লোহিত সাগরের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হুথি। ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে শিক্ষা দিতে ইয়েমেনে বড় আকারের বিমানহানা চালিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে অবশ্য বিষাক্ত সাপ তেহরান। পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুকটিকে খোলাখুলি হুমকি দিয়েছেন তিনি। এতে পশ্চিম এশিয়ায় নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, পরমাণু হাতিয়ার তৈরির খুব কাছাকাশি পৌঁছে গিয়েছে ইরান। পর্দার আড়ালে থেকে তেহরানকে এ ব্যাপারে ক্রমাগত সাহায্য করে চলেছে চিন এবং রাশিয়া। গুপ্তচর সংস্থা মারফৎ এই খবর কানে যেতেই আতঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র। পারস্য উপসাগরের শিয়া মুলুকটি পরমাণু শক্তিধর হলে আমেরিকা যে তাদের খোলা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি ওমান উপসাগরে হরমুজ প্রণালীর কাছে রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালায় ইরানি নৌসেনা। এর পোশাকি নাম ছিল ‘মেরিটাইম সিকিউরিটি বেল্ট ২০২৫’। বিষয়টি নজরে আসতেই রক্তচাপ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, তেহরান যে ভাবে নৌশক্তি বৃদ্ধি করছে, তাতে ভবিষ্যতে পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগর দিয়ে মার্কিন পণ্য চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে তারা।
বিশ্বের খনিজ তেল পরিবহণের এক পঞ্চাংশ যায় পারস্য উপসাগর দিয়ে। তা ছাড়া ভূমধ্যসাগর, সুয়েজ খাল হয়ে লোহিত সাগর ঘুরে এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে আনা-নেওয়া চলে দুনিয়ার ১২ শতাংশ পণ্যের। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সামনে রেখে ইরান এই রাস্তা বন্ধ করলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিরাট লোকসানের মুখে পড়বে ওয়াশিংটন।
লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগরের রাস্তা বন্ধ হলে আফ্রিকা ঘুরে ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে পণ্য পরিবহণ করা ছাড়া আমেরিকার সামনে অন্য পথ খোলা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, পরমাণু হাতিয়ার হাতে এসে গেলে সরাসরি ইজ়রায়েলকে নিশানা করতে পারে ইরান। কারণ, ইহুদিদের উপর আক্রমণ শানালে যুক্তরাষ্ট্রকে যে টেনে যুদ্ধে নামানো যাবে, তা ভাল ভাবেই জানে তেহরান।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, ইরানের পরিস্থিতিও ইরাকের মতো হতে পারে। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ বাগদাদ আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বাহিনী। ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের কাছে ‘গণবিধ্বংসী হাতিয়ার’ (ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশান) রয়েছে বলে ওই সময়ে অভিযোগ তুলেছিল আমেরিকা।
সূত্রের খবর, দীর্ঘ দিন ধরেই ইরানের কট্টরপন্থী শিয়া শাসকদের সরিয়ে নিজেদের পছন্দমাফিক কাউকে কুর্সিতে বসাতে চাইছে ওয়াশিংটন। মার্কিন গুপ্তচরেরা যে সেই চেষ্টা করেননি, এমনও নয়। কিন্তু অধরাই থেকে গিয়েছে সাফল্য। অন্য দিকে একের পর এক ইরানি পরমাণু গবেষককে গুপ্তহত্যা করে শিয়া ফৌজের জন্য ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তৈরি ঠেকাতে চেয়েছে ইজ়রায়েল।
কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে এত দিনের যাবতীয় পরিশ্রম ব্যর্থ হতে চলেছে বলেই মনে করছেন মার্কিন গোয়েন্দারা। আর তাই ইরানকে ‘শিক্ষা’ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর শরীরী ভাষায় তেহরান আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার ঝলক দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। ২০০৩ সালে ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল তাঁরই পূর্বসূরি জর্জ ডব্লু বুশের মধ্যে।
হুথিদের উপর বিমান হামলার পর নিজের সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এই নিয়ে একটি লম্বা পোস্ট করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘সমস্ত হুথি সন্ত্রাসবাদীকে বলছি, তোমাদের সময় শেষ। আজ থেকে আক্রমণ বন্ধ কর। সেটা না করলে তোমাদের উপর নরক বৃষ্টি নামবে, যা সহ্য করা সম্ভব নয়।’’
