রাতের অন্ধকারে কিভের একটি তিনতলা আবাসনের বেসমেন্টে জেগে এক দল তরুণ-তরুণী। যুদ্ধকালীন গতিতে তৈরি করে চলেছেন মলোটভ ককটেল।
শুধুমাত্র রাজধানী কিভই নয়। গোটা ইউক্রেন জুড়ে লোকজনের হাতে হাতে ঘুরছে এই ককটেল। রাশিয়ানদের ঠেকাতে ইউক্রেনীয়দের নয়া অস্ত্র!
না! এটি কোনও পানীয় নয়। বরং বোতলবন্দি দাহ্য তরল। একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে ওই বোতলের মুখ বন্ধ করা থাকে। প্রয়োজনে সেই কাপড়ের টুকরোয় আগুন ধরিয়ে জ্বলন্ত বোতল ছুড়ে ঘায়েল করা যায় শত্রুপক্ষকে। খানিকটা বোতল-বোমার মতো এই অস্ত্রেই কিভের রাস্তায় রাশিয়ার একাধিক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দিয়েছেন স্থানীয়রা।
কিভের বেসমেন্টে আজকাল রাত জাগছেন ওলগা (নাম পরিবর্তিত)-ও। সপ্তাহ দুয়েক আগে একটি বেসরকারি সংস্থায় প্রজেক্ট ম্যানেজারের চাকরি ছেড়েছেন। সোমবার থেকে তাঁর নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তবে শিয়রে এখন শত্রুর ছায়া! তাই সে সব ছেড়েছুড়ে ওলগাও যোগ দিয়েছেন মলোটভ ককটেল প্রস্তুতকারীদের দলে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের আট থেকে আশির মতো তিনিও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চান। ওলগা বলেন, ‘‘নতুন চাকরির থেকেও এটা জরুরি।’’
বৃহস্পতিবার ইউক্রেন আক্রমণের পর ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাধারণ নাগরিককে আহ্বান জানিয়েছে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। পুতিনবাহিনীর যাবতীর পদক্ষেপে সতর্ক থাকার পাশাপাশি মন্ত্রকের আহ্বান— ‘মলোটভ ককটেল তৈরি করে শত্রুকে প্রতিরোধ করুন!’
শুধুমাত্র মলোটভ ককটেলই নয়। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আর্জি, ‘গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করে দিন। বাড়ির দরজায় জাল লাগিয়ে রাখুন। যদি জানতে পারেন যে রাশিয়ার সেনারা জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছে, তবে গোটা জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিন। শত্রুর হাড়ের উপর দিয়ে আবারও গাছ গজিয়ে উঠবে।’’
সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন সাধারণ ইউক্রেনীয়রা। পুতিনবাহিনীর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে তাঁরাও যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছেন। তবে গোপনে।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর দাবি, ইউক্রেনে হামলার পর থেকেই গত কয়েক ঘণ্টায় ‘মলোটভ ককটেল’ তৈরিরর প্রক্রিয়া খুঁজতে শুরু করেছেন সাধারণ ইউক্রেনীয়রা। গুগ্লে সকলেরই প্রশ্ন— ঘরে বসে কী ভাবে তৈরি করা যায় মলোটভ ককটেল?
আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের দাবি, শনিবার পর্যন্ত পুতিনবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ইউক্রেনের ১৯৮ জন জাতীয় নিরাপত্তারক্ষী। এ ছাড়া, নিহত হয়েছেন ৩৩ শিশু-সহ এক হাজার ১১৫ জন নাগরিকও।
কিন্তু সড়কপথে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এই ঘরোয়া অস্ত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কি সম্ভব? নিউ ইয়র্কের মর্ডান ওয়ার ইনস্টিটিউট-এর আর্বান ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ-এর প্রধান জন স্পেনসারের মতে, যুদ্ধের ময়দানে প্রতিটি ক্ষুদ্র প্রতিরোধ একত্রে হলে তা কার্যকর হতে পারে।
স্পেনসার বলেন, ‘‘সেনাবাহিনী কতটা শক্তিশালী, তা শহুরে ভূখণ্ডে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুদ্ধের কৌশলে অপটু ব্যক্তিও পাশা পাল্টে দিতে পারেন।’’ তিনি বলেন, ‘‘একটি গোটা জাতি যখন যুথবদ্ধ হয়ে সেনানিদের পথে বাধার সৃষ্টি করে এবং তাদের রসদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তখন সেটা ফাঁদ হয়ে যায়।’’
এ ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালের ‘হোম অ্যালোন’ সিনেমার উদাহরণ টেনে এনেছেন স্পেনসার। তিনি বলেন, ‘‘ঠিক যেমন ‘হোম অ্যালোন’ ছবিতে হয়েছিল। বাড়িতে একলা হয়ে যাওয়ার পর শত্রুপক্ষকে একের পর এক ফাঁদ পেতে ঘায়েল করেছিল এক নিরস্ত্র নাবালক।’’
শত্রুদের ঘায়েল করতে কী ভাবে মলোটভ ককটেল তৈরি করছেন ইউক্রেনীয়রা? পরিচয় গোপন রেখে এক ইউক্রেনীয় আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, স্টাইরোফোমের টুকরো ভেঙে তার সঙ্গে নুড়িপাথর একটি বোতলে ঢুকিয়ে তাতে দাহ্য মিশ্রণ ঢেলে দেওয়া হয়।
কী থাকে ওই মিশ্রণে? বিয়ার, জিন, ওয়াইনের সঙ্গে মেশানো হয় সিরাপ-চিনি-নানা ফলের রসযুক্ত সানগ্রিয়া। এর পর ওই মিশ্রণটিতে ঢালা হয় জ্বালানী এবং তেল। এর পর তা বোতলে ভরে তার মুখে তা পর্দার বা রুমালের টুকরো গুঁজে দেওয়া হয়। বোতল ছোড়ার পর সেটি ফিউজের কাজ করে। এর পর ওই কাপড়ের টুকরোয় কিছুটা অংশ সলতের মতো পাকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে মলোটভ ককটেল ছুড়ে দেওয়া হয়।
পুতিনের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ভাবেই সরাসরি যুদ্ধে নেমেছেন ইউক্রেনীয়রা। একে তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ বলতে চান। এই যুদ্ধের ছবিতে ছয়লাপ নেটমাধ্যম।
যুদ্ধে যে তাঁদের জয় নিশ্চিত, তা মনে করছেন বহু ইউক্রেনীয়। টুইটারে এক জনের মন্তব্য, ‘দেশকে বাঁচাতে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন ৮০ বছরের ইউক্রেনীয়ও। মলোটভ ককটেল তৈরি করে যুদ্ধ করছেন তিনি। দু’জন প্রাক্তন বক্সিং চ্যাম্পিয়নও ময়দানে নেমেছেন। মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা করতে প্রেসিডেন্ট (ভোলোদিমির) জেলেনস্কি নিজের জীবন বিপন্ন করছেন। পুতিন জিততে পারবেন না!’