একাদশ-দ্বাদশ শতকে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন তাঁরা। সিসিলি থেকে আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত ছিল তাঁদের দাপট। ক্রমেই আড়েবহরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাঁদের বাহিনী। পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল সম্পত্তি। আচমকাই ফরাসি সম্রাটের রোষে পড়ে তাঁদের পতন। কোথায় গেলেন সেই নাইট টেম্পলাররা? কোথায়ই বা গেল তাঁদের সেই অগাধ সম্পত্তি?
নাইট টেম্পলারদের ‘সলোমনের মন্দিরের সেনা’ও বলা হত। মনে করা হয় ১১১৯ সাল নাগাদ ক্যাথলিক পুরুষদের নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। এঁদের সদর দফতর ছিল জেরুজালেমের টেম্পল পাহাড়ে। সে কারণেই সম্ভবত এদের ‘নাইট টেম্পলার’ বলে ডাকা হত। প্রায় দু’শো বছর টেম্পলারদের দাপট বজায় ছিল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকায়।
সরকারি ভাবে এই নাইট টেম্পলারদের নিয়োগ করেছিল ক্যাথলিক গির্জা। এদের গায়ে থাকত সাদা রঙের কেপ বা জোব্বার মতো পা পর্যন্ত লম্বা পোশাক। তাতে আঁকা থাকত লাল ক্রস।
এই নাইট টেম্পলাররা ধর্মযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী দেশগুলির অর্থনীতিতে তাঁদের বড় ভূমিকা ছিল। তাঁরাই পৃথিবীতে প্রথম ব্যাঙ্কিং প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। গোটা ইউরোপ জুড়ে চলতে তাঁদের এই ব্যাঙ্কিং প্রক্রিয়া।
কেন এই বাহিনী তৈরির প্রয়োজন পড়েছিল? প্রথম ধর্মযুদ্ধের পর জেরুজালেম সুরক্ষিত ছিল। সেখানে ক্ষমতায় ছিলেন খ্রিস্টান সম্রাট। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার বাকি দেশগুলি ততটা সুরক্ষিত ছিল না। এ দিকে ইউরোপ থেকে জেরুজালেমে তীর্থ করতে আসতেন বহু মানুষ। তাঁরা পথে চোর-ডাকাতের কবলে পড়তেন। অর্থের সঙ্গে প্রাণও যেত।
১১১৯ সাল নাগাদ ফরাসি নাইট ইউ দ্য পায়েঁ জেরুজালেমের সম্রাট এবং লাতিন পালকের কাছে একটি প্রস্তাব রাখেন। জেরুজালেমের সম্রাট তখন দ্বিতীয় বল্ডউইন। ফরাসি নাইটরা জানান, তাঁরা খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের রক্ষার জন্য বাহিনী তৈরি করতে চান।
১১২০ সাল নাগাদ সম্রাট সায় দেন। টেম্পল পাহাড়ের প্রাসাদে ওই বাহিনীর সদর দফতর গড়ে দেন সম্রাট বল্ডউইন। প্রচলিত ধারণা রয়েছে, এই টেম্পল পাহাড়েই রয়েছে সলোমনের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বাহিনীর নাম হয় ‘পুয়োর নাইটস অব ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব সলোমন’।
অনুদানেই বাড়তে থাকে বাহিনী। নাইট টেম্পলারের প্রতীক ছিল, একটি ঘোড়ায় বসে রয়েছেন দু’জন নাইট।
প্রাথমিক ভাবে পুণ্যার্থীদের রক্ষার জন্য এই বাহিনী তৈরি হলেও ক্রমেই আর্থিক পরিকাঠামো রক্ষার বিষয়েও বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই কাজেও নিযুক্ত হয়েছিলেন হাজার হাজার নাইট।
কী ভাবে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এই নাইট টেম্পলাররা? দ্বাদশ শতকে অনেক খ্রিস্টানই ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যেতেন। যাওয়ার আগে নিজেদের সম্পত্তি এই টেম্পলারদের কাছে রেখে যেতেন। বদলে নিয়ে যেতেন ক্রেডিট নোট। যুদ্ধ থেকে ফিরে সেই নোট দেখালে হাতে পাওয়া যেত সম্পত্তি।
