মৃত্যু কী? তা কি সব কিছুরই শেষ? নাকি মৃত্যুর পরে শুরু হয় আর এক জীবন? প্রাচীন কাল থেকে এখনও পর্যন্ত মানুষ এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজেছে। কিন্তু আজও কোনও সঠিক উত্তর মেলেনি। অনেকে বলেন, তাঁরা ‘মৃত্যুর মুখ’ থেকে ফিরে এসেছেন। সেই কথাটি নেহাত লব্জ হিসেবেই মানুষ ধরে থাকে। কিন্তু এমনও কি সম্ভব, যেখানে মানুষ জীবদ্দশাতেই মৃত্যুর পরের অভিজ্ঞতা লাভ করে আবার জীবনেই ফিরে এসেছে? কড়া যুক্তিবাদীরা এমন ঘটনাকে উড়িয়ে দিলেও মনোচিকিৎসক ও অতিপ্রাকৃত নিয়ে চর্চাকারীদের অনেকেই স্বীকার করেছেন ‘নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স’ বা ‘মৃত্যুতুল্য অভিজ্ঞতা’-র কথা।
নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স বা সংক্ষেপে ‘এনডিই’ নিয়ে এক দিকে যেমন বিভিন্ন তত্ত্ব পেশ করেছেন স্নায়ুবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে ধর্মশাস্ত্রবিদরা, সেই সঙ্গে অগণিত মানূষ তাঁদের ‘এনডিই’ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাকে নথিবদ্ধ করেছেন।
‘এনডিই’-কে অনেকে ‘আউট অব বডি’ এক্সপিরিয়েন্স' বলেও ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ দেহ থেকে বেরিয়ে এসে সত্তা নিজের দেহকেই দেখতে পায়, এমন এক অবস্থা।
দেহ থেকে সত্তা বা আত্মাকে বার করে আনার উপায় নাকি যোগ সাধনমার্গেও রয়েছে। কিন্তু, ‘এনডিই’ সে সবের মতো নয়। এই অবস্থায় এক দিকে কেউ নিজের পড়ে থাকা দেহকে যেমন দেখতে পান, তেমনই নাকি অন্য অনেক অ-প্রাকৃত অভিজ্ঞতাও তাঁদের ঘটে।
‘এনডিই’ নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করেন ব্রুস গ্রেসন নামক এক আমেরিকান মনোচিকিৎসক। ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার নিউরোবিহেভোরিয়াল সায়েন্সের ইমেরিটাস অধ্যাপক গ্রেসন মনস্তত্ত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু ২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আফটার: আ ডক্টর এক্সপ্লোরস হোয়াট নিয়ার-ডেথ এক্সপিরিয়েন্সেস রিভিল অ্যাবাউট লাইফ অ্যান্ড বিয়ন্ড’-ই তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছে। এই বইতেই গ্রেসন তাঁর ‘এনডিই’-সংক্রান্ত বক্তব্যকে পেশ করেছেন প্রভূত উদাহরণ এবং ‘কেস স্টাডি’ সহযোগে।
গ্রেসনের মতে, ‘এনডিই’-লব্ধ মানুষের অধিকাংশই দুর্ঘটনায় আহত বা অন্য অসুখে শয্যাশায়ী অবস্থায় এই অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তাঁর মতে ব্যক্তিভেদে ‘এনডিই’ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। কোন ব্যক্তি কেমন ‘এনডিই’ লাভ করবেন, তা নির্ভর করছে সেই ব্যক্তির সাংস্কৃতিক, দার্শনিক এবং ধর্মীয় অবস্থানের উপর। ‘এনডিই’-প্রাপ্তদের অভিজ্ঞতায় কয়েকটি বিষয় অবশ্য সাধারণ থাকে বলেই গ্রেসন মনে করেন।
গ্রেসনের মতে, ‘এনডিই’-র ক্ষেত্রে যে সব বিষয় প্রত্যকে অনুভব করেছেন, সেগুলি হল— (ক) নিজের মৃত্যু হয়েছে, এ সম্পর্কে স্পষ্ট এক বোধ। (খ) দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে বা নিজের মৃতদেহকে দেখতে পাওয়া। (গ) এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাত্রা বা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার অনুভূতি। (ঘ) এক অপার্থিব আলো বা জ্যোতি দেখতে পাওয়া।
এগুলির সঙ্গে গ্রেসন যুক্ত করেছেন, ‘এনডিই’-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা নাকি সাদা পোশাক পরিহিত কিছু আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিকে দেখতে পান। তাঁরা আসলে দেবদূত। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষেরাই এই ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’-দের দেখতে পান। অন্য ধর্মের মানুষরা হয়তো অন্য কিছু দেখেন।
‘এনডিই’-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা নাকি নিজেদের সম্পূর্ণ জীবনকে চোখের সামনে অতি দ্রুত সিনেমার মতো দেখতে পান। অনেকে নাকি জন্মের মুহূর্তকেও স্পষ্ট মনে করতে পারেন।
এর পরে ঘটে ফিরে আসার পর্ব। তবে এই ‘ফিরে আসা’-র বিষয়টি নাকি ঐচ্ছিক। ‘এনডিই’-প্রাপ্তরা যে আলো দেখতে পান, সেই আলো নাকি তার মধ্যে বিলীন হতে প্রাণিত করে। যদি তিনি সেই আলোর মধ্যে বিলীন হতে চান, তা হলে তাঁর আর ‘ফেরা’ হবে না। তিনি অন্য লোকে চলে যাবেন।
কিন্তু ‘এনডিই’-প্রাপ্ত ব্যক্তি ইচ্ছে হলে ফিরে আসতেও পারেন। তাঁর সত্তা পুনরায় দেহে প্রবেশ করতে পারে। এই ফেরা বা না ফেরার সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হ্যারি পটার সিরিজের অন্তিম পর্বে লেখক জেকে রাওলিং নিয়ে এসেছিলেন এই ফেরা বা না-ফেরার প্রসঙ্গ। খলনায়ক ভোল্ডেমর্ট হ্যারির উদ্দেশে ‘ডেথ কার্স’ নিক্ষেপ করে। হ্যারি জ্ঞান হারায়। অচৈতন্য অবস্থায় সে দেখতে পায়, কিংস ক্রস স্টেশনে সে দাঁড়িয়ে। গোটা এলাকা জুড়ে আশ্চর্য আলোর বন্যা। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় প্রয়াত শিক্ষক ডাম্বলডোরের। কথোপকথনের পরে ডাম্বলডোর তাকে ফিরে যেতে বলেন। হ্যারি তার অচৈতন্য দেহে ‘ফিরে আসে’।
গ্রেসনের আগে ১৯৭৫ সালে রেমন্ড মুডি প্রায় ১৫০ জন মানুষের উপরে এক সমীক্ষা চালান। সেই সমীক্ষায় ন’টি স্তরের অভিজ্ঞতাকে তিনি ‘এনডিই’-র ক্ষেত্রে সাধারণ বলে বর্ণনা করেন। শেষ স্তরে তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দেবতা-স্থানীয় কেউ ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি নাকি মনে করিয়ে দেন যে, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর সময় তখনও আসেনি। মুডি এ কথাও বলেন যে, সব মানুষের ‘এনডিই’ এক রকম হতে পারে না। সব ক’টি স্তরের অভিজ্ঞতা সকলে প্রাপ্ত না-ও হতে পারেন।
১৯৮১ সালে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার ডারহামে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন ফর নিয়ার-ডেথ স্টাডিজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘এনডিই’ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো এই অলাভজনক সংস্থা আজ আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করে চলেছে।
এই সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কেনেথ রিং ১৯৮০ সালে জানিয়েছিলেন যে, ‘এনডিই’-র মধ্যে পাঁচটি স্তর দেখা যায়। এগুলি হল— শান্তির অনুভূতি, দেহ থেকে বিচ্ছিন্নতার বোধ, জ্যোতি দর্শন এবং সেই জ্যোতির ভিতর দিয়ে অন্য এক অস্তিত্বের জগতে প্রবেশ।
এত কিছুর পরেও মনস্তত্ত্বের গবেষকদের এক বড় অংশ ‘এনডিই’-র বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এবং গ্রেসন-সহ বাকিদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, ‘এনডিই’ আসলে এক বিভ্রম, যা মানুষ দুর্বল শারীরিক ও মানসিক অবস্থাতেই ‘প্রত্যক্ষ’ করে। এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।
কিন্তু গ্রেসন, কেনেথ রিং প্রমুখ আজও রত ‘এনডিই’-র রহস্য উদ্ধারে। তাঁদের সম্মিলিত বক্তব্য থেকে এ কথা বোঝা যায় যে, ‘এনডিই’-র সঙ্গে মানুষের সামূহিক স্মৃতির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। যোগ রয়েছে সংস্কৃতিরও। খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিতে লালিত মানুষ যদি ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’-দের দেখতে পান, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তা হলে দেখতে পাবেন যমদূতদের। তবে সাংস্কৃতিক বিভাজন নির্বিশেষে ‘এনডিই’-প্রাপ্তরা সকলেই সুড়ঙ্গ ও জ্যোতি বা অপার্থিব আলো দেখতে পেয়েছেন বলেই জানা যায়।
‘নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স’ আজও রহস্যাবৃত। যদি এই অভিজ্ঞতা সত্য হয়েও থাকে, তবে প্রকৃত মৃত্যুর সময়ে কি একই ঘটনা ঘটে— এই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, কোনও মৃত ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা শোনাতে ফিরে আসেননি। প্ল্যানচেটে বিশ্বাসীরাও জানাননি, কোনও আত্মা তাঁদের মৃত্যুকালীন অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন কি না।