Myanmar Rebels

তরমুজের মতো ফালাফালা হচ্ছে দেশ! প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বিদ্রোহীদের দাপাদাপিতে আতঙ্কে বাংলাদেশও

কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি থেকে শুরু করে আরাকান সেনা। মায়ানমারের একাধিক এলাকা কব্জা করেছে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ফলে যে কোনও দিন ইয়াঙ্গনের জুন্টা সেনা সরকারের পতন হতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৭
Share:
০১ ২১

গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে পূর্বের প্রতিবেশী। কামান-বন্দুকের গোলাগুলির শব্দে নিত্য দিন ঘুম ভাঙছে সেখানকার বাসিন্দাদের। এলাকায় এলাকায় শুধুই ভারী বুটের পদধ্বনি! পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে সিরিয়ার মতো ওই দেশের শাসনভারও বিদ্রোহীদের হাতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ঢাকার। স্বস্তিতে নেই নয়াদিল্লিও।

০২ ২১

ভারতের একেবারে পূর্ব প্রান্তের প্রতিবেশী মায়ানমার। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছে সেখানকার গৃহযুদ্ধ। একের পর এক এলাকা কব্জা করে চলেছেন বিদ্রোহীরা। তাঁদের সাঁড়াশি আক্রমণের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সেখানকার ফৌজি জুন্টা সরকার। আগামী দু’-তিন মাসের মধ্যে এর পতনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

Advertisement
০৩ ২১

চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর সাবেক বর্মার (পরে নাম হয় মায়ানমার) তাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মানেরপ্লা গ্রাম দখল করে ‘কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন’ বা কেএনইউ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী। একটা সময়ে এখানেই ছিল তাঁদের সদর দফতর। প্রায় তিন দশক পর সেই এলাকা পুনর্দখল করলেন বিদ্রোহীরা।

০৪ ২১

তাই সীমান্ত লাগোয়া মানেরপ্লা কব্জা করা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে কেএনইউ। সেখানে এই ঘটনাকে বড় দিনের উপহার বলে বর্ণনা করেছেন তাঁরা। সূত্রের খবর, বিদ্রোহীদের প্রবল আক্রমণের চাপ সহ্য করতে না-পেরে একটা সময়ে জুন্টা সেনা এই এলাকা ছেড়ে চম্পট দেয়। তবে এই লড়াইয়ে হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।

০৫ ২১

কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের মুখপাত্র পাদোহ সাও তাও নি বলেছেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে সংঘর্ষে অবশেষে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর, সোমবার গভীর রাতে মানেরপ্লা পুনর্দখল করা গিয়েছে। বর্তমানে এই এলাকা সম্পূর্ণ ভাবে জুন্টার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। বড়দিনের আগে আমাদের কাছে এর চেয়ে ভাল খবর আর কিছুই নেই।’’

০৬ ২১

মায়ানমারের স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ‘নারিনজারা নিউজ়’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাতের অন্ধকারে মানেরপ্লার জুন্টা সেনা ছাউনিতে অতর্কিতে হামলা চালায় কেএনইউ-এর সশস্ত্র শাখা কারেন ন্যাশনাল আর্মি। তাঁদের আক্রমণে প্রাণ হারান অধিকাংশ ফৌজি। জুন্টা সেনার বিপুল হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ কব্জা করেছে কেএনইউ। এর মধ্যে রয়েছে ১২০ এবং ৮১ মিলিমিটারের ছোট কামান।

০৭ ২১

১৯৪৮ সাল থেকে স্বাধীন কারেন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে মায়ানমারের সরকারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসছে সেখানকার বিদ্রোহী কেএনইউ গোষ্ঠী। ১৯৭৫ সালে মানেরপ্লার ‘কাউথুলেই’তে রাজধানী তৈরি করে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। কিন্তু পরবর্তী কালে সেখানকার একাধিক উপদলের সাহায্য নিয়ে মানেরপ্লা কব্জা করে সেনা। মানেরপ্লা কেএনইউ-এর হাতছাড়া হওয়ার তারিখ ছিল ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি।

০৮ ২১

একুশ শতকে অল্প কিছু সময়ের জন্য গণতন্ত্রের মুখ দেখেছিল মায়ানমার। কিন্তু, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের ক্ষমতা দখল করে সেনা। প্রথম দিন থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। এ বছর আর এক সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘পিপলস্ ডিফেন্স ফোর্স’-এর (পিডিএফ) সঙ্গে মিলে তাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মায়াওয়াদ্দি আক্রমণ করে কেএনইউ-এর বিদ্রোহী সেনাদল।

০৯ ২১

গত এপ্রিলে মানেরপ্লা এলাকার একটু বাইরের দিকে জুন্টা সরকারের সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায় কারেন ন্যাশনাল আর্মি। ওই হামলায় আংশিক সাফল্য পেয়েছিলেন তাঁরা। সে যাত্রায় কোনও মতে ছাউনিটিকে রক্ষা করে জুন্টার সৈনিকেরা।

১০ ২১

অন্য দিকে উত্তর মায়ানমারের নাগাল্যান্ড-মণিপুর সীমান্ত লাগোয়া ভামো এবং মানসি শহরে জোরালো আঘাত হানে ‘কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি’ (কেআইএ)। গত ৪ ডিসেম্বর তাঁরা জুন্টার ৪৭ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সৈনিকদের থেকে ভামোর একটি ঘাঁটি ছিনিয়ে নিয়েছে বলে খবর এসেছে। উত্তর মায়ানমারের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে স্বাধীন কাচিন রাজ্য তৈরির স্বপ্ন দেখছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

১১ ২১

২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর উত্তর মায়ানমারের কেআইএ তাঁদের আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছে। সূত্রের খবর, কাচিন ছাড়াও উত্তর সাগাইং এবং শান রাজ্যের অন্তত ১২টি শহর এই বিদ্রোহী সেনাদলের দখলে রয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির হাতে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জুন্টার অন্তত ৩০০টি সেনাঘাঁটি।

১২ ২১

এ ছাড়া এ বছরের (পড়ুন ২০২৪) ডিসেম্বরে দক্ষিণ পূর্বের বঙ্গোপসাগর লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের দখল নিয়েছে ‘আরাকান আর্মি’ নামের আর একটি বিদ্রোহী সেনাদল। মায়ানমারের এই এলাকাটির সঙ্গে বাংলাদেশের লম্বা সীমান্ত রয়েছে। এই ইস্যুতে ঢাকার উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

১৩ ২১

সূত্রের খবর, সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে বেশ কিছুটা জমি কব্জা করেছে আরকান আর্মি। ঢাকার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময়ও হয়েছে তাঁদের। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একটি শব্দও খরচ করেনি।

১৪ ২১

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আরকান আর্মির পরবর্তী নিশানা হল বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ওই এলাকাটির কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। এ ছাড়া বাংলাদেশের কক্স বাজার কব্জা করার সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে এই বিদ্রোহী সেনাদলের।

১৫ ২১

একাধিক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণে মায়ানমারের জুন্টা সরকারের ক্রমশ শক্তিক্ষয় হওয়ায় বিপাকে পড়েছে চিনও। পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে বেজিংয়ের। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের আওতায় সেখানে চলছে ‘চিন-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডর’ নির্মাণের কাজ। বিদ্রোহীদের আক্রমণে যা থমকে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

১৬ ২১

আর তাই গত মাসে মায়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানে চিন-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডর রক্ষায় বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী তৈরির বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত ফৌজ ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’-এর আদলে ওই বাহিনী গঠিত হবে বলে সূত্র মারফত খবর মিলেছে।

১৭ ২১

বেজিংয়ের পাশাপাশি বিদ্রোহীদের হাতে মায়ানমারের একাধিক এলাকা চলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লিও। বর্তমানে রাখাইন এলাকায় চলছে ‘কালাদান মাল্টি মডেল ট্রান্সজ়িট ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের কাজ। এর মাধ্যমে কলকাতা বন্দর থেকে পণ্যসামগ্রী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কালাদান নদী পেরিয়ে সরাসরি পৌঁছে যাবে মিজোরামে। জুন্টা সরকারের পতন হলে এই ধরনের প্রকল্পগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

১৮ ২১

রাখাইনের দখল নেওয়ার পর অবশ্য আরাকান আর্মি কালাদান প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছে। কেন্দ্রের তরফে তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মণিপুর-নাগাল্যান্ডের মতো উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলিতে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে কাচিন করিডর ব্যবহার করেন ড্রাগ মাফিয়ারা।

১৯ ২১

কাচিনের বিদ্রোহীরা অবশ্য মাদক পাচার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তা বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। পাশাপাশি এই এলাকায় রয়েছে দুর্লভ খনিজ সম্পদের ভান্ডার। এত দিন কাচিন থেকে সেই খনিজ বিপুল পরিমাণে আমদানি করত বেজিং।

২০ ২১

কিন্তু জুন্টা সরকারকে সরাসরি সমর্থন করে যাওয়ায় ড্রাগনের উপর বেজায় চটেছে বিদ্রোহীরা। সূত্রের খবর, আপাতত কাচিন থেকে চিনের দুর্লভ খনিজ পাওয়ার রাস্তা বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি, এই ইস্যুতে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ খুলে গিয়েছে কেন্দ্রের।

২১ ২১

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশর দাবি, বিদ্রোহীদের হাতে ইয়াঙ্গনের জুন্টা সেনা সরকারের পতন হলে মায়ানমারের দশাও সিরিয়ার মতো হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বর্মা মুলুকের টুকরো টুকরো হয়ে একাধিক দেশে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সেই অভিঘাত সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হবে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও চিনকে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement