গাজ়ায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের মধ্যে। তবে এই দুই যুযুধান দেশের ‘শত্রুতা’ বা লড়াই নতুন নয়। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই চলছে দু’পক্ষের সংঘাত। আরবদের সঙ্গে ইহুদিদের জাতিগত শত্রুতার শুরু ইসলামের জন্মের আগে থেকেই। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে জানা যায়, ইজ়রায়েল অঞ্চল থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত হতে হয়েছিল। তার পর তারা দেশ-বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, আধুনিক কালে আরব ও ইহুদিদের সংঘাতের সূত্রপাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে ইহুদি সম্প্রদায় অর্থসাহায্য করে। পরিবর্তে ইহুদি জ়ায়োনিস্ট নেতারা (ইহুদিদের সংহতি বিষয়ক এবং আদিভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সংগঠিত আন্দোলন) তাঁদের আদিভূমির দাবি জানান। ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের বিদেশ সচিব আর্থার ব্যালফুর ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লর্ড রথসচাইল্ডের কাছে এক পত্র দ্বারা সেই সময়ে ওটোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে ইজরায়েল উদ্ধার সম্ভব হলে তা ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের জায়োনিস্ট ফেডারেশনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলেন।
ব্যালফুরের এই আশ্বাসকে ‘ঘোষণাপত্র’ হিসেবে ইহুদিরা গণ্য করে এবং যুদ্ধ শেষ হলে সেখানে বসতি স্থাপনের আশা পোষণ করতে থাকে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত ইহুদিরা বার বার বিভিন্ন শক্তির আক্রমণে বিধ্বস্ত হতে হতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিল। জায়োনিস্ট আন্দোলন তাদের মনেও নতুন আশার সঞ্চার ঘটায়।
১৯১৮ সালে ইহুদিদের একটি বাহিনী ব্রিটিশ সেনাদের প্যালেস্তাইন দখলে সহায়তা করে। একটি ম্যান্ডেট দ্বারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উপর ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের আধিপত্য স্বীকৃত হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন অঞ্চলে আসতে শুরু করেন। স্বাভাবিক ভাবেই ওই অঞ্চলে বাসরত আরবেরা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেনি। তাদের সঙ্গে ইহুদিদের দাঙ্গা শুরু হয়। ব্যালফুর ঘোষণাপত্রে আরবদের প্যালেস্তাইন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। ফলে আরব ও ইহুদিদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্বে ইজরায়েলে ধনী ইহুদিদের আগমন অব্যাহত থাকে। তুলনায় দরিদ্র, পশুপালন ও সামান্য কৃষিনির্ভর আরবেরা এতে শঙ্কিত বোধ করে এবং সমস্যা আরও বাড়তে থাকে।
জার্মানিতে হিটলারের শাসন কায়েম হলে সেখানে ইহুদি বিরোধিতা মারাত্মক আকার নেয়। ইহুদিদের নির্বিচারে হত্য করা শুরু হয়। নয়তো পাঠিয়ে দেওয়া হতে থাকে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’-এ, যা আরও আতঙ্কের। জার্মানি ছেড়ে সেই সময় বহু ইহুদিই তখন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁদের আদিভূমি হিসাবে কথিত জেরুসালেমের দেশ প্যালেস্তাইনে।
প্যালেস্তিনীয় আরব ও ইজ়রায়েলপন্থী ইহুদিদের মধ্যে সংঘাত বাড়লে ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন প্রস্তাব দেয়, ইহুদিদের থাকার জন্য আলাদা রাষ্ট্র হওয়া দরকার।
তারা জানায়, ১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইনকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা হবে। তবে তার আগে এই এলাকা ভাগ হওয়া দরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
প্যালেস্তাইনকে ভেঙে দেওয়া হয় দু’ভাগে— আরবীয়দের থাকার আলাদা অংশ, ইহুদিদের জন্য আলাদা। যদিও এই ভাগাভাগি কখনওই মেনে নিতে পারেনি একক রাষ্ট্র থাকতে চাওয়া প্যালেস্তাইন। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। শুরু হয় বিদ্রোহ।
