অর্থনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে দিন দিন বাড়ছে বাজারদর। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলি দামি হওয়ায় নাভিশ্বাস উঠছে মধ্যবিত্তের। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, বছরে গড়ে মুদ্রাস্ফীতির হার থাকবে ছ’শতাংশ। সে ক্ষেত্রে পণ্য ও পরিষেবা খাতে নাগরিকদের বার্ষিক খরচও বৃদ্ধি পারে সমানুপাতিক হারে। এক কথায় বলতে গেলে খরচ বৃদ্ধির পরিমাণও ছ’শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।
মুদ্রাস্ফীতির সরাসরি প্রভাব দেখা যায় নাগরিকদের সঞ্চিত অর্থ এবং সম্পত্তির উপর। উদাহরণ হিসাবে বিলাসবহুল গাড়ি বা বাড়ির কথা বলা যেতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির জেরে আগামী দিনে এগুলির দর আরও বৃদ্ধি পাবে বলে স্পষ্ট করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, বর্তমানে যে গাড়ি কিনতে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে, এক দশক পর দেড় গুণেরও বেশি বাড়বে সেটির দাম। তাঁদের অনুমান, ওই গাড়ির দাম তখন দাঁড়াবে ৯০ লক্ষ টাকা। অর্থনীতির নিয়মে মুদ্রাস্ফীতির জেরে নাগরিকদের বার্ষিক খরচ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
আর সেই কারণেই গাড়ি হোক বা অন্য কিছু, যে পণ্যের আজকের দিনে ৫০ লক্ষ টাকা দাম, তার মূল্য প্রতি বছর চক্রবৃদ্ধি হারে ছ’শতাংশ করে বাড়তে থাকবে। এই হিসাবে পাঁচ বছর পর উক্ত গাড়ির দাম দাঁড়াবে ৬৬ লক্ষ ৯১ হাজার ১২৮ টাকা।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই মুদ্রাস্ফীতি? অর্থনীতিতে একে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সমার্থক করে দেখা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা কারণে পণ্য ও পরিষেবার খরচ বা দাম বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অর্থনীতিতে তাকেই বলে মুদ্রাস্ফীতি।
মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে বড় কুপ্রভাব হল টাকার অবমূল্যায়ন। এর সূচক যত বাড়তে থাকে, ততই কমে নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা। বর্তমানে এক জন ব্যক্তি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থে যে পরিমাণ সামগ্রী কিনতে পারেন, মুদ্রাস্ফীতির জেরে আগামী দিনে তার থেকে অনেক কম সামগ্রী পাবেন তিনি।
উদাহরণ হিসাবে মুদির দোকানের সামগ্রী এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কথা বলা যেতে পারে। পাঁচ বছর আগে অনেকটাই সস্তায় পেট্রল কিনতে পারতেন এ দেশের মানুষ। চাল-গম-তেল-নুনের মতো নিত্যদিনের সামগ্রীর দর ছিল বেশ সস্তা। এগুলির মূল্যবৃদ্ধির এক এবং একমাত্র কারণ হল মুদ্রাস্ফীতি।
আর সেই কারণেই পাঁচ বছর পর ৫০ লক্ষ টাকার বিলাসবহুল গাড়ির দাম বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৭ লক্ষ টাকা। ১০ বছর পর আরও চড়ে ৮৯ লক্ষ ৫৪ হাজার ২৩৯ টাকায় পৌঁছে যাবে দাম। তবে এই হিসাবে দু’ক্ষেত্রেই মুদ্রাস্ফীতির হার বছরে ছ’শতাংশ ধার্য করা হয়েছে।
একই কথা বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বর্তমানে যে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ৫০ লক্ষ টাকায় মিলবে, এক দশক পর সেই আবাসই কিনতে প্রায় দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে গ্রাহককে। আরও দেরি করে কিনলে দর যে আরও চড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
এখন ধরা যাক কোনও ব্যক্তি বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা করে সঞ্চয় করছেন। ৫০ লক্ষ টাকার বাড়ি কেনাই তাঁর স্বপ্ন। সে ক্ষেত্রে স্বপ্নের আবাসের ক্রয়ক্ষমতায় পৌঁছতে তাঁর ১০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু তত দিনে সংশ্লিষ্ট বাড়িটির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। তখন জমানো টাকায় ওই বাড়ি কিনতে পারবেন না তিনি। তবে ওর চেয়ে কিছুটা ছোট আকারের বাড়ি বা ফ্ল্যাট পেতে পারেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, মুদ্রাস্ফীতির জেরে আগামী দিনে আরও বাড়বে শিক্ষার খরচ। বর্তমানে দেশের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স শেষ করতে খরচ হচ্ছে অন্তত ২০ লক্ষ টাকা। সেটাই বেড়ে ৩৬ লক্ষতে গিয়ে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াতে বেশ কয়েকটি পন্থা অবলম্বনের কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড বা বন্ডে বিনিয়োগ। ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের প্রথাগত সঞ্চয়ের তুলনায় এই ধরনের খাতে লগ্নিতে বেশি মুনাফার সুযোগ রয়েছে।
তবে স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড বা বন্ড আর্থিক ভাবে ঝুঁকিুপূর্ণ। আর তাই লগ্নিকারীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র রাখতে বলেছেন বিশ্লেষকেরা। রিয়্যাল এস্টেট থেকে ভাল লাভের সুযোগ থাকে। সে দিকেও নজর দিতে বলেছেন তাঁরা।
অর্থনীতিবিদদের কথায়, সমস্ত পণ্য ও পরিষেবার উপর বেড়েই চলে মুদ্রাস্ফীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এর থেকে বাঁচার উপায় হল, দ্রুত সঞ্চয়ের পরিকল্পনা সেরে ফেলা। সব দিক বিবেচনা করে বিনিয়োগ করতে হবে। লগ্নিকারীর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ক্ষমতা বোঝাটাও জরুরি। এতে সঞ্চয় এবং মুদ্রাস্ফীতির দ্বিমুখী প্রভাব বুঝতে পারবেন তিনি।
এ বছরের ডিসেম্বরের গোড়ায় বৈঠক করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) মুদ্রানীতি কমিটি। সেখানে চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-’২৫) মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ৪.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এটি ৪.৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতির হারকে নিরন্তর চার শতাংশের নীচে নামানোর চেষ্টা করছে আরবিআই। মুদ্রানীতি কমিটির অনুমান, আগামী আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) প্রথম দু’টি ত্রৈমাসিকে এর হার থাকবে যথাক্রমে ৪.৬ এবং চার শতাংশ।
এই আবহে আমজনতার সঞ্চয়ের রুচি বদলের বিষয়টি ধরা পড়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) রিপোর্টে। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, একটু বেশি রিটার্নের আশায় মিউচুয়াল ফান্ড বা স্টকে বিনিয়োগ পরিমাণ বর্তমান সময়ে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরও প্রথাগত সঞ্চয়ের নিরিখে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত।
এসবিআইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে (এসআইপি) বিনিয়োগ ২০১৮ সালের তুলনায় বেড়েছে চার গুণ। বর্তমানে এসআইপি অ্যাকাউন্টের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৮ কোটি। পাশাপাশি বেড়েছে স্টকে লগ্নিও। এক দশক আগে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের অবদান ছিল ০.২ শতাংশ। চলতি আর্থিক বছরে (২০২৪-’২৫) তা বেড়ে এক শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।