জিবুতির পর এ বার বেনিন। ধীরে ধীরে মাকড়সার মতো জাল বিছিয়ে ‘অন্ধকার মহাদেশ’কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে চিন। ঋণ, আর্থিক এবং সামরিক সাহায্যের টোপ গিলিয়ে আফ্রিকার একের পর এক রাষ্ট্রকে তাঁর ইশারায় চলতে বাধ্য করছে বেজিং। অন্য দিকে, ড্রাগনের বিষাক্ত নিঃশ্বাস ঘাড়ের কাছে পড়তে থাকায় রাতের ঘুম উড়েছে আমেরিকার।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিন প্রজাতন্ত্রের (রিপাবলিক অফ বেনিন) কৌশলগত অবস্থানে নজর রয়েছে চিনের। সেখানকার আমজনতার সবচেয়ে বড় অংশটিই বাস করে আটলান্টিক সংলগ্ন গিনি উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলে। বলা বাহুল্য, উপসাগরীয় এলাকাটিতে নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করতে পারলে সরাসরি আটলান্টিকে প্রবেশের সোজা রাস্তা পেয়ে যাবে বেজিংয়ের লালফৌজ। এতে তাঁদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো অনেক বেশি সহজ হবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরে ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা’র মতো সেই সুযোগই চলে এসেছে ড্রাগনের কাছে। গত অগস্টে বেনিন সরকারকে বিরাট অঙ্কের সামরিক অনুদান দেয় বেজিং। চিন থেকে সেখানে পাঠানো হয় কামান ও গোলা-বারুদ। দীর্ঘ দিন ধরেই উত্তরের ইসলামীয় চরমপন্থীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেখানকার সরকারি সেনা। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ড্রাগনের সাহায্য সময়োপযোগী ছিল বলে জানিয়েছে আফ্রিকার ওই দেশ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেজিংয়ের এ-হেন ‘পরোপকারী’ মনোভাবের সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে চলেছে। এর বিনিময়ে আগামী দিনে গিনি উপসাগরে নৌঘাঁটি তৈরির অনুমতি পাবে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। গত কয়েক দশক ধরে নিঃশব্দে এই লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে গিয়েছে ড্রাগন।
আফ্রিকার একের পর এক দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের চিনা নীতিকে ‘নিউ গ্রেট গেম’ হিসাবে দেখতে শুরু করেছেন বিশ্লেষকেরা। এর জন্য বহুমুখী পদ্ধতি অবলম্বন করছেন ড্রাগনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ‘অন্ধকার মহাদেশে’ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভুত্ব স্থাপনের পাশাপাশি পরিকাঠামো এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়িয়েই চলেছে বেজিং।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দু’ধরনের চাল দিতে পছন্দ করেন জিনপিং। এর প্রথমটির নাম ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই। পরিকাঠামো খাতে উন্নতির নামে চলা এই প্রকল্পের লোভ দেখিয়ে আফ্রিকার একাধিক দেশকে জালে তুলেছেন তিনি।
বিআরআইয়ের প্রধান অসুবিধা হল বিশাল অঙ্কের ঋণ। কখনও সেই টাকা পরিশোধ হবে না-জেনেও আফ্রিকার দেশগুলিকে তা দিচ্ছে বেজিং। বিনিময়ে সেখানে রাস্তা, সেতু থেকে শুরু করে রেললাইন পাতার মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক কাজ করছে একাধিক চিনা সংস্থা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ওই কাজ অন্য কোনও দেশের সংস্থাকে দিয়ে করানোর নিয়ম নেই। আর এ ভাবেই ঋণের টাকা ঘুরপথে নিজেরই দেশের সংস্থাগুলির মাধ্যমে ঘরে ফেরাচ্ছে ড্রাগন।
দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার দেশগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই রয়েছে। কোথাও কোথাও চলছে গৃহযুদ্ধ। সেই সংঘর্ষের আগুনে হাত সেঁকে নেওয়ার সুযোগ ছাড়ছে না চিন। সংঘর্ষে লিপ্ত দেশগুলিকে একতরফা ভাবে হাতিয়ার সরবরাহ করে যাচ্ছে বেজিং। ফলে যত সময় গড়াচ্ছে ততই ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির রাষ্ট্রগুলি ড্রাগনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর তাঁদের নিজের ইচ্ছামতো কাঠের পুতুল করে নেপথ্যে থেকে নাচিয়ে চলেছেন চেয়ারম্যান শি।
