আমেরিকার নেভাদায় অবস্থিত টেসলার কারখান এর কাছে আয়তনে নেহাতই শিশু। আয়তনে এটি মার্কিন মুলুকের শহর সানফ্রান্সিসকোর সমান বলে দাবি উঠেছে। ৩২ হাজার একর জুড়ে বিস্তৃত চিনের একটি বৈদ্যুতিক যানবাহন কারখানার ছবি সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। আয়তনে এটি টেসলার বৃহত্তম কারখানা ‘গিগাফ্যাক্টরি’র ১০ গুণ।
বিওয়াইডি (বিল্ড ইয়োর ড্রিম) নামের বিদ্যুৎ যানের নতুন সেই কারখানাটি অবস্থিত হেনান প্রদেশের ঝেংঝুতে। সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে, চিনে একটি বৈদ্যুতিক যানবাহন নির্মাণের অতিকায় কারখানা তৈরি হচ্ছে। টেসলার সঙ্গে পাল্লা দিতে বিশাল বড় সাম্রাজ্য নিয়ে প্রতিযোগিতার বাজারে পা রাখতে চলেছে বিওয়াইডি।
ড্রোন ফুটেজে দাবি করা হয়েছে যে, ঝেংঝুতে তৈরি হওয়া এই কারখানটির নিজস্ব ফুটবল মাঠও রয়েছে। কারখানাটির নির্মাণ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সেটি সম্পূর্ণ হলে এটি ১২৯ বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থান করবে। সেই তুলনায় এটি সানফ্রান্সিসকোর চেয়ে কিছুটা বেশিই।
সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে বিশাল বিশাল ইমারত তৈরি হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। যেন আস্ত একটি শহর ঢুকে পড়েছে কারখানার মধ্যে। চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা থাকবে সেখানেই। ফুটবল মাঠ ছাড়াও সেখানে রয়েছে টেনিস কোর্টও।
ড্রোন ফুটেজে এমন কিছু জমিও দেখানো হয়েছে যেখানে এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের প্রকল্পটি আটটি পর্যায়ে তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চারটি পর্যায়ের কাজ শেষ। বাকি চারটি পর্যায়ের কাজ এখনও চলছে। এই কাজ শেষ হলে বৈদ্যুতিক যানের বৃহত্তম উৎপাদন কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটিতে রূপান্তরিত হবে এই কারখানটি।
এমন ভাবে কারখানটির নকশা করা হয়েছে, যাতে এটিকে একটি সম্পূর্ণ শহরের মতো আকার দেওয়া যায়। অর্থাৎ সেখানে কর্মীরা থাকবেন এবং কাজও করবেন। এটি একটি ছোট ইউরোপীয় শহরের মতো, যেখানে আবাসস্থল, বিনোদন এলাকা সংযুক্ত করা হয় বলে জানা গিয়েছে।
চিনের সংবাদমাধ্যম ‘চায়না ডেলি’র মতে, ফেব্রুয়ারির শুরুতে প্রায় ৬০ হাজার কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিওয়াইডি নামের সংস্থাটি ২০২৫ সালের প্রথম দিকে আরও ২০ হাজার কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে বলেও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্বব্যাপী ৯ লক্ষ কর্মী নিয়ে ঢেলে সাজছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক বাজারে টেসলার সঙ্গে টক্কর দিতে কোমর বেঁধে নামছে চিনা সংস্থাটি। উৎপাদন ও মার্কেটিং অবিচ্ছিন্ন রাখতেই এই ব্যবস্থা। নিয়োগ বৃদ্ধিতে এই সংস্থা এতটাই আগ্রহী যে, তারা চাকরিপ্রার্থীদের জন্য জিনিসপত্র রাখার সুবিধা-সহ একটি পৃথক নিয়োগ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। নিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুততর করতেই এই পদক্ষেপ।
সাক্ষাৎকার এবং চিকিৎসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা যাতে দ্রুত চুক্তি স্বাক্ষর করে সংস্থার ডরমিটরিতে থেকে কাজ শুরু করতে পারেন, তার সমস্ত ব্যবস্থা সেরে রাখছে তারা। কর্মীদের অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা এবং ক্যান্টিনে ভর্তুকিযুক্ত খাবার।
