ভোর ৫টা ৫৫ মিনিট। তখনও ঘুমের ঘোর কাটেনি ইউক্রেনের। তখনও সে দেশের অনেকেই জানেন না, জল-স্থল-বায়ুপথের ত্রিমুখী হানায় ইউক্রেনে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
২৪ ফেব্রুয়ারির ভোর থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে লাগাতার হামলায় নানা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র কাজে লাগিয়েছে পুতিনবাহিনী। সেগুলির কোনওটি আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের নিশানাকে উড়িয়ে দিতে পারে। কোনওটি আবার ৫০০ কিলোমিটারের দূরত্ব পর্যন্ত উড়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারে।
পরমাণু শক্তিধর দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেশ বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন। সেনাদের পাশাপাশি লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আমজনতার অনেকেই। পুতিনবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির অস্ত্রভান্ডারও হেলাফেলার নয়।
সংসাদ সংস্থা রয়টার্সের দাবি, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে কৌশলী রাশিয়াকে দেখা গিয়েছে। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনাঘাঁটিগুলিকে নিশানা করেছে রাশিয়া। এর পরের ধাপে স্থলপথে আক্রমণের পন্থা বেছে নিয়েছে পুতিনবাহিনী। তৃতীয় ভাগে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিকে দখলের পথে নেমেছে তারা। যদিও এখনও পর্যন্ত বন্দরশহর খারসন ছাড়া ইউক্রেনের কোনও শহর কব্জা করতে পারেনি রাশিয়া।
কোন কোন অস্ত্র নিয়ে ময়দানে নেমেছে পুতিনবাহিনী? জেলেনস্কির আস্তিনেই বা কী কী অস্ত্র রয়েছে?
রাশিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৯কে-৭২০ ইসকান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এসআরবিএম)। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শ’য়ে শ’য়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে রাশিয়া। ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের লক্ষ্যে আঘাত হানতে এ অস্ত্র কাজে লাগাচ্ছে তারা। স্বল্প দৈর্ঘ্যের হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী। নিশানাও প্রায় অব্যর্থ। অভিযোগ, সেনাঘাঁটির ছাড়াও ইউক্রেনীয় নাগরিকের ঘরবাড়ি, হাসপাতাল বা স্কুলগুলিকে এই অস্ত্রেই ধ্বংস করেছেন পুতিনের সেনারা। এর ঘায়ে নিহত হয়েছেন বহু নাগরিক।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের নয়, এই ক্ষেপণাস্ত্র হানা দিতে পারে আড়াই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। জল থেকে স্থথপথের হানায় পুতিনবাহিনীর অন্যতম মারণাস্ত্র ৩এম-১৪ ক্যালিবার ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র (এলএসিএম)। যুদ্ধবিশারদদের দাবি, ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় এই অস্ত্র দিয়েই লাগাতার হামলা করেছে রাশিয়ার বায়ুসেনা।
পুতিনের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে আরও মাল্টিব্যারেল রকেটলঞ্চার— টিওএস-১ (হেভি ফ্লেমথ্রোয়ার সিস্টেম)। এটি প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত হামলা চালাতে সক্ষম। রকেটের মাধ্যমে যথেচ্ছ ভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। ওই রকেটের মাথায় থাকে থার্মোবারিক ওয়ারহেডস।
এ যুদ্ধে স্থলপথে যথেচ্ছ আক্রমণে টি-৯০ মেন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এবং টি-৭২ বিএম৩ ব্যাটল ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে রাশিয়া। যদিও ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের জেরে এখনও পর্যন্ত খুব একটা সফল হয়নি এই দুই অস্ত্র।
জেলেনস্কির দেশে যে গতিতে যুদ্ধে এগোচ্ছে, তাতে নাকি সন্তুষ্ট নন পুতিন। সোমবার এক বিবৃতিতে ন্যাশনাল গার্ড অব রাশিয়ার প্রধান ভিক্টর জলোটভ স্বীকার করেছেন যে যুদ্ধের গতি আশাতীত ভাবে শ্লথ। এর পিছনে ইউক্রেনের পাল্টা প্রতিরোধও দায়ী। রাশিয়াকে রুখতে কী কী অস্ত্রশস্ত্র ময়দানে নামিয়েছেন জেলেনস্কি?
ইউক্রেনের কাছে রয়েছে বেরাখটার টিবি২ ড্রোনের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র। তুরস্কের প্রযুক্তিতে তৈরি এই ড্রোন প্রায় সাতাশ ঘণ্টা আকাশপথে নজরদারি চালাতে সক্ষম। রাশিয়ার সেনাদের নিশানা করতে যথেচ্ছ ভাবে এই ড্রোন ব্যবহার করেছে ইউক্রেন।
জেলেনস্কির সেনানিদের কাছে রয়েছে আরও অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। আমেরিকার থেকে কেনা সে অস্ত্র হল এফজিএম-১৪৮ জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র। নামের মতোই কাজ। জ্যাভেলিনের মতো উড়ে প্রায় চার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত নিখুঁত ভাবে নিশানাভেদ করতে সক্ষম এটি। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম বিধ্বংসী এই অস্ত্রে বহু রাশিয়ান সাঁজোয়া গাড়ি গুঁড়িয়ে গিয়েছে বলে দাবি।
অত্যাধুনিক রূপের লাইট অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ওয়েপন (এএলএডব্লিউ)-কে এ যুদ্ধের ময়দানে নামিয়েছে ইউক্রেন। প্রায় ৮০০ মিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যভেদে সক্ষম এই অস্ত্র আানা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। এটিও শত্রুপক্ষের সাঁজোয়া গাড়ি ওড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকদের দাবি, ইউক্রেনের আকাশপথে লাগাতার বিমানহানা সত্ত্বেও তেমন ভাবে সফল হতে পারেনি রাশিয়া। এর পিছনে স্টিঙ্গার সারফেস-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের ভূমিকা কম নয়। পশ্চিমী দেশগুলির থেকে আমদানি করা এই অস্ত্রেই নাকি রাশিয়ার বহু হেলিকপ্টার উড়িয়ে দিয়েছে ইউক্রেন। আট কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের থাকা লক্ষ্যে আঘাত করতে পারদর্শী এই মারণাস্ত্র।