ভারত এবং পাকিস্তানের চিরন্তন দ্বন্দ্বের কথা কারও অজানা নয়। দুই দেশের সীমান্তে প্রায়ই অশান্তির আঁচ পাওয়া যায়। পারস্পরিক ‘শত্রুতা’র উত্তাপ পৌঁছয় খেলার মাঠেও।
তবে শুধু হিমালয়ের দক্ষিণে নয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন অনেক ‘ভারত-পাকিস্তান’ ছড়িয়ে আছে। প্রতিবেশী বা নিকটবর্তী দু’টি দেশের সম্পর্কের উত্তাপ যেখানে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। তার প্রভাব পড়ছে অন্য দেশেও।
পশ্চিম এশিয়ায় এমনই দুই ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ’ হল সৌদি আরব এবং ইরান। দু’টিই মুসলমান প্রধান দেশ। দুই দেশেই ইসলামকে সরকারি ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত সৌদি এবং ইরান।
গত ৪৪ বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ার এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত চলছে। যার সূত্রপাত ১৯৭৯ সালে। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ইরান এবং সৌদি আরব একের পর এক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। নানা বিষয়ে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সংঘাতের উত্তাপ ছড়িয়েছে পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলিতেও।
কী নিয়ে দ্বন্দ্ব পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই রাষ্ট্রের? ‘ইসলামের আঁতুড়ঘর’ সৌদির সঙ্গে ইরানের বিরোধের মূল কারণ কিন্তু ধর্মীয় মতভেদই। সৌদি আদ্যোপান্ত সুন্নি অধ্যুষিত দেশ। ইরানের অধিকাংশ বাসিন্দা শিয়া।
ইসলামের জন্ম সৌদি আরবেই। এই দেশ থেকেই ইসলাম ধর্ম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ইসলামি দুনিয়ায় প্রথম থেকেই সৌদির আধিপত্য সর্বজনস্বীকৃত।
সৌদির এই ইসলামি আধিপত্য প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ১৯৭৯ সালে। ওই বছর থেকেই ইরানে শিয়াপন্থী মুসলমানেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তাঁরা শিয়া আদর্শকে ইরানের গণ্ডির বাইরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
ইরান এবং সৌদির মধ্যবর্তী দেশ ইরাক। সেখানকার প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সুন্নি মতাবলম্বী। ১৯৮০ সালে তিনি শিয়া অধ্যুষিত পড়শি দেশ ইরান আক্রমণ করেন। শুরু হয় ইরাক-ইরান যুদ্ধ।
ইরাক এবং ইরানের মধ্যে যুদ্ধ চলেছিল দীর্ঘ আট বছর। ওই যুদ্ধে ইরাকের পাশে দাঁড়িয়েছিল সৌদি আরবও। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইরান।
২০০৩ সালে পশ্চিম এশিয়ার এই ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিতে শামিল হয় আমেরিকা। তারা ইরাক আক্রমণ করে। সেই থেকে ইরাকে শিয়াপন্থী শাসক বসানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শিয়া অধ্যুষিত কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম ইরাক।
ইরাকের মসনদে বসা শিয়াপন্থী সরকার ২০০৬ সালে সাদ্দামের ফাঁসির হুকুম দেয়। সেই সিদ্ধান্তে উৎসব পালন করেছিল ইরানবাসী। যা ভাল চোখে দেখেনি সৌদি।
সৌদি এবং ইরানের পারস্পরিক সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে গত ১৫ বছরে। দু’টি দেশই পশ্চিম এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী। ওই এলাকার অন্য ছোট দেশগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করতে মরিয়া উভয়েই।
সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরিনের মতো ছোট দেশগুলিতে শিয়া এবং সুন্নি মতাদর্শের প্রভাব বিস্তার করতে দীর্ঘ দিন ধরে সচেষ্ট ইরান এবং সৌদি। তারা অন্য কোনও দেশের ঘনিষ্ঠ হতে গেলেই চড়তে থাকে উত্তাপের পারদ।
বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং বাহরিন সম্পূর্ণরূপে সৌদি আরবের সমর্থক। তবে ইরাকের সরকার ইরানের পক্ষে। এ ছাড়া, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনের সমর্থন দুই দেশের পক্ষে দ্বিধাবিভক্ত।
সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বরাবর রাশিয়ার সমর্থন এবং সাহায্য পেয়ে এসেছে ইরান। অন্য দিকে, আমেরিকা সাহায্য করে সৌদিকে। ফলে পশ্চিম এশিয়ার দুই দেশের দ্বন্দ্ব বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ দু’টির মদতেই পরিপুষ্ট হয়ে আসছে।
সম্প্রতি, ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বে নাক গলিয়েছে চিন। শুধু তাই নয়, দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তিও স্থাপিত হয়েছে বেজিংয়ের মধ্যস্থতায়। যা পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
গত ১০ মার্চ ইরান এবং সৌদি চিনের এক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিকের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দুই দেশই আগামী দু’মাসের মধ্যে দূতাবাস খুলে দেবে।
২০১৬ সালে শীর্ষস্থানীয় এক শিয়া নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সৌদি আরবে। তার প্রতিবাদে ইরানের বিক্ষুব্ধ জনতা সৌদির দূতাবাসে ভাঙচুর চালিয়েছিল। তার পর থেকেই বন্ধ ছিল ওই দূতাবাস। পারস্পরিক সম্পর্কও ছিন্ন করে দুই দেশ।
চিনের মধ্যস্থতায় সাত বছর পর ইরানে আবার সৌদির দূতাবাস খুলেছে। তবে পশ্চিম এশিয়ার ‘ভারত-পাকিস্তান’-এর সম্পর্ক কি সুস্থ করতে পারবে চিন? অনেকেই বলছেন, বেজিং কেবল দ্বন্দ্বে সাময়িক প্রলেপ লাগিয়েছে। আসলে তা ‘ছাইচাপা আগুন’-এর মতোই জ্বলছে।