সেই শুরু। তার পর থেকে বহু যুদ্ধ হয়েছে। ক্রমশ বদলেছে প্যালেস্তাইনের মানচিত্র।
১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইন ভেঙে যায় দু’খণ্ডে। আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পায় ইজ়রায়েল। শুরু হয় নতুন লড়াই। ইজ়রায়েলিদের তাড়া খেয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় বহু প্যালেস্তিনীয়কে।
কম করে সাত লক্ষ প্যালেস্তাইনবাসীকে আশ্রয় নিতে হয় মিশর, জর্ডনের মতো আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে।
তত দিনে ধাক্কা খেতে খেতে কোণঠাসা হয়েছে আজকের প্যালেস্তাইন। ১৯১৭ সালে গোটা দেশের মানচিত্র যা ছিল, ৪০ বছরে তা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে দু’টি ছোট্ট টুকরোয়। এক ভাগের নাম ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। অন্য ভাগটির নাম গাজ়া স্ট্রিপ।
সেটা ১৯৫৬ সাল। প্যালেস্তাইন তখন তাদের মূল ভূখণ্ডের মাত্র ২২ শতাংশ এলাকায় বিরাজমান। বাকি ৮৮ শতাংশ জুড়েই রয়েছে ইহুদিদের রাষ্ট্র ইজ়রায়েল।
তবে দুই দেশেরই দাবি পবিত্র শহর জেরুসালেমের উপর। এই নিয়ে সংঘাতের জেরে একের পর এক অভ্যুত্থান শুরু হয় প্যালেস্তাইন এবং ইজ়রায়েলে।
১৯৬৭ সালে ছ’দিনের যুদ্ধে গোটা প্যালেস্তাইনের দখল নেয় ইজ়রায়েলিরা। প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়া স্ট্রিপে শুরু হয় ইজ়রায়েলের শাসন।
কিন্তু প্যালেস্তাইনের মুক্তির লড়াই থামেনি। ১৯৯৩ আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইয়াসির আরাফতের নেতৃত্বে প্যালেস্তাইন মুক্তি সংগঠন পিএলও এবং ইজ়রায়েল একটি সমঝোতায় আসে। স্বাক্ষরিত হয় অসলো চুক্তি।
ওই চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয়, প্যালেস্তাইন তাদের চিহ্নিত অংশ দু’টি নিজেরাই শাসন করবে। ইজ়রায়েল মান্যতা দেবে প্যালেস্তাইনের মানুষের অধিকারকে।
কিন্তু ২০০৬ সালে আবার গুলিয়ে যায় পুরনো হিসাব আর যাবতীয় বোঝাপড়া। পিএলও নিয়ন্ত্রিত ফতাহ পার্টিকে পিছনে ফেলে প্যালেস্তাইনের সংসদীয় নির্বাচনে জয়ী হয় চরমপন্থী হামাস।
নতুন করে শুরু হয় নিজেদের মধ্যে লড়াই। ২০০৭ সালে গাজ়া স্ট্রিপের দখল নেয় হামাস। ইজ়রায়েল জানিয়ে দেয়, গাজ়ায় কোনও যানবাহন ঢুকতে পারবে না। কোনও পণ্য নিয়ে যাওয়া যাবে না বাইরে থেকে।
গাজ়ার সীমানার এক প্রান্তে ভূমধ্যসাগর। অন্য প্রান্তটি পুরোপুরি ইজ়রায়েলের গা ঘেঁষে থাকা। ইজ়রায়েলের ওই সিদ্ধান্তে একঘরে হয়ে যায় গাজ়া।
তত দিনে প্যালেস্তাইন মূল দেশের ১৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে। এক একটি টুকরো এক একটি ‘এনক্লেভ’। এর মধ্যে প্যালেস্তাইনের নিয়ন্ত্রণে ১৬৫টি। ইজ়রায়েলের নিয়ন্ত্রণ ২০০টি এনক্লেভের উপর।
জেরুসালেমে তখনও ইজ়রায়েলি নিয়ন্ত্রণ। তাই নিয়ে প্যালেস্তাইন-ইজ়রায়েলের ক্ষমতার লড়াইও জারি।
গত ৭ অক্টোবর সেই লড়াই পরিণত হল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। দু’দিন আগে প্যালেস্তাইনের দুই ‘জঙ্গি’কে খতম করে ইজ়রায়েলের সেনা। সেই হামলা নিয়ে হামাসের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যেই গাজ়ার শাসক হামাস নিরন্তর রকেট হামলা শুরু করে জেরুসালেমে।
ভোর সাড়ে ৬টায় প্রায় ৫০০০ রকেট হামলার পরে হামাসের প্রধান মহম্মদ দাইফ ঘোষণা করেন তাঁরা অপারেশন আল আকসা ফ্লাড শুরু করেছেন। পাল্টা ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, যুদ্ধ শুরু হল।
সাত দিনেই এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন না হোক ১৩০০ মানুষ। জখম প্রায় সাড়ে তিন হাজার। ২০০ জনকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাজ়ায়। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী জানা যায়নি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষের ঘরবাড়ি। ঘরছাড়া লক্ষাধিক। আপাতত যুদ্ধ থামার লক্ষণই নেই গাজ়ায়।