এমনিতে দু’দেশের সম্পর্ক ভাল নয়। সাম্প্রতিক অতীতে বার বার সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ভারত ও চিন। কিন্তু, বেশ খানিকটা সময় পিছিয়ে গেলে দেখা যায়, দুই সভ্যতার মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন বেশ দৃঢ়ই ছিল। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে চিন ও ভারত প্রাচীন কালে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
চিনের প্রায় সর্বত্রই বৌদ্ধ সংস্কৃতির চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। সে দেশের প্রাচীন ধর্ম কনফুসীয় মতবাদের সঙ্গে বৌদ্ধ দর্শনের আদান-প্রদানে এক বিশেষ সংস্কৃতির জন্ম হয়। বুদ্ধ চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এমনকি, চিনের লৌকিক দেবতাদের অনেকেই বৌদ্ধ দেবলোকে স্থান পান। এমন কিছু দেবমূর্তিকে চিনের মানুষ ‘বুদ্ধ’ বলে মানতে শুরু করেন, যাঁদের সঙ্গে শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থের কোনও সম্পর্কই নেই।
কিন্তু এ কথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, চিন এক সময় সার্বিক ভাবেই বুদ্ধ, ধম্ম ও সঙ্ঘকে মেনে নিয়েছিল। চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছিল বৌদ্ধ মঠ। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে কুষাণ আমলে সম্রাট কণিষ্কের কালেই জন্ম নেয় মহাযানবাদ। বৌদ্ধধর্মের এই রূপটি ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু কণিষ্কের বহু আগেই বৌদ্ধধর্ম যাঁর কল্যাণে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, তিনি মৌর্য সম্রাট অশোক। তাঁর ‘ধম্মবিজয়’ নীতির মূল কথাই ছিল প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিভিন্ন দেশে তিনি দূত প্রেরণ করেন। তাঁর উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয় বৌদ্ধ মঠ ও স্তূপ।
সম্রাট অশোকের অন্যতম কীর্তি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমানা বরাবর কিছু স্তম্ভ নির্মাণ। অশোক স্তম্ভগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার শীর্ষে থাকা সিংহের অবয়ব। বর্তমান উত্তরপ্রদেশের সারনাথে এক বৌদ্ধ বিহার ও স্তূপের ধংসাবশেষ রয়েছে। বৌদ্ধ সূত্র থেকে জানা যায়, সারনাথেই বুদ্ধদেব সর্বপ্রথম তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বা বলা ভাল, তাঁর নির্বাণ-জাত উপলব্ধিকে ব্যক্ত করেছিলেন। আদি বৌদ্ধ ধর্মে সারনাথ অতি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ হিসাবে পরিচিত। সম্রাট অশোক এখানে তাঁর অন্যতম স্তম্ভটি নির্মাণ করান। যার শীর্ষদেশের চারটি সিংহ স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক।
বর্তমান তিব্বত সংলগ্ন চিনের চিংহাই প্রদেশে অশোক একটি স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ স্তূপ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রতীক। প্রতিটিতেই বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষিত আছে। অশোক নির্মিত এই স্তূপও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সিল্ক রুট বা রেশম পথের উপর অবস্থিত চিংহাই। এই পথ দিয়েই চিনের সঙ্গে ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার বাণিজ্য চলত। কুষাণ আমলে এই অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষ প্রসার লাভ করে। (সঙ্গের ছবিটি সারনাথের স্তূপ ও বিহারের প্রত্নক্ষেত্রের)
কালের প্রলেপে চিংহাইয়ের বৌদ্ধ স্তূপ চাপা পড়ে যায়। ২০০৭ সালে চিন সরকার এবং মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের স্থানীয় শাখা দ্রুকপার প্রধান গ্যালওয়াং দ্রুকপার আগ্রহে ও তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য শুরু হয়। এই সময় নাংচেন নামক স্থানে এই স্তূপ ও সংলগ্ন বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা জানান, এই বিহার ও স্তূপ মৌর্য সম্রাট অশোকের কালে নির্মিত।
২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত খননকার্য চালিয়ে যে প্রত্নক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়, তার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয় এক ভারতীয় ভিক্ষুকে দিয়ে বৌদ্ধ আচার পালন করে। ভারত থেকেই যে বৌদ্ধ ধর্ম চিনে পোঁছেছিল, এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে তারই স্মারক বলে প্রচার করা হয়। (সঙ্গের ছবিটি প্রত্নক্ষেত্রের সাম্প্রতিক সময়ের)
স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে চিনে মোট ১৯টি স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। এর প্রতিটিতেই বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষিত হয়। তার মধ্যে নাংচেনের এই বিহার অন্যতম। এই বিহার তথা স্তূপকে তিব্বতী দ্রুকপা বৌদ্ধ এবং চিনের সংস্কৃতি মন্ত্রক বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখতে শুরু করে।
নাংচেনের এই প্রত্নক্ষেত্রে পরে একটি বুদ্ধমন্দির নির্মিত হয় এবং বুদ্ধের এক সুবিশাল মূর্তিও সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সম্রাট অশোকের স্মৃতিতে এখানে চিন সরকার একটি অশোক স্তম্ভ নির্মাণ করে। সারনাথের স্তম্ভের আদলেই নির্মিত হয় এই স্তম্ভ। এর চূড়ায় ভারতের জাতীয় প্রতীক চারটি সিংহ-সহ ধর্মচক্র ও অন্যান্য প্রতীক যথাযথ ভাবেই স্থান পায়।
বর্তমানে নাংচেনের এই বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। শুধু এই প্রত্নাবশেষ বা অশোক স্তম্ভ নয়, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও পর্যটকদের কাছে বিশেষ আবেদন রেখেছে। এলাকাটি ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য হোটেল এবং অতিথিশালা।