পুণ্যার্থীরাও একই কাজ শুরু করলেন। দ্বাদশ শতকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, রোম থেকে খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে যেতেন। অর্থ, ধনরত্ন নিয়ে গেলে পথেই ছিনতাই হয়ে যেত। তাঁরা যাত্রার শুরুতে টেম্পলারদের কাছে সেই অর্থ জমা রাখতে শুরু করলেন। বদলে নিয়ে যেতেন ক্রেডিট নোট। তাতে টেম্পলারদের স্ট্যাম্প লাগানো হত।
পথের মাঝে টাকার প্রয়োজন হলে কোনও টেম্পলারকে ওই ক্রেডিট নোট দেখালেই নেওয়া যেত প্রয়োজন মতো টাকা। গন্তব্যে পৌঁছেও প্রয়োজন মতো টাকা তোলা যেত। মনে করা হয়, এখান থেকে পরে চেক ব্যবস্থার সূত্রপাত। এর ফলে পথে ডাকাতদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন না পুণ্যার্থীরা। উল্টো দিকে সেই টাকা ধীরে ধীরে বিনিয়োগ শুরু করেন টেম্পলাররা। ধার দিতে শুরু করেন ব্যবসায়ী, জমিদারদের।
গচ্ছিত টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি বহু অনুদানও পেতেন টেম্পলাররা। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা তাঁদের অনুদান দিতেন। ইউরোপ জুড়ে বিঘার পর বিঘা জমি অধিকার করেছিলেন তাঁরা। চাষের জমি, বাড়ি, দুর্গ, আঙুর বাগিচাও দখলে এসেছিল তাঁদের। ক্রমে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন টেম্পলাররা।
চতুর্দশ শতকে পতন হয়েছিল এই বিশাল বাহিনীর। নেপথ্যে ছিলেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চম ফিলিপ। কথিত রয়েছে, টেম্পলারদের ধ্বংসের নেপথ্যে তাঁদের সম্পত্তিই কাল হয়েছিল।
কথিত, ফরাসি সম্রাট নিজেও নাকি টেম্পলারদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। সে সময়ই টেম্পলারদের থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, সে টাকা আর ফেরত দিতে হবে না।
অনেকে টেম্পলারদের পতনের জন্য পোপ পঞ্চম ক্লেমেন্ট এবং ফরাসি সম্রাটের বিরোধকে দায়ী করেন। অনেকে আবার মনে করেন, পোপের দুর্বল চরিত্রের জন্যই বলি হতে হয়েছিল টেম্পলারদের।
ফরাসি সম্রাট টেম্পলারদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে বিচার চালাতে থাকেন। ফ্রান্স জুড়ে টেম্পলারদের গ্রেফতারি শুরু হয়। তাঁদের বিনা বিচারে আটক করে জেলে ভরা হয়।
১৩১৪ সালে টেম্পলারদের প্রধান জাক দ্য মোল-সহ তিন নাইট নেতাকে পুড়িয়ে মারা হয় প্যারিসে। টেম্পলারদের সম্পত্তিও অধিকার করেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চম ফিলিপ। যদিও কয়েক মাস পরেই মৃত্যু হয় তাঁর। টেম্পলারদের ওই সম্পত্তি সম্রাটও ভোগ করতে পারেননি।
মনে করা হয়, সম্রাটের থেকে বাঁচিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিলেন টেম্পলাররা। বহু হিরে, জহরত, অর্থ সরিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। অনেকে মনে করেন, স্কটল্যান্ডের রোজ়েলিন চ্যাপেলে সে সব ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন নাইটরা। অনেকে মনে করেন, বাল্টিক সাগরের ড্যানিশ দ্বীপে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সে সব।
কেউ আবার বলেন, কানাডার নোভা স্কোটিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে সব ধনরত্ন। কী ভাবে, তা নিয়েও রয়েছে ধন্দ। যদিও এখনও সে সব উদ্ধার হয়নি। অনেকে আবার মনে করেন, টেম্পলাররা ফরাসি সম্রাটকে লুকিয়ে কিছুই সরাতে পারেননি। আসলে কী হয়েছিল, তা নিয়ে ধন্দ কাটেনি আজও।