পশ্চিম আফ্রিকার বেনিনের গল্পটাও একই রকমের। সেখানেও বিপুল চিনা বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটির অবিসংবাদিত বামপন্থী নেতা ছিলেন ম্যাথু কেরেকৌ। তাঁর শাসনকালেই বেজিংয়ের সঙ্গে বেনিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে একাধিক বার ড্রাগনল্যান্ড সফরে গিয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালে ‘আফ্রিকা নীতি’ ঘোষণা করেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি। এর পর বেনিনে লগ্নির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় বেজিং। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বর্তমানে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটি পুরোপুরি ড্রাগনের উপর নির্ভরশীল। ফলে গিনি উপসাগরের উপকূল নৌঘাঁটি তৈরির জন্য লালফৌজকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব নয়।
২০২২ সালে বেনিনে চিনা রফতানির পরিমাণ ছিল ১৪৯ কোটি ডলার। আফ্রিকার দেশটিতে মূলত লোহা, তুলো এবং বাইক সরবরাহ করে বেজিং। সেখানকার কম্পিউটার সেন্টারগুলিও চালায় শি প্রশাসন। প্রতি বছর সেখানে এক শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে চিনা বাণিজ্য।
দক্ষিণ চিনের ঝেজ়িয়াং এবং গুয়াংডং প্রদেশের সঙ্গে বেনিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর। ২০০৯ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে ‘ইকোনমি অ্যান্ড ট্রেড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ তৈরি হয়। সেই কাজে সাহায্য করেছিল ঝেজ়িয়াং টিমস ইন্টারন্যাশনাল নামের সংস্থা। বর্তমানে সেখানে ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে ৭০০ চৈনিক সংস্থা। প্রসাধনী তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায় ওই ট্রেড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত চিনের থেকে বেনিনের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার। এ ছাড়া শুধুমাত্র রেলপথ তৈরি করতে বেজিংয়ের থেকে ৪০০ কোটি ডলার ধার করেছে পশ্চিম আফ্রিকার ওই দেশ। সেখানকার কোটোনউ ফ্রেন্ডশিপ স্টেডিয়ামের নির্মাণকারী সংস্থাও চৈনিক।
বেনিনের স্বাস্থ্য পরিষেবাও অনেকটাই চিনের উপর নির্ভরশীল। গত কয়েক দশক ধরে সেখানে কর্মরত রয়েছেন সাড়ে পাঁচ শতাধিক চিনা চিকিৎসক। ৮০ হাজারের বেশি অস্ত্রোপচার করেছেন তাঁরা। ২০১৪ সালে আফ্রিকা জুড়ে ইবোলা ভাইরাসের দাপট শুরু হলে তার আঁচ থেকে বাঁচতে পারেনি বেনিন। ওই সময়ে ১,৬০০-র বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেন চিনা চিকিৎসকেরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ভাবে বিভিন্ন সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বেনিনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে চিন। সেখানকার প্রশাসনিক কর্তারা বেজিংকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। ফলে তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে আফ্রিকায় নিজের স্বার্থরক্ষা করা ড্রাগনের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়।
আফ্রিকার মতো ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতেও ঋণের জাল ছড়িয়ে রেখেছে চিন। কিন্তু সমুদ্রপথে সেখানে পৌঁছতে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হয় বেজিংকে। আর তাই বেনিনের গিনি উপসাগরে নৌঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে পিএলএ। শেষ পর্যন্ত এই অনুমতি পেলে আটলান্টিকের আমেরিকার নৌসেনার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে পারবেন তাঁরা।
জিনপিংয়ের ‘আফ্রিকা নীতি’ অনুযায়ী মহাদেশটিতে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের প্রভুত্ব পুরোপুরি শেষ করতে চাইছে চিন। সেখানকার দেশগুলিকে আর্থিক উপনিবেশে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে বেজিংয়ের। পরবর্তী পর্যায়ে আফ্রিকায় চৈনিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারে ড্রাগন।
এই পরিস্থিতিতে বেনিনকে চিনের কবল থেকে বার করে আনার পাল্টা চাল দিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাঁর সহযোগীরা। ভারত, ব্রাজ়িল ও তুরস্কের মতো দেশগুলি সেখানে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। বেনিন বাদে নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকার দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু তার পরেও এই এলাকা থেকে চিনকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন।