সপ্তম দিনে পা দিল ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র বাহিনী হামাসের সংঘাত। সংঘর্ষের ষষ্ঠ দিনে ইজ়রায়েলি সেনা জানিয়েছে, প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র বাহিনী হামাসের সঙ্গে সংঘাতে এখন পর্যন্ত সে দেশের ১,২০০ নাগরিক মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮৯ জন সেনা। গাজ়ার প্রশাসন জানিয়েছে, সেখানে মৃত্যু হয়েছে ১,৩০০ জনের।
হামাসের হামলার পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে ইজ়রায়েলও। ইজ়রায়েলের দাবি, ইতিমধ্যেই তারাও হামাস বাহিনীর ১৫০০ জনকে খতম করেছে। ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাতে গাজ়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে হামাসের সঙ্গে ইজ়রায়েল সেনা সংঘাতের সূত্রপাত। হামাসকে রুখতে সেনা গাজ়া ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী।
তবে গাজ়ায় প্রবেশ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বলেও ইজ়রায়েলি সেনা জানিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা এএফপি-র সূত্র অনুযায়ী, ইজ়রায়েলি সেনার মুখপাত্র রিচার্ড হেচট বলেন, ‘‘আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গাজ়ায় প্রবেশের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। এমনিতে আমরা গাজ়ায় প্রবেশ করত প্রস্তুত।’’
গাজ়া বিশ্বের অন্যতম জনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেই ভূখণ্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ বসবাস করেন। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৪০০ জনের বাস।
গাজ়া ভূখণ্ড নিয়ে প্যালেস্তাইন, ইজ়রায়েল এবং মিশরের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন এমনিতেই সমস্যায় জর্জরিত। সম্প্রতি শুরু হওয়া ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতের কারণে গাজ়াবাসীদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
এমনিতেই সীমিত খাদ্য, পানীয় এবং জ্বালানির উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতে হয় গাজ়া ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষকে।
তবে সম্প্রতি তৈরি হওয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েল এবং মিশর গাজ়া সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় সেই ভূখণ্ড বর্তমানে বিশ্বের ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’-এ পরিণত হয়েছে।
গাজ়া ভূখণ্ড ৪০ কিমি লম্বা এবং ৯.৬ কিমি প্রশস্ত একটি সঙ্কীর্ণ ভূখণ্ড যা পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তর-পূর্বে ইজ়রায়েল এবং দক্ষিণে মিশর দ্বারা বেষ্টিত। গাজ়া ভূখণ্ডের মধ্যেই রয়েছে প্যালেস্তাইনের বৃহত্তম শহর গাজ়া।
ইজ়রায়েল থেকে কাঁটাতার দিয়ে বিচ্ছিন্ন গাজ়া ভূখণ্ড বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। যা ওয়াশিংটনের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ।
গাজ়ার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ১৮ বছরের কম। দারিদ্রের হার ৫৩ শতাংশ। বিশ্বের অন্যতম জায়গা, যেখানে বেকারত্বের হার খুব বেশি। সেই গাজ়াতেই ঢুকে হামলা চালানোর চিন্তাভাবনা করছে ইজ়রায়েলি সেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইজ়রায়েলি সেনা স্থল এবং আকাশপথে গাজ়ায় প্রবেশ করতে শুরু করলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সেই ভূখণ্ডের অলিগলিতে রক্তগঙ্গা বইবে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হবে পুরো এলাকা জুড়ে। সঙ্কীর্ণ ওই ভূখণ্ডে বহু মানুষ মারা যাবেন।
তবে অনেকেই আবার মনে করছেন, ইজ়রায়েলি সেনার পক্ষে গাজ়ায় প্রবেশ করে হামলা চালানো খুব একটা সহজ হবে না।
এলাকার তুলনায় জনসংখ্যার ভার অনেক বেশি হওয়ায় গাজ়া ভূখণ্ডের ভবনগুলি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। রাস্তাঘাট সরু।
অর্থাৎ, ইজ়রায়েলি বোমার হামলায় যদি গাজ়ার বেশ কয়েকটি ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তা হলে সেই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে ইজ়রায়েলি বাহিনীর পক্ষে।
ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে সাঁজোয়া গাড়ি বা ট্যাঙ্ক নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে ইজ়রায়েল বাহিনীর।
অন্য দিকে, হামাসের সশস্ত্র বাহিনী গাজ়া ভূখণ্ড হাতের তালুর মতো চেনে। তাই অলিতে-গলিতে ইজ়রায়েলের সেনার জন্য ফাঁদ পেতে রাখা তাদের জন্য খুবই সহজ হবে। গাজ়া ভূখণ্ডের ‘গোলকধাঁধা’, সঙ্কীর্ণ রাস্তা-বাড়িঘরের কারণে স্নাইপারদের জন্যও হামলা চালানো খুব কঠিন হবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
গাজ়ায় প্রতি দিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। যুদ্ধ শুরুর পর তা আরও বেড়ে গিয়েছে। তাই অন্ধকারের মধ্যে ইজ়রায়েলের সেনা বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও বাজিমাত করতে পারে হামাস।
সিরিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে দেখা গিয়েছে, কী ভাবে ছোট ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট দিয়ে বড় পদাতিক বাহিনীকে তছনছ করা যায়। আর সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহজেই গাজ়ার বুকে ইজ়রায়েলের বিশাল বাহিনীকে বিপদে ফেলতে পারে হামাস।
বিমানে করে গাজ়ায় বায়ুসেনা ঢোকানোও ঝুঁকিপূর্ণ হবে ইজ়রায়েলের জন্য। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
গাজ়ার আকাশ ছোট। তাই সেখানে ইজ়রায়েলের যুদ্ধবিমানকে সহজেই চিহ্নিত করা সহজ হবে। হামাসের ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করতে হতে পারে বিমানগুলিকে। হামাসের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে যেতে পারে ইজ়রায়েলি বিমান।
তবে ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী গাজ়ায় প্রবেশ করলে সমূহ বিপদের মুখোমুখি হতে হবে গাজ়ার সাধারণ মানুষকে। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে গাজ়া।