ব্যাটারিচালিত গাড়ির বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য আমেরিকার সংস্থা টেসলার। বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রিক গাড়ির বাজারে রকেটের গতিতে এগোচ্ছে এই সংস্থার ব্যবসা। মার্কিন সংস্থা টেসলাকে ধরাশায়ী করতে একগুচ্ছ নতুন মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে আনতে চলেছে তারা।
শেনঝেনের এই সংস্থা ১৯৯৫ সাল থেকে মোবাইল ফোনের ব্যাটারি তৈরি করে। ২০০০ সালে তারা গাড়ির ব্যাটারি তৈরির কাজে হাত দেয়। সস্তায় ব্যাটারি বিক্রি করে গ্রাহকদের পেট্রলচালিত গাড়ি থেকে সরিয়ে ব্যাটারিচালিত গাড়ির দিকে টানে এই সংস্থা। তাতে সফলও হয়।
ক্রমেই নিজেদের গাড়ির মান উন্নত করেছে বিওয়াইডি। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাদের লাভের অঙ্ক। পরিসংখ্যান বলছে চিনের যে তিনটি ইভি প্রস্তুতকারক সংস্থা বর্তমানে লাভের মুখ দেখেছে সেগুলি হল, বিওয়াইডি, লি অটো এবং হুয়াওয়ে টেকনোলজিস।
গত বছরের শেষ দিকে হাইব্রিড মডেলের ইভির দাম হ্রাস করে দুনিয়ার অন্যতম বড় ইভি প্রস্তুতকারী চিনা সংস্থা বিওয়াই়ডি। সিলিয়ন-০৫ মডেলের বৈদ্যুতিন এসইউভির দাম ১১.৫ শতাংশ কমিয়ে দেয় তারা। ফলে চিনে ওই গাড়িটির দর কমে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ৮০০ ইয়েন। ২০২৩ সালের প্রথম ছ’মাসে সংস্থার লাভের পরিমাণ ১৯২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২২৫ শতাংশ।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইভি রফতানির পরিমাণ ৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে চিন। মোট ১২ লক্ষ ৮০ হাজার বৈদ্যুতিন গাড়ি বিদেশে পাঠিয়েছে বেজিং।
চিনেও বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবহার। গত বছর চিনে যেখানে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশ ব্যাটারিচালিত, সেখানে গোটা পৃথিবীতে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার ১৩ শতাংশ ব্যাটারিচালিত। ২০২২ সালে ইউরোপে ৮ লক্ষ ৫০ হাজার ব্যাটারিচালিত গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। এর অর্ধেকেরও বেশি এসেছে চিন থেকে।
দূষণ এবং জ্বালানির খরচ কম হওয়ার কারণে ভারতেও ক্রমে ইভি বা বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বাড়ছে। ভারতের গাড়ির বাজার ধরতেও উঠেপ়়ড়ে লেগেছে বিওয়াইডির শাখা বিওয়াইডি ইন্ডিয়া। চাহিদার কথা মাথায় রেখে তারা এ দেশে বৈদ্যুতিক যাত্রী গাড়ির বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখলের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল ২০২৩ সালে।
চেন্নাইয়ের কারখানায় চিন থেকে আনা যন্ত্রাংশ জুড়ে বৈদ্যুতিক যাত্রী গাড়ি তৈরি করছে বিওয়াইডি। ২০২২ সালে একটি মডেলেরই ৭০০টি গাড়ি বিক্রির করে সংস্থাটি। সংস্থার এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ২০৩০ সালে মোট গাড়ির ৩০ শতাংশ হবে বৈদ্যুতিক। তাঁদের লক্ষ্য তার ৪০শতাংশ দখল করা।
কারখানাটি তৈরির পর বিওয়াইডি এই মেগা উৎপাদনকেন্দ্রটি থেকে বছরে ১০ লক্ষ গাড়ি উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানা গিয়েছে। বিওয়াইডির সাফল্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে খনিজ উত্তোলনকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্কে। ব্যাটারি তৈরিতে দরকার হয় লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ। এগুলো যারা উত্তোলন করে, তারা সম্পূর্ণ ভাবে বিওয়াইডির নিয়ন্ত্রণে।