বাতাসে বারুদের গন্ধ। বোমা-গুলির অভিঘাতে রং পাল্টেছে আকাশের। মাটিতে লেগে রয়েছে রক্তের দাগ। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এমন বীভৎস ছবির সাক্ষী থেকেছে বিশ্ব। সেই যুদ্ধের মধ্যেই পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ বাধল আরও দুই দেশের মধ্যে। ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সুর ক্রমেই চড়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই দুই দেশ মিলিয়ে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
প্যালেস্টাইন এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘ দিনের। জেরুসালেম এবং গাজ়া স্ট্রিপের দখলকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা লেগেই থাকে। শনিবার নতুন করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল দুই দেশ। যার জেরে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ওই দুই দেশ।
শীঘ্রই যুদ্ধ থামার যে কোনও লক্ষণ নেই, মঙ্গলবার ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্যেই তার আন্দাজ পাওয়া গিয়েছে। দেশবাসীর উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘‘(যুদ্ধ) শুরু করেছে ওরা (হামাস), শেষ করব আমরা।’’
শনিবার সকালে আচমকা ইজ়রায়েলের মধ্যে ঢুকে আচমকা হামলা চালিয়েছে প্যালেস্টাইনের হয়ে অস্ত্র ধরা হামাস বাহিনী। তাদের ‘আইএস জঙ্গি’ বলে দাবি করেছেন নেতানিয়াহু।
সেই হামাস বাহিনী এখন মাথাব্যথা ইজ়রায়েল সরকারের। হামাসের মোকাবিলা করতে সেনাবাহিনীকে ছাড়পত্র দিয়েছে ইজ়রায়েল সরকার। তার পর থেকেই গাজ়ায় পাল্টা হামলা শুরু করেছে নেতানিয়াহুর সেনা।
যুদ্ধের মধ্যে হামাস বাহিনীর এক কমান্ডারকে ঘিরে জোর আলোচনা চলছে। গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইজ়রায়েলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছেন তিনি। এই হামলার পর নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন ওই কমান্ডার।
নাম মোহাম্মেদ দেইফ। প্যালেস্টাইনের নাগরিক তিনি। ২০২২ সাল থেকে হামাসের সামরিক বাহিনীর প্রধান দেইফ। বিভিন্ন হামলার ঘটনায় মূলচক্রী এই দেইফ।
তবে এখন আর তাঁর শরীরে তেমন জোর নেই। হুইলচেয়ারে বসেই দিন গুজরান করছেন তিনি। সেখান থেকেই হামাস বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই কমান্ডার। তাঁর এক চোখ নেই।
২০ বছর আগে এয়ার স্ট্রাইকে মরতে মরতে কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন দেইফ। সেই হামলায় এক চোখ, এক হাত এবং এক পা হারান। তার পর থেকে হুইলচেয়ারই তাঁর সম্বল।
ষাটের দশকে গাজ়ায় একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম দেইফের। জন্মের সময় দেইফের নাম ছিল মোহম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি। সেই সময় মিশরের দখলে ছিল গাজ়া। পরে দেইফ নামে পরিচিতি পান তিনি। আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি’।
গাজ়ায় ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে গাজ়া কব্জা করে ইজ়রায়েল।
গত শনিবার ইজ়রায়েলের ভূখণ্ডে যেখানে হামাস বাহিনী ঢুকে হামলা চালিয়েছে, পঞ্চাশের দশকে দেইফের বাবা, কাকারা সশস্ত্র প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে সেই এলাকাতেই হানা দিয়েছিল। ছোট থেকেই যুদ্ধের পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা দেইফের।
ইজ়রায়েলের দখলে ছিল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়া স্ট্রিপ। এর প্রতিবাদে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল প্যালেস্টাইনে। সেই সময় ১৯৮৭ সালে হামাস তৈরি করা হয়।
আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়েছিল সেই সময়। ওই ঘটনায় দেইফ জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। তার জেরে তাঁকে জেলে পাঠিয়েছিল ইজ়রায়েল।
গাজ়ায় ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই হামাস বাহিনীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেইফের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে প্যালেস্টাইনের বহু নেতা দেশের মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সেই শুরু। তার পর থেকে প্যালেস্টাইনের হয়ে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছেন দেইফ। সেই ‘মাথা’কে হন্যে হয়ে খুঁজছে ইজ়রায়েল সরকার।
বার বার দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শোনা যায়, কমপক্ষে সাত বার দেইফকে মারার চেষ্টা করা হয়।
দেইফকে খতম করতে ২০১৪ সালে একটি বাড়িতে হামলা চালায় ইজ়রায়েল সরকার। সেই হামলায় মৃত্যু হয় দেইফের স্ত্রী এবং দুই সন্তানের।
গত শনিবার সকালে ইজ়রায়েল ভূখণ্ডে ঢুকে আচমকা হামলা চালিয়েছে হামাস বাহিনী। এই প্রসঙ্গে দেইফ বার্তা দিয়েছেন, ১৬ বছর ধরে গাজ়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইজ়রায়েলের দখলের জবাবে এই হামলা।
হামাস বাহিনীকে মোকাবিলা করতে পাল্টা জবাব দিয়েছে ইজ়রায়েল। শনিবারের হামলার পরই একে ‘সরাসরি যুদ্ধ’ বলে ঘোষণা করেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
তার পর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। ইজ়রায়েলের পাল্টা হামলায় রক্তাক্ত গাজ়া। চারদিকে বারুদের গন্ধ। রাস্তায় পড়ে দেহ। ধোঁয়ায় ঢেকেছে আকাশ।
গাজ়ার শহরগুলি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। থেকে থেকেই শোনা যাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। হামাসকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে উঠে পড়ে লেগেছে ইজ়রায়েল সরকার। নেতানিয়াহু এ-ও বলেছেন, ‘‘এই যুদ্ধ পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্রকে পাল্টে দেবে।’’
মঙ্গলবার ইজ়রায়েল সেনার তরফে দাবি করা হয়েছে, সে দেশে ১৫০০ জন হামাস জঙ্গির দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
অন্য দিকে, হামাস বাহিনীর হাতে বহু ইজ়রায়েলের নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকালে গাজ়া স্ট্রিপের কাছে এক মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল চলছিল। উৎসবের আবহে আচমকা হামলা চালিয়েছিল হামাস বাহিনী।
হামাস বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ইজ়রায়েলের জনপ্রিয় টিভি সঞ্চালক মায়ান আদমের বোন মাপাল আদম। যুদ্ধে দুই দেশের বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ঝড়ের গতিতে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। জখমও অনেকে। এই যুদ্ধ থামবে কবে? এই প্রশ্নেরই উত্তর হাতড়াচ্ছেন দুর্গতরা।