৫০ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনার ফলে প্রাণ হারানো বিমানচালক রবার্ট অ্যালবিন লফ্ট ও বিমানের সহ-পাইলট ফার্স্ট অফিসার অ্যালবার্ট জন এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সেকেন্ড অফিসার ডোনাল্ড লুইসকে নাকি দেখতে পাওয়া যায় আজও।
উড়ানের আগে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি বা বিপদের সম্ভাবনা থাকলে বিমানকর্মীদের আগাম সতর্ক করতে নাকি হাজির হন দুর্ঘটনার কবলে পড়া ফ্লাইট ৪০১ বিমানের চালক ও কর্মীদের প্রেতাত্মা।
এক নয়, একাধিক ব্যক্তি রবার্টদের চাক্ষুষ করার দাবি করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন এই অশরীরীদের উপস্থিতি। এমনকি বিধ্বস্ত বিমানটি থেকে উদ্ধার করা ভাঙা অংশগুলি থেকে নানা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে বলেও দাবি করা হয়েছে বহু বার।
কিন্তু এ রকম ঘটনা কী ভাবে সম্ভব, তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ সব কিছুকেই ‘ভূতুড়ে’ বলে দাবি করেছেন অনেকেই। বিমানকর্মীরা সত্যি সত্যিই ‘ভূত’ দেখছেন, না কি এ সবই গুজব, তা জানতে বিমান সংস্থার তরফে তদন্ত করা হয়। অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই রহস্যের কিনারা সম্ভব হয়নি।
১৯৭৮ সালে এই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। এর পর পেরিয়ে গিয়েছে কয়েক দশক। কিন্তু ফ্লাইট ৪০১ রহস্যের সমাধান আজও অধরা।
ঠিক কী ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর? ফ্লাইট ৪০১ বিমানের সঙ্গে সম্পর্কই বা কী এই ধরনের ভূতুড়ে কার্যকলাপের? অভিশপ্ত সেই দিন ১৬৩ জন যাত্রী, ১০ জন বিমানকর্মী এবং তিন জন বিমানকর্মী নিয়ে নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স ফ্লাইট-৪০১ যাত্রা শুরু করে।
সে দিনের ‘ফ্লাইট ৪০১’-এর ক্যাপ্টেন ছিলেন ৫৫ বছরের রবার্ট অ্যালবিন লফ্ট। ক্যাপ্টেন লফ্টের ৩২ বছরের কর্মজীবনে মোট উড়ানের সময় ছিল ২৯ হাজার ঘণ্টা। লুইসের অভিজ্ঞতাও কম ছিল না। তাঁর মোট উড়ানের সময় ছিল ১৫,৭০০ ঘণ্টা।
রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বিমানটি মায়ামি বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পৌছে যায়। কিন্তু বিপত্তি বাধে শেষ মুহূর্তে। অবতরণের আগের মুহূর্তেই বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে।
ক্যাপ্টেন ল্যান্ডিং গিয়ারের লিভারটি নীচে নামানোর সময় লক্ষ করেন, নোজ় গিয়ারের সঙ্গে যুক্ত ইন্ডিকেটরের আলো জ্বলছে না। সাধারণত, বিমান টেক-অফের সময় ল্যান্ডিং গিয়ারের লিভার নীচে নামালে ইন্ডিকেটরটি জ্বলে ওঠে। এর ফলে বোঝা যায়, ল্যান্ডিং গিয়ারটি খুলেছে কি না।
এই অবস্থায় কোনও ভাবেই বিমান অবতরণ করানো সম্ভব নয়। কারণ ল্যান্ডিং গিয়ার না খুললে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। তাই বিমানচালকেরা বিমানটিকে দু’হাজার ফুট উচ্চতায় অটোপাইলট মোডে রেখে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে ডাকেন।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার পুরো ইন্ডিকেটর সিস্টেম পরীক্ষা করেন। বিমানের সব আলো জ্বলে উঠলেও ইন্ডিকেটরের আলো কিছুতেই জ্বলছিল না। এর কারণ কোনও ভাবেই খুঁজে উঠতে পারেননি তিনি।
এই অবস্থায় তাই তাঁরা মাঝ আকাশেই কিছু ক্ষণ বিমানটি ‘স্থির অবস্থায়’ রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিমানটি যে নিজে থেকেই ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে, তা বিমানচালক এবং অন্যেরা বুঝতেই পারেননি। তাঁরা বুঝতে পারেননি যে অটোপাইলট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ করেই ৯০০ ফুট উচ্চতায় নেমে যায় বিমানটি। বিমানের ফার্স্ট অফিসার এই বিষয়ে পাইলটকে অবগত করার আগেই তিনি বিমানটিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেলেন। মুহূর্তের মধ্যে এভারগ্লেডস জলাভূমির মধ্যে আছড়ে পড়ে বিমানটি।
৭৫ জনকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হলেও বিমানের পাইলট-সহ দু’জন ক্রু সদস্য, দু’জন বিমানকর্মী এবং ৯৬ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়।
এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিক থাকলেও সমস্যা শুরু হয় ফ্লাইট ৪০১ বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের পর থেকে। যে অংশগুলি তখনও অক্ষত ছিল, সেগুলি মেরামত করে ওই সংস্থার অন্য বিমানে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই ফ্লাইট ৩১৮-এ লাগানো হয়েছিল।
তার পর থেকেই বিমানকর্মী থেকে শুরু করে ক্রু সদস্যেরা ফ্লাইট ৪০১ দুর্ঘটনায় মৃত ক্যাপ্টেন, সহ-পাইলট এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের প্রেতাত্মার উপস্থিতির দাবি করতেন প্রায়শই।
১৯৭৩ সালে এমনই এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। যে বিমানে ফ্লাইট ৪০১-এর যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের সেই ফ্লাইট ৩১৮-এ সফর করছিলেন তিনি। তাঁর পাশের আসনে বসেছিলেন ফ্লাইট ৩১৮ বিমানের ক্যাপ্টেন।
কিছু সময় পর তাঁর মনে হয়, তাঁর পাশে যদি ক্যাপ্টেন বসে থাকেন তবে বিমানটি ওড়াচ্ছে কে? পাইলট কেবিনের দিকে হতদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়ার সময় লক্ষ করেন, তাঁর পাশে বসে যিনি এত ক্ষণ গল্প করছিলেন তাঁর মুখের আদলের সঙ্গে মিল আছে ৪০১ বিমানের ক্যাপ্টেন লফ্টের। অথচ এর এক বছর আগেই মারা গিয়েছেন লফ্ট।
এক এক সময় এমনও দাবি করা হয়েছিল যে, সেই অভিশপ্ত বিমানের ইঞ্জিনিয়ার লুইস অন্য বিমানের কর্মীদের সাবধান করেছিলেন বিমানের ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে।
শোনা যায়, বহু বিমানকেই দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন ফ্লাইট ৪০১-এর ক্রু সদস্যরা। নিজেরা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন বলেই কি বার বার অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে হাজির হন বিমানকর্মীরা? বিতর্ক যা-ই থাকুক না কেন, বহু অনুসন্ধান সত্ত্বেও ফ্লাইট ৪০১ রহস্য আজও অনাবৃতই রয়েছে।