Khooni Darwaza

‘ঘুরে বেড়ায়’ শাহজাদার কবন্ধ শরীর! দিল্লির ‘খুনি দরওয়াজ়া’ থেকে নাকি এখনও চুঁইয়ে পড়ে রক্ত

মহাবিদ্রোহের সময় দিল্লি যে প্রায় এক মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই সময় থেকেই ‘লাল দরওয়াজ়া’ পরিচিতি পেতে থাকে ‘খুনি দরওয়াজ়া’ নামে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৩
Share:
০১ ২১

রাজধানী দিল্লির আনাচকানাচে জমে রয়েছে ইতিহাসের বহু বিষাদময় অধ্যায়। সুলতানি আমল থেকে উপমহাদেশের রাজধানী শহর কম রক্তক্ষয়, প্রতিহিংসা, ষড়য়ন্ত্র, গৃহযুদ্ধ আর বহির্শত্রুর আক্রমণ দেখেনি। সেই সব স্মৃতি আবহমানে জন্ম দিয়েছে অগণিত কিংবদন্তির। যার মধ্যে এমন কিছু আখ্যান রয়েছে, যা থেকে গোটা দিল্লি শহরকে ‘প্রেতাবিষ্ট’ বলেও মনে হতে পারে।

০২ ২১

দিল্লির বেশ কিছু সৌধে রয়েছে ‘প্রেতের’ আনাগোনা— এমন রটনা কম নেই। যার মধ্যে অন্যতম হল ‘খুনি দরওয়াজ়া’। সাবেকি দিল্লির অন্যতম নগরতোরণ এই দ্বার ‘লাল দরওয়াজ়া’ নামেও পরিচিত। এই দ্বার নির্মাণ করান শের শাহ সুরি। তখন এই দ্বারের পরিচিতি ছিল ‘কাবুলি দরওয়াজ়া’ হিসাবে।

Advertisement
০৩ ২১

আকবরের মৃত্যুর পর যখন জহাঙ্গির সিংহাসনে বসেন, তখন মুঘল দরবারের কিছু অভিজাত তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। আকবরের সভায় ‘নবরত্ন’ হিসাবে পরিচিত অভিজাতদের অন্যতম আবদুর রহিম খান ছিলেন এই বিরোধিতার প্রধান মুখ। জহাঙ্গির আবদুরের দুই পুত্রের প্রাণদণ্ডের বিধান দেন। আবদুরের সন্তানদের মৃতদেহ লাল দরওয়াজ়ায় টাঙিয়ে রাখা হয়।

০৪ ২১

আওরঙ্গ‌জ়েব তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারা সিকোহ্‌কে হত্যা করেন। দারার ছিন্নমুণ্ড লাল দরওয়াজ়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

০৫ ২১

১৭৩৯ সালে যখন পারস্য সম্রাট নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন, তখন তিনি শহর জুড়ে রক্তের স্রোত বইয়ে দেন বলে জানা যায়। অনেকের মতে, এই দ্বারের সামনেই এক বড়সড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।

০৬ ২১

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় তিন মুঘল শাহজাদাকে হত্যা করে হয় এখানে। বাহাদুর শাহ জ়াফরের দুই পুত্র মির্জ়া মুঘল ও মির্জ়া খিজ়র সুলতান এবং তাঁর নাতি মির্জ়া আবু বখ্‌তকে ব্রিটিশ সেনাধিকারিক উইলিয়াম হাডসন হত্যা করেন। কথিত, তাঁদের মৃতদেহ লাল দরওয়াজ়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। যদিও সমকালীন সাক্ষ্য জানায়, শাহজাদাদের দেহ অন্যত্র রাখা হয়েছিল।

০৭ ২১

তবে মহাবিদ্রোহের সময় দিল্লি যে প্রায় এক মৃত্যুনগরীতে পরিণত হয়, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই সময় থেকেই ‘লাল দরওয়াজ়া’ পরিচিতি পেতে থাকে ‘খুনি দরওয়াজ়া’ নামে।

০৮ ২১

১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এই দ্বার সংলগ্ন এলাকায় শরণার্থীদের শিবিরে হামলা হয়। বহু মানুষ মারা যান সেই হামলায়।

০৯ ২১

খুনি দরওয়াজ়ার পিছনে থমকে থাকা এই রক্তস্রোত ও হিংসার ইতিহাস থেকে ক্রমেই জন্ম নেয় বেশ কিছু কিংবদন্তি। শোনা যায়, বর্যাকালে খুনি দরওয়াজ়ার ভিতরের ছাদ থেকে রক্ত চুঁইয়ে প়ড়ে।

১০ ২১

এমন কথাও রটে যে, খুনি দরওয়াজ়ার ভিতরের সিঁড়িতে এক কবন্ধমূর্তিকে দেখা যায়। ধারণা, এই মুণ্ডহীন প্রেত নাকি শাহজাদা দারা সিকোহ‌্‌র। যাঁকে আওরঙ্গজ়েব প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন।

১১ ২১

এক সময়ে খুনি দরওয়জ়ার ভিতরে প্রবেশ করা যেত। তখন নাকি অনেকেই অশরীরীর স্পর্শ পেয়েছেন। কেউ নাকি তাঁদের গালে চড় মেরেছে অথবা কেউ তাঁদের ঠেলে ফেলে দিয়েছে, এমন কথা প্রায়শই শোনা গিয়েছে এককালে। প্রেতান্বেষীদের বক্তব্য, এই অশরীরীরা বাহাদুর শাহ জ়াফরের বংশধরদের প্রেত। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই তারা এমন সব কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে।