এর পরই ইরানকে হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, ‘‘হুথিদের সমর্থন এবং সাহায্য করা অবিলম্ব বন্ধ করুক তেহরান। নইলে তার চরম মূল্য দিতে হবে।’’ এ ব্যাপারে পাল্টা হুমকি দিয়েছে শিয়া মুলুকটিও। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এই ইস্যুতে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি লিখেছেন, ‘‘আন্তর্জাতিক আইনের কোনও তোয়াক্কাই করছে না ওয়াশিংটন। আগে ইজ়রায়েলি গণহত্যাকে সমর্থন করা বন্ধ করুক আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্র যে ভাবে ইয়েমেনের নিরীহ নাগরিকদের খুন করেছে, তা কখনওই সমর্থন যোগ্য নয়।’’
চলতি বছরের ১৫ মার্চ ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের গুপ্তঘাঁটিতে বিমানহানা চালায় মার্কিন ফৌজের সেন্ট্রাল কমান্ড। এতে ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটির একাধিক শীর্ষনেতার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে ওয়াশিংটন। অন্য দিকে হুথিদের পাল্টা দাবি, ওই বিমানহানায় প্রাণ গিয়েছে শিশু ও মহিলা-সহ কমপক্ষে ৫৩ জনের।
কিন্তু, ইয়েমেনে এই মার্কিন হামলার দমে না গিয়ে বিপুল উৎসাহে প্রত্যাঘাত শানিয়েছে ‘লোহিত সাগরের হাঙর’ হুথিরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানহানার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত তিন বার প্রতি আক্রমণ চালায় এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান’ নামের বিমানবাহী রণতরী এবং ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ। এগুলির উপর ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় হুথিরা।
এই অবস্থায় হুথিদের কোমর ভাঙতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ইয়েমেনে বিমানহানা চালাতে বাধ্য হয় মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড। তাঁদের সঙ্গে ছিল ব্রিটিশ বিমানবাহিনীও। হুথি মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বলেছেন, ‘‘ইয়েমেনে অবিলম্বে বন্ধ হোক মার্কিন আগ্রাসন। নইলে লোহিত সাগরে আমেরিকার জাহাজগুলিকে নিশানা করতে বাধ্য হব আমরা।’’
হুথিদের উপর এই বিমান হামলার লাইভ ফুটেজ ফ্লোরিডার ওয়াররুমে বসে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সাদা রঙের একটি গল্ফ টি-শার্ট পরে সেখানে একগুচ্ছ সেনা অফিসারের মাঝে বসেছিলেন তিনি। পরে সেই ছবি সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করে হোয়াইট হাউস। ওই অপারেশনের পরই হুথি এবং ইরানকে সাবধান করে হুমকি দেন বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ় জানিয়েছেন, অভিযান পুরোপুরি সফল হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আপাতত ইয়েমেনে বিমানহানা অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যম ‘আল-হাদাত’ আবার জানিয়েছে, গত ১৭ মার্চ লোহিত সাগরে ইরানের একটি গুপ্তচর জাহাজকে ডুবিয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী। ডুবে যাওয়া জাহাজটির নাম ছিল ‘জাগ্রোস’। ওই এলাকায় এটি সিগন্যাল ইনটেলিজেন্সের কাজ করছিল। ইরানের একটি সবচেয়ে উন্নত গোয়েন্দা জাহাজ ছিল বলে জানা গিয়েছে।
ইরান অবশ্য সৌদি আরবের দাবিতে পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ইরাকের মতো তেহরানকে কব্জা করা আমেরিকার পক্ষে খুব সহজ হবে না। কারণ, পশ্চিম এশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যস্ত রাখতে শিয়া মুলুকটিকে অত্যাধুনিক হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করতে পারে চিন এবং রাশিয়া।
ইরান-হুথি বনাম ইজ়রায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে নয়াদিল্লির যথেষ্ট উদ্বেগের জায়গা রয়েছে। কারণ, তেহরান এবং তেল আভিভ দুই জায়গাতেই বিপুল লগ্নি রয়েছে ভারতের। লড়াইয়ের জন্য সেখানে বড় আকারের লোকসান সইতে হতে পারে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে।