সাধারণত যাঁদের উচ্চতা কম, তাঁদের ‘লিলিপুট’ বলে সম্বোধন করে ব্যঙ্গ করা হয়। এই তির্যক মন্তব্যের হাত থেকে রেহাই পাননি বলি অভিনেতা এমএম ফারুকিও। ৩ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এই অভিনেতা তাই নিজেই নিজের নাম বদলে ‘লিলিপুট’ রেখে দিয়েছিলেন।
মুম্বইয়ে আসার ১০ বছর পর জনপ্রিয় তারকাদের সঙ্গে একের পর এক হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন লিলিপুট। পর্দায় বেশির ভাগ সময় অভিনেতাকে কৌতুক চরিত্রেই দেখা যেত। ঋষি কপূর, রাজেশ খন্না, ধর্মেন্দ্র, কমল হাসনের মতো তারকাদের সঙ্গে তাঁকে এক সময় চুটিয়ে অভিনয় করতে দেখা গেলেও এখন তাঁকে ভুলে গিয়েছে বলিউড। ধার করে দিন কাটাচ্ছেন লিলিপুট।
বিহারের গয়ায় জন্ম লিলিপুটের। ছোট থেকেই তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্থিতিশীল ছিল না। এই পরিস্থিতি ভুলে থাকতে তিনি বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতেন। পড়াশোনাতেও মন ছিল না লিলিপুটের। তাঁর যখন ৬-৭ বছর বয়স তখন লিলিপুটের জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়।
লিলিপুট যে স্কুলে পড়তেন, সেখানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দুই অনুষ্ঠানের মাঝে সময়ের পার্থক্য তৈরি হওয়ায় শিক্ষক তাঁর হাতে মাইক ধরিয়ে মঞ্চে উঠিয়ে দেন। লিলিপুটও নিজের মনের মতো পারফর্ম করেন। সকলে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে বেজায় খুশি হন। লিলিপুট তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, তিনি অভিনয় করবেন।
স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে মুম্বই যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন লিলিপুট। মুম্বইয়ে লিলিপুটের এক বন্ধু থাকতেন। তিনি জানান যে, শহরে এলে তিনি লিলিপুটকে কাজ জোগাড় করে দিতে পারবেন। চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি গয়া থেকে ট্রেনে চেপে মুম্বই পাড়ি দেন। কিন্তু মুম্বই পৌঁছতেই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
লিলিপুটের বন্ধু স্টেশনে তাঁকে নিতে এসে জানান যে, তাঁর নিজেরই চাকরি চলে গিয়েছে। তাই তিনি লিলিপুটকে কোনও কাজ জোগাড় করে দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এ দিকে লিলিপুটও জেদ ধরে বসেছিলেন যে আর যা-ই হোক, তিনি আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। অচেনা শহর, হাতে টাকাপয়সাও তেমন নেই। এই অবস্থায় কখনও স্টেশনে, কখনও ফুটপাতে কখনও বা জুহু বাস স্ট্যান্ডে থাকতেন লিলিপুট।
মাত্র একটিই পোশাক ছিল লিলিপুটের সঙ্গে। সারা সপ্তাহ ওই পোশাক পরে থাকার পর প্রতি রবিবার রাস্তার শৌচালয়ে গিয়ে পরনের পোশাক কাচতেন। আবার ওই ভেজা জামা পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন লিলিপুট। রোদের তেজে জামা শুকাতেন তিনি। কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি।
হঠাৎ এক দিন এক দোকানের সামনে লিলিপুটের সঙ্গে এক অপরিচিত ব্যক্তির আলাপ হয়। তিনি লিলিপুটকে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। লিলিপুটও তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। নাটকে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতেন তিনি। অভিনয়ের গুণে কিছু দিনের মধ্যেই লিলিপুটকে নাটকের দলে সদস্য হিসাবে যোগ করা হয়। শুধু অভিনয় নয়, সংলাপ লেখা, এমনকি নাটকের গল্প লেখার দায়িত্বও দেওয়া হয় লিলিপুটকে।
দিনের বেলায় নাটকের করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য রাতে দিনমজুরের কাজ করতেন লিলিপুট। কাজের ফাঁকে নাটকের জন্য লেখালেখিও করতেন তিনি। এত পরিশ্রম করেও মাসে হাজার দেড়েক টাকার বেশি আয় করতে পারতেন না তিনি। কিন্তু সেই পথও বন্ধ হয়ে যায়।
লিলিপুটের লেখা গল্প শুনে অনেকে বলতেন, এই গল্প অন্য কোনও নাটকের দল আরও বেশি টাকা দিয়ে কিনত। লিলিপুট যে নাটকের দলে কাজ করতেন, সেই দলের মালিকের কাছে এই খবর পৌঁছে যায় এবং লিলিপুটকে দল থেকে বার করে দেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই লিলিপুটের অভিনয় দক্ষতা অনেকের নজরে পড়ে গিয়েছিল।
পৃথ্বী থিয়েটারে একটি নাটকে অভিনয় করার সময় লিলিপুট সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৮৫ সালে ‘সাগর’ ছবিতে প্রথম বার বড় পর্দায় দেখা যায় তাঁকে। তার পর ‘হুকুমত’, ‘আন্টি নম্বর ১’, ‘জ়খমো কা হিসাব’ ছবিতে কাজ করেন তিনি। ‘বান্টি অওর বাবলি’, ‘বিস্ট’ ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি।
শুধু তা-ই নয়, দূরদর্শনের বিখ্যাত ‘ইন্দ্রধনুশ’ ধারাবাহিক থেকে শাহরুখ খান অভিনীত ‘চমৎকার’ ছবির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বে ছিলেন লিলিপুট। এমনকি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘দেখ ভাই দেখ’-এর মজাদার সংলাপও তাঁর লেখা। বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর সময়ের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে। ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি থেকে কাজ কম পেতে শুরু করেন তিনি।
২০১৮ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় শাহরুখ খান, ক্যাটরিনা কইফ এবং অনুষ্কা শর্মা অভিনীত ‘জ়িরো’ ছবিটি। এই ছবিতে শাহরুখকে একটি বামনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। এই বিষয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন লিলিপুট।
লিলিপুটের অভিযোগ ছিল, যে ছবিতে বামনের ভূমিকা রয়েছে, সেই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বড় মাপের তারকাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ডাক পান না। বড় পর্দার পাশাপাশি টেলিভিশনের বিভিন্ন ধারাবাহিকে অভিনয় করা লিলিপুট বহু দিন অভিনয়জগৎ থেকে দূরে।‘মির্জাপুর’ ওয়েব সিরিজ়ে শেষ বারের মতো অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে লিলিপুটকে।
বর্তমানে তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ শোচনীয়। মেয়ের কাছে টাকা ধার চেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। এক সময়ের প্রতিভাবান লিলিপুটকে ভুলেই গিয়েছে বলিউড।