছেন তিনি। অভিযোগ, জেলে বসেই নীরজ তাঁর গ্যাং চালান। তাঁর গ্যাংয়ের সঙ্গে প্রায়ই অন্যান্য গ্যাংয়ের ঝামেলা লেগে থাকে। দিল্লির উপকণ্ঠে অনেক ছোট-বড় গ্যাং আছে। কিন্তু বলা হয়, নীরজের মতো বড় গ্যাং আর নেই। এমন কোনও অপরাধ নেই যা এই গ্যাং করেনি।
রাজন, নীরজ ছাড়া জঙ্গি জিয়াউরও তিহাড়ে কেজরীওয়ালের প্রতিবেশী। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য তিনি। একাধিক সন্ত্রাসমূলক কাজের সঙ্গে জিয়াউরের নাম জড়িয়েছে। বর্তমানে তাঁর ঠিকানা তিহাড় জেল।
কেজরীর সেলে থাকলেও এই তিন অপরাধীকে জেলের ‘হাই রিস্ক’ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। ‘হাই রিস্ক’ ওয়ার্ড জেলের ভিতরে সম্পূর্ণ আলাদা একটি অংশ। এই ওয়ার্ডের প্রবেশ এবং বেরোনোর পথও আলাদা। তাই কেজরীর সঙ্গে তাঁদের দেখাসাক্ষাতের তেমন সম্ভাবনা নেই।
কেজরীওয়ালের পাশের সেলে আছেন তাঁর মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য মণীশ সিসৌদিয়া। আবগারি মামলাতেই মণীশকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ ছাড়াও দিল্লির প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন রয়েছেন সাত নম্বর সেলে। আর পাঁচ নম্বর সেলে ছিলেন আপের রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় সিংহ। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে জামিন পেয়েছেন তিনি।
ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) নেত্রী তথা তেলঙ্গানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-এর কন্যা কে কবিতার জন্য বরাদ্দ তিহাড়ের মহিলা বিভাগের ছ’নম্বর সেল।
অন্য বন্দিদের মতোই সুযোগ-সুবিধা পাবেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের যা যা বিধিনিষেধ আছে, তাঁর ক্ষেত্রেও সে সবই বহাল থাকবে। তবে তিনি কিছু বাড়তি সুযোগও পাবেন। যেমন, তাঁর সেলে টিভির ব্যবস্থা থাকবে। সংবাদ, বিনোদন এবং খেলাধূলা-সহ ১৮-২০টি চ্যানেল দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কেজরীওয়ালকে। তা ছাড়া তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে সারা দিন চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীর ব্যবস্থা থাকবে। বন্দি অবস্থায় তাঁর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।
আবগারি দুর্নীতি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেজরীকে ন’বার সমন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রতি বারই হাজিরা এড়িয়েছেন। গত ২১ মার্চ ছিল নবম বারের হাজিরার দিন। ইডি দফতরে না গিয়ে কেজরী সে দিন গিয়েছিলেন হাই কোর্টে। রক্ষাকবচের আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। তার পর ওই দিন রাতেই দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছে যান কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকেরা। ঘণ্টা দুয়েক তল্লাশির পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
সোমবার ইডি হেফাজত শেষে কেজরীওয়ালকে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক তাঁর ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। বিকেল ৪টে ১৩ মিনিটে তিহাড় জেলে নিয়ে আসা হয় কেজরীকে। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ২ নম্বর সেলে থাকবেন। যে ২ নম্বর সেলে রাখা হয়েছে কেজরীকে, কিছু দিন আগে সেখানে ছিলেন তাঁরই দলের নেতা সঞ্জয় সিংহ।
আপ সূত্রে খবর, তিহাড়ে বিনিদ্র রাত কাটছে কেজরীর। মাত্র কিছু ক্ষণ ঘুমোচ্ছেন তিনি। কেজরীকে সোমবার বিকেলে তিহাড়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়েছিল। এক জেল আধিকারিক জানান, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর শরীরে শর্করার মাত্রা ৫০-এর নীচে নেমে গিয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়। তাঁর শরীরের কথা মাথায় রেখে দুপুরে এবং রাতে বাড়ির তৈরি খাবার খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আপের দাবি, জেলে যাওয়ার পরে কেজরীওয়ালের ওজন অনেকটাই কমেছে। তাঁর ওজন নাকি সাড়ে চার কেজি কমে গিয়েছে। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ সেই দাবি মানতে নারাজ। তাঁরা জানিয়েছেন, জেলের মধ্যে সুস্থই আছেন কেজরী। কারাগারের চিকিৎসকেরাও তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করেননি।