অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্য তখন অস্তমিত। পূর্ব ইউরোপের দেশটির গায়ে লাগল ‘রুগ্ন মানুষ’-এর তকমা। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক— সব ক্ষেত্রেই সে দেশে তখন চলছে মারাত্মক অস্থিরতা। সেই জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল বসফরাস প্রণালীর তীরের ওই রাষ্ট্র। ফৌজি হানাদার ড্রোন বানিয়ে আমেরিকা, রাশিয়া, চিন-সহ গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা।
একরকম খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো দেশটি হল এশিয়া মাইনরের তুরস্ক। ১৯ শতকে যাকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি বা রাশিয়ার মতো ইউরোপের প্রবল প্রতাপশালী দেশগুলি। ২০ শতকের মধ্য ভাগে আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে চলা ‘শীতল যুদ্ধ’-এর সময়েও তুরস্কের নাম সে ভাবে কাউকে নিতে দেখা যায়নি।
কিন্তু, ২১ শতকে পা দেওয়ার পর নতুন করে সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে কামাল আতাতুর্কের দেশ। জোর দেয় মানববিহীন উড়ুক্কু যান নির্মাণে। যার পোশাকি নাম ‘ড্রোন’। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এ ব্যাপারে ইহুদিদের সাহায্য চেয়েছিলেন তুর্ক যোদ্ধারা।
উন্নত ফৌজি ড্রোন তৈরি করে দুনিয়ায় প্রথম বার চমকে দিয়েছিল ইজ়রায়েল। শত্রুতা ভুলে পশ্চিম এশিয়ার সেই ইহুদি রাষ্ট্রের থেকে মানববিহীন উডুক্কু যান কেনার আগ্রহ ছিল তুরস্কের। সব যখন প্রায় ঠিক, তখনই বাদ সাধল ইজ়রায়েলের দেওয়া শর্ত। ফলে বাতিল হয় ওই ড্রোন চুক্তি।
সেনা ড্রোন বিক্রির ক্ষেত্রে ইজ়রায়েল শর্ত দিয়েছিল, তাঁদের ফৌজিরাই সেগুলিকে পরিচালনা করবে। কারণ মানববিহীন এই হাতিয়ার আকাশে ওড়ানোর মতো ক্ষমতা বা প্রশিক্ষণ নেই তুরস্ক বাহিনীর। এ হেন শর্তে আঙ্কারের গায়ে যে জ্বলুনি হবে, তা বলাই বাহুল্য। বাস্তবে হয়েছিলও তাই।
ইজ়রায়েলের সঙ্গে চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরই ঘরের মাটিতে সামরিক ড্রোনের হাব তৈরির পরিকল্পনা করে ফেলে তুরস্ক। যাতে মিশে ছিল ইহুদিদের অপমানের মুখের মতো জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা। সেখানকার প্রযুক্তিবিদ ও প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় কয়েক দশকের মধ্যে সবাইকে ছাপিয়ে যায় ইউরোপ-এশিয়ার সঙ্গমস্থলের এই দেশ।
সম্প্রতি, তুরস্কের সামরিক ড্রোন নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’ (সিএনএএস) নামের একটি সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, ফৌজি ড্রোনের ব্যাপারে আমেরিকা, চিন ও ইজ়রায়েলের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে আঙ্কারা। যা যে কোনও যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিতে পারে।
রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, ২০১৮ সালে আমেরিকা, চিন ও তুরস্ক যৌথ ভাবে ৪০টি দেশে ৬৯ ধরনের হাতিয়ার যুক্ত ড্রোন বিক্রি করেছিল। তার পর থেকে বিভিন্ন দেশের আঙ্কারার মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির উপর নজর পড়ে। ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে ড্রোনের বাজারে ‘বড় খেলোয়াড়’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এশিয়া মাইনরের এই দেশ।
আমেরিকান সংস্থা সিএনএএসের দাবি, ২০১৮ সালের পর থেকে হাতিয়ার যুক্ত সামরিক ড্রোন বাজারের ৬৫ শতাংশ তুরস্কের দখলে চলে গিয়েছে। ২৬ শতাংশ রয়েছে চিনের হাতে। সেখানে আমেরিকা ড্রোন বাজারে জায়গা পেয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।
তুরস্কের ড্রোনের চাহিদা বৃদ্ধির নেপথ্যে মূল কারণ হিসাবে এর সস্তা দরকে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ড্রোনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং যুদ্ধের সময়ে হামলার পদ্ধতিও খুবই সরল। যা ফৌজি জেনারেলদের সহজেই আকৃষ্ট করছে।
আঙ্কারা নির্মিত ড্রোনগুলির মধ্যে আবার ‘বের্যাকটার টিবি-২’-এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে ছ’টি নতুন দেশকে যা বিক্রি করেছে প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান সরকার। সূত্রের খবর, এশিয়া এবং ইউরোপের আরও কিছু দেশ এই মানববিহীন উডুক্কু যানগুলি কেনার ব্যাপার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বের্যাকরা টিবি-২ পুরোপুরি হাতে পাওয়ার পর তা বিদ্রোহী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’-র উপর প্রয়োগ করা শুরু করে তুরস্কের সেনাবাহিনী। ২০২০ সালে নাগোরনো-কারাবাখের অধিকার নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। যার ফলাফল আজ়ারবাইজানি বাহিনীর অনুকূলে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা পালন করেছিল এই তুর্কি ড্রোন।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ফের খবরের শিরোনামে চলে আসে বের্যাকটার টিবি। তুরস্কের এই ড্রোন দিয়ে রুশ ফৌজের মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম হয় ইউক্রেনীয় সেনা। লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ড্রোনগুলি হামলা চালায় মস্কোতেও। কিছু ক্ষেত্রে যা ‘বায়ু প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ও রাডারকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম হয়েছে।
এই তিনটি সংঘর্ষ বাদ দিলে লিবিয়ার যুদ্ধেও ব্যবহার হয়েছে বের্যাকটার টিবি। ২০১৪ সালে ড্রোন বিক্রিতে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে ছিল চিন। নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধের পর ২০২১ সালে সেই জায়গা ছিনিয়ে নেয় তুরস্কের বের্যাকটার টিবি। আর অনেকটা পিছিয়ে পড়ে আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইজ়রায়েল।
সিএনএএসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের পর থেকে আফ্রিকার বহু দেশে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে সক্ষম বের্যাকটার টিবি সরবরাহ করেছে তুরস্ক। যা সেখানকার গৃহযুদ্ধকে আরও রক্তক্ষয়ী করছে। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকার ওই সংস্থা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, তুরস্কের এই বের্যাকটার টিবি ড্রোনটিকে পছন্দ করে আমেরিকার তৈরি শক্তিজোট ‘নেটো’ ভুক্ত রাষ্ট্রগুলিও। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের চারটি এবং নেটোর ছ’টি দেশের অস্ত্রাগারে এই ড্রোন আছে বলে জানা গিয়েছে।
২০২৩ সালে তুরস্কের থেকে এই ড্রোন কেনে পাকিস্তান। যা সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ১ হাজার ৩০০ কেজি ওজন নিয়ে দিব্যি দীর্ঘ সময় আকাশে ভেসে থাকতে পারে এই ড্রোন।
ভারতীয় সেনার হাতে নেই তুরস্কের বের্যাকটার টিবি। তবে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে স্থলবাহিনী। যার পোশাকি নাম ‘নাগাস্ত্র’। এ ছাড়া আমেরিকার থেকে ৩১টি ‘এমকিউ-১ প্রিডেটর’ নামের মানববিহীন হাতিয়ার যুক্ত উড়ুক্কু যান কিনেছে নয়াদিল্লি। যাকে এখনও পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম উন্নত ড্রোন বলে মনে করেন সমর বিশেষজ্ঞেরা।