১২ ২১

খুনি দরওয়াজ়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর এক কিংবদন্তি বহু কাল ধরে দিল্লিতে চালু আছে। জনশ্রুতি, প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর নাকি এক মহিলা লাল কেল্লায় এক শোকযাত্রা বার করেন। পুরো ব্যাপারটাই নাকি ‘ভৌতিক’।

১৩ ২১

কথিত, খুনি দরওয়াজ়ায় নিহত শাহজাদাদের শবযাত্রা এটি। আর সেই মহিলা শেষ মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জ়াফরের পত্নী জ়িনত মহল। লাল কেল্লার লাহৌর গেট থেকে বার হয়ে নাকি গোটা কেল্লা পরিক্রমা করে সেই শোকযাত্রা।

১৪ ২১

অনেকের দাবি, এই ‘ভৌতিক’ শোকযাত্রার পুরোভাগে থাকেন স্বয়ং বাহাদুর শাহ জ়াফর। যদিও নির্বাসিত বাদশাহের মৃত্যু হয় মায়ানমারে (তৎকালীন বর্মা) এবং তাঁকে সেখানেই কবর দেওয়া হয়। তবু তাঁর ‘প্রেতাত্মা’ নাকি আজও লাল কেল্লায় ঘুরে বেড়ায়। অকালপ্রয়াত শাহজাদাদের জন্য শোকপালন করে।

১৫ ২১

শাহি দিল্লির আর এক লোকশ্রুতি মুঘল শাহজাদি জ়েব-উন-নিসাকে ঘিরে। তিনি বাদশা আওরঙ্গজ়েবের জ্যেষ্ঠা কন্যা। তাঁর আত্মা নাকি আজও সালিমগড় দুর্গে ঘুরে বেড়ায়।

১৬ ২১

জ়েব-উন-নিসা ছিলেন বিশেষ প্রতিভার অধিকারিণী। তিনি ৭ বছর বয়সেই পবিত্র কোরান মুখস্ত বলতে পারতেন। সম্রাট আওরঙ্গজ়েবের অন্ধ ভালবাসা ছিল তাঁর প্রতি। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ়েব-উন-নিসার মধ্যে কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটে। সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জ়েব-উন-নিসা ‘মাখফি’ ছদ্মনামে বহু গজ়ল রচনা করেছিলেন।

১৭ ২১

১৬৮২ সালে আওরঙ্গজ়েব তাঁর প্রিয়তম সন্তান জ়েব-উন-নিসাকে সালিমগড় দুর্গে বন্দি করেন। কেন তিনি এমন কাজ করেছিলেন, তা নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। কারও মতে, জ়েব-উন-নিসা কোনও অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে প়়ড়ায় আওরঙ্গজ়েব তাঁকে এই শাস্তি দেন।

১৮ ২১

যত দূর জানা যায়, জ়েব-উন-নিসা তাঁর জীবনের শেষ দুই দশক এই দুর্গেই কাটিয়েছিলেন। ১৭০২ সালে এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তার পর থেকে নাকি সালিমগড় দুর্গে জ়েব-উন-নিসার ‘প্রেতাত্মা’ ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। চাঁদনি রাতে কালো হিজ়াবে মুখ ঢেকে তাঁকে গজ়ল গাইতে দেখা যায়— এমন দাবি অনেকেরই।

১৯ ২১

সালিমগড় দুর্গটি তৈরি করিয়েছিলেন শের শাহের পুত্র সালিম শাহ সুরি। পরে হুমায়ুন এটি দখল করেন। এটি দীর্ঘ কাল মুঘল অধিকারেই ছিল। আওরঙ্গজ়েবের আমলে এটিকে বন্দিশালায় পরিণত করা হয়। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশরা এই দুর্গ দখল করে।

২০ ২১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯৪৫ সালে আজ়াদ হিন্দ ফৌজের বহু সৈন্যকে সালিমগড় দুর্গে বন্দি রাখা হয়। তাঁদের অনেকে বন্দিদশাতেই মারা যান। স্থানীয়েরা বিশ্বাস করেন যে, আজ়াদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের প্রেতাত্মাও এই দুর্গে ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই নাকি তাদের অট্টহাসি, হাহাকার এবং শিকলের ঝন ঝন শব্দ শুনতে পেয়েছেন।

২১ ২১

আজকের দিল্লির নগরায়ণ আর রোশনাইয়ের এক পরত নীচে যে আজও এমন সব অন্ধকারাচ্ছন্ন কাহিনি ঘুরপাক খায়, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু, যে কোনও পুরনো শহরের এটাই বৈশিষ্ট্য। ‘ভৌতিক’ আখ্যানের আড়ালে থেকে যায় বহু বেদনার গল্প। দিল্লিও তার ব্যতিক্রম নয়। মুঘল দিল্লির করুণ দিনগুলির স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই হয়তো এই সব লোকবিশ্বাস সক্রিয় থেকেছে, জন্ম দিয়েছে একের পর এক কিংবদন